সমুদ্রের অতল জলরাশির জগতটাকে আমাদের মতো স্থলচারী প্রাণীদের কাছে মনে হয় নিঃশব্দ, ভুতুড়ে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, অতল জলরাশির এই জগতটাতে আসলে আলোর চেয়ে শব্দেরই প্রাধান্য বেশি। আমাদের হয়তো শোনার মতো কান নেই, কিন্তু এই জগতে বেশিরভাগ সময়ে চারপাশে নানা রকমের শব্দরাই শুধু খেলে বেড়ায়। শব্দময় এই জগতটায় সবচেয়ে বিখ্যাত সম্ভবত তিমি মাছদের মুখ নিঃসৃত শব্দ। জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগানের এতই পছন্দ ছিলো তিমিদের এই শব্দময় জগতটাকে যে, ১৯৭০-এর দশকের শেষে যখন ‘ভয়েজার’ প্রজেক্টের জন্যে গোল্ডেন ডিস্ক তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁকে, তখন সেই ডিস্কে ‘সাউন্ড অব আর্থ’ ক্যাটাগরিতে পিঠকুঁজো তিমির গান জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
কথা হলো, কী ঘটবে, কোনো একদিন যদি দেখেন আপনি কারো সাথে কথা বলে আর মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছেন না? আপনি কথা বলতে পারছেন ঠিকই, কিন্তু আপনার ভাষা কেউ বুঝতে পারছে না এবং আপনার হাতে অন্য কোনো উপায়ও নেই ভাব বিনিময় করার। কী অবস্থা হবে আপনার?
পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করতে হলে আসুন জানি এক রহস্যময় শব্দের কথা। সেই সাথে জেনে নিই দুনিয়ার নিঃসঙ্গতম তিমি সম্পর্কে, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ফিফটি টু (52)’। আমাদের আজকের আর্টিকেলের আরেক নাম দেয়া যেতে পারে, ‘দ্যা লিজেন্ড অব ফিফটি টু’।
ফিফটি টু – প্রথম আবির্ভাব
কাহিনীর শুরু ১৯৮৯ সালে। আমেরিকা বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে আমেরিকান নেভি কিছু স্থাপনা বানিয়েছিলো যেখান থেকে সোভিয়েত সাবমেরিনের গতিবিধি লক্ষ্য করা যায়। সোভিয়েত সাবমেরিনগুলো যাতে কারো অগোচরে আমেরিকার সীমানার ভিতরে ঢুকে পড়তে না পারে, সেজন্যে এই সব স্থাপনায় এমন সব যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিলো যা দিয়ে সমুদ্রের অত্যন্ত গভীরের মৃদু হতে মৃদুতম শব্দও রাডারে ধরা পড়ে। সোভিয়েতের সাবমেরিনগুলো সাধারণত ২০-৫০ হার্জের মধ্যে শব্দ উৎপাদন করে চলাচল করতো গভীর সমুদ্রে। যন্ত্রপাতিগুলোও তাই বসানো হয়েছিলো সেভাবেই। আমেরিকার উপকূলে হঠাৎ এই রেঞ্জের মধ্যে শব্দ রাডারে ধরা পড়লে শব্দের উৎসটাকে ট্র্যাক করা হতো। সেটা কোন পথ দিয়ে কোথায় যাচ্ছে, তা মনিটরিং করা হতো। চলাচলের প্যাটার্নে সন্দেহজনক কিছু পেলেই কেল্লা ফতে। রিপোর্ট চলে যেতো উপর মহলে।
এই কাজ করতে গিয়ে আরেকটা বোনাস দিক খুঁজে পেলো আমেরিকান নেভি। তারা আমেরিকার উপকূলীয় অঞ্চলের তিমি মাছদের ট্র্যাক করতে সক্ষম হলো তাদের রাডারে। তিমি মাছেরা প্রজাতি ভেদে ১০ হার্জ থেকে ৪০ হার্জের মধ্যে শব্দ উৎপাদন করে। সোভিয়েতদের সাবমেরিনও এই রেঞ্জেই কাজ করে। ফলে, সেই সব শব্দ দিয়ে তিমি মাছদের উপরে গবেষণার এক নতুন দুয়ার খুলে গেলো তাদের সামনে। ১৯৮০-এর দশকের শেষে সোভিয়েত বনাম আমেরিকা ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ির ইতি ঘটলে নেভির তৈরি এই সব লিসেনিং পোস্টকে দিয়ে দেয়া হয় মেরিন লাইফের গবেষণার জন্যে।
এমনই এক মেরিন লাইফ নিয়ে গবেষণাকারী স্থাপনা হচ্ছে ম্যাসাচুসেটসে। এটার বর্তমান নাম ‘Woods Hole Oceanographic Institution’। এখানে ১৯৯২ সালের ৭ ডিসেম্বর ‘বিল ওয়াটকিনস’ নামের এক গবেষক অদ্ভুত এক সিগন্যাল ধরে ফেলেন রাডারে। তরঙ্গটার কম্পাংক ছিলো ৫২ হার্জ। ততদিনে সোভিয়েতের সাবমেরিন ট্র্যাক করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। তার মানে এটা ঐ অঞ্চলের জলচর কোনো প্রাণীরই তৈরি করা শব্দ। বিল দেখলেন, শব্দের উৎসটার চলাচলের পথের সাথে তিমি মাছের চলাচলের পথের মিল আছে। ঐ অঞ্চলে নীল তিমি (Blue Whale) এবং ফিন তিমি (Fin Whale) যে প্যাটার্নে চলাফেরা করে, ঠিক সেই প্যাটার্নেই ঘুরেফিরে চলছে এই শব্দের উৎসটা। কিন্তু সমস্যা বাঁধছে একটা জায়গায়। ৫২ হার্জ মানুষের কানে শুনার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী শব্দতরঙ্গ না। কিন্তু তিমি মাছেদের জন্যে এটা অনেক বেশিই বলা চলে। ঐ অঞ্চলের নীল কিংবা ফিন তিমিরা সাধারণত ৪০ হার্জের উপরে শব্দ উৎপাদন করতে পারে না। নীল তিমির শব্দের রেঞ্জ ১০ হার্জ থেকে ৪০ হার্জ। আর ফিন তিমির শব্দের রেঞ্জ মোটামুটি ২০ হার্জ।
বিল ওয়াটকিনসকে নেশায় পেয়ে বসলো। তিনি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এই ৫২ হার্জের শব্দটাকে ট্র্যাক করে চললেন। ট্র্যাক করে দেখলেন, ৫২ হার্জের এই শব্দটা শুধু অদ্ভুতই নয়, বরং বেশ ইউনিক। এটা শুধু একটা মাত্র উৎস হতেই আসছে। আর সেই শব্দ উৎসের মালিকটার সাথে মিলছে নীল এবং ফিন তিমির চলাচলের প্যাটার্ন। তার মানে এই শব্দ উৎসের মালিক একটা তিমি মাছ। এমন এক তিমি মাছ, যেটা ৫২ হার্জের শব্দ উৎপাদন করতে পারে। এই শব্দ তৈরি করে সে যোগাযোগ করতে চাইছে তার প্রজাতির অন্য কোনো সদস্যের সাথে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে আর কোনো ৫২ হার্জের শব্দ ভেসে আসছে না। ফলে ৫২ হার্জের শব্দের মালিক নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের অতলে। তবে সে টের পাচ্ছে না, সে আসলে একা নয়। মাইল কয়েক দূরের উপকূলে এক রিসার্চ সেন্টারে বসে জীবন সায়াহ্নে উপনীত হওয়া এক ব্যক্তি গভীর মুগ্ধতায় সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে তাকে। শুনে যাচ্ছে তার আরেকজন সঙ্গী খুঁজে পাবার আকুতি।
বিল ওয়াটকিনসের পুরো নেশা ধরে গিয়েছিলো ব্যাপারটায়। রাতের পর রাত তিনি একটা পাকা দালানের ভিতরে ল্যাবরেটরিতে বসে গভীর মনোযোগে শুনে চলতেন আর রেকর্ড করতেন ৫২ হার্জের শব্দটাকে। প্রায় এক যুগ ধরে তিনি মুগ্ধ বিস্ময়ে যতটুকু সম্ভব ডেটা রেকর্ড করেছিলেন এই শব্দ উৎসটার। ২০০৪ সালে এই শব্দটার প্রতি এক বিশাল মুগ্ধতা নিয়েই তিনি ৭৮ বছর বয়সে বিদায় নেন পৃথিবী হতে। রেখে যান এই শব্দ উৎসের ব্যাপারে করে যাওয়া তাঁর সকল গবেষণাপত্র। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পরেই সেগুলো প্রকাশিত হয় জার্নালে। হৈচৈ পড়ে যায় মিডিয়ায়। পত্রপত্রিকায় চলে আসে এক নিঃসঙ্গ তিমি মাছের কথা, যে ৫২ হার্জের শব্দ উৎপাদন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার মতো আরেকজন সঙ্গীকে। কিন্তু তার কথা তার প্রজাতির আর কেউ বুঝতে পারে না। ফলে আসে না কোনো প্রত্যুত্তর। আর সেই তিমিটা নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়ায় প্রশান্ত মহাসাগরের সুবিশাল জলরাশির এমাথা-ওমাথায়। শব্দের উৎসটার নাম হয়ে যায় ‘ফিফটি টু – দ্যা লোনলিয়েস্ট হোয়েল অন আর্থ’।
লিজেন্ড অব ফিফটি টু
সব পত্রপত্রিকা ফলাও করে প্রচার করে এটা একটা নিঃসঙ্গ তিমি মাছের গান। তার ভাষা কেউ বুঝতে পারছে না, ফলে তার সঙ্গী খুঁজে পাবার আহবানে কেউ সাড়া দিতে পারছে না। ইংল্যান্ডের ‘দি এক্সপ্রেস’ তো ছাপিয়েই দিয়েছিলো, “পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম তিমি মাছের অনন্য সুরটাই তাকে তার ভালোবাসা খুঁজে পেতে বাধা দিচ্ছে”। (নিচের পত্রপত্রিকার লিংকে সর্বশেষ এড্রেসটা দ্রষ্টব্য)
কিন্তু সত্যিটা আসলে কী? ফিফটি টু কি আসলেই কোনো তিমি মাছ?
বিল ওয়াটকিনস এবং তার আরেক সহ-গবেষক তাদের জার্নালে উল্লেখ করেছিলেন, “এটা আসলেই যদি একটা তিমি মাছের গান হয়, তবে মেনে নেয়া খুবই কঠিন হবে যে, এই বিশাল মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই ধরণের প্রাণী শুধুমাত্র এমন একটাই আছে। তা সত্ত্বেও বছরকে বছর সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে পুরো এলাকা জুড়ে এই বৈশিষ্ট্যের ডাক এমন একটাই পাওয়া গেছে। প্রতি মৌসুমে একটা উৎস হতেই এমন ডাক ভেসে আসে”। (২ নং লিংক দ্রষ্টব্য)
ঘটনা আসলেই তাই। বিল এবং তার সহ-গবেষকদের প্রকাশিত জার্নাল অনুযায়ী প্রতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ ৫২ হার্জের এই সুরটা ভেসে আসতো তাদের রাডারে। এটা চলতো জানুয়ারির শেষ হতে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপরে শব্দ উৎসটা আবার উপকূলের সীমানার বাইরে চলে যেতো। ঠিক প্রশান্ত মহাসাগরের ঐ অঞ্চলে তিমির ঝাঁকেরা যেভাবে ঘুরে বেড়ায়, সেই প্যাটার্নের সাথে মিল রেখে। পুরো ১২ বছর এই ধাঁচেই সুরটা রেকর্ড করেছিলেন বিল ও তার সহযোগীরা। কিন্তু ট্যুইস্ট একটা জায়গাতেই। প্রত্যেকবার ৫২ হার্জের শব্দ একটা উৎস থেকেই পেয়েছিলেন বিল।
ট্যুইস্টের উপরে ওভার ট্যুইস্ট দিতে সাম্প্রতিক কালের আরো কিছু কথা যোগ করা যায়। বিল ২০০৪ সালে মারা যাবার পরে ফিফটি টু-কে ট্র্যাক করা এক প্রকার বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। বিল ওয়াটকিনসের মতো মুগ্ধতা নিয়ে আর কেউ দিনের পর দিন এই কাজ চালিয়ে যাননি। খুবই ছাড়া ছাড়া ভাবে এই গবেষণাটা চালিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেটুকুতেই ধরা পড়ে আরেক চমকপ্রদ ব্যাপার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৫২ হার্জের সুর উৎপাদনকারী উৎসটা মোটামুটি ৪৭-৪৯ হার্জের সুর তৈরি করে যাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ‘স্ক্রিপস ইন্সটিটিউশন অব ওশেনোগ্রাফি’-র গবেষক জন হিলডাব্র্যান্ড বলছেন, এই ব্যাপারটা তিমি মাছদের শিশু হতে প্রাপ্তবয়স্ক হবার সময়ে গলার টোন পালটে যাবার সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ, ধারণা করা হচ্ছে, আমাদের সেই শিশু তিমিটা এখন আর শিশু নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে! তবে হিলডাব্র্যান্ড তার এক গবেষণাপত্রের ফলাফল উল্লেখ করে আরো জুড়ে দিয়ে বলেন, “তিমি মাছেরা, বিশেষত নীল তিমিরা ১৯৬০ সালের পর থেকেই গভীর হতে গভীরতর পিচে গলার সুর ছেড়ে চলছে। হয়তো সেটাও ফিফটি টু-এর গলার সুর পালটে যাবার আরেকটা ব্যাখ্যা হতে পারে”। এভাবেও হয়তো তিমি মাছের সাথে রহস্যময় শব্দ উৎসটার আরেকটা যোগসূত্র দাঁড় করানো যায়। কিন্তু চাক্ষুষ প্রমাণ এখনো কারো হাতে নেই।
কথা হলো, আমাদের ফিফটি টু যদি একটা তিমি মাছই হয়, তবে তার এমন অনন্য সুর উৎপাদনের কার্যকারণটা কী?
এখন পর্যন্ত, কয়েকটা হাইপোথিসিস দাঁড় করানো হয়েছে। একটা ধারণায় বলা হচ্ছে, এটা সম্ভবত নীল এবং ফিন তিমির সংকর। এমন সংকর তিমির শরীরের গঠন হবে পুরোই অন্যরকম। ফলস্বরূপ, তার গলার সুর পালটে ৫২ হার্জের সুর তৈরি হতে থাকাও বিচিত্র কিছু নয়। এই ধরণের সংকর তিমিদের শারীরিক গঠন হয় অনেকটা ফিন তিমির মতো, কিন্তু গলার সুর এবং অন্যান্য আচার-আচরণ হয় নীল তিমির মতো। সিয়াটলের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের প্রফেসর ‘কেইট স্টাফোর্ড’ এর মতে, “ফিফটি-টু এর আচরণও পুরোই নীল তিমির মতো। এর বিভিন্ন মৌসুমে এক এলাকা হতে অন্য এলাকায় মাইগ্রেশন করার প্যাটার্নটা নীল তিমির সাথে মিলে যায়। সুতরাং আমার ধারণা, এই প্রাণীটার কিছু অংশ অবশ্যই নীল তিমির মতো”।
আরেক হাইপোথিসিসে বলা হচ্ছে, এই তিমিটা সম্ভবত কোনো ভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে থাকতে পারে। সেই প্রতিবন্ধকতার দরুন এমন অনন্য কম্পাংকের এক সুর বের হয় তার গলা দিয়ে।
এদিকে নিউইয়র্কের ইথাকা কর্নেল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ‘ক্রিস্টোফার উইলস ক্লার্ক’ বলেন, “মানুষ ফিফটি টুর ডাককে যতটা অনন্য মনে করছে, ততটা অনন্য হয়তো নয় ব্যাপারটা। এখন পর্যন্ত বহু অঞ্চলের তিমির ডাক রেকর্ড করা হয়েছে। সেখান থেকে দেখা গেছে, একেক অঞ্চলের তিমির একেক রকমের ডায়ালেক্ট আছে। একেক অঞ্চলের মানুষ যেমন একেক ভাষায় কথা বলে, তেমন”। কিন্তু তাতেও এই রহস্যের সমাধান হয় না তেমন একটা। কারণ বিলের রেখে যাওয়া গবেষণা অনুযায়ী, এই শব্দের উৎস কেবল একটাই।
তবে এক্ষেত্রে ২০১০ সালের একটা ঘটনা উল্লেখ করা যায়। বিলের মৃত্যুর পরে আর কেউ তেমন উৎসাহ নিয়ে ফিফটি টুর সুর ট্র্যাক করে যায়নি নিরলস ভাবে। উপরে উল্লিখিত গবেষক হিলডাব্র্যান্ড ২০১০ সালে এই ব্যাপারে পুনরায় কৌতূহল প্রকাশ করলে তার এক সহকারী আবার ট্র্যাক করা শুরু করেন শব্দটাকে। শব্দের উৎসটা বিলের গবেষণা অনুযায়ীই চলাচলের প্যাটার্ন দেখাতে শুরু করে সেন্সরে। হিলডাব্র্যান্ডের অফিস থেকে মাত্র ৫-৬ মাইল গভীর সমুদ্রে অবস্থান দেখাতে থাকে ৫২ হার্জ সুরটা। তবে এবারে একটু ভিন্ন ফলাফল পাওয়া যায়, যা কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করে সবার মনে। দেখা যায়, সমুদ্রে পরস্পর হতে বহুদূরে অবস্থিত আলাদা এলাকার দু’টো সেন্সর থেকে এই তরঙ্গ ভেসে আসছে। তার মানে, হয়তো আমাদের ফিফটি টু আর আমাদের ধারণা অনুযায়ী নিঃসঙ্গ কোনো প্রাণী নয়। তাছাড়া অনেক বিজ্ঞানী “তার কাছাকাছি প্রজাতির অন্য কেউ ৫২ হার্জ কম্পাংকের সুর বুঝতে পারে না” এমন ধারণাও উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের মতে, নীল তিমি হয়তো ৪০ হার্জের বেশি সুর উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ৫২ হার্জের একটা সুর তারা শুনতে পারবে না এবং শুনলেও সেটা বুঝতে পারবে না”।
ফিফটি টু – পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম তিমি মাছ?!
ফিফটি টু কি আদৌ কোনো তিমি মাছ, নাকি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত রকমের কোনো শব্দের উৎস? তিমি মাছ হলে সে পুরুষ না স্ত্রী? কী ধরণের তিমি সে? নীল তিমি, ফিন তিমি, নাকি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের নতুন কোনো প্রজাতির তিমি? নাকি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এক নীল তিমি সে, যার কথা কেউ বুঝতে পারছে না? শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে দলের বাইরে সঙ্গীহীন অবস্থায় প্রশান্ত মহাসাগরের জলরাশিতে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিঃসঙ্গ, একাকী! বয়স বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে তার গলার সুরের গভীরতা!
এখন পর্যন্ত এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। তবে ২০১৬ সালে এক গবেষক দল অবশেষে অভিযানে নেমেছেন এই ব্যাপারটার সুরাহা করতে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন আমেরিকান ফিল্মমেকার ‘জশ যেমান’ এবং অভিনেতা ‘আদ্রিয়ান গ্রেনিয়ের’। এই অভিযানে যা কিছুই ঘটবে, সবকিছুই পরবর্তীতে একটা ডকুমেন্টারি হিসেবে রিলিজ দেয়া হবে। এই অভিযানের পেছনে খরচের জন্য ২০১৫ সালে ‘কিকস্টার্টার’ এর মতো সাইটে জনগণের সাহায্য চাওয়া হয়েছিলো। জনগণ বিপুল সাড়া দিয়েছিলো সেখানে। তারপরেও কিছুটা ঘাটতি রয়ে গিয়েছিলো ফান্ড তোলাতে। তখন এগিয়ে এসেছিলেন হলিউড অভিনেতা ‘লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও’। নিরলস ভাবে সুস্থ পৃথিবী ও পরিবেশের জন্যে কাজ করে যাওয়া এই ব্যক্তি ৫০,০০০ ডলার দান করে দিয়েছিলেন তার ফান্ড হতে। ২০১৭ সালের কোনো এক সময়ে ডকুমেন্টারিটা রিলিজ পাওয়ার কথা রয়েছে।
ফিফটি টুকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত অনেক কবিতা, গান এবং গল্প তৈরি হয়েছে। সবখানেই তাকে নিঃসঙ্গ এক তিমি মাছ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আজকে জুল ভার্ন বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো দুর্ধর্ষ এক কল্পবিজ্ঞান কাহিনী ফেঁদে বসতেন। সেই কাহিনীতে থাকতো বিল ওয়াটকিনসের ফিফটি টুর ব্যাপারে অসামান্য মুগ্ধতার কথা। ফিফটি টুর পেছন পেছন ধাওয়া করে চলা কোনো এক চরিত্রের রোমাঞ্চকর সমুদ্রাভিযানের কথা। সবশেষে হয়তো তিনি সমাপ্তি টানতেন কোনো এক জোছনা ভরা রাতে। আমাদের চরিত্রটা হয়তো ভেদ করতে পারেনি ফিফটি টুর রহস্য। খুবই কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো সে। কিংবা ভেদ করলেও হয়তো সেটা মনুষ্য সমাজ হতে আড়াল করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কারণ তাতে “নিঃসঙ্গ, শারীরিক প্রতিবন্ধী কিন্তু অনন্য” এই তিমিটার ক্ষতি হতে পারে। সে আর ডক্টর বিল ওয়াটকিনসের অশরীরী ছায়ামূর্তি জাহাজের ডেকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রহস্য ঘেরা পরিবেশে উপভোগ করতে থাকে সমুদ্রের রূপালী জোছনা। তাদের সামনেই সেই জোছনায় প্রশান্ত মহাসাগরের জলের উপরে খানিক ঝিকমিকিয়ে উঠে আবার ডুবে যায় ‘ফিফটি টু’। মানব সভ্যতা তাকে ছুঁতে চায়, কিন্তু সে মানুষের আড়ালে থেকে ৫২ হার্জে গেয়ে চলে তার গান – হয়তো নিজ প্রজাতির কোনো সঙ্গী খুঁজে পাবার আশায়।
তথ্যসূত্র:
========
১। ফিফটি টুর কণ্ঠ, যেটা ধারণ করেছিলেন গবেষক বিল ওয়াটকিনস – https://soundcloud.com/bbc_com/the-52hz-whale-recorded-by-bill-watkins
২। বিল ওয়াটকিনসের রেখে যাওয়া মূল গবেষণাপত্র- http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0967063704001682
৩। বিবিসি আর্থ – http://www.bbc.com/earth/story/20150415-the-loneliest-whale-in-the-world
৪। স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন – http://www.smithsonianmag.com/smart-news/maybe-worlds-loneliest-whale-isnt-so-isolated-after-all-180955005/
৫। উইকিপিডিয়া পেইজ – https://en.wikipedia.org/wiki/52-hertz_whale
৬। আরও কিছু পত্রপত্রিকার লিংক –
অনেকদিন পর প্রিন্সের লেখা পেলাম। ভালো বিষয় নিয়ে লিখেছেন। একদম নতুন একটা জিনিস জানলাম। তবে মনের ভেতর একটা ছটফটানিও টের পাচ্ছি “কে এই ৫২?” প্রশ্ন নিয়ে। আশা করি, খুব দ্রুত গবেষকরা এই রহস্যের সমাধান করবেন।
বিঃ দ্রঃ নিয়মিত লিখুন প্লিজ।
যে হারে ইন্সপায়ার করেছেন লেখককে, তাতেই লেখাটা দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে। নতুবা আরো কিছুদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ফ্যাঁ ফ্যাঁ করে ঘুরে বেড়ানোর প্ল্যান ছিলো লেখকের। মন্তব্যকারীকেও ধন্যবাদ লেখাটা তৈরির পেছনে এমন “উচ্চ চাপের” উৎসাহ জুগিয়ে যাবার জন্যে।
Stay like this, like an amazing couple. একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিতে দিতে যাতে চান্দে উঠে যেতে পারো।