“কসমস” দেখতে দেখতে মনে হয়েছিলো, অনুসরণ করার জন্য ওনার চেয়ে ভালো ব্যক্তিত্ব আর দেখিনি। একটা মানুষ এতো অসাধারণ কেন? এই পৃথিবীর প্রতি তার ভালোবাসা বোঝা যায় স্পষ্ট। ত্রিশ বছরেরও আগে এই মানুষটা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ হুমকির কথা চিন্তা করে বক্তব্য রেখে গেছেন, কর্মপন্থা ঠিক করে দিয়ে গেছেন। মানুষ সেগুলো শুনেছে, বাহবা দিয়েছে। কিন্তু নীতি নির্ধারকদের মাথায় সেই কথাগুলো ঢোকেনি, শুধু মহাকাশ গবেষণায় গুরুত্বারোপ ছাড়া হয়তো…….
কসমস কী, কসমস সিরিজে কী আছে, এই অনুষ্ঠানের এপ্রোচ কী, আর এই অনুষ্ঠানটার প্রয়োজনীয়তা কী – সেটা নিয়ে রাতদিন আলোচনা করা যায়। কিন্তু, কার্ল সেগান অনুষ্ঠানের একদম শুরুতে যা বলেছেন, তার চেয়ে সুন্দর করে বলা আর কারো পক্ষেই সম্ভব না।
প্রথম পর্বে শুরুতেই উনি বললেন,
কসমস হচ্ছে, যা কিছু বর্তমান, যা অতীতে ছিলো, বা ভবিষ্যতে আসবে। কসমস নিয়ে আমাদের ভাবনা, আমাদেরকে অভিভূত করে,যেন শিরশির করে ওঠে মেরুদণ্ড, রোধ হয়ে আসে কণ্ঠ। এক ক্ষীণ অনুভূতি, যেন বিশাল উচ্চতা থেকে লাফ দেয়ার সুদূর অতীতের স্মৃতি। উপলব্ধি আসে, যেন আমরা সর্বোচ্চ রহস্যের ভেতরে ঢুকে পড়ছি। কসমসের আয়তন বা বয়স মামুলি মানুষের জ্ঞানের সীমার বাইরে। এই বিশাল আর অসীম শূন্যতার কোথাও লুকিয়ে আছে আমাদের বসতি, এই পৃথিবী। প্রথমবারের মত আমাদের হাতে এসেছে, এই পৃথিবীর ও নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। সময়টা খুবই নাজুক। কিন্তু আমাদের প্রজাতি এখনো তরুণ, কৌতুহলী, এবং সাহসী! ব্যাপারটা আশাব্যঞ্জক! গত কয়েক হাজার বছরে, আমরা চোখ ধাঁধানো এবং অপ্রত্যাশিত কিছু আবিষ্কার করেছি – এই কসমস এবং এর মধ্যে আমাদের অবস্থানের ব্যাপারে। আমার বিশ্বাস, আমাদের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ধারিত হবে আমরা কসমসকে কতটুকু বুঝি, তার ওপর… যে কসমসে আমরা ভেসে আছি, সকালের আকাশে ধূলোর একটা কণার মত করে।
আমরা একটা যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি, এই কসমসের মধ্যে। আমাদের পথে আসবে ছায়াপথ, নক্ষত্র, গ্রহ; প্রাণ ও সচেতনতার আগমন, বিবর্তন, এবং বিলুপ্তি; বরফের গ্রহ, হীরের নক্ষত্র’ নক্ষত্রের মত বিশাল পরমাণু, আর পরমাণুর চেয়েও ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড! কিন্তু এই গল্পটা আমাদের এই গ্রহ নিয়েও। এবং সেই উদ্ভিদ ও প্রাণীদের নিয়ে, যারা আমাদের সাথে এই গ্রহটাতে ভাগাভাগি করে আছে। আর এই গল্পটা আমাদের। কীভাবে আমরা কসমস সম্পর্কে এতোটুকু জ্ঞান অর্জন করলাম। কীভাবে কসমস আমাদের বিবর্তন ও সংস্কৃতিতে প্রভাব রেখেছে। আর আমাদের নিয়তি কেমন হতে পারে। আমরা সত্যের সন্ধান করতে চাই, সেটা আমাদেরকে যেদিকেই নিয়ে যাক না কেন!
কিন্তু সত্যের সন্ধানে, কল্পনা এবং সংশয়-দুটোরই ডাক পড়বে। আমরা অনুমান করতে পিছপা হবো না। কিন্তু সতর্ক থাকবো, অনুমান আর বাস্তবকে যাতে মিলিয়ে না ফেলি। এই কসমস ঠাসা, অগণিত চমকপ্রদ বাস্তবতা দিয়ে, অভাবনীয় পারস্পরিক সম্পর্ক দিয়ে, প্রকৃতির অবিশ্বাস্য জটিলতা দিয়ে। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ হচ্ছে, মহাজাগতিক সমুদ্রের সৈকতের মত। এই সৈকতেই, আমরা আমাদের জানা অধিকাংশ তথ্য পেয়েছি। খুব সম্প্রতি, আমরা সামান্য একটু এগিয়েছি… গোড়ালি পর্যন্ত বলা যায়। আর পানিটা বেশ বন্ধুভাবাপন্ন বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের অস্তিত্বের একটা অংশ ঠিকই জানে, আমাদের সৃষ্টি এখানেই। আমরা বাড়ি ফিরে যেতে চাই। এবং, আমরা পারবোও। কারণ, কসমস আমাদের ভেতরেও আছে। আমরা নক্ষত্রের টুকরো দিয়েই তৈরি। আমাদের মধ্যে দিয়েই কসমস নিজেকে খুঁজে পাবে। আমাদের সবার যাত্রার শুরু – এখানেই।
সেই যে যাত্রা শুরু করলাম, ১৩ পর্ব শেষ করার আগে আর উঠতে পারিনি। বারবার দেখার দাবি রাখে, এমন একটা সিরিজ, কসমস। এতো সুন্দর করে, সহজ করে, আনন্দ নিয়ে একজন মানুষ একটার পর একটা বিষয় শিখিয়ে গেলেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। যেহেতু “কসমস” কভার করে সবকিছু, তাই শো এর মধ্যে উনি বললেন সবকিছু। মানবদেহের ভেতরের ঘটনা, অণুর ভেতরের কাহিনী থেকে শুরু করে গ্যালাক্সীর শেষ মাথা পর্যন্ত কিছুই তার আলোচনার পরিসর থেকে বাদ গেলোনা। চাইলে প্রত্যেক পর্ব নিয়েই বড়সড় রিভিউ লেখা যায়। এবং লেখা হবেও।
সক্রেটিসের দর্শনের ভক্ত আমি, এবং সেগুলো মানি। কিন্তু সেখানে আমার করার কিছু নেই। মার্কসের দর্শন মানি বলে রাজনীতি করেছি অনেকদিন, এবং সামনে বাংলাদেশ সমাজতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত হবে, সেটাই চাই। কিন্তু কীভাবে নিজে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারি, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। স্যাগান আমাকে পথ দেখালেন, ১৯৮০ সালের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সেই পথ খুঁজে পেতে আমার একটু দেরি হয়ে গেলো। কিন্তু খুঁজে পাওয়ার পর আর দেরি করার কোনো মানে হয়না। অন্যান্য সব কাজের পাশাপাশি আমি একজন সায়েন্স কমিউনিকেটর হতে চাই। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য গত বছরের শেষের দিকে, বিজ্ঞানের মায়েরে বাপ নামে একটা পেইজ খুলেছিলাম। চেষ্টা করছি নতুন-পুরনো আবিষ্কারগুলো ওখানে বাংলায় সহজ এবং ইন্টেরেস্টিং করে ছড়িয়ে দিতে। আর সেখান থেকেই এই ওয়েবসাইটের সূচনা।
কিন্তু এটা দিয়ে কেবল শুরু…… সামনে আরো অনেক কিছু করার ইচ্ছে আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে প্রাথমিকভাবে ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইটের বিজ্ঞান বইকে পুনরায় লিখে আরো ইন্টেরেস্টিং করে তোলা। জানিনা, কখন সময় পাবো! কিন্তু আর যাই করি, এ বছরের মধ্যেই কসমস বাংলায় অনুবাদ করে ফেলবো, আশা করি। ইতোমধ্যে অনুবাদকদের আড্ডা পেইজ থেকে এটার বাংলা সাবটাইটেলের কাজ শুরু করে দিয়েছি। ১৫ই জুন থেকে পাবলিশ করা শুরু হবে। আশা করি, তখন সবাই দেখবেন, অন্যদেরকে দেখাবেন। এই সিরিজ সবার দেখা দরকার, দেখে বোঝা দরকার।