(প্রবন্ধটি বিজ্ঞানযাত্রা ম্যাগাজিনের দ্বিতীয় ভলিউমে প্রকাশিত হয়েছে)
সজলঃ দোস্ত, রবিনরে দেখি না বহুদিন। কই গেছে কইতে পারবি?
কাজলঃ না রে দোস্ত, জানিনা।
এমন অবস্থায় কাকতালীয়ভাবে রবিনের আগমন। তখনই সজল বলে উঠলো, “আরে রবিন, তোর কথাই তো কইতেছিলাম আমরা। বহুত দিন বাঁচবি তুই!”
নিজেকে প্রশ্ন করুন তো, আদৌ কি কোন যুক্তিযুক্ত সম্ভাবনা আছে আপনাদের আলোচনায় কাকতালীয়ভাবে কারো আগমনের কারণে তার আয়ু বৃদ্ধির? না, এবং একদমই না। শূন্যের কাছাকাছি সম্ভাবনাও নেই এমন কিছু ঘটার! এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটা কুসংস্কার। যেমনটা জ্যোতিষশাস্ত্র!গ্রহ নক্ষত্রের গতির সাথে যেমন আপনার ভবিষ্যতের কোনো সম্পর্ক নেই, তেমনি আপনাদের কারো আলোচনায় থাকা ব্যক্তির কাকতালীয় আগমনেও তার বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়ার প্রভাব নেই। এমন কিছু কুসংস্কারের সাথে আজ পরিচয় করিয়ে দিবো আপনাদের। আর পরামর্শ দিবো যথাসম্ভব এগুলোকে নর্দমায় ফেলতে!
১) খেতে খেতে মৃদু কাশিঃ একইরকম একটা কুসংস্কার হলো, কিছু খেতে খেতে গলায় বেঁধে যাওয়া বা কাশি হওয়া। এই ঘটনায় বলা হয়, “কেউ হয়তো আমার নাম করছে বা গালি দিচ্ছে তাই এমনটি হলো!”। এইসব কথার না আছে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা না আছে কোনো বিন্দুমাত্র শক্ত যুক্তি। শক্ত যুক্তিই বা বলছি কেন? বরং, কোনরকম যুক্তিই নেই এমন হাস্যকর দাবির। আপনার হোঁচট খাওয়া,গলায় কাটা বিঁধে যাওয়া বা কাশি হওয়ার সাথে কারো কথার কিভাবে সম্পর্ক থাকে? অথচ, আমরা প্রতিনিয়ত এমন কথা বলে থাকি ও শুনি!
২) দরজায় বাধা পাওয়াঃ ঘর থেকে বের হয়েছেন কোন জরুরি কাজে। অসাবধানতা বশত হোঁচট খেলেন ঠিক ঘরের দরজাতে! আপনার বাবা-মা বা দাদী বাধা দিয়েছেন,”বাবা, আজ যেতে হবে না। হয়তো বিপদ আছে কোনো!” এমন সমস্যার মুখোমুখি আমরা হয়তো প্রায়ই হই। এখানে একটা যুক্তি দেওয়া যেতে পারে, “দরজায় হোঁচট খেলেন, আরেকটু সাবধান হোন।” কিন্তু, আপনার ভবিষ্যৎ বিপদ বা ভালো কিছু অর্জনের পিছনে দরজায় হোঁচট কোনো প্রভাব রাখবে কিভাবে? আপনি কেন এমন তুচ্ছ ও স্বাভাবিক ঘটনার কারণে যাত্রা-ই বন্ধ রাখবেন? এটা আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত কুসংস্কার, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই!
৩) মরা গাছে কাক ডাকাঃ অনেকে মনে করেন, মরা গাছে কাক ডাকলে নাকি কারো মৃত্যু সংবাদ আসে। এ ধারণায় বিশ্বাসীরা সঙ্গে সঙ্গে কাক তাড়াতে নেমে পড়েন। কিন্তু কাক তাড়িয়ে মৃত্যুর সংবাদকে কতটা দূরে সরিয়ে রাখা যায়? এমন পাগলামির কি কোনো যুক্তি আছে? আর আমাদের সমাজে কাক ও কুকুরকে সবসময়ই ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়। এটাকে নিছক মস্তিষ্কবিকৃতি ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?
৪) শেষ রাতে শিয়াল ডাকাঃ কাক ডাকা দুঃসংবাদের হলেও শেষ রাতের শিয়ালের ডাককে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়! কারণ শেষ রাতে শিয়ালের ডাক ফসলের ভাল দাম পাওয়ার সংকেত। যারা এমনটাই বিশ্বাসী, তারা বেশির ভাগই কুকুরের ডাককে খারাপ সংকেত ভাবলেও শেয়ালের ডাককে শুভ সংকেত ভেবে থাকেন। শেষ রাতে শেয়ালের ডাক শুনে ফসলের ভালো দাম পাওয়ার স্বপ্নে আশার জাল বুনতে থাকেন। হয়তো কখনো কখনো সকালে উঠে মুরগীর ঘরের বিক্ষিপ্ত অবস্থা দেখে সেই ভোরের শেয়ালকেই গালি দিতে থাকেন! গ্রামের কৃষক সম্প্রদায়ের ভিতরে এই কুসংস্কারের ভক্তি খুব ভয়ংকরভাবে পরিলক্ষিত হয়।
৫) গভীর রাতে পেঁচার ডাকঃ পেঁচা তো রাতেই ডাকবে! তার পরও গভীর রাতে পেঁচার ডাককে অনেকে ঝগড়া-বিবাদের সংকেত মনে করেন। পেঁচা রাতে মাটি কামড়ে নাকি ঝগড়া বাড়িয়ে দিতে চায়! বাস্তবে ইঁদুর শিকারের জন্য রাতে পেঁচা মাটিতে নেমে আসে, কোনো মানুষের ভিতর ঝগড়া বাঁধাতে না।
৬) যাত্রাপথে খালি কলস দেখাঃ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় যদি সামনে খালি কলস পড়ে বা কেউ খালি কলস নিয়ে গেলে অনেকে যাত্রা বন্ধ রাখেন। কারণ যাত্রাপথের খালি কলস কাজে ব্যর্থ হওয়ার লক্ষণ। আবার অনেকে এটাকে অভাবের আগাম সংকেত হিসেবে ধরে নেন। যেমনটা দরজায় হোঁচট খাওয়া! বাস্তবে এটার সাথে বিপদের কোনো সম্পর্ক নেই।
৭) পিছন থেকে ডাকাঃ যখন আমি কুসংস্কারের তালিকা তৈরি করছি, তখন হঠাৎ আম্মুর ভিতরে এই কুসংস্কারের ছোঁয়া দেখে অনেক অবাক হয়েছিলাম। কেউ যাত্রা পথে পিছন থেকে ডাকলে নাকি বিপদ হয়! ভাবুন, আপনার পিছন থেকে কোনো গাড়ি এসে ধাক্কা দিবে, এমন অবস্থায় কেউ পিছন থেকে আপনাকে ডেকে সতর্ক করে দিলো, সেটা কি বিপদে ফেললো নাকি উদ্ধার করলো? ভিত্তিহীন ও চরম অবৈজ্ঞানিক ধারণার মধ্যে এটা একটা। ভেবে অবাক হতে হয়, আমি প্রচুর মানুষের ভিতরে এই ধরনের অন্ধ বিশ্বাস দেখেছি!
৮) হাতের তালু চুলকানোঃ ডান হাতের তালু চুলকালে টাকা আসবে। আর বাম হাতের তালু চুলকালে বিপদ আসবে! এমন হাস্যকর বিশ্বাস অনেকের ভিতরে অবস্থান করছে। যখন এটি লিখছি, তখন আমার হাতের তালু চুলকাচ্ছিলো, বাম হাতের তালু। বারবার চুলকানো দেখে এক ভাই বলেছিলো, বিপদ হতে পারে আমার! তৎক্ষণাৎ চমৎকার কিছু যুক্তি ছাড়া আমার কাছে কোনো বিপদ আসেনি! আর, বিপদ আসার সম্ভাবনাও দেখিনা এই স্বাভাবিক চুলকানির জন্য! মানুষের সহ যে কোন প্রাণীর কোনো ভালো কিছু অর্জন বা বিপদের জন্য কোনো চুলকানি, কলস, হোঁচট নয়, বরং তার কর্ম দায়ী।
চমৎকার এবং অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে একটি পোস্ট। কুসংস্কার এবং ভুল বিশ্বাস নিয়ে আরো পোস্ট লিখবেন আশা করি। মানুষ সচেতন হবে এতে করে। ধন্যবাদ।