আমরা অনেকেই হয়তো নিজেদের অজান্তেই এমন এক বোমা সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি যেটা যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। জৈবিক এই টাইম বোমাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অ্যানিউরিজম (Aneurysm)। পৃথিবীতে প্রতি ৫০ জনে ১ জন মাথায় অ্যানিউরিজম বহন করে বেড়াচ্ছে। অ্যানিউরিজম বয়ে বেড়ানোর ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় চল্লিশোর্ধ মহিলারা অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
১. অ্যানিউরিজমে বিপদ
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের একটি বিশেষ জায়গা হচ্ছে অ্যারাকনয়েড পর্দার (Arachnoid mater) ঠিক নিচে, অ্যারাকনয়েড ও পায়া পর্দার (Pia mater) মধ্যবর্তী সাবঅ্যারাকনয়েড অঞ্চলে (subarachnoid space). অ্যারাকনয়েড ও পায়া পর্দা হচ্ছে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুরজ্জুকে নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে ঘিরে থাকা আবরণ। এই দুটি পর্দাসহ আরেকটি পর্দা, ডুরা পর্দা (Dura mater) মিলে তৈরি হয় মেনিনজেস (Meninges). কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখার গুরু দায়িত্বটি পালন করে এই মেনিনজেস।
সাবঅ্যারাকনয়েড স্পেসে রক্তক্ষরণের কিছু উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে আছে- অ্যানিউরিজম ফেটে যাওয়া, ধমনী-শিরার অস্বাভাবিক গঠন ইত্যাদি। অনেক কারণ এখনও অজানা। তবে এখানে রক্তক্ষরণের শতকরা আশি ভাগই হয় অ্যানিউরিজম ফেটে যাওয়ার কারণে। মস্তিষ্কের ধমনী-শিরা গাত্রের কিছু স্থান স্ফীত হয়ে এই অ্যানিউরিজম গঠিত হয়। আবার ধমনীগাত্র ছিদ্র হলে জমাটবদ্ধ রক্ত স্ফীত হয়ে অ্যানিউরিজম গঠিত হতে পারে। কারণ হিশেবে বংশগতির কথা খুব গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়। আমরা অনেকেই হয়তো এ ধরনের গঠন মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অ্যানিউরিজমে সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে, মাথায় এই অস্বাভাবিক গঠন ধারণকারীরা সবসময়ই একটা স্ট্রোকের ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। আরও একটি সমস্যা হচ্ছে, ফেটে যাওয়ার আগে এটি আপাত কোন উপসর্গ দেখায় না। ফলে দিনের পর দিন সম্ভাব্য বিপদ মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়।
২. স্ট্রোক কী এবং কেন?
বর্তমানে পৃথিবীতে স্ট্রোকজনিত মৃত্যুর হার অনেক বেশি এবং সময়ের সাথে তা বেড়েই চলেছে। স্ট্রোক প্রধানত দুই ধরনের হয়- ইস্কেমিক স্ট্রোক (Ischemic stroke) ও হিমোরেজিক স্ট্রোক (Haemorrhagic stroke). ইস্কেমিক স্ট্রোক হয় যখন জমাটবদ্ধ রক্ত বা চর্বির পুরু আস্তরণ এর কারণে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের জীবনীশক্তি যেমন কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, লিপিড, ভিটামিন ও খনিজ যেগুলো আমরা খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহন করি, তেমনি কোষের খাদ্য হচ্ছে অক্সিজেন যা রক্তের মাধ্যমে গৃহীত হয়। কোষকে সচল রাখার জন্য চাই অক্সিজেন। মস্তিষ্কের কোন একটি অংশে রক্ত চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে অক্সিজেন পৌঁছতে পারে না, যার ফলে উক্ত অংশের কোষগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। আমরা জানি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িত। কোষীয় মৃত্যু ঐ সকল কাজগুলো সঠিকভাবে করতে বাধা দেয়, যা স্ট্রোকের উপসর্গরূপে প্রতীয়মান হয়। আবার অনেক সময় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে একইরুপ সমস্যা দেখা দেয়। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে যে স্ট্রোক হয় সেটাকে বলা হয় হিমোরেজিক স্ট্রোক। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী একটি রক্তনালী হঠাৎ ছিঁড়ে গেলে মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ইস্কেমিক স্ট্রোকের অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় অর্থাৎ অ্যানিউরিজম ফেটে গেলেও একই ঘটনা ঘটে।
৩. বেরি অ্যানিউরিজম
অ্যানিউরিজম গঠিত হওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে মস্তিষ্কের নিম্নাংশে অবস্থিত ধমনীজাল যেটাকে “Circle Of Willis” বলে। অ্যানিউরিজম যখন থলে বা গোল ফল আকৃতির হয় তখন সেটাকে বলে বেরি অ্যানিউরিজম (Berry Aneurysm).
অ্যানিউরিজমের এই আকৃতিটিই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মস্তিষ্কের নিম্নোক্ত স্থানসমূহে বেরি অ্যানিউরিজম গঠিত হতে পারেঃ
ক. অভ্যন্তরীণ ক্যারোটিড ধমনী (Internal Carotid Artery) ও পশ্চাৎবর্তী সংযোগকারী সেরেব্রাল ধমনীর (Posterior Communicating Cerebral Artery) সংযোগস্থল
খ. সম্মুখবর্তী সংযোগকারী ধমনী (Anterior Communicating Artery) ও সম্মুখবর্তী সেরেব্রাল ধমনীর (Anterior Cerebral Artery) সংযোগস্থল
গ. মধ্যবর্তী সেরেব্রাল ধমনীর (Middle Cerebral Artery) বিভাজনস্থল
ঙ. রোস্ট্রাল ব্যাসিলার ধমনীর (Rostral Basilar Artery) সংযোগস্থল
৪. যখন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
আকার ও অবস্থানগত কারণে অনেক সময় অ্যানিউরিজম ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়, যেমন অ্যানিউরিজম যদি অভ্যন্তরীণ ক্যারোটিড ধমনী (Internal Carotid Artery) ও পশ্চাৎবর্তী সংযোগকারী সেরেব্রাল ধমনীর (Posterior Communicating Cerebral Artery) সংযোগস্থলে অথবা রোস্ট্রাল ব্যাসিলার ধমনীর (Rostral Basilar Artery) সংযোগস্থলে গঠিত হয় এবং আকার ৭ মিলিমিটারের থেকে বড় হয় তখন সেটা ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধরা হয়। এছাড়াও আরও কিছু উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে আছে- বংশগতি, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, রক্তক্ষরণের অতীত ইতিহাস, ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপান, রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা যেমন- হিমোফিলিয়া এবং ইস্ট্রোজেন হরমোনের স্বল্পতা।
৫. উপসর্গসমূহ ও করণীয়
আগেই বলেছি, অ্যানিউরিজম ফেটে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ না হওয়া পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো তেমন কোন উপসর্গ দেখা যায় না। তবে অনেক সময় যে কোন একটি চোখের উপরের অংশে ব্যাথা অনুভব করা, চোখের তারা প্রসারিত হওয়া, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, অসাড়তা, মুখমন্ডলের একটা পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। রক্তক্ষরণ হয়ে গেলে স্ট্রোকের অনুরূপ উপসর্গগুলো দেখা যায়। যেমন, হঠাৎ প্রচন্ড মাথাব্যাথা শুরু হওয়া যেটাকে কোন সাধারণ মাথা ব্যাথার সাথে তুলনা করা যায় না। মনে হবে যেন মাথায় সজোরে কেউ লাথি মারলো। বমি ও খিঁচুনি হতে পারে। রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং অবশেষে কোমায় চলে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিশেবে অ্যানিউরিজমের অভ্যন্তরভাগ কুন্ডলীকরণের মাধ্যমে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়। এই পদ্ধতিতে একটি ফাঁপা নল ধমনীর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করিয়ে ধাতব কুন্ডলী দ্বারা অ্যানিউরিজমটি ভরাট করে দেয়া হয়। সার্জারির তুলনায় এই পদ্ধতিটি অপেক্ষাকৃত কম ঝামেলামুক্ত হলেও অনেক সময় অ্যানিউরিজম ফেটে গিয়ে হিতে বিপরীত হতে পারে।
সূত্রঃ অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অফ ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও ওয়েবএমডি.কম