ভূমিকা
আইনস্টানের ভাষায় সময় একটি ভ্রম। তাঁর তত্ত্বেই সময়ের পরমতায় প্রথম আঘাতটি এসেছে। যার যার কাছে তার তার সময়। একমাত্র স্থান ও কাল-কে একত্র করা হলেই সেটা পরমার্থে দেখা সম্ভব। আবার তাঁর মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুসারে সময়ের উপর মহাকর্ষের প্রভাব রয়েছে।
সময় এমন একটা বিষয়, যেটা সম্পর্কে বিশিষ্ট পদার্থবিদ ব্রায়ান গ্রিন বলেছেন,
সময় হচ্ছে মানবজাতির জানা সবচেয়ে পরিচিত অথচ দুর্বোধ্য একটি বিষয়। আমরা বলি, এটি চলমান, এটি অর্থ (টাকাপয়সা)। আমরা এটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করি, এটা নষ্ট হলে আমরা অপরাধবোধে ভুগি। কিন্তু সময় জিনিসটা আসলে কী?
আর এজন্যই বিজ্ঞানীরা সময়ের সাথে এনট্রপির (অনিয়মের মাত্রা) একটা সম্পর্ক খুঁজেন। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা সময় কী, সেটা না বলে বরং সময় কিসের সাথে সম্পর্কিত, সেটা দেখি।
সময় ও এনট্রপি
আমরা জানি, সময়ের সাথে সাথে এনট্রপি বাড়ে। তাপগতিবিদ্যার অতি চমৎকার একটি বিষয় এই এনট্রপি, অর্থাৎ কোনো ব্যবস্থার যাবতীয় কার্য সম্পাদনের সাথে সাথে তাপের যে অভাব দেখা দেয় বা যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এখানে বলা হয়েছে, বদ্ধ সিস্টেমে সময়ের সাথে এনট্রপি বাড়ে। এটা মানুষ সৃষ্ট কোনো আইন নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতি প্রদত্ত একটি নিয়ম। একটা উদাহরণ ভেবে দেখুন। ১২০০ পৃষ্ঠার কোনো বইয়ের সবগুলো পাতা যদি বাইন্ডিং খুলে ছড়িয়ে দেয়া হয়, তবে সেগুলো বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। হিসাব করলে দেখা যাবে, অসংখ্য উপায় আছে যা অনুসরণ করে পাতাগুলোকে ফের জড়ো করে বাইন্ডিং করা যায়। কিন্তু যদি আপনি আগের মতো ক্রমানুসারে (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬……………………, ১২০০) পাতাগুলোকে জড়ো করতে চান, তবে একটি এবং কেবলমাত্র একটি পথই বিদ্যমান।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, অনিয়মিত আকারে জড়োবদ্ধ হওয়া তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ এবং প্রকৃতি সর্বদা সবচেয়ে সহজ পথটাই বেছে নেয়। মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। এজন্য সময়ের তীর নির্ধারণেও এনট্রপিকে মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়। এটা মহাবৈশ্বিক সময়, যেটার তীর ভবিষ্যতের দিকে। আমরা যারা তরুণ/তরুণী, তারা একটি সত্য কখনই অস্বীকার করতে পারবো না যে, আমরা সময়ের সাথে বৃদ্ধ/বৃদ্ধা হবো; শিশু হয়ে মাতৃগর্ভে প্রবেশ করবো না। মজার বিষয় হচ্ছে, মহাবিশ্বের আভ্যন্তরীণ সময়কে ব্যক্তিগতভাবে বা স্থানীয়ভাবে খণ্ড বিখণ্ড করা সম্ভব। বিগত শতাব্দী ধরে আমরা সেটাই জেনে আসছি।
মনস্তাত্ত্বিক সময়
এ তো গেলো পদার্থবিদ্যাগত ধারণায় সময়ের দিক নির্ধারণ। আরো এক প্রকার সময় আছে, যেটাকে বলা হয় মনস্তাত্ত্বিক সময়। মনস্তাত্ত্বিক সময়ের তীরও সামনের দিকে। কারণ, আমরা অতীতকে স্মরণ করতে পারি, অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে কথা বলতে ও লিখতে পারি, যদিও ভবিষ্যৎ আমাদের কাছে সবসময় অজানা থেকে যায়। মানসিকভাবে আমরা যেন অজানাকে জানার প্রস্তুতি নিয়েই অপেক্ষা করি।
ষষ্ঠ শতকের বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক সাইলেসিয়াস মনে করতেন, মানসিক শক্তির মাধ্যমে সময়কে থামিয়ে দেয়া সম্ভব। তাঁর মতে সময় মানুষের নিজস্ব সৃষ্টি, যার ধারণা মূলত চেতনা থেকে জন্ম নেয়। আর চেতনা হচ্ছে মস্তিষ্কের ক্রিয়া। অর্থাৎ সময়ের ঘড়ি আমাদের মস্তিষ্কে অবস্থিত। সময়ের ধারণাকে দূরে সরিয়ে রাখার মাধ্যমে মৃত্যুকেও ঠেকিয়ে রাখা যায়।
আইনস্টাইনের মতো অনেক দার্শনিকই সময়কে ভ্রম বলে আখ্যা দিয়েছেন। অনেকে এটাকে বলেছেন ছলনা। আমাদের স্মৃতি অতীতের ভ্রম তৈরি করে। কোনো ঘটনার চেতনাজাত উপলব্ধি বর্তমান সময়ের বোধ জাগায়। অতীত স্মৃতির অভিজ্ঞতা ভবিষ্যৎ চিন্তার মানসিক শক্তি যোগায়। আমাদের বিশ্ব সদা পরিবর্তনশীল। সময় এই সদা পরিবর্তনশীল পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে তোলে।
গতি ও পরিমাপ
অ্যারিস্টটল সময় আর গতিকে এক করে দেখতেন। তাঁর মতে, গতি বাড়তে কমতে পারে কিন্তু সময় একই ধারায় প্রবাহিত হয়। জন এলিস ও ম্যাক ট্যাগারট-এর মতে, সময়ের প্রবাহ একটি ভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। শুধুমাত্র বর্তমানকাল বাস্তব। অর্থাৎ তাদের মতে সময়ের তীর বলতে আসলে কিছু নেই। যা চলে যায় অথবা যা আসবে, তার সবই অবাস্তবতার অন্ধকারে বিলীন হয়ে যায়।
২০১০ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সময়টি রেকর্ড করা হয়েছে, যার মান ছিলো ১২ অ্যাটো সেকেন্ড (তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণু পাশাপাশি রাখলে যে দৈর্ঘ্য হয়, ঐ দৈর্ঘ্য অতিক্রম করতে আলোর যে সময় লাগে তা-ই ১ অ্যাটো সেকেন্ড)। তারও আগে ১০০ অ্যাটো সেকেন্ড সময়কাল পরিমাপ করা সম্ভব হয়েছিলো। এভাবে চলতে থাকলে সময়ের ধারণা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, একবার ভেবে দেখুন।
আমরা দেখেছি, মহাকর্ষ এমনকি মস্তিষ্কও হয়তো বা সময়কে পরিবর্তন করতে সক্ষম। সময়ের মস্তিষ্কজাত চেতনা সম্পর্কিত ধারণার সাথে বৈজ্ঞানিক নীতিগুলোর কিছুটা হলেও মিল রয়েছে। দার্শনিকরা যখন বলেন, মস্তিষ্কের মাধ্যমে সময়কে পরিবর্তন করা সম্ভব, তখন তারাও কিন্তু সময়কে পরমার্থে না দেখে বরং ব্যক্তি নির্ভর বলে মেনে নেন।
আমরা মহাবিশ্বের (আবদ্ধ একটি সিস্টেম) অংশ বলে মহাবৈশ্বিক সময় অনুসারে সামনের দিকেই যাই (যদি সামনের দিক বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, সেটা যথেষ্ট সুন্দরভাবে সংজ্ঞায়িত করা থাকে)।
স্থান-কাল
স্থান ও কাল মিলে মহাবিশ্ব চার মাত্রার। তাই বলে যে স্থান ও কালকে একেবারেই পৃথকভাবে বিবেচনা করা যাবে না, তা নয়। সময়কে পৃথকভাবে বিবেচনা করতে গেলেই আমাদেরকে আবার সেই সময়ের খণ্ডিত চিত্রের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়। তবে স্থান-কাল চার মাত্রাকে একত্রে বিবেচনা করলে মহাবৈশ্বিক সময়ের সাথে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। আমরা জানি, ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষক সাপেক্ষে স্থান-কাল একত্রে কোনো পরিবর্তন প্রকাশ করে না, যেটা মহাবৈশ্বিক সময়ের সমরূপ। এই অভিন্নতা হয়তো মহাবৈশ্বিক সময়েরই একটা অংশ।
মহাবৈশ্বিক সময়কে যদি নদীর স্রোতের সাথে তুলনা করা হয়, তবে স্থানীয়ভাবে বাঁধ দিয়ে এই স্রোতকে আটকে ফেলা যায়। স্রোতের দিক পরিবর্তন করে দেয়া যায়, এমনকি স্রোতের গতিও পরিবর্তন করা যায়। সময়কেও তদ্রুপ নিজেদের ইচ্ছামতো পরিবর্তন করা সম্ভব। আইনস্টাইনের তত্ত্বগুলো অন্তত তা-ই বলে। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি, বেগের পরিবর্তন করে, মহাকর্ষের তীব্রতা বাড়িয়ে কমিয়ে স্থানীয়ভাবে সময়কে নিজের ইচ্ছামতো চালনা করা সম্ভব।
সময় ব্যবস্থা
এবার আসা যাক সময় ব্যবস্থা প্রসঙ্গে। ঘড়ির সাথে সময় শব্দটি এমনভাবে জড়িত যেন, সময় মানেই ঘড়ি আর ঘড়ি মানেই সময়। ঘড়ি একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যবস্থা পরিমাপক যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। আসলে ঘড়ির জন্য সময় সৃষ্টি হয়নি, মানুষের সুবিধার জন্য ঘড়ি তৈরি করে নেয়া হয়েছে। তাই ঘড়িকে সময় পরিমাপের একমাত্র মানদণ্ড মনে করাটা ঠিক হবে না।
ঘড়ির কাঁটার চক্রাকারে স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা সময়ের হিসাব রাখি। তেমনি পৃথিবী একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আসে, বালুঘড়ি নির্দিষ্ট সময় অন্তর বালুর চক্র সম্পন্ন করে। এছাড়াও হৃদস্পন্দন, সিজিয়াম পরমাণুর অণুকম্পন – এ সবই ঘড়ির ন্যায় বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। তাই শুধুমাত্র যান্ত্রিক ঘড়ির সাথে সময়কে জড়িয়ে ফেলাটা মূলত আমাদের চিন্তার জগতটাকে সংকুচিত করে দেয়।
আমরা রাত দিনের হিসাব মিলিয়ে আমাদের মতো করে একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যবস্থা তৈরি করে নিয়েছি। অন্য সকল গ্রহ বা ছায়াপথে অথবা মহাবিশ্বের অন্য কোথাও আমাদের সময় ব্যবস্থা যে অচল, তা বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন। সে সকল স্থানে দিনকে ২৪ ঘণ্টায়, মাসকে ৩০ দিনে এবং বছরকে ৩৬৫ দিনে ভাগ করলে চলবে না। অর্থাৎ ঐ সকল গ্রহে ১২ ঘণ্টা পর সকাল ও তারপরের ১২ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা নামবে – এরূপ চিন্তা করে বসে থাকলে সেটা হবে মস্ত বড় ভুল। এমনকি সময় ব্যবস্থার ভিন্নতার কারণে সেখানে জীবনব্যবস্থায়ও ভিন্নতা দেখা দিবে। তাই সময়কে কঠিন ও নির্দিষ্ট কোনো নিয়মে বেধে ফেলাটা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়।
মন্তব্য
সময় নিয়ে আলোচনায় পদে পদে বিচ্যুতি আসে। ফলে অনেক কিছুই অপ্রকাশিত থেকে যায়। তবে সময় জটিল একটি বিষয় হলেও সময় সংক্রান্ত আলোচনায় অনেক কিছুই তুলে আনা যায়। সময়ের সাথে আমদের সেই চিরকালীন বন্ধন এবং সময় ব্যবস্থায় আমাদের অভ্যস্ততাই এর মূল কারণ বলে মনে হয়। সময় বিষয়টির জটিলতা এর গভীর ও অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত। সময়ের বাহ্যিক ও প্রায়োগিক দিকগুলো আমরা সহজে আত্মস্থ করতে পারলেও এর দর্শন ও গভীরতা উপলব্ধি করতে গেলেই যতো সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর সেজন্যই সময় বিষয়টাকে যেন ধরি ধরি করেও আর ধরা হয়ে ওঠে না।