[ বইঃ মৃত্যু ঠেকানোর ফন্দি=স্বাস্থ্যের সাথে সন্ধি (প্রথম খন্ড)
– দীপায়ন তূর্য Deepayan Turja ও Nutritionist Mishu Das
আদর্শ প্রকাশনী Adarsha , ২০২১ একুশে বইমেলা ]
আমাদের মাঝে কারো না কারো খুব প্রিয় কোনো মানুষের মস্তিষ্কের রোগে মৃত্যু ঘটেছে। কারো হয়ত ঘটেছে স্ট্রোকে, অথবা কারো ঘটেছে আলঝেইমার রোগে। শিশুকালে যে মানুষটা অতি স্নেহে জড়িয়ে রাখতো সবসময় , সেই মানুষটিই স্ট্রোকে তাৎক্ষণিকভাবে কিংবা ধীরে ধীরে কর্মক্ষমতা, ভাষা, বোধশক্তি হারিয়ে চোখের সামনে মারা গেছে। আলঝেইমারে আক্রান্ত হয়ে শেষকালে মানসিক রোগীর মত চেঁচামেচি, রাগ কিংবা হিংস্র আচরণ করতে দেখেছি অতি আপনজনকে। বিচারবুদ্ধি লোপ পেয়ে একসময় ধীরে ধীরে ভেতরের ভালোবাসাপূর্ণ মানুষটাকে হারিয়ে যেতে দেখেছি।
মস্তিষ্কের অসুখের বিভীষিকা এমনই। অন্যান্য অসুখে হয়ত আপনার কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সমস্যা হবে, আর মস্তিষ্কের অসুখ আঘাত হানবে আপনার নিজের সত্ত্বার উপর।
পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৬ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে [১]। তার মাঝে সবচেয়ে বেশী মৃত্যু হয় যৌথভাবে হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হার্ট-এটাকে (Ishaemic Heart Disease) আর স্ট্রোকে। পঞ্চম স্থানে আছে আলঝেইমার ও স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়া। স্ট্রোক হতে পারে দুই ভাবে। মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে অক্সিজেনের অভাবে অথবা মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের মাধ্যমে। ৯০% এর মত স্ট্রোকে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে স্ট্রোক ঘটায়। এটার নাম তাই ইসকেমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke) [ল্যাটিন শব্দ Ischaemia অর্থ রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া]। বাকী ১০% এর মত স্ট্রোক যেখানে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটে তার নাম হেমোরেজিক স্ট্রোক (hemorrhagic Stroke)।
আলঝেইমার রোগ ও স্মৃতি নষ্ট (dementia) হয়ে যাওয়াতে স্ট্রোকের মত যদিও দ্রুত মৃত্যু ঘটে না, কিন্তু এই রোগটা শারীরিক ও মানসিক দুইদিক থেকেই রোগী এবং সেবাকারীর জন্য কষ্টের বোঝা। ইসকেমিক স্ট্রোকে মস্তিষ্কের অক্সিজেনপূর্ণ রক্তনালী বা ধমনীতে কোলেস্টেরল জমতে জমতে একসময়ে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। তেমন করে আলঝেইমার রোগে মস্তিষ্কের টিস্যুতে এমাইলয়েড প্রোটিন জমে [২], যা পরবর্তীতে স্মৃতিশক্তি নষ্ট করার পেছনে কাজ করে এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
যদিও স্ট্রোক ও আলঝেইমারের পেছনের ব্যাপারগুলো ভিন্ন, তাও এই দুই ধরণের রোগকে একসুতায় এনে ফেলা যায় একটা দিক থেকেঃ স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস দিয়ে এদের প্রতিরোধ করা সম্ভব- জড়ো হওয়া বৈজ্ঞানিক প্রমাণগুলো সেটারই পরামর্শ দিচ্ছে। [৩], [৪] ইত্যাদি।
এই লেখাটা দুইটা অংশে তাই ভাগ করে লিখছি। প্রথম অংশে থাকছে স্ট্রোককে কীভাবে খাবার দিয়ে প্রতিহত করা যায় এবং দ্বিতীয় অংশে থাকছে আলঝেইমার ও স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়াকে কীভাবে খাবার দিয়ে প্রতিহত করা সম্ভব তার উপর।
স্ট্রোক: যেভাবে করে মৃত্যু ঠেকাতে পারি
স্ট্রোকে কী পরিমাণ ক্ষতি হবে সেটা নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে অক্সিজেন যায়নি (কিংবা ধমনী ছিঁড়ে গেছে) তার উপর, এবং কত সময় ধরে অক্সিজেনের অভাবে ছিল মস্তিষ্কের টিস্যু, তার উপর। কেউ যদি অল্প সময়ের জন্য স্ট্রোকের শিকার হয় তাহলে হয়তো হাত বা পায়ের দুর্বলতাতেই রক্ষা পাবেন। কিন্তু যাদের বড়মাত্রার স্ট্রোক হয় তাদের প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাত , কথা বলার ক্ষমতা হারানো , এমনকি অধিকাংশ সময়ে মৃত্যু হতে পারে।
কখনো কখনো মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধাটা হতে পারে একেবারে ক্ষণিকের জন্য- যেটা সাধারণভাবে বোঝার উপায় থাকেনা, কিন্তু এর মাঝেই মস্তিষ্কের একটা ছোট্ট অংশ মারা যায়। এ ধরণের স্ট্রোককে সাধারণভাবে সাইলেন্ট স্ট্রোক বলা হয়। এরকম স্ট্রোক ঘটার সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে এবং ধীরে ধীরে জ্ঞানবুদ্ধি কমে যেতে যেতে একসময় পুরোপুরি স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আমাদের লক্ষ্য হল ছোট ও বড় দুই ধরণের স্ট্রোককেই প্রতিহত করা। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস শরীরে কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ কমিয়ে এবং সাথে সাথে রক্তপ্রবাহ ও এন্টি-অক্সিডেন্টের মাত্রা বাড়িয়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারে।
ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার বা আঁশযুক্ত খাবারের পরিমাণ বাড়ান।
অধিক পরিমাণ ফাইবারযুক্ত খাবার যেমন আপনার পাকস্থলীর কাজকর্মকে ভালো রাখে, ঠিক তেমনি মলাশয় ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও মোটা হয়ে যাওয়াকে প্রতিহত করে- অর্থাৎ সাধারণভাবে অল্পবয়সে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই দেয়। অনেকগুলো স্টাডি [৩] বলছে যে অধিক পরিমাণে ফাইবারযুক্ত খাবার খেলে স্ট্রোকের কবলে পড়ে মৃত্যু হওয়াকে দূরে রাখা সম্ভব। ফাইবার সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায় পুরোপুরি উদ্ভিদ থেকে পাওয়া খাবারে (whole plant food)। প্রক্রিয়াজাত খাবারে ফাইবারের পরিমাণ কম থাকে, আর প্রাণিজ খাবারে ফাইবার একেবারেই থাকে না।
স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর শুরুর জন্য যে পরিমাণ ফাইবারের প্রয়োজন সেটা বেশ কমই বলা যায়। প্রতিদিন যদি এখন যা খাবার খাচ্ছেন তার সাথে বাড়তি মাত্র ৭ গ্রাম ফাইবার বেশী খান তাহলে স্ট্রোক হবার ঝুঁকি ৭% কমে যায় [৩]। এই পরিমাণ ফাইবার নিজের খাবারের তালিকায় যোগ করা খুবই সহজ। উপরে ফল ছিটিয়ে সাজানো একবাটি ওটমিল বা তিন টেবিলচামচ পাকা শিমে (১২০ গ্রামে) এই পরিমাণ ফাইবার রয়েছে।
প্রশ্ন জাগতে পারে যে ফাইবার কীভাবে করে মস্তিষ্ককে সুরক্ষা দিবে। আমরা নিশ্চিতভাবে এটার কার্যপ্রণালীর ব্যাপারে জানি না, তবে আমরা এটা জানি যে ফাইবার আমাদের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা [৫] এবং রক্তে চিনির মাত্রা [৬] নিয়ন্ত্রণ করে- যার ফলে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমণীতে চর্বির স্তর বা প্লাক (plaque) জমার পরিমাণ কমে যায়। সাথে সাথে ফাইবারযুক্ত খাবার খেলে উচ্চ রক্তচাপ কমে [৭], যার ফলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি কমে। তবে বিজ্ঞানীরা এটার পুঙ্খানুপুঙ্খ কার্যপদ্ধতি জানার আগেই আপনি এই জ্ঞান নিজের জীবন বাঁচাতে কাজে লাগাতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক আদ্যিকালের এক কৃষক জানে যে জমিতে যদি গাছের বীজ ছড়ানো হয় তাহলে সেখান থেকে চারা গাছ জন্মায় ও ফসল হয়। সে যদি ঠিক কীভাবে করে চারা গাছের জন্ম হয় সেটার জীববিজ্ঞান জানার আশায় বীজ না ছিটিয়ে বসে থাকতো তাহলে কী বেশী দিন পৃথিবীতে টিকতে পারতো? ঠিক তেমনিভাবেই ফাইবারযুক্ত খাবার খেলে যে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে সেই জ্ঞান আপনি ব্যবহার করুন, পুরো মেকানিজম হয়ত আমরা অচিরেই জানতে পারবো। ততদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে তো, তাই না?
চাইলে অল্প বয়স থেকেই স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া শুরু করা যায়। যদিও স্ট্রোককে ধরা হয় বুড়ো মানুষের রোগ, কারণ পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের আগে শুধুমাত্র মোট স্ট্রোকের ফলে মৃত্যুর ২% ঘটে [৮], তা সত্ত্বেও ঝুঁকির কারণগুলো ঘটা শুরু করতে পারে একেবারে শিশুবয়স থেকেই। অসাধারণ একটা স্টাডিতে কয়েকশ ছেলেমেয়ের উপর স্কুলে যাওয়ার বয়স থেকে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত মোট ২৪ বছর ধরে তাদের খাবারের অভ্যাসের উপর নজর রাখা হয়। গবেষকরা দেখেন যে যারা কম ফাইবার খেয়েছে তাদের মস্তিষ্কে অক্সিজেনপূর্ণ রক্ত নিয়ে যাওয়া ধমনীগুলো তুলনামূলক বেশী শক্ত হয়ে গেছে- যেটা স্ট্রোক ঘটাবার পেছনে কাজ করে। এই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েগুলোর মাত্র ১৪ বছর বয়সেই পরিষ্কারভাবে পার্থক্য করা যাচ্ছিল যে কাদের ধমনীর অবস্থা ভালো আর কার খারাপ- যেটা সরাসরি ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়ার তারতম্যের সাথে মেলানো যাচ্ছিল [৯]।
আবারো বলা যায়, শৈশবে খাবারের তালিকায় ফাইবারের পরিমাণ বাড়ানো এমন কোনো কঠিন কিছু নয়। শৈশবে প্রতিদিন একটা বাড়তি আপেল, এক কাপের চারভাগের একভাগ বাড়তি ব্রকলি কিংবা দুই টেবিলচামচ শিমের বীচি – এগুলোই পরবর্তী জীবনে ধমনীর স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে [৯।
আপনি যদি আগে থেকেই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে চান তাহলে বর্তমানে আমাদের হাতে থাকা সবচেয়ে ভালো বিজ্ঞান আপনাকে সাজেস্ট করছে [১০] যে আপনি স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারেন যদি পানিতে দ্রবীভূত হয় এমন ফাইবার আপনি প্রতিদিন কম করে হলেও ২৫ গ্রাম করে খান (যে ফাইবার পানিতে দ্রবীভূত হয় সেগুলো সাধারণত শিম, ওটস, বাদামজাতীয় ফল এবং বেরীজাতীয় ফলে থাকে )। সাথে সাথে খেতে হবে ৪৭ গ্রাম ফাইবার যেগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয় না (যেসব ফাইবার পানিতে দ্রবীভূত হয়না তাদের মাঝে মূলত আছে পুরো-শস্য , যেমন লাল চালের ভাত, পুরো-গম যা কিনা প্রক্রিয়াজাত নয় )।
ফাইবারের পরিমাণ দেখে মনে হতে পারে আপনাকে অসাধারণরকম স্বাস্থ্যকর খাবারের মেনু তৈরি করতে হবে। বিজ্ঞান এমনটাই বলছে। বাকীটা আপনিই বেছে নিন।
পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ বাড়ান।
আপনার দেহের প্রতিটা কোষের জন্য পটাসিয়াম প্রয়োজন। শুধুমাত্র খাবারের মাধ্যমে পটাসিয়াম পাওয়া সম্ভব। আর পটাসিয়ামের মূল উৎস হল উদ্ভিদ থেকে পাওয়া খাবার। মানুষের ইতিহাসে প্যালিওলিথিক যুগে আমাদের খাবারের ধরণ এমন ছিল যে আমরা দৈনিক ১১০০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পটাসিয়ামযুক্ত খাবার খেতাম [১১], যেখানে বর্তমানে খুব কম মানুষই সুপারিশকৃত পরিমাণ প্রতিদিন ৪৭০০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম [১২] খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করে। এই ঘটনা ঘটার কারণ খুব সহজ। আমরা প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণ অপ্রক্রিয়াজাত উদ্ভিদ জাতীয় খাবার খাই না। প্রশ্ন হল পটাসিয়ামের সাথে স্ট্রোক থেকে বাঁচার সম্পর্ক কোথায়?
স্ট্রোক ও হৃদরোগ নিয়ে যত সেরা সেরা স্টাডি হয়েছে সেগুলোর উপর করা একটা রিভিউ স্টাডি বলছে প্রতিদিনের খাবারে পটাসিয়ামের পরিমাণ যদি ১৬৪০ মিলিগ্রাম বাড়ানো যায় তাহলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ২১% কমে যায় [১৩]। ভেবে দেখুন আপনি যদি আপনার খাবারের তালিকায় পুরোপুরি উদ্ভিদ থেকে পাওয়া খাবারের পরিমাণ দুই বা তিনগুণ করতে পারেন তাহলে কতটুকু স্ট্রোকের ঝুঁকি আপনি কমাতে পারেন।
যদিও চলতি সময়ে পটাসিয়ামের উৎস হিসেবে কলাকে সবাই মনে রাখে, তা সত্ত্বেও বলতে হবে কলা পটাসিয়ামের সেরা উৎসগুলোর মাঝে পড়ে না। শুধু তাই না কোন খাবারে কতটুকু পটাসিয়াম পাওয়া যায় এমন একটা তালিকা করা হয়েছে যেখানে কলার অবস্থান ১৬১১ তম! [১৪] কলা দিয়ে যদি পটাসিয়ামের দৈনিক সর্বনিম্ন চাহিদা পূরণ করতে চান তাহলে আপনাকে ডজনখানেক কলা খেতে হবে প্রতিদিন। তাহলে সত্যিকার অর্থে পটাসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার কোনগুলো? সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর সাধারণ অপ্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো হল সবুজ সবজি, পালংশাক, শিম, মিষ্টি আলু [১৫], [১৬], [১৭], [১৮]।
সাইট্রাস ফল (লেবুজাতীয় ফল) এবং স্ট্রোক
কমলা যারা ভালোবাসে তাদের জন্য সুখবর। সাইট্রাস ফল খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে [১৯], এমনকি আপেল খেলেও ততটা কমে না। এর মূল চাবিকাঠি হল সাইট্রাস ফলে থাকা হেসপিরিডিন (hespiridin) নামক যৌগ যা সারা দেহে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়, সাথে সাথে মস্তিষ্কেও [২০]। বিজ্ঞানীরা লেজার ডপলার ফ্লুক্সিমিটার নামের একটা যন্ত্রের সাহায্য দেহের বিভিন্ন প্রান্তে কী পরিমাণ রক্ত চলাচল করছে সেটা পরিমাপ করতে পারেন। পরীক্ষায় দেখা গেছে মানুষজন যখন দুই কাপ কমলার রসে যে পরিমাণ হেসপিরিডিন থাকে সেই পরিমাণ হেসপিরিডিনের দ্রবণ খায় তখন তাদের রক্তচাপ কমে এবং সার্বিকভাবে রক্ত চলাচল বাড়ে। যখন তারা সরাসরি কমলার রস খায়, তাদের রক্ত চলাচল আরো ভালোভাবে হয়। সহজ কথায়, কমলার জুসের স্ট্রোককে প্রতিহত করার ক্ষমতা একা হেসপিরিডিনের চেয়েও বেশী।
রক্ত চলাচল বাড়ানোর বেলায় সাইট্রাস ফলের ক্ষমতা পরিমাপের জন্য যন্ত্র না হলেও চলবে। একটা স্টাডিতে ঠান্ডা আবহাওয়ার ব্যাপারে স্পর্শকাতর এমন কিছু মহিলাকে নেয়া নয় যাদের হাত, পা ও পায়ের পাতা কমবেশী ঠান্ডা হয়ে থাকে। তাদের বেশ অনেক ঠান্ডা একটা এয়ার-কন্ডিশন করা রুমে রাখা হয়। একদলকে খেতে দেয়া হয় সত্যিকারের সাইট্রাস ফলে থাকা বিভিন্ন উপাদান, আর অন্য দলকে দেয়া হয় আর্টিফিশিয়ালভাবে স্বাদ দেয়া কমলার জুস (একে প্লাসিবো গ্রুপ বলা হয়- যারা মনে করেছে তাদের সত্যিকার জুস দেয়া হয়েছে)। দেখা গেছে যাদের আর্টিফিশিয়াল কমলার জুস দেয়া হয়েছিল তাদের আঙুলের ডগার তাপমাত্রা ৯ ফারেনহাইট এর কাছাকাছি কমে গেছে পরীক্ষার সময়, কিন্তু আসল সাইট্রাস ফলের উপাদান খাওয়া মহিলাদের আঙুলের ডগার তাপমাত্রা অতটা দ্রুত কমে যায়নি [২১]।
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ঠান্ডার মাঝে ঘুরতে যাবার আগে কয়েকটা কমলা খেয়ে গেলে ঠান্ডাতে ঠকঠক করে কাঁপা কিছুটা হলেও কম হবে। এটা যেমন শুনতে ভালো লাগছে, ঠিক তেমনি দৈনিক সাইট্রাস ফল খাওয়া স্ট্রোকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবে এটা শুনতে আরো বেশী ভালো লাগে, তাই না?
ঘুমের পরিমাণ এবং স্ট্রোক: ঠিক কতটা ঘুম ভালো?
ঘুমের ঘাটতি কিংবা মাত্রারিক্ত ঘুম – উভয়ই স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় [২২]।
প্রশ্ন হল কতসময় ঘুমালে ঘুম কম বলা হবে, কিংবা কতসময় ঘুমালে ঘুমকে বেশী বলা হবে?
জাপানের বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য প্রথম বড়সড় একটা পরীক্ষা করেন। প্রায় ১ লাখ লোকের উপর চৌদ্দ বছর ধরে গবেষণা করা হয়। দেখা গেছে যারা গড়ে ৭ ঘন্টা ঘুমিয়েছে তাদের তুলনায় যারা গড়ে চার ঘন্টা বা তার কম ঘুমিয়েছে, এবং যারা দশ ঘন্টা বা তার বেশী ঘুমিয়েছে তাদের স্ট্রোকের কবলে পড়ে মৃত্যুর আশংকা ৫০% বেশী [২৩]। সাম্প্রতিক সময়ে ১৫০০০০ লোকের উপর আমেরিকায় আরো বিস্তারিত গবেষণা করা হয়। দেখা গেছে যারা ছয় ঘন্টা বা তার কম ঘুমায় এবং যারা নয় ঘন্টা বা তার বেশী ঘুমায় তাদের মাঝে স্ট্রোকের কবলে পড়ে মৃত্যুর হার অনেক বেশী। সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে পাওয়া গেছে সেসব মানুষকে যারা রাতে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমিয়েছে [২৪]। ইউরোপ, চীন ও অন্যান্য জায়গায় চালানো স্টাডিতেও একই ফলাফল পাওয়া গেছে । ৭-৮ ঘন্টার ঘুম স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় [২৫],[২৬],[২৭]। আমরা এখনো পুরোপুরি এটার পেছনের কার্যকারণ জানি না। যত সময় আরো বেশী আমরা এ ব্যাপারে জানছি না , তত সময় কেন এই ৭-৮ ঘন্টা সময় ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করবেন না?
ভালোভাবে ঘুমান!
এন্টি-অক্সিডেন্ট এবং স্ট্রোক
“বুড়ো হয়ে যাওয়া একটা রোগ। মানুষের আয়ু নির্ভর করে কোষের ভেতর জমা হতে থাকা ফ্রি-রেডিক্যাল (উচ্চ শক্তিসম্পন্ন মুক্ত পরমাণু বা পরমাণুর গ্রুপ) কোষের কি পরিমাণ ক্ষতিসাধন করে তার উপর। যখন অনেক বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয়, কোষ তখন ঠিকভাবে বাঁচতে পারে না- হাল ছেড়ে দেয়”, প্রখ্যাত বায়োকেমিস্ট আর্ল স্ট্যাডম্যান (Earl Stadtman), যিনি বিজ্ঞানে আমেরিকার সর্বোচ্চ পদক ‘ন্যাশনাল মেডাল অফ সায়েন্স’ পেয়েছেন, ঠিক এমনটাই বলেছেন [২৮]।
বার্ধক্যকে যদিও অনেকে এখনো রোগ হিসেবে নিতে দ্বিধায় আছে [২৯], তা সত্ত্বেও আগামী দিনগুলোতে বার্ধক্যকে রোগ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী যেন এটাকে ঠেকানো যায় এই মতাদর্শের বিজ্ঞানীদের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে [৩০]।
১৯৭২ সালে প্রথম প্রস্তাবিত [৩১] যা বর্তমানে “মাইটোকন্ডিয়াল থিওরী অব এজিং” (Mitochondrial Theory of aging) (অর্থাৎ যে তত্ত্বে মাইটোকন্ড্রিয়ার সাথে বার্ধক্যের সম্পর্কের কথা বলা হয়) নামে পরিচিত, সেটা অনুযায়ী কোষের শক্তিঘর হিসেবে পরিচিত মাইটোকন্ড্রিয়াতে শক্তি উৎপাদনের সময় যে সব ফ্রি-রেডিক্যাল তৈরি হয় সেগুলোর পরিমাণ সময়ের সাথে বাড়তে থাকে এবং তারা অন্যান্য বড় অণু যেমন লিপিড, প্রোটিন, ডিএনএ ইত্যাদির ক্ষতি করে। এই ক্ষয়ক্ষতিগুলো পরবর্তীতে বার্ধক্যের সৃষ্টি করে। তত্ত্বটি পুরোনো মনে হলেও ইদানিংকালে এটাকে আবার রিভিউ করা হয়েছে যা এই তত্ত্বকে সঠিক হিসেবেই গণ্য করছে [৩২], [৩৩]।
প্রশ্ন জাগতে পারে “এই ফ্রি-রেডিক্যাল মূলত কী, আর আমরা এদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিতে পারি?”
ফ্রি রেডিক্যাল হল সেসব পরমাণু, অণু অথবা আয়ন যাদের এমন একটি যোজনী ইলেকট্রন আছে যা কিনা জোড়া গঠন করেনি অর্থাৎ একা আছে [৩৪]। একা ইলেকট্রন থাকার ফলে ফ্রি রেডিক্যালরা রাসায়নিকভাবে খুবই সক্রিয় হয়। আমাদের শরীরে বিভিন্নভাবে ফ্রি রেডিক্যাল তৈরি হতে পারে। যেমনঃ খাবার শরীরে প্রক্রিয়াজাত হবার সময়, চাপের মাঝে থাকলে, ধূমপান-মদ্যপান করলে, এক্সারসাইজ করলে, কোনো কারণে দেহে প্রদাহ সৃষ্টি হলে, ওষুধের প্রভাবে, সূর্যের আলোতে গেলে এবং বায়ু দূষণের মাঝে থাকলে [৩৫]। অনেক ধরণের ফ্রি রেডিক্যাল আছে। তার মাঝে যেসব জীব অক্সিজেন গ্রহণ করে তাদের ভেতর অক্সিজেন আছে এমন ফ্রি রেডিক্যাল অনেক বেশী উৎপন্ন হয় যাদের সাধারণভাবে Reactive Oxygen Species (ROS) নামেও ডাকা হয়। এসব অক্সিজেনযুক্ত ফ্রি রেডিক্যালের মাঝে আছে সুপারঅক্সাইড, হাইড্রোক্সিল আয়ন, পারঅক্সাইড ও একক অক্সিজেন পরমাণু [৩৬]।
আমাদের কোষের ভেতরে থাকা মাইটোকন্ড্রিয়াতে ATP (adenosine triphosphate) নামক যৌগ উৎপন্ন হয় যা কোষকে শক্তি সরবরাহ করে। ATP উৎপাদনের সময় ইলেকট্রন প্রয়োজন হয়। দেখা যায় ATP উৎপাদনের সময় ১-২% ইলেকট্রন মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে বের হয়ে পানির সাথে বিক্রিয়া করে বিভিন্ন অক্সিজেনযুক্ত ফ্রি রেডিক্যাল (ROS) উৎপন্ন করে [৩৭],[৩৮]। মাইটোকন্ড্রিয়াল থিওরী অব এজিং অনুযায়ী মাইটোকন্ড্রিয়াতে ATP উৎপাদনের সময় যেসব ফ্রি রেডিক্যাল উৎপন্ন হয় সেগুলো কোষের অন্যান্য বড় বড় অণু যেমন লিপিড, প্রোটিন ও ডিএনএ ইত্যাদির সাথে বিক্রিয়া করে এগুলোর ক্ষতি করে। এই ক্ষতির ফলেই আমাদের শরীর বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হয় [৩৯]।
যখন অক্সিজেনযুক্ত ফ্রি রেডিক্যালগুলো ডিএনএ-র সংস্পর্শে আসে, তখন তারা জিনের (gene) ক্ষতি করতে পারে। এই ক্ষতিকে যদি ঠিকঠাক করা না হয় তাহলে সেটা আপনার ক্রোমোজোমের মিউটেশান (mutation) অর্থাৎ পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্যান্সারের সৃষ্টিও করতে পারে [৪০]। সৌভাগ্যের কথা হল এধরণের ঘটনাগুলো ঘটার সময় আমাদের শরীর তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ডাক দেয়, যাদের নাম হল ‘এন্টি-অক্সিডেন্ট’ (antioxidants)। এন্টি-অক্সিডেন্টরা ফ্রি রেডিক্যালের সাথে বিক্রিয়া করে তাদের নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
যে পরিমাণ ফ্রি রেডিক্যাল উৎপন্ন হচ্ছে সে পরিমাণ এন্টি-অক্সিডেন্ট যদি কোনো কোষে প্রয়োজন মোতাবেক না থাকে তাহলেই ঘটে বিপত্তি। কোষ তখন বাড়তি ফ্রি রেডিক্যালের প্রভাবে চাপের মুখে পড়ে যায়। বৈজ্ঞানিক পরিসরে এর নাম দেয়া হয়েছে ‘অক্সিডেটিভ স্ট্রেস’ (Oxidative stress)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী অক্সিডেটিভ স্ট্রেসে থাকলে কোষের যে ক্ষতি হয় তার ফলেই মানুষ বুড়িয়ে যায়। হাতের পেছনদিকে যে বাদামী রঙের বয়সকালীন দাগ (age spot) তৈরি হয় তার কারণ কি জানেন? এগুলো তৈরি হয় চামড়ার নীচে থাকা চর্বির সাথে বিভিন্ন ফ্রি রেডিক্যালের বিক্রিয়ার মাধ্যমে [৪১]।
অক্সিডেটিভ স্ট্রেসকে দায়ী করা হয় আমাদের মুখে বলিরেখা (wrinkles) সৃষ্টির জন্য, আমাদের স্মৃতিশক্তি কমে গিয়ে অনেক ঘটনা ভুলে যাওয়ার জন্য, বয়সের সাথে সাথে আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ ঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়ার জন্য। মূলত, এই তত্ত্ব অনুযায়ী, যতই সময় যায় আমাদের শরীরে জং ধরে যায়।
শরীরের এই বুড়িয়ে যাওয়ার গতিকে আপনি প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার খেয়ে কমিয়ে দিতে পারেন। কোন খাবারটি এন্টি-অক্সিডেন্টে ঠাসা সেটা খুব সহজেই বোঝা যায়। খাবারটি ধরা যাক কোনো ফল। সেটাকে কেটে বাতাসে উন্মুক্ত অবস্থায় রেখে দিন আর দেখুন কি হয়। যদি এটা বাদামী বা লালচে বা কালচে রঙ ধারণ করে তাহলে বোঝা যাবে যে এটা বাতাসে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করছে বা অক্সিডাইজ হচ্ছে। দুইটা সবচেয়ে জনপ্রিয় ফলের কথা ভাবুনঃ আপেল আর কলা। কাটা অবস্থায় বাতাসে রেখে দিলে এগুলো দ্রুত বাদামী রঙ ধারণ করে- এর মানে হল এগুলোতে খুব বেশী এন্টি-অক্সিডেন্ট নেই (আপেলের বেশীরভাগ এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকে খোসায়)। অন্যদিকে একটা আম কেটে বাতাসে রাখলে কী দেখা যায়? অনেক সময়েও আমের রঙের খুব বেশী পরিবর্তন হয় না- তার কারণ আমে প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকে। ফলের সালাদকে বাদামী হওয়া থেকে ঠেকাতে কী করা হয়? সালাদে লেবুর রস মিশানো হয়, যেটাতে থাকে ভিটামিন-সি যেটা একটা এন্টি-অক্সিডেন্ট। এন্টি-অক্সিডেন্টরা যেমন আপনার খাবারকে অক্সিডাইজ হয়ে যাওয়া থেকে ঠেকায়, ঠিক তেমনি তারা শরীরের ভেতরও একই কাজ করে।
এন্টি-অক্সিডেন্টপূর্ণ খাবারদাবার যেসব রোগ ঠেকাতে পারে তার মাঝে একটা হল স্ট্রোক। সুইডেনের গবেষকরা ৩০ হাজারেরও বেশী বয়স্ক মহিলাকে প্রায় ১২ বছরের উপর পর্যবেক্ষণ করে এবং দেখে যে যারা সবচেয়ে বেশী এন্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার খেয়েছে তাদের মাঝে স্ট্রোকের ঝুঁকি কম ছিল [৪২]। একই ধরণের ফলাফল পাওয়া গেছে ইতালীতে করা তরুণ বয়সী নারী ও পুরুষের উপর করা গবেষণাতেও [৪৩]। মজার কথা হল, আপনি যদি বুদ্ধি ফলিয়ে এন্টি-অক্সিডেন্টের সাপ্লিমেন্ট অর্থাৎ ওষুধ খান তাহলে কিন্তু কোনো লাভ হবে না [৪৪]। প্রকৃতি মায়ের ক্ষমতাকে এক্ষেত্রে ওষুধের মাঝে ঢোকানো যায় না।
এতসব কিছু জানার পর বিজ্ঞানীরা মাঠে নামেন সবচেয়ে বেশী এন্টি-অক্সিডেন্ট কোন কোন খাবারে আছে সেটা খুঁজে বের করতে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ১৬ জন গবেষক তিন হাজারের উপরে বিভিন্ন খাবারের মাঝে থাকা এন্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণের উপর একটা ডাটাবেস তৈরি করেন [৪৫]। তারা ডাবুরের চ্যাবনপ্রাস থেকে শুরু করে আফ্রিকার বাওবাব গাছের শুকনা গুঁড়ো করা পাতাকেও ডাটাবেসে রেখেছেন। তারা এমনকি ডজনখানেক বীয়ারের ব্র্যান্ডকেও পরীক্ষা করে দেখেন কাদের মাঝে বেশী এন্টি-অক্সিডেন্ট আছে সেটা জানতে। আপনি চাইলে এই লিস্ট দেখে আপনার পছন্দের খাবার আর পানীয় ঠিক কত তম স্থানে আছে সেটা বের করতে পারেন। লিস্টটা এখানেঃ http://bit.ly/antioxidantfoods
১৩৮ পৃষ্ঠার এই লিস্ট যদিও আপনার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। একটা সহজ নিয়ম হলঃ গড়ে উদ্ভিদ জাতীয় খাবারে প্রাণীজ খাবারের তুলনায় ৬৪ গুণ বেশী এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকে।
কিছু বেরী জাতীয় ফলে থাকে ১০০০ ইউনিটের চেয়েও বেশী এন্টি-অক্সিডেন্ট (ইউনিট = daμmol) । আইসবার্গ লেটুসের মাঝে আছে মাত্র ১৭ ইউনিট, যেটার ৯৬%-ই পানি [৪৬]। বেরীর কাছে আইসবার্গ লেটুসকে মনে হচ্ছে হতদরিদ্র তাই না? মুরগীতে কত? ৫ ইউনিট। তাজা স্যামন মাছে ৩ ইউনিট। ননীবিহীন দুধ বা সিদ্ধ ডিমে আছে মাত্র ৪ ইউনিট। আর সফট ড্রিংক স্প্রাইটে আছে একটা বিশাল বড় ঘোড়ার ডিম- ০ ইউনিট।
গবেষকরা সিদ্ধান্ত টানেন এভাবে- “এন্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবারের উৎস হল উদ্ভিদ জগত, যেখানে প্রাণীজগত থেকে আসা মাংস, মাছ বা অন্যান্য খাবারে এন্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ কম থাকে। উদ্ভিদ থেকে আসা বিভিন্ন খাবার এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হবার কারণ হল সেগুলোতে হাজার হাজার জৈবিকভাবে সক্রিয় রাসায়নিক পদার্থ থাকে যেগুলো অবিকৃত অবস্থায় খাবার ও পানীয়তে রয়ে যায়।” [৪৫] ।
লিস্ট দেখে খাবার নিয়ে বাছাবাছি না করলেও পারেন। মনে রাখার সহজ উপায় হল, প্রতিবেলার খাবারে বিভিন্নরকম ফল, সবজি, তৃণজাতীয় উদ্ভিদ আর মসলা অন্তর্ভুক্ত করা।
এভাবেই আপনি আপনার শরীরকে অনবরত এন্টি-অক্সিডেন্ট দিয়ে পরিপূর্ণ করে রাখতে পারেন যা আপনাকে স্ট্রোক ও বার্ধক্যজনিত অন্যান্য রোগ থেকে রক্ষা করবে।
সারমর্ম হল, এন্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার রক্তের মাধ্যমে অক্সিডাইজড চর্বির পরিবহণে বাধা দেয় যেগুলো কিনা মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র রক্তনালীর দেয়ালকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। এভাবে করে এন্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার স্ট্রোক থেকে আমাদের সুরক্ষা দেয় [৪৭]। শুধু তাই না, এরা আমাদের রক্তবাহী ধমনীর শক্ত হয়ে যাওয়াকে কমায় [৪৮], রক্তনালীর ভেতর রক্ত জমাট বাধাকে প্রতিহত করে [৪৯] এবং উচ্চ রক্তচাপ কমায় [৫০]। ফ্রি রেডিক্যালরা আমাদের শরীরের প্রোটিনকে এমনভাবে পালটে দিতে পারে যে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক সময় সেগুলোকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয় [৫১]। এর ফলে শরীরের ভেতর প্রদাহ শুরু হয়। এই প্রদাহকে প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি আমাদের শরীরকে এন্টি-অক্সিডেন্ট দিয়ে পরিপূর্ণ করে রাখা যায়।
যদিও সবধরণের উদ্ভিদ থেকে পাওয়া খাবারেরই শরীরের ভেতরে চলা প্রদাহকে বাধা দেয়ার সামর্থ্য আছে [৫২], তাও কিছু উদ্ভিদ অন্যদের তুলনায় ভাল। যেমন বেরী জাতীয় ফল ও সবুজ শাকসবজিতে অনেক বেশী এন্টি-অক্সিডেন্ট আছে, যেখানে আমাদের অধিক পরিচিত কলা কিংবা লেটুস পাতা এন্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে [৫৩]।
কি ধরণের খাবার আমরা বেছে নিচ্ছি সেটাই আমাদের একজনের সাথে আরেকজনের স্বাস্থ্যের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করে।
(চলবে)
[ বইঃ মৃত্যু ঠেকানোর ফন্দি=স্বাস্থ্যের সাথে সন্ধি (প্রথম খন্ড)
– দীপায়ন তূর্য Deepayan Turja ও Nutritionist Mishu Das
আদর্শ প্রকাশনী Adarsha , ২০২১ একুশে বইমেলা ]
আদর্শ প্রকাশনী Adarsha থেকে একুশে বইমেলা, ২০২১ এ আমাদের এভিডেন্সভিত্তিক নিউট্রিশান সায়েন্সের বই মৃত্যু ঠেকানোর ফন্দি=স্বাস্থ্যের সাথে সন্ধি (প্রথম খন্ড)- এর একটা আগাম ‘অনলাইন ভার্সান’ আমার ওয়েবসাইটে বইয়ের সেকশানে পাওয়া যাবে। এই ভার্সানে বইয়ের প্রথম অর্ধেক অংশ পুরোপুরি আছে। এই অর্ধেক অংশ অনলাইনের বিভিন্ন জায়গায় ভাগ ভাগ করে পোস্ট করা হয়েছিল। আগ্রহী পাঠকদের সুবিধার জন্য সেগুলো একসাথে করে পিডিএফ আকারে দেয়া হল।
https://deepayanturja.wordpress.com/books
আমরা আন্তরিকভাবে সবার সুস্থতা কামনা করি, তাই মহামারীতে বইমেলায় স্টলে গিয়ে বইটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে পড়ে দেখার আগেই যেন বাসায় বসে বইটা সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা পাওয়া যায় সেই চিন্তা থেকেই এই অনলাইন ভার্সানটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলাম।
বইটা সম্পর্কে পাঠকদের আগাম প্রতিক্রিয়া, অভিমত, আলাপ-আলোচনা আন্তরিকভাবে কাম্য।
https://deepayanturja.wordpress.com/books
অভিমত, আলাপ-আলোচনার জন্য নিউট্রিশান সায়েন্স সংক্রান্ত সায়েন্টিফিক পেপারের বিচার বিশ্লেষণ গ্রুপটা আমরা তৈরি করেছি যেন নিউট্রিশান সংক্রান্ত বিভিন্ন সায়েন্টিফিক পেপারের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়। আমাদের মাঝে যাঁরা ডাক্তার আছেন তাঁরাও তাঁদের ফিল্ডের পেপারের ব্যাপারে আলোচনা-সমালোচনা করতে পারেন। লেখায় পেপারের সোর্স (জার্নালের লিংক বা সাইটেশান) দিয়ে সেটার মূল বক্তব্য হিসেবে আপনি কী বুঝতে পারলেন সেটা যে কেউ উপস্থাপন করতে পারেন। সেটার ব্যাপারে পক্ষে কিংবা বিপক্ষে আপনার বুদ্ধিদীপ্ত মতামত দিতে পারেন। আপনি যদি নিউট্রিশান/মেডিকেল সায়েন্সে ডিগ্রী নিয়ে থাকেন তাহলে আপনার গবেষণা বা থিসিস নিয়েও সবাইকে জানাতে পারেন।শুধু তাই নয় , আপনি যদি নিউট্রিশান/মেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ডের কেউ নাও হন, তারপরও আপনি এ বিষয়ক সায়েন্টিফিক পেপার পড়ে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। এতটুকুই শুধু মাথায় রাখলে হবে যে সেটা যেন কোনো নিউজ আর্টিক্যাল না হয়। বরং নিউজ আর্টিক্যালের মাঝে যে পেপার নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেটার মূল সোর্স খুঁজে সেটা নিয়ে লিখতে পারেন। যেকোনো পোস্টের কমেন্ট বক্সে সমালোচনা অবশ্যই কাম্য। শুধু এতটুকু মাথায় রাখলেই হবে – “সমালোচক নিন্দুক নন”
সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আশা করছি।।
তথ্যসূত্র:
[১] https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/the-top-10-causes-of-death
[২] https://www.nia.nih.gov/health/what-happens-brain-alzheimers-disease
[৩] Threapleton DE, Greenwood DC, Evans CE, et al. Dietary fiber intake and risk of first stroke: a systematic review and meta-analysis. Stroke. 2013;44(5):1360–8.
[৪] Barnard ND, Bush AI, Ceccarelli A, et al. Dietary and lifestyle guidelines for the prevention of Alzheimer’s disease. Neurobiol Aging. 2014;35 Suppl 2:S74–8.
[৫] Whitehead A, Beck EJ, Tosh S, Wolever TM. Cholesterol-lowering effects of oat β-glucan: a meta-analysis of randomized controlled trials. Am J Clin Nutr. 2014;100(6):1413–21.
[৬] Silva FM, Kramer CK, De Almeida JC, Steemburgo T, Gross JL, Azevedo MJ. Fiber intake and glycemic control in patients with type 2 diabetes mellitus: a systematic review with meta-analysis of randomized controlled trials. Nutr Rev. 2013;71(12):790–801.
[৭]Streppel MT, Arends LR, van ’t Veer P, Grobbee DE, Geleijnse JM. Dietary fiber and blood pressure: a meta-analysis of randomized placebo-controlled trials. Arch Intern Med. 2005;165(2):150–6.
[৮]Centers for Disease Control and Prevention. Deaths: final data for 2013 table 10. Number of deaths from 113 selected causes. National Vital Statistics Report 2016;64(2).
[৯] van de Laar RJ, Stehouwer CDA, van Bussel BCT, et al. Lower lifetime dietary fiber intake is associated with carotid artery stiffness: the Amsterdam Growth and Health Longitudinal Study. Am J Clin Nutr. 2012;96(1):14–23.
[১০]Casiglia E, Tikhonoff V, Caffi S, et al. High dietary fiber intake prevents stroke at a population level. Clin Nutr. 2013;32(5):811–8.
[১১]Eaton SB, Konner M. Paleolithic nutrition. A consideration of its nature and current implications. N Engl J Med. 1985;312(5):283–9.
[১২]Cogswell ME, Zhang Z, Carriquiry AL, et al. Sodium and potassium intakes among US adults: NHANES 2003–2008. Am J Clin Nutr. 2012;96(3):647–57.
[১৩]D’Elia L, Barba G, Cappuccio FP, et al. Potassium intake, stroke, and cardiovascular disease a meta-analysis of prospective studies. J Am Coll Cardiol. 2011;57(10):1210–9.
[১৪]U.S. Department of Agriculture. USDA National Nutrient Database for Standard Reference.
http://ndb.nal.usda.gov/ndb/nutrients/index?fg=&nutrient1=306&nutrient2=&nutrient3=&subset=0&sort=c&totCount=0&offset=0&measureby=g2011. Accessed April 1, 2015.
[১৫] https://health.gov/our-work/food-nutrition/2015-2020-dietary-guidelines/advisory-report/appendix-e-3/appendix-e-32
[১৬] https://ods.od.nih.gov/factsheets/Potassium-HealthProfessional/
[১৭] https://nutritiondata.self.com/facts/vegetables-and-vegetable-products/2667/2
[১৮] https://www.healthline.com/nutrition/foods-loaded-with-potassium
[১৯] Hu D, Huang J, Wang Y, Zhang D, Qu Y. Fruits and vegetables consumption and risk of stroke: a meta-analysis of prospective cohort studies. Stroke. 2014;45(6):1613–9.
[২০] Morand C, Dubray C, Milenkovic D, et al. Hesperidin contributes to the vascular protective effects of orange juice: a randomized crossover study in healthy volunteers. Am J Clin Nutr. 2011;93(1):73–80.
[২১]Takumi H, Nakamura H, Simizu T, et al. Bioavailability of orally administered water-dispersible hesperetin and its effect on peripheral vasodilatation in human subjects: implication of endothelial functions of plasma conjugated metabolites. Food Funct. 2012;3(4):389–98.
[২২] Patyar S, Patyar RR. Correlation between sleep duration and risk of stroke. J Stroke Cerebrovasc Dis. 2015;24(5):905–11.
[২৩] Ikehara S, Iso H, Date C, et al; JACC Study Group. Association of sleep duration with mortality from cardiovascular disease and other causes for Japanese men and women: the JACC study. Sleep. 2009;32(3):295–301.
[২৪]Fang J, Wheaton AG, Ayala C. Sleep duration and history of stroke among adults from the USA. J Sleep Res. 2014;23(5):531–7.
[২৫]von Ruesten A, Weikert C, Fietze I, et al. Association of sleep duration with chronic diseases in the European Prospective Investigation into Cancer and Nutrition (EPIC)-Potsdam study. PLoS ONE. 2012;7(1):e30972.
[২৬]Pan A, De Silva DA, Yuan JM, et al. Sleep duration and risk of stroke mortality among Chinese adults: Singapore Chinese health study. Stroke. 2014;45(6):1620–5.
[২৭]Leng Y, Cappuccio FP, Wainwright NW, et al. Sleep duration and risk of fatal and nonfatal stroke: a prospective study and meta-analysis. Neurology. 2015;84(11):1072–9.
[২৮]Sansevero TB. The Profit Machine. Madrid: Cultiva Libros. 2009;59.
[২৯]Gavrilov LA, Gavrilova NS. [Is aging a disease? Biodemographers’ point of view.]. Adv Gerontol. 2017;30(6):841-842. PMID: 29608825; PMCID: PMC6057778.
[৩০] Opening the door to treating ageing as a disease, The Lancet Diabetes & Endocrinology, Editorial, Volume 6, ISSUE 8, P587, August 01, 2018
[৩১] Harman D. The biologic clock: the mitochondria? J Am Geriatr Soc. 1972;20(4):145–7.
[৩২] Wei, Yau-Huei & Ma, Yi-Shing & Lee, Hsin-Chen & Lee, Cheng-Feng & Lu, Ching-You. (2001). Mitochondrial theory of aging matures ─ Roles of mtDNA mutation and oxidative stress in human aging. Chinese medical journal. 64. 259-270.
[৩৩]Gustavo Barja, Comprehensive Invited Review , Updating the Mitochondrial Free Radical Theory of Aging: An Integrated View, Key Aspects, and Confounding Concepts, Antioxidants & Redox Signaling , Vol. 19, No. 12
[৩৪] IUPAC Gold Book radical (free radical)
[৩৫] https://www.dermalinstitute.com/article/37/
[৩৬] Hayyan M, Hashim MA, AlNashef IM (March 2016). “Superoxide Ion: Generation and Chemical Implications”. Chemical Reviews. 116 (5): 3029–85.
[৩৭]Chance B, Sies H, Boveris A. Hydroperoxide metabolism in mammalian organs. Physiol Rev. 1979;59(3):527–605.
[৩৮]Turrens JF (October 2003). “Mitochondrial formation of reactive oxygen species”. The Journal of Physiology. 552 (Pt 2): 335–44.
[৩৯]Kowald; Kirkwood (2018). Resolving the Enigma of the Clonal Expansion of mtDNA Deletions. Genes (Basel). 9 (3): 126.
[৪০]Emerit I. Reactive oxygen species, chromosome mutation, and cancer: possible role of clastogenic factors in carcinogenesis. Free Radic Biol Med. 1994;16(1):99–109.
[৪১]Silva, Silas Arandas Monteiro E et al. “An overview about oxidation in clinical practice of skin aging.” Anais brasileiros de dermatologia vol. 92,3 (2017): 367-374.
[৪২] Rautiainen S, Larsson S, Virtamo J, et al. Total antioxidant capacity of diet and risk of stroke: a population-based prospective cohort of women. Stroke. 2012;43(2):335–40.
[৪৩]Del Rio D, Agnoli C, Pellegrini N, et al. Total antioxidant capacity of the diet is associated with lower risk of ischemic stroke in a large Italian cohort. J Nutr. 2011;141(1):118–23.
[৪৪]Hankey GJ. Vitamin supplementation and stroke prevention. Stroke. 2012;43(10):2814–8.
[৪৫]Carlsen MH, Halvorsen BL, Holte K, et al. The total antioxidant content of more than 3100 foods, beverages, spices, herbs and supplements used worldwide. Nutr J. 2010 Jan 22;9:3.
[৪৬]Bastin S, Henken K. Water Content of Fruits and Vegetables. ENRI-129. University of Kentucky College of Agriculture Cooperative Extension Service.
http://www2.ca.uky.edu/enri/pubs/enri129.pdf. December 1997. Accessed March 3, 2015.
[৪৭] Kelly PJ, Morrow JD, Ning M, et al. Oxidative stress and matrix metalloproteinase-9 in acute ischemic stroke: the Biomarker Evaluation for Antioxidant Therapies in Stroke (BEAT-Stroke) study. Stroke. 2008;39(1):100–4.
[৪৮] Lilamand M, Kelaiditi E, Guyonnet S, et al. Flavonoids and arterial stiffness: promising perspectives. Nutr Metab Cardiovasc Dis. 2014;24(7):698–704.
[৪৯]Santhakumar AB, Bulmer AC, Singh I. A review of the mechanisms and effectiveness of dietary polyphenols in reducing oxidative stress and thrombotic risk. J Hum Nutr Diet. 2014;27(1):1–21.
[৫০]Stoclet JC, Chataigneau T, Ndiaye M, et al. Vascular protection by dietary polyphenols. Eur J Pharmacol. 2004;500(1–3):299–313.
[৫১]Moylan S, Berk M, Dean OM, et al. Oxidative & nitrosative stress in depression: why so much stress?. Neurosci Biobehav Rev. 2014;45:46–62.
[৫২]Watzl B. Anti-inflammatory effects of plant-based foods and of their constituents. Int J Vitam Nutr Res. 2008;78(6):293–8.
[৫৩]Franzini L, Ardigi D, Valtueña S, et al. Food selection based on high total antioxidant capacity improves endothelial function in a low cardiovascular risk population. Nutr Metab CardiovascDis. 2012;22(1):50–7.