১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর। ১৭ বছরের একজন তরুণের জীবনে অভিভূত হবার মত একটা ঘটনা ঘটল। তার হাতে এসে পৌছুল খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের চিঠি। যিনি খুবই জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির অ্যাস্ট্রনমির অধ্যাপক এবং গবেষক। তিনি সেই সতের বছরের তরুণকে চিঠির মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সামনের শনিবার উইকএন্ডে কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে তাঁর সাথে সময় কাঁটানোর জন্য। ঘটনার আকস্মিকতায় তরুণ মুগ্ধ, অভিভূত। মাত্র কিছুদিন আগেই সে কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য আবেদন করেছে। সেই আবেদনপত্রটি দেখে প্রফেসরের মনে হয়েছে এই তরুণের সাথে কথা বলা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
চিত্রঃ নীল টাইসনকে লেখা চিঠি
সেই কাঙ্খিত শনিবারটি তরুণের জীবনের সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রফেসর সেই তরুণকে কর্নেল ইউনিভার্সিটির সমস্ত ল্যাব ঘুরে দেখান, উপহার হিসেবে তরুণকে দেন তাঁর লিখা জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞানের বই—The Cosmic Connection, যার কভারে লিখা ছিল “To Neil Tyson, a future astronomer”.
চিত্রঃ The Cosmic Connection বইয়ের উপরে নীল টাইসনকে উদ্দেশ্য করে লেখা প্রফেসরের উক্তি
সেইদিনের সতের বছরের তরুণ আজকের জনপ্রিয় বিজ্ঞানী, গবেষক, সঞ্চালক Neil deGrasse Tyson সেই শনিবারের ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে—
“সেই দিন শেষে তিনি আমাকে ড্রাইভ করে বাস স্টেশন পর্যন্ত পৌছে দিলেন। সেসময় খুব ঝড়ো হাওয়ার সাথে প্রচন্ড তুষারপাত হচ্ছিল। তিনি একটি ছোট্ট কাগজে তাঁর ফোন নাম্বার এবং তাঁর বাসার ফোন নাম্বার লিখলেন, এবং কাগজটি আমাকে দিয়ে বললেন—বাসটি যদি কোন কারণে না পৌছায় আমাকে ফোন করো, আজকের রাতটি আমার বাসায় আমার পরিবারের সাথে কাটাও।
আমি সবসময়ই জানতাম এবং মনে করতাম বড় হয়ে অবশ্যই আমি একজন বিজ্ঞানী হব। কিন্তু সেদিনের সেই বিকেলবেলা কার্ল সেগানের সাথে সময় পার করে আমি বুঝতে পারলাম আমি কীরকম মানুষ হতে চাই। আমি ছাড়াও অসংখ্য মানুষকে তিনি অনুপ্রণিত করেছেন পড়ালেখা, গবেষণা, বিজ্ঞান বিষয়ে। শিখিয়েছেন কীভাবে সত্যিকার অর্থে শিখাতে হয়। বিজ্ঞান হচ্ছে সহযোগিতামূলক একটি উদ্যোগ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে হয় সবার মাঝে।“
যদিও নীল টাইসন কর্নেল ইউনিভার্সিটির পরিবর্তে হার্ভার্ড ইউনিভাসিটিতে অ্যাস্ট্রোনমিতে গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করেন, তিনি সবসময় বলেন এটি আমার দায়িত্ব আমার শিক্ষার্থীদের যেকোন আবেদনে সাড়া দেওয়া, যেরকমটি আমি পেয়েছি কার্ল সেগানের কাছ থেকে।
চিত্রঃ টাইসন এবং সেগান
কার্ল এডওয়ার্ড সেগান, শুধু একটি নাম নয়, তিনি সকল বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য একজন অনুপ্রেরণা। আমাদের আজকের গল্প কার্ল সেগানকে নিয়ে, যিনি সত্যিকার অর্থেই একজন মহাজাগতিক যাত্রী।
চিত্রঃ কার্ল এডওয়ার্ড সেগান, একজন মহাজাগতিক যাত্রী
কার্ল সেগান সারাজীবন অনুসন্ধান করে গেছেন এই মহাবিশ্বে স্থান ও সময়ের মাঝে আমাদের অবস্থান। কীভাবে আমরা আজকের অবস্থায় আসলাম, ভবিষ্যত পৃথিবীতে আমাদের অবস্থা কেমন হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা কীভাবে চিন্তা করত। এই সমগ্র মহাবিশ্বে পৃথিবীই কি একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে?? নাকি অন্য কোন সভ্যতা মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে বসে আমাদের মতই চিন্তা করছে?? তিনি সবাইকে বোঝাতে চেয়েছেন সমগ্র মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের অবস্থান কতই না নগণ্য। আমাদের বসবাসের জায়গাটি কতটুকু ক্ষীণ। আমরা কীভাবে আমাদের প্রাণের সঞ্চারক এই ছোট পৃথিবীকে নিজেদের অজান্তে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছি। তিনি আমাদের সতর্ক করেছেন বারবার। পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন নিজেদের ভিতর সহনশীলতা। পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী করার জন্য আমরা নিজেরাই কি বহুলাংশে দায়ী নই??
কার্ল সেগানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৯ নভেম্বর ব্রুকলিনের একটা ছোট্ট পরিবারে। তাঁর বাবা স্যামুয়েল সেগান ছিলেন একজন গার্মেন্টস্ কর্মী, যিনি তৎকালীন রাশিয়া থেকে অভিবাসী হয়ে নিউয়র্কে এসেছিলেন। মা রাচেল মলি গ্রুবার ছিলেন সাধারণ একজন গৃহিণী। কার্ল সেগানের একজন বোন ছিল, যার নাম ছিল ক্যারোল। বাবা মা কেউই বিজ্ঞানের সাথে তেমন সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কার্ল সেগানের বিজ্ঞানপ্রেমী হয়ে ওঠার পিছনে তাদের যথেষ্ট অবদান ছিল। কার্ল সেগানের ভাষায়—
কিন্তু আমি যদি পিছনে ফিরে তাকাই তাহলে এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আমি আমার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস স্কুল শিক্ষকদের কাছ থেকে নয়, এমন কি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কাছেও নয়, বরং শিখেছি আমার পিতামাতার কাছ থেকে, যাঁরা বলতে গেলে বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।
ছোটবেলা থেকেই কার্ল সেগান প্রশ্ন করতে পছন্দ করতেন। ছোটবেলায় তার প্রশ্ন করার প্রিয় বিষয় ছিল ডায়নোসর এবং আকাশের তারা। এইসব বিষয়ে ছেলের কৌতুহল বুঝতে পেরে তার মা তাকে একটা লাইব্রেরী কার্ড এনে দেয়, তখন সেগানের বয়স মাত্র পাঁচ। মাত্র পাঁচ বছর বয়সের ছোট্ট সেগান একা একা হেঁটে হেঁটে লাইব্রেরীতে গিয়ে লাইব্রেরীয়ানকে বলেছিল স্টারের উপর একটা বই দিতে। বই হাতে নিয়ে বাসায় এসে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো বইটিতে ‘স্টার’ সম্পর্কে কিছু লিখা নেই, পৃষ্ঠা জুড়ে হলিউডের নায়ক নায়িকাদের ছবি!! সেগান বইটি লাইব্রেরীয়ানকে ফেরত দিয়ে সত্যিকার স্টারের উপর লিখা বই চাইলো। তখন মাত্র লাইব্রেরীয়ান বুঝতে পারলো পাঁচ বছরের এই ছোট্ট বাচ্চা আকাশের স্টারদের নিয়ে লিখা বই চাচ্ছে, হলিউডের কোন স্টার নয়!
প্রাণের উদ্ভব এবং এর বিবর্তন নিয়ে কার্ল সেগানের বেশ ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল। যখন সেগানের বয়স ছয় কি সাত তখন সে তার এক ঘনিষ্ট বন্ধুকে সাথে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল নিউয়র্ক সিটির আমেরিকান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব নেচারাল হিস্টরিতে। সেখানে প্রকৃতিতে বিলুপ্ত হওয়া বিভিন্ন প্রাণি ছাড়াও ছিল প্রাচীন পৃথিবীতে আঘাত করা বিভিন্ন গ্রহাণুপুঞ্জের প্রস্তরখণ্ড। সেই যাদুঘরে পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবর্তনগুলো খুব সুন্দরভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল। সেখানে প্রাচীন পৃথিবীতে ডায়নোসররা কীভাবে বসবাস করত তার একটা চমৎকার ধারণা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এই যাদুঘর কার্ল সেগানের বিজ্ঞান দর্শনে খুব বড় একটা প্রভাব ফেলেছিল। এমনকি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও তার প্রথম থিসিসের বিষয় ছিল প্রাচীন পৃথিবীর তেজষ্ক্রিয় পরিবেশে কীভাবে প্রাণের প্রথম উপাদান অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়েছিল তার উপর।
ছোটবেলায় সেগানের খেলার প্রধান উপাদান ছিল কেমিস্ট্রি সেট। এটি সেগানের বাবা মা তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। সায়েন্স ফিকশন ছিলো মজার একটি অনুসঙ্গ। ছোটবেলায় কার্ল এইচ. জি. ওয়েসের সায়েন্স ফিকশন পড়ার সময় চিন্তা করতো মঙ্গল গ্রহে যদি প্রাণের উদ্ভব হয় তাহলে সেটি কেমন হবে। ১৯৪৭ সালে ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ নামে একটি সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা কার্লের চোখে পড়ল। হার্ডকোর সায়েন্স ফিকশন বলতে যা বোঝায়, অর্থ্যাৎ যে সায়েন্স ফিকশনগুলো বিজ্ঞানের নিয়ম একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে—এমন ধারণা সে মূলত এই পত্রিকা থেকেই পেয়েছিল। মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে কার্লের আগ্রহ সম্ভবত সেখান থেকেই রূপ পেয়েছিল।
কার্ল সেগানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিউজার্সির রাহওয়ে হাইস্কুল থেকে। অবশ্য তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করেছিলেন ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো থেকে। গ্রাজুয়েশনের পর পোস্টগ্রাজুয়েশনও করলেন পদার্থবিজ্ঞানের উপর। পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়লেও তার প্রথম থিসিস পেপার ছিল প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশের উপর। ১৯৬০ সালে পি এইচ ডি ডিগ্রী সম্পূর্ণ করার পর কার্ল সেগান গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করার পর তার শিক্ষকতার মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি। হার্ভার্ডের কিছু প্রফেসর তার বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে বলা হয়, তিনি মেধার জোরে না, বরং জনপ্রিয়তার জোরে টিকে আছেন! তাই তাকে আর হার্ভার্ডে প্রয়োজন নেই!
হার্ভার্ড থেকে ফিরে এসে কার্ল সেগান যোগ দেন কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে ১৯৭১ সালে ফুল প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে তিনি গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি নিয়ে গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। দীর্ঘ নয় বছর কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে সেন্টার ফর রেডিওফিজিক্স অ্যান্ড স্পেস রিসার্চে অ্যাসোসিয়েট ডিরেকটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সালের পর থেকে নাসা যে কয়টি স্পেস প্রোগ্রাম পরিচালনা করেছে তার প্রায় সবকয়টিতেই সেগান ছিলেন পরামর্শক হিসেবে। কার্ল সেগানই প্রথম ব্যক্তি যিনি পৃথিবীর বাইরের কোন বুদ্ধিমত্তার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করা যায়, তার একটি প্রকল্প নিয়ে চিন্তা করেন। ভয়েজার স্পেসক্রাফটের সাথে যে বার্তাটি সোনার প্লেটে খোদাই করা ছিল, সেটি ছিল মানবজাতির প্রথম বার্তা, যেটি মহাজাগতিক কোন প্রাণীর উদ্দেশে পাঠান হয়েছিল।
যেন অন্য কোন মহাজাগতিক প্রাণী এই বার্তাটি দেখে পৃথিবীর প্রানি এবং মানুষ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারে। সোনার প্লেটে যে বার্তাটি ছিল তাতে আঁকা ছিল হাইড্রোজেন পরমাণু, ইলেকট্রনের স্পিন। গ্যালাক্সিতে আমাদের সূর্যের অবস্থান, এবং আমাদের সৌরজগৎ, যেখানে আমাদের একমাত্র বাসস্থান- পৃথিবী অবস্থিত। সৌরজগৎের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো নাসার রোবোটিক স্পেসক্রাফ্ট প্রজেক্টেও কার্ল সেগান একজন পরামর্শক হিসেবে ছিলেন। নিউমোনিয়ার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কার্ল সেগান কর্নেল ইউনিভার্সিটির ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং বিষয়ে পড়িয়ে গেছেন।
চিত্রঃ ভয়েজার স্পেসক্রাফটে পাঠানো বুদ্ধিমান প্রাণীদের উদ্দেশ্যে মানবজাতির বার্তা
কার্ল সেগানের একসময়কার ছাত্র ডেভিড মরিসন সেগানকে বর্ণনা করেছেন একজন আইডিয়াবাজ মানুষ হিসেবে। তার বিভিন্ন বিষয়ে আইডিয়াগুলো শুধুমাত্র চমকপ্রদ তাই নয়, অন্যান্য ছাত্র এবং তার অধীনস্ত বিজ্ঞানীদেরও মোটিভেট করতে এগুলো কাজে লাগতো।
কসমোলজিতে সেগানের মূল গবেষণার বিষয় ছিল শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও এর প্রকৃতি নির্ণয় সম্পর্কে। ১৯৬০ সালের দিকে সৌরজগৎের গ্রহগুলোর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও পরিবেশ সম্পর্কে কারো কোন ধারণা ছিল না। কার্ল সেগান ধারণা করেছিলেন শুক্র গ্রহ খুবই শুষ্ক এবং এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বেশী। পরে সেগান শুক্র গ্রহ থেকে নির্গত রশ্মি পর্যবেক্ষণ করে এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস নির্ণয় করেন। পরে আমরা জানতে পারি শুক্রের অতিরিক্ত তাপমাত্রা শুধুমাত্র সূর্যের কাছাকাছি থাকার কারণে নয় বরং এর পিছনে গ্রীন হাউস ইফেক্ট একটা বড় কারণ। এরপরে আমরা সতর্ক হই পৃথিবীর গ্রীন হাউস ইফেক্ট কমানোর জন্য। আমরা দেখতে পারি সাময়িক সুবিধা আদায়ের জন্য আমরা আমাদের পৃথিবীকেও আমরা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
সেগানই প্রথম ব্যক্তি যিনি শনির উপগ্রহ টাইটানে তরলের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপায় পানির উপস্থিতি থাকতে পারে। পরে ‘গ্যালিলিও’ স্পেসক্রাফটের সাহায্যে এর প্রমাণ মিলে। টাইটানে তরলের উপস্থিতির কারণ ছিল সেখানে প্রচুর পরিমাণে জৈব তরলের বৃষ্টিপাত। সেগান বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডল এবং মঙ্গলে ঋতুর পরিবর্তন নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। সেগান মঙ্গলের পৃষ্ঠের রঙের পরিবর্তন কারণ হিসেবে বর্ণনা করেন এর উপর বয়ে যাওয়া বালুর ঝড়কে। এর আগে মঙ্গলের ঋতু পরিবর্তনকে এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হত। সেগান এবং তার কর্নেল ভার্সিটির কলিগ এডুইন আর্নেস্ট সালপিটার বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং এর বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে জৈব পদার্থের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। বৃহস্পতির অত্যন্ত ঘন বায়ুমণ্ডল মূলত এই জৈবপদার্থের উপস্থিতির কারণেই সৃষ্ট।
বহুমুখী গবেষণামূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকলেও সেগান মূলত বিখ্যাত ছিলেন পৃথিবীর বাইরের প্রাণ সৃষ্টির উপর গবেষণা জনিত কারণে এবং প্রাচীন পৃথিবীর পরিবেশে বৈদ্যুতিক সংযোগের ফলে প্রাণের প্রধান উপাদান অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরী সংক্রান্ত পরীক্ষার জন্য।
চিত্রঃ কার্ল সেগান ও তার সহধর্মিনী অ্যান ড্রুইয়ান
সেগান আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আমাদের যুক্তিগুলোকে অবারিত করেছেন। একই সাথে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন মানবজাতির সীমাবদ্ধতার কথা। তার আইডিয়াগুলো আমাদের মহাবিশ্বকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। তিনি মানবজাতির পৃথিবীতে টিকে থাকার গুরূত্ব সম্পর্কে যতটুকু বলেছেন ততটুকুই তুলনা করেছেন মহাবিশ্বের বিশালতার সাথে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতার। তার সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ কাজ, তের পর্বের প্রবল জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক টেলিভিশন সিরিজ Cosmos: A Personal Voyage তৈরী করেছেন তার যোগ্য সহধর্মিনী অ্যান ড্রুইয়ানকে সাথে নিয়ে। কসমস তৈরী করার সময় ছিল না কোন ইন্টারনেট, ছিল না বিজ্ঞানকে বোঝানোর জন্য প্রয়োজনীয় অ্যানিমেশন অথবা প্রযুক্তিগত সহয়তা। তবু কসমসে কার্ল সেগানের মোহনীয় কণ্ঠ তার বিজ্ঞানকে সহজভাবে বোঝানোর ভঙ্গি আজও আমাদের শিহরিত করে, প্রজন্ম নিয়ে আমাদের স্বপ্নগুলোকে প্রতিফলিত করে।
চিত্রঃ কার্ল সেগানের সহধর্মিনী অ্যান ড্রুইয়ান
কসমসে বিজ্ঞানের বিস্তৃত বিষয় সম্পর্কে সাবলীল আলোচনার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মাঝে মাঝে অতীতকে স্মরণ করা হয়েছে, কখনো ভবিষ্যৎের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব থেকে শুরু করে মহাবিশ্বে আমাদের স্থান ও কালগত অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি ১৯৮০ সালে প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয় এবং পৃথিবী প্রায় ৬০ টি দেশের প্রায় ৫০ কোটি মানুষের কাছে এটির সম্প্রচার করা হয়।
চিত্রঃ কসমস সম্প্রচারকালীন সময়ে কার্ল সেগান
পৃথিবীর বাইরের প্রাণ এবং এর অস্তিত্ব নিয়ে কার্ল সেগানের সীমাহীন আগ্রহ ছিল। বিজ্ঞান সমাজের কাছে তিনি রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে বাইরের বুদ্ধিমান প্রাণির সন্ধানের গুরূত্ব তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি ১৯৭৪ সালের ১৬ই নভেম্বর পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান প্রাণিদের উদ্দেশ্যে পাঠানো ফ্রাঙ্ক ড্রেক কতৃক লিখিত মেসেজ লিখতে সাহায্য করেছিলেন।
সেগান দি প্লানেটারি সোসাইটির সহপ্রতিষ্ঠাতা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানুষদের সংঘ যারা মহাকাশ সম্পর্কে আগ্রহী। তিনি জনপ্রিয় বিজ্ঞান সম্পর্কে বেশ কিছু বই লিখেছিলেন, যার একটি হচ্ছে Pale Blue Dot: A Vision of the Human Future in Space, এই বইটি ছিল Cosmos এর সিক্যুয়েল। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েৎ ইউনিয়নে ভিতরকার স্নায়ু যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন The Demon-Haunted World।
সেগান ছিলেন একজন মুক্তমনা। কসমসে ব্যবহৃত তার কিছু উক্তি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তার একটি হচ্ছে “Extraordinary claims require extraordinary evidence.” সেগান অদ্ভুৎ উপায়ে চিন্তা করতে পারতেন। বই সম্পর্কে তার চিন্তা ছিল এরকম, যা আজও অভিভূত করে—
“What an astonishing thing a book is. Its’ a flat object from a tree, with flexible parts on which are imprinted lot of funny squiggles. But one glance at it and you’re inside the mind of another person. Maybe somebody dead for thousands of years. Across the millennia an author is speaking clearly and silently inside your head, directly to you. Writing is perhaps the greatest of human inventions. Binding together people who never knew each other. Citizens of distance epochs. Books breaks the shackles of time. A book is proof that humans are capable of working magic. And this room(library) is filled with magics.”
সেগান বিজ্ঞানকে সাধারণ জনগনের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। তিনি আমাদের জানাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন আমাদের উৎস সম্পর্কে, জানতে চেয়েছিলেন আমাদের মানবজাতির ভবিষ্যৎ। একদিকে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় আমাদের কতটা সতর্ক হতে হবে, অন্যদিক দিয়ে তিনি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন- এই বিশাল মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের জাতিগত বিভেদ, দলীয় ক্ষুদ্রতা কতটা সংকীর্ণ। খুব অল্প সময়ের জন্য তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন। মাত্র ৬২ বছর বয়সে, ১৯৯৬ সালের ২০ ডিসেম্বর সিয়াটলের ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে নিওমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।