এখন পর্যন্ত একমাত্র গ্রহ হিসেবে পৃথিবী প্রাণের অস্তিত্ত্ব নিয়ে মহাশূন্যে টিকে আছে। এর জন্য সবার আগে আপনি কাকে কৃতজ্ঞতা জানাবেন? আমি সূর্যকেই জানাবো। সূর্যের কাছে আমরা হাজারো ভাবে ঋণী। কারণ বললে শেষ করা যাবে না। তবে এর মধ্যে সবার আগে থাকবে আলো। হয়তো প্রাণ সূর্যের আলোহীন অঞ্চলে (মহাসাগরের তলদেশে তৈরি হয়েছে), কিন্তু প্রাণের ব্যাপক বৈচিত্র্যের ব্যাপারটা আলো ছাড়া কোনোভাবেই কল্পনা করা যায় না। আচ্ছা কখনো ভেবেছেন, কিভাবে এই আলো সূর্যে তৈরি হয়/কিভাবেই বা এই আলো পৃথিবীতে আসে?
আসুন আজ জানি আলোর জন্মের গল্প…
আগে একটি সিম্পল ম্যাথ দিই আপনাকে – সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে কতটুকু সময় লাগে? খুব সহজ!
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার আলোর গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার ভাগ করুন। উত্তর এসে যাবে – ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড। এখন আমি যদি বলি, উত্তরটা আংশিক সত্য?
সূর্য থেকে আলো আসতে সর্বসাকুল্যে ১০,০০০ থেকে প্রায় ১,৭০,০০০ বছর সময় নেয়! কি, আঁতকে উঠলেন? এটাই সত্যি। কেন সেটা লেখা পুরোটা পড়েই জানতে পারবেন।
নিউক্লিয়ার ফিউশন
সহজ ভাষায় কয়েকটি ছোট পরমাণু মিলে একটি বড় পরমাণু তৈরি হওয়া। শুনতে খুব সাধারণ বিক্রিয়া মনে হলেও, এর ফলাফল ব্যাপক। হাইড্রোজেন বোমার নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? এটম বোমার থেকেও অনেক গুণ শক্তিশালী। হাইড্রোজেন বোমার যে অমানুষিক ভয়াবহতা, সেটা এই নিউক্লিয়ার ফিউশনেরই ফলাফল! আর অদ্ভুত হলেও সত্য – সূর্যের থেকে প্রাপ্ত আলো এই নিউক্লিয়ার ফিউশনেরই সন্তান!
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, নিউক্লিয়ার ফিউশনে এমন কী হয় যার কারণে আলোক কণা/ফোটন তৈরি হয়? এর মূল সমীকরণ অনেক জটিল। তার চেয়ে আসুন সিম্পল ফিজিক্স নিয়ে এগোই – পরমাণু কী দিয়ে তৈরি? নিউক্লিয়াস এবং কক্ষপথ! নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন এবং নিউট্রন, আর কক্ষপথে ইলেকট্রন। যেহেতু “নিউক্লিয়ার” ফিউশন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, ইলেকট্রনকে পরবর্তী আলোচনায় অগ্রাহ্য করা হলো।
সূর্যের মোট ভরের প্রায় ৭৫ ভাগেই হাইড্রোজেন। সূর্যে ক্রমাগত এই হাইড্রোজেন পরমাণু গুলো পরস্পরের সাথে ফিউশন (মানে, যুক্ত হওয়া) করে অপেক্ষাকৃত বড় পরমাণু হিলিয়াম তৈরি করে। তাহলে আলো কিংবা ফোটনটা আসে কোথা থেকে? আইসোটোপ সম্পর্কে আশা করি সবারই ধারণা আছে। আইসোটোপ হচ্ছে একই পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা যেখানে নিউক্লিয়াসের প্রোটন সংখ্যা সমান থাকে, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন।
হাইড্রোজনের আইসোটোপ তিনটি –
প্রোটিয়াম-যেখানে নিউট্রন সংখ্যা শূন্য
ডিউটেরিয়াম-নিউট্রন সংখ্যা ১
ট্রিটিয়াম-নিউট্রন সংখ্যা ২
যাই হোক, সূর্যের নিউক্লিয়ার ফিউশনের আরেকটা নাম আছে। প্রোটন-প্রোটন চেইন রিয়েকশন, সহজ ভাষায় দুইটি ভিন্ন পরমাণুর প্রোটনগুলো মিলে যায়। আর নতুন ভরের একটি পরমাণু তৈরি করে। তবে এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। প্রোটন সাধারণত positively charged বা ধনাত্মক আধানযুক্ত থাকে। নরমাল ফিজিক্স অনুযায়ী দুইটি প্রোটন তাহলে পরস্পরকে বিকর্ষণ করার কথা। সেখানে ফিউশন হওয়ার প্রশ্নই আসে না! এটাই সত্যি।
কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে, আমাদের সৌরজগতের মোট ভরের ৯৯.৮ ভাগই সূর্যের দখলে। এই ব্যাপক ভরের কারণে সূর্যের মহাকর্ষ বল (Gravity) অবিশ্বাস্যকর। পৃথিবী থেকে প্রায় ২৪ গুণ বেশি। এই মারাত্মক মহাকর্ষ বলই দুটো বিকর্ষণকারী প্রোটনকে ফিউশন করতে বা যুক্ত হতে বাধ্য করে!
এখন যদি একটি প্রোটিয়াম ও একটি ডিউটেরিয়াম ফিউশন করে তাহলে কী হবে? আমরা আগেই জেনেছি, ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন থাকে। ধরুন (জাস্ট মনে করুন), এই প্রোটন ও নিউট্রনকে একসাথে ধরে রাখতে ডিউটেরিয়ামের মোট শক্তির প্রয়োজন হয় ৩ জুল (Joule, শক্তির একক)।
যেহেতু প্রোটিয়ামে কোন নিউট্রন থাকে না, শুধু প্রোটন থাকে, তাই প্রোটিয়ামের কোন শক্তির প্রয়োজন নেই নিউট্রন এবং প্রোটনকে একসাথে ধরে রাখার জন্য। তাই শক্তির পরিমাণ এখানে শূন্য! তাহলে প্রোটিয়াম এবং ডিউটেরিয়ামের মোট শক্তির পরিমাণ ৩ জুল। এখন এই দুইটি পরমাণু মিলে গেলে তৈরি হয় হিলিয়াম-৩। যার নিউক্লিয়াসে থাকে দুইটি প্রোটন এবং একটি নিউট্রন।
হিলিয়াম-৩ এ প্রোটনের পরিমাণ ডিউটেরিয়ামের তুলনায় বেড়ে যাওয়াতে নিউক্লিয়াসের আভ্যন্তরীণ শক্তির পরিমাণ হ্রাস পাবে (নিউক্লিয়ার ফিজিক্স অনুযায়ী)। ধরে নেই, সেটার পরিমাণ ২ জুল। কিন্তু ফিউশন হওয়ার পূর্বে মোট শক্তি ছিল ৩ জুল। তাহলে বাকি এক জুল ফিউশন হওয়ার পর কোথায় গেল? এইতো পয়েন্টে এসেছেন! এই বাকি থেকে যাওয়া এক জুলই শক্তির রূপান্তরের সূত্র অনুযায়ী রেডিয়েশনের মাধ্যমে আলোককণা হিসেবে বেরিয়ে আসে –
ঠিক এই প্রক্রিয়াটাই ক্রমাগত চলছে সূর্যের একদম ভেতরের স্তরে, যাকে বলা হয় Core Of Sun. যা দখল করে আছে সূর্যের মোট ব্যাসার্ধের এক চতুর্থাংশ। আর এই স্তরের তাপমাত্রাটাও অভাবনীয় -১৫ মিলিয়ন কেলভিন!
কিন্তু তৈরি হওয়ার পরে আলোক কণা চাইলেই সরাসরি এসে পড়তে পারে না সূর্যের উপরিভাগে। তাকে পার করে আসতে হয় আরো দুটি স্তর রেডিয়েটিভ জোন এবং কনভেক্টিভ (সঞ্চালন) জোন। এই রেডিয়েটিভ জোনে আলোক কণা ক্রমাগত বাধাপ্রাপ্ত হয়, শোষিত হয়, আবার পুনরায় বিক্ষিপ্ত হয়। তারপর সঞ্চালন জোনের মাধ্যমে সূর্যের উপরিভাগ, অর্থাৎ ফটোস্ফিয়ারে আসে। তৈরি হওয়ার পর থেকে এই ফটোস্ফিয়ারে আসার পুরো সময়টা অভাবনীয়, যা আমি পূর্বেই মেনশন করেছিলাম। দশ হাজার থেকে প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার বছর। রেডিয়েটিভ জোনে ক্রমাগত বাধাপ্রাপ্ত হওয়াই এর প্রধান কারণ।
যাই হোক, ফটোস্ফিয়ার থেকে আরো দুইটা পাতলা স্তর ক্রোমোস্ফিয়ার এবং করোনা পেরিয়ে, এরপরে শূন্যের মধ্যে দিয়ে আলো তার স্বাভাবিক বেগে পৃথিবীতে এসে পড়ে মাত্র ৮ মিনিটের কাছাকাছি সময়ে। তার মানে যে আলো আপনাকে দিনে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে তা হাজার হাজার বছর পুরোনো। হাজারো বাধা পেরিয়ে সে ছুটে এসেছে নরকের উত্তাপ থেকে!
আলো নিয়ে ৩টি মজার ফ্যাক্ট-
১) চাঁদ থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় নেয় মাত্র ১ সেকেন্ড।
২) কম্পিউটার কিংবা মোবাইল থেকে আসতে আলো সময় নেয় ন্যানো সেকেন্ডেরও কম সময়।
৩) সূর্যের পর আমাদের সবচেয়ে নিকটতম নক্ষত্র আলফা সেন্টোরি, যার দূরত্ব পৃথিবী থেকে ৪.৩৭ আলোকবর্ষ। তাই সেখান থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় নেয় প্রায় সাড়ে ৪ বছর, তার মানে টেলিস্কোপ কিংবা খালি চোখে আপনি তাকে যখন দেখছেন, ধরে নিতে হবে আপনি সাড়ে চার বছর আগের আলফা সেন্টোরিকে দেখছেন। ঠিক একই ভাবে ওখান থেকে যদি কোন এলিয়েন পৃথিবীকে শক্তিশালী কোনো টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে তাহলে তারাও সাড়ে চার বছর আগের পৃথিবীকে দেখবে।
সবাইকে ধন্যবাদ!
তথ্যসূত্র:
সূর্যের আলো, ফোটন, আলফা-সেন্টোরি
বিজ্ঞানযাত্রা বাংলাদেশের আধুনিক মনোবিকাশের তথা বিজ্ঞানমনোস্কতা সমাজ বিনির্মানে এক বিশাল ভূমিকা রাখবে এ কথা অনাসয়ে বলা যায়।
আপনাদের বিশাল উদ্যোগী কর্মোদ্দীপনার প্রতি একরাশ শুভেচ্ছা থাকল।