আচ্ছা, এই যে বাচ্চা-কাচ্চা, কিশোর-কিশোরী থেকে বড় ও বুড়োরা সবাই সারাদিন স্মার্টফোন আর ট্যাব হাতে নিয়ে মাথা হেঁট করে বসে থাকি, এর কারণে কি শরীরে কোন খারাপ প্রভাব পড়ছে? মাথার খুলিতে শিঙ গজিয়ে যাচ্ছে না তো! শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঘটনা সত্যি। সম্প্রতি খবরে বেরিয়েছে যে অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক যন্ত্র হাতে ধরে ব্যবহার করে করে কমবয়সীদের মাথার খুলির নিচে, ঘাড়ের ঠিক ওপরে তৈরি হচ্ছে শিঙয়ের মতো অতিরিক্ত হাড়।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ডেভিড শাহার প্রায় বিশ বছর ধরে ইউনিভার্সিটি অফ সানশাইন কোস্টে স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা করছেন। প্রায় দশ বছর ধরে বিভিন্ন রোগীর এক্স-রে করার সময় তিনি খেয়াল করলেন যে অনেকেরই মাথার পেছনে প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা শিঙয়ের মতো হাড়! ব্যাপারটা এমন না যে হুটহাট দুয়েকজনের বেলায় এমন পাচ্ছেন, বরং যতই সময় গিয়েছে এই ‘শিঙবিশিষ্ট’ খুলির সংখ্যা বাড়তে লাগলো। মনের খচখচানি দূর করতে তিনি তাই জোরেশোরে গবেষণার জন্য তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা শুরু করলেন। তার সুপারভাইজার মার্ক সেয়ার্সকে সাথে নিয়ে তিনি প্রায় হাজারেরও বেশি মানুষের মাথার এক্স-রে নিলেন। এদের সবার বয়স ছিল ১৮ থেকে ৮৬ বছরের মধ্যে। তারা দেখলেন যে এই হাড়ের প্রবৃদ্ধি তরুণদের (১৮-৩০ বছর বয়সী) মধ্যে অনেক বেশি – প্রতি চারজনে একজন! অন্যদিকে বয়স্ক থেকে বৃদ্ধদের মধ্যে একেবারেই নেই। খুলির এক্স-রের পাশাপাশি মানুষটি কীভাবে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকেন, অর্থাৎ তার posture-ও তারা রেকর্ড করেছিলেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই শাহার মনে করেন যে তরুণদের শরীরে এই শিঙয়ের উদ্ভব হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে।
আমরা সারাদিন হাতে মোবাইল ফোন বা ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ নিয়ে তাতে ঘাড় বাঁকা করে মুখ গুঁজে থাকি। এভাবে সারাক্ষণ ঘাড় বেঁকে থাকায় ভারি মাথার খুলির চাপ পড়ে ঘাড়ের টেন্ডন আর মেরুদণ্ডের প্রথম কশেরুকাগুলোর ওপর। খুলির এই ভারকে ভারসাম্য দিতেই তাই এর নিচ থেকে অতিরিক্ত হাড় বড় হচ্ছে, যার সাথে সেই টেন্ডনগুলো টানটান হয়ে আটকে থেকে জোড়টাকে মজবুত করছে। মানুষের মাথার ভর প্রায় ১০ পাউন্ড বা সাড়ে চার কেজির মতো হয়ে থাকে। আমরা যখন পিঠ ও মাথা সোজা করে বসি তখন মাথার ওজন সরাসরি পড়ে মেরুদণ্ডের ওপর, যা তৈরিই হয়েছে এই ভার নেয়ার সামর্থ নিয়ে। কিন্তু হাতের স্মার্টফোনে লম্বা সময় ফেসবুকিং বা গেমিংয়ে ঘাড়ে ব্যথা হয়। অনেক ডাক্তার একে “টেক্সট পেইন” বলে থাকেন। এই ব্যথা নিরাময়ে শরীর নিজেই সাড়া দিয়েছে হাড়কে নিচের দিকে সূঁচালোভাবে বাড়িয়ে। শাহারের মতে, এই শিঙ সহসাই দূর হয়ে যাবে না, বরং সময়ের সাথে সাথে আরো বেশি বেশি দেখা যাবে এবং এদের আকার আরো লম্বা হতে থাকবে।
তাদের পুরো গবেষণাটি ‘Nature’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে। সম্প্রতি বিবিসি প্রকাশিত ‘How modern life is transforming the human skeleton’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই আবিষ্কারটি উল্লেখ করা হলে তা আবারও আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। এখন প্রশ্ন হলো এই সমস্যার সমাধান কী? এমন না যে শিঙ এড়াতে এখন থেকে সব মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। চাইলেও তো তা করা সম্ভব না, কারণ এই প্রযুক্তি এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। যা করতে হবে, তা হলো এর সীমিত ব্যবহার এবং শারীরিক চর্চার বিবর্তন। কম্পিউটার বা মোবাইলে বাঁকা হয়ে বসে পিঠ ও ঘাড় ব্যথা দূর করার অনেক শরীরচর্চার নিয়ম ইন্টারনেটে সুলভ আছে। সেগুলোর পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহারের সময়সীমা দিন বা রাতে সীমাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করতে হবে। অন্তত ১০-১২ ঘণ্টা যেন কোনোভাবেই হাতে মোবাইল ফোন না থাকে, বিশেষ করে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তাও করতে আলসেমি লাগছে? তাহলে আপনার ঘাড়ের উপরে যেখানে খুলির হাড় শেষ হয়েছে সেখানে ভালভাবে হাত বুলিয়ে দেখুন তো, কোন শক্ত শিঙয়ের মতো অংশ টের পাচ্ছেন কিনা? যদি পান, তাহলে আজই কবি নজরুল ইসলামের কবিতা আওড়াতে শুরু করুন,
“বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!”