রেল চলে ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম। এইসব ছড়া শুনে শুনেই বড় হয়ে গেলাম। রেলগাড়িতে আমার অমোঘ আকর্ষণ। রেল নিয়ে কত যে ঘাঁটাঘাঁটি করি, তা বলে বোঝাতে পারবো না। ট্রেনে চেপে অনেক বেড়াতে গেছি এমন নয়, ছোট বেলায় ম্যাপ দেখে দেখে বুঝতাম ভূ-ভারতে কোথায় কোথায় লাইন পাতা, কোন লাইন দিয়ে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ ঢুকে যাওয়া যায়, কোন লাইনটা পাকিস্তানে চলে যায়। অবাক লাগতো। টেরা বেঁকা লাইনগুলো কেমন দেশ হতে দেশান্তরে ঢুকে গেছে। সেসব রেলের ম্যাপ আজকাল অনেক বদলেও গেছে। এখন রেলের ম্যাপ দেখতে বই লাগেই না, গুগল ম্যাপ আছে। এই তো সেদিন রেলপথ ধরে এগিয়ে গেলাম। শিয়ালদহ থেকে গেদে হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে দর্শনা থেকে এগিয়ে হার্ডিংজ ব্রীজের নিচে গঙ্গাকে থুরি পদ্মাকে রেখে, ঈশ্বরদী হয়ে বামে রাজশাহী, দিনাজপুর, হিলি, পার্বতীপুরকে ফেলে রেখে, ডান দিকে ঘুরে কত যায়গা ছেড়ে দিয়ে এসে, ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে- আবার ভুল, যমুনা পেরিয়ে ঢাকা দিয়ে সোজা চট্টগ্রাম চলে গেলাম, আবার খুলনা থেকে যশোর এসে বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশ চষে দেশে ফিরে এলাম। রেলের সাথে সাথে বাংলাদেশের প্রতিও অনেক আবেগ বাঁচিয়ে রেখেছি বুকের ভেতর।
আমার এবারের লেখাটি এই রেল ও রেল জীবনকে নিয়ে। যথেষ্ট দীর্ঘ লেখা হওয়াতে ধারাবাহিক ৩ ধাপে এই লেখা দেবো এখানে। আমি মূলত ৩টি ভাগকে এই ভাবে রাখছিঃ
১) ভারতের মেট্রো রেল সম্পর্কিত তথ্য ও রেলে ব্যবহৃত প্রযুক্তি সম্পর্কিত আলোচনা।
২)ভারতীয় রেলের পরিসেবা ও পরিসংখ্যান।
৩) ভারত ও বাংলাদেশে ব্যবহৃত এল এইচ বি কোচ সহ অন্যান্য কোচ ও তাদের প্রযুক্তি নিয়ে নানা তথ্য উপস্থাপন।
প্রথম ভাগ
আধুনিক মেট্রো রেল
কদিন আগেই ভারতীয় রেলের ১৬৩ তম জন্মদিবস ছিল। মানে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান সবার রেলেরই অনেক বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো নিরন্তর পরিসেবায় ব্যস্ত। যুগ বদলেছে, সময় পেরিয়েছে, বেড়েছে রেলের গতি, পথ, পরিসেবা সব কিছুই। কিন্তু এসব বাড়াতে যা লেগেছে তা হল বিজ্ঞানের অবদান। রেল মাত্রই বিজ্ঞান, তার চাকার পরিমাপ থেকে, গতি থেকে, চালিকা শক্তি থেকে ভেতরে পাখা, এসি এমনকি রেলের থেমে যাওয়াটাও বিজ্ঞান। আর এই বিজ্ঞানের সব থেকে সুসন্তান হল প্রযুক্তি, যা মানব জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ বদলে দিয়েছে। রেলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। প্রতিদিন নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ ও ব্যবহার চলছে। চলছে আধুনিক ট্রেন বানানোর প্রয়োগ। জাপান, চীনে চলছে মনোরেল (ভারতের মুম্বাইয়েও খুব ছোট্ট রুটে চালু হয়েছে সম্প্রতি)। পৃথিবীর বড় বড় শহর গুলোতে চলছে মেট্রো রেল। মাটির তলা দিয়ে উন্নত প্রযুক্তিতে রেল চলেছে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সব থেকে জটিল সিস্টেম হল লন্ডনে। ওরা মেট্রোকে ‘টিউব রেল’ বলে। ওখানে মাটির নীচে পর পর তিনটি স্তরে ‘টিউব রেল’ চলে। সব থেকে বড় আর ২৪ ঘণ্টার পরিসেবা দেওয়া মেট্রো জাল নিউ ইয়র্ক শহরের ‘সাবওয়ে রেল’।
কিন্তু এসব ধনী দেশের আধুনিক প্রযুক্তির কচকচানিতে আটকে থাকলে তো আমাদের মত গরীব দেশগুলির চলে না। আমাদের মেধা আছে, লোকবল আছে, কিন্তু টাকা নাই। কাজেই মেধা আর পরিশ্রমকে বেশি কাজে লাগিয়ে আমাদের মত করে কিছু প্রযুক্তি বানানো দরকার। সেটার বোধহয় অন্যতম নিদর্শন কলকাতা মেট্রো রেলওয়ে। ভারতীয় প্রযুক্তিতে, স্বল্প খরচে মাটির ২৫ ফুট নিচ দিয়ে নন এসি রেক চালিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া গেছিলো সেই ‘৮৪ সালে। এর পর ভারতে দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, জয়পুর এ মেট্রো চলতে শুরু করে এই হালে। হায়দ্রাবাদ, কোচি, লখনৌ, নাগপুর, পাটনাতে চালু হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। এগুলো সব আধুনিক প্রযুক্তির। খুব সম্প্রতি দিল্লী মেট্রোতে চালক বিহীন মেট্রোর ট্রায়াল রানও সফল ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখানে টানেল কম, ব্রিজ বা এলিভেটেড করিডর বেশি, সব গাড়ি এসি। কিন্তু কলকাতা এখনো টানেলের মধ্যে গরম বাতাস বাইরে বের করে, কুলারের ঠাণ্ডা বাতাস বইয়ে দিয়ে নন এসি মেট্রো চালিয়ে যাচ্ছে। হালে ১৪ খানা এসি মেট্রো চললেও বাকি নন এসিদের দিয়ে প্রতিদিন ৬.৫ লাখ মানুষকে মাত্র ৫০ মিনিটে ২৪ টি স্টেশন ছুঁয়ে প্রায় ৩০ কিমি রাস্তা পার করে দিচ্ছে শুধু মাত্র বিজ্ঞানের জোরে, অনেক কম খরচে। খবর পেয়েছি এবারে মেট্রো রেলের তালিকাতে আসতে চলেছে পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল শহর, যা তার জ্যামের কারণে বিখ্যাত, ঢাকা। খুব সম্প্রতি মাননীয়া শেখ হাসিনা, প্রধান মন্ত্রী, বাংলাদেশ এই প্রকল্প রূপায়ণের কাজের শুভারম্ভ করেছেন।
দিল্লীতে কাজের নিরিখে সব থেকে কম সময়ে সব থেকে বেশি রাস্তার মেট্রো জাল ছড়ানো গেছে। বর্তমানে দিল্লীতে প্রায় ২২০ কিমি মেট্রো রেল পথ রয়েছে। লাল, হলুদ, বেগুনী, নীল, সবুজ ও কমলা এই ৬ টি করিডর বর্তমান এবং একদম সদ্য চালু হল গোলাপী লাইন। হ্যাঁ, গোলাপী এখন ট্রেনেই। কলকাতা এই উপমহাদেশের প্রথম মেট্রো রেল পেলেও বর্তমানে একটিই করিডর চালু আছে। কিন্তু সঙ্গে আরো ৫ টি নতুন করিডরের কাজ চলছে যা কলকাতা শহর কে তার মেট্রোপলিটন এলাকাতেও যুক্ত করবে এই রেল যোগাযোগে। এর মধ্যে অন্যতম হল ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো, যার অধিকাংশ অংশের কাজ শেষ। এই প্রকল্পটির নাম করলাম কারণ এই প্রকল্পের সব থেকে জটিল অংশ হল গঙ্গার তলদেশেরও নীচ দিয়ে ১ কিলোমিটারের বেশি পথের মেট্রো টানেল চলে যাবে কলকাতা শহর থেকে হাওড়া শহর পর্যন্ত। প্রকল্পটি অনেকটা ইউরো টানেলের মত। কলকাতা ও বেঙ্গালুরু মেট্রোতে পাওয়ার দেওয়া হয় ৭৫০ ভোল্টের ডিসি বিদ্যুতের মাধ্যমে। এই বিদ্যুৎ সংবাহিত করা হয় মেট্রো ট্রাকের রেলের পাশে থাকা আরেকটি রেলের দ্বারা। এই রেল কে থার্ড রেল বা তৃতীয় রেল বলা হয়ে থাকে। দিল্লী, মুম্বাই চেন্নাই, জয়পুর মেট্রোর ক্ষেত্রে ২৫০০০ ভোল্টের এসি ওভার হেড লাইন ব্যবহৃত হয়। কলকাতা শহরের সমস্ত মেট্রো জাল সম্পন্ন হলে মোট ১২০ কিমির মেট্রো রেল পথ হবে মোট ৬ টি লাইনে। কলকাতা মেট্রো সব গুলিই ৮ কোচের। দৈর্ঘ্য ১৫৬ মিটার। দুটি স্টেশনের মধ্যের গড় দুরত্ব ১.১৪ কিলোমিটার। সব থেকে বেশি দূরত্বের স্টেশন দুটি ২.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। নতুন চলা এসি মেট্রো রেকের ক্ষমতা হল ৫৯৪৯ অশ্ব শক্তি সম্পন্ন। যাত্রী বহন ক্ষমতা ৩২০০ এর কাছাকাছি।
এই মেট্রো সিস্টেমে এক বিশেষ প্রযুক্তি ও ব্যবহার করা হয় দুর্ঘটনা এড়াতে। এই প্রযুক্তির নাম TRAIN PROTECTION AND WARNING SYSTEM. এই প্রযুক্তিতে লাইনের সঙ্গে সিগনাল পোস্টের কিছু আগে এক ধরনের ইলেক্ট্রনিক সার্কিট রাখা থাকে। যেখানে সেন্সর ও উপস্থিত থাকে। কোন ভাবে ট্রেন লাল সিগনাল ভাঙলে বা ওভার স্পীডে থাকলে ট্রেনে অটোমেটিক ব্রেকিং সিস্টেমে চলে যায়। এছাড়াও স্বয়ংক্রিয় সিগনাল ব্যবস্থাতো আছেই। যা নিয়ে পরে আলোচনা করেছি।
জয়পুর শহরে মেট্রো করিডর। তৃস্তরীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা।
রাস্তার ওপরেই রয়েছে মেট্রো স্টেশন। নীচে নির্বিঘ্নে ট্রাফিক চলাচল। বেঙ্গালুরু।
রেলওয়েতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি
যাই হোক, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় রেল থেকে একটা ট্রেনিং নিয়েছিলাম। ইলেক্ট্রনিক্স ও কমিউনিকেশন বিভাগের ছাত্র হওয়াতে আমরা রেলের সিগনাল ও টেলিকমিউনিকেশন বিভাগে ট্রেনিং নেওয়া শুরু করি। ২০১০ সালের জুন মাসের ট্রেনিং। এখন ২০১৬, সুতরাং সব কিছু একদম বিস্তারিত মনে নেই। যতটা মনে আছে গল্পের মত করে বলছি।
রোদে গরমের ঐ ট্রেনিং এ কোনোদিন ক্লান্ত হইনি। শিখেছিলাম কীভাবে রুট রিলে ইন্টারলকিং (RRI) কেবিনে বসেই বিশাল বোর্ড থেকেই বোঝা যায় লাইন খালি আছে কিনা। RRI কেবিন হলো সেই বিশেষ একটি ঘর যেখান থেকে সিগনালিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ট্রেন ট্রাফিক সামলানো হয়ে থাকে।
RRI CABIN, নৈহাটি, পশ্চিমবঙ্গ।
একটি স্টেশনের ইন্টারলকিং পদ্ধতিতে, ইন্টারলকিং কেবিন থেকে কন্ট্রোল প্যানেলের নকশার সাহায্যেই গোটা স্টেশনের ট্রেন ট্রাফিক কন্ট্রোল হয়। গোটা স্টেশন চত্বর এবং স্টেশনের আউটার এরিয়ার রেলপথ, তার শাখা লাইন, লুপ লাইন, ক্রসিং পয়েন্ট, সিগনাল এই সমস্ত কিছুর অবস্থান নক্সা হিসেবে একটি বোর্ডের লে-আউটে থাকে। স্টেশন আউটার এরিয়া মানে স্টেশনের বাইরের যতদূর পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ ওই স্টেশনের হাতে থাকে, সেই এলাকা। এবারে ওই বোর্ডের নকশাতে ক্রসিং পয়েন্ট, সিগনাল পয়েন্টের সঙ্গে সুইচ থাকে। এই সুইচের সাহায্যেই ইলেক্ট্রো-মেকানিকাল পদ্ধতিতে রুট ও সিগনাল বানানো হয়।
পূর্বে ব্যবহৃত এনালগ কন্ট্রোল প্যানেল ও ইলেক্ট্রোমেকানিকাল সুইচ। বর্তমানে ডিজিটাল বোর্ডে কম্পিউটার কন্ট্রোলড।
এটি কিন্তু জিপিএস সিস্টেম নয়। সম্পূর্ন ইলেক্ট্রনিক আর মেক্যানিকাল সিস্টেমের সমন্বয়ে তৈরি। রেলওয়ে সিগনালিং ব্যবস্থাতে ট্রেনের সঠিক অবস্থান নির্ণয় খুব জরুরি। জিপিএস এর দ্বারা প্রত্যেক মুহূর্তের নিখুঁত অবস্থান নির্ণয় সম্ভব না। তাছাড়া ভারতে জিপিএস সিস্টেমে গুগল ম্যাপকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্তই দেখানোর অনুমতি আছে। এটা বোঝা যায় যদি স্যাটেলাইট ভিউতে ভারতের একটি শহরকে দেখি, দেখব একটা নির্দিষ্ট সময় পর আর জুম করা যাবেনা। কিন্তু ইউরোপিয়ান দেশ, আমেরিকা, কানাডা এগুলোর ক্ষেত্রে একদম রাস্তাতেও নেমে যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে মানুষ গাড়ি, দোকান সব আলাদা করে দেখা যায়। মানুষের মুখ আর গাড়ির নম্বর শুধু আবছা করা থাকে। বাকি একদম হাই ডেফিনিশন ছবি।
রুট বানানোর ক্ষেত্রে এই ট্রেনের অবস্থান নির্ণয় করতে হয় ও সেই অনুসারে সিগনাল দিতে হয়। ট্রেনের অবস্থান নির্ণয়ের অনেক রকম ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতি আছে তার মধ্যে অন্যতম দুটি হল ট্র্যাক সার্কিট ও এক্সেল কাউন্টার।
১) ট্র্যাক সার্কিটঃ
রেলের ট্র্যাক তৈরি হয় সমান্তরাল ভাবে বসানো দুটি রেল লাইনের দ্বারা। এই ট্র্যাককে কিছু দূর অন্তর অন্তর আলাদা সেকশনে ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রতিটি সেকশন কে এক একটি ব্লক বলা হয়ে থাকে। প্রতিটি পাশাপাশি ব্লককে বৈদ্যুতিক ভাবে আলাদা করা থাকে ওদের মাঝে ইনসুলেটর প্রতিস্থাপন করে, যাতে ব্লক কে তড়িতাহিত করা হলেও পাশের ব্লকে সেই বিদ্যুৎ সংবাহিত হতে না পারে। এমন হলে সিগনালিং ব্যবস্থা কাজ না করতে পারে। এখন একটি ব্লকের এক প্রান্তের দুটি রেল কে আলাদা আলাদা আধানে আহিত করা হয় বৈদ্যুতিক তার সংযোগে একটি ব্যাটারির দ্বারা। আর ওই তারের অপর দুই প্রান্ত একটি রিলের(এক ধরনের ইলেক্ট্রিক্যাল সুইচ) সলিনয়েডে জড়ানো থাকে। লাইনে ট্রেন না থাকলে এই সার্কিটটি সম্পূর্ণ হয় ফলে ওই রিলে ENERGIZED হয় এবং ব্লকের পূর্ববর্তী সিগনালকে এবং অপারেটরের কাছে মানে ওই কন্ট্রোল রুমে ‘লাইন ক্লিয়ার’ বার্তা পাঠায়। এক্ষেত্রে সেমি অটোমেটিক সিগনালিং সিস্টেমের বার্তা অবুযায়ী ট্রেনকে ধীরে ধীরে পরবর্তী ব্লক পর্যন্ত এগোনোর অনুমতি দেয় অথবা অপারেটর পরিস্থিতি ও সামনের ট্রেনের অবস্থান বুঝে ম্যানুয়ালি সবুজ সংকেত দেন ও নির্দিষ্ট গতি বজায় রাখার অনুমতি দেন।
ট্র্যাক সার্কিট লাইন ক্লিয়ার অবস্থা।
কিন্তু এক্ষেত্রে যদি ওই ব্লকের ট্রেন চলে আসে, তাহলে ট্রেনের ধাতু নির্মিত চাকা দুই রেলের মাঝে শান্টের মত কাজ করে ফলে সার্কিটটি শর্ট হয়ে যায় এবং রিলে ‘line occupied’ হওয়ার বার্তা দেয়। ফলে স্টপ সিগনাল বা লাল সিগনাল তৈরি হয়। এই ব্যাবস্থায় আরেকটি সাবধানতা অবলম্বন করা হয় সেটা হল একটি ব্লকের পার্শবর্তী ব্লকে দুটি রেলকে ঠিক বিপরীত মেরুর আধানে আহিত করা হয়(অর্থাৎ আগের ব্লকে যদি ডান দিকের রেলে ঋনাত্মক আধানে আহিতকরণ করা হয়ে থাকে তাহলে পরের ব্লকের বাম দিকের রেলকে ওই মেরুর আধান দেওয়া হয়।) কোনো রকম বিদ্যুতঘটিত অসুবিধা এড়ানোর জন্য। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে লাইনে পা দিলে আমাদের শক লাগে না কেন। তার কারণ, খুব কম ভোল্ট কারেন্ট পাঠানো হয়। পরিমাণ ১.৫ ভোল্ট থেকে ১২ ভোল্ট।
ট্র্যাক সার্কিট লাইন অক্যুপায়েড অবস্থা।
২) এক্সেল কাউন্টারঃ
এবারে এক্সেল কাউন্টার বা চক্র গণক। এই এক্সেল কাউন্টারে একটি সেন্সর থাকে যা ট্র্যাকের দুটি রেলের সঙ্গে লাগানো থাকে। এটি চাকার সংখ্যা গণনা করে। ট্র্যাকের নির্দিষ্ট স্থানে দুটি রেলের সঙ্গে এই কাউন্টার লাগানো হয় আবার নির্দিষ্ট দূর পরে ওই আগের কাউন্টারের সঙ্গে সম্পর্কিত আরো দুটি কাউন্টার দুই রেলের সঙ্গে বসানো হয়। এবারে প্রথম কাউন্টারে যখন চাকা গোণা শেষ করে অর্থাৎ গোটা ট্রেনের সব চাকা গোণার পর ও অপেক্ষা করতে থাকে। এবং যতগুলো চাকা গুণেছে সেই নম্বরটা মনে রেখে দেয়। কারণ এই কাউন্টার তো মানুষ না যে ও বুঝতে পারবে ট্রেন চলে গেছে গোটাটা। এমন তো হতে পারে কিছু দূর এগিয়ে কোনো কারণে থেমে গেল। সেই জন্য এই কাউন্টার তার সঙ্গে সম্পর্কিত পরবর্তী কাউন্টারে গণনা করে মনে রাখা সংখ্যার সঙ্গে নিজের মনে রাখা সংখ্যা মিলিয়ে নেয়। যদি মিলে যায় তাহলে কাউন্টার ‘লাইন ক্লিয়ার’ বার্তা পাঠিয়ে সিগনাল তৈরি করে আগের পদ্ধতিতে।
ট্র্যাক সার্কিট অপেক্ষা এই পদ্ধতি বেশি ব্যাবহার করা হয় কারণ এক্ষেত্রে রেলগুলি ইনসুলেটর প্রতিস্থাপিত না হয়ে নিরবিচ্ছিন্ন ও ঝালাই বিহীন ইস্পাতের হয়ে থাকে। এই কাউন্টার জলে নষ্ট হয় না, সুতরাং লাইনে জল জমলেও সিগনালিং ব্যবস্থা ঠিক থাকে। যদিও দুটি পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এক্সেল কাউন্টার বা হুইল কাউন্টার। কলকাতা।
জলে ডোবা ট্র্যাকেও চালু আছে ট্রেন। মুম্বাই
সিগনাল সিস্টেম
এবারে স্টেশন এলাকাতে সিগনাল বানানোর জন্য ট্রেনের অবস্থান নির্ণয়ের পদ্ধতি জানার পর সিগনাল সিস্টেম সম্পর্কে জেনে নেব। একটি সিগনাল বারে মূলত ৪টি সিগনাল লাইট থাকে।
১) একদম নীচে লাল, যার মানে ডেঞ্জার। থেমে যাও।
২) তার ওপরেরটা হলুদ বা সতর্কতা অবলম্বন করো এবং সামনের সিগনাল লাল আছে তা জানানো। সুতরাং গতি থাকলে কমাও এবং এগোও।
৩) তার ওপরে থাকে সবুজ মানে চালু হও অথবা ফুল স্পীডে বেরিয়ে যাও।
৪) তার ওপরে থাকে আরেকটা হলুদ। এক্ষেত্রে দুই নম্বর হলুদ আর এই ৪ নম্বর হলুদ একসঙ্গে জ্বলে। এর মানে ধীরে এগোও, সতর্ক থাকো, সামনের সিগনাল হলুদ রয়েছে।
সাধারণত ডবল লাইনের ক্ষেত্রে স্টেশনে দুটি প্লাটফর্ম থাকে। সেক্ষেত্রে কোন প্লাটফর্ম বদলানোর দরকার পড়ে না। কিন্তু একটি লাইনের ক্ষেত্রে স্টেশনে যখন দুটি প্লাটফর্ম থাকে বা ডবল লাইনের ক্ষেত্রে বা আরো বেশি লাইনের ক্ষেত্রে লাইনের সংখ্যার থেকে বেশি প্লাটফর্ম থাকলে তখন লাইন বদলানোর দরকার পড়তে পারে। লাইন বদলানোর জন্য সিগনাল পোলে সিগনাল আলোগুলির সজ্জা একটু অন্য রকম। লাইন বদলানোর পয়েন্টর আগে যে সিগনাল পোল থাকে তাতে এই ৪ টী লাইট ঠিক ওপরে দুদিকে দুটো বা একদিকে একটা বা চারিদিকে বেশ কয়েকটা, একটু বেঁকিয়ে মানে একটু কোণ করে, ভাগ হয়ে যায় পোলের ওপরের আলোর সজ্জাটা। নিচের ছবি দেখলে ধারণাটি পরিস্কার হবে। ওই ভাগগুলিতে রুট সিগনাল দেখানো হয়। ভাগের সংযোগে একটি ও প্রতিটি ভাগে আরো ৪ টি করে লাইট থাকে। এগুলো সব হলুদ আলো।
১) এবারে রুট সিগনালের দুটো হলুদ আলো শুধু থাকলে আর কোন রুট নির্দেশক আলোগুলি না জ্বললে চালক বুঝবে নির্দিষ্ট গতিতে এগোতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে যে সামনের সিগনাল মানে প্লাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার সিগনাল হলুদ আছে জেনে।
২) ঐ দুটো হলুদের সঙ্গে যদি ওপরের ভাগ হয়ে যাওয়া দন্ডের কোন একটা দিকের হলুদ আলোগুলো জ্বলে তাহলে চালক বুঝবে আগের মত করেই। শুধু অতিরিক্ত যা বুঝবে তা হল যেদিকের হলুদ আলো জ্বলছে সেই দিকের লুপ বা শাখা লাইন তার জন্য বানানো আছে।
৩) শুধু হলুদের ক্ষেত্রে ড্রাইভার বার্তা পাবে তাকে প্লাটফর্মে থামতে হবে, তা যদি লুপ বা শাখা লাইনের দিকে ভাগ হওয়ার ইঙ্গিত থাকে তবে লুপ/শাখা লাইনের প্লাটফর্মে থামতে হবে।
৪) আর সবুজ মানে গতি না কমিয়ে, কোন লুপ লাইনে না গিয়ে, প্লাটফর্মে না থেমে সোজা মেইন লাইন ধরে বেরিয়ে যাবে। সবুজের সঙ্গে ট্র্যাক নির্দেশক আলো জ্বলা মানে শুধু সেই দিকে এগোবে গাড়ি।
প্রসঙ্গত বলে রাখি ট্রেনে কিন্তু কোনো স্টীয়ারিং থাকে না যে চালক সেই দিকের লাইনে গাড়িকে নিয়ে যাবে। লাইন স্টেশন থেকেই বানানো থাকে। গাড়ি একাই সেদিকে চলে যাবে। চালকের কাজ শুধু সিগনাল অনুযায়ী গতির নিয়ন্ত্রণ।
মেইন লাইন, লুপ লাইন, শাখা লাইন
মেইন লাইন হলো ট্রেন যে লাইনে চলছে সেই সোজা লাইনটি। লুপ লাইন হলো মেইন লাইন থেকে ভাগ হয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট দূরে গিয়ে আবার মেইন লাইনের সঙ্গে মিশে গিয়ে যে লাইন একটি লুপ তৈরি করে সেটি। মেইন লাইনের প্লাটফর্ম ছাড়া অন্য প্লাটফর্মে যেতে হলে মেইন লাইন থেকে লুপ লাইনে যেতে হয়। শাখা লাইন হল জংশন স্টেশনে অন্য একটি রুটের জন্য যে লাইন তৈরি হয় বা এসে মেইন লাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
লাইন ক্রস ওভার কার্য্যপ্রণালী
এবারে আগের দিনে অধিকাংশ সিগনাল ম্যানুয়াল ছিল। এমনকি লাইনের ক্রসিং মানে দুটি লাইনের জংশন গুলিতে লাইন নির্মাণ করা হতো মানুষের পেশীর জোরে। অর্থাৎ মেক্যানিক্যাল লিভারের সাহায্যে।
পূর্বতন ম্যানুয়াল ক্রস ওভার পয়েন্ট।
বর্তমানে রুট রিলে ইন্টারলকিং বা RRI কেবিন থেকে বোর্ডে রেলের অবস্থান, সিগনালের অবস্থা ও কর্ডলেস ফোনের ব্যবহারের মাধ্যমে লোকো পাইলটের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে, কেবিন থেকে থেকে এই কাজ হয়।
লাইন ক্রস ওভার পয়েন্টের বিভিন্ন অংশের নাম সহ ছবি
এবারে ট্রেনের লাইন পরিবর্তন করার কার্য্যপ্রণালী দেখাতে নীচে একটি ছবি দিচ্ছি ও বিশ্লেষণ করছি।
ওপরের ছবি অনুসারে পয়েন্ট ব্লেড বাম দিকের স্টক রেলের সঙ্গে লাগানো আছে। ফলে ট্রেনের ইঞ্জিনের প্রথম AXLE এর বাম দিকের চাকার ঘাট বা FLANGE পয়েন্টে এসে পয়েন্ট ব্লেডের গা ঘষে HEEL অংশ থেকে ডান দিকে ভাগ হওয়া লাইনে উঠে যাবে। ফলে AXLE এর বাম দিকের চাকার FLANGE ও ডান দিকের স্টক রেলের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
এবারে বাম চাকা যখন ক্রসিং এর V আকৃতির অংশের কাছে আসবে তখন হিসেবে মত চাকা ওই V রেলের ওপর উঠে যেতে পারে। তাতে লাইন বদলানোর প্রক্রিয়া সফল হবে না। এই অসুবিধা দূর করার জন্য তখন ডান দিকে ভাগ হয়ে যাওয়া রেলের ডান স্টক রেলের সঙ্গে আরেকটা চেক রেল বা গার্ড রেল লাগানো হয়। এই চেক রেলের জন্য যে চাপ তৈরি হয় AXLE এর ডান দিকের চাকার FLANGE ওপর তার ফলে চাকা ডান স্টক রেল থেকে সরে আসতে পারে না। যলে বাম দিকের চাকা V রেলে উঠে না গিয়ে ডান দিকে বাঁক নেওয়ার জন্য রেলে উঠে আসে। পয়েন্ট ব্লেড উল্টো দিকে সরানো হলে ট্রেন ডান দিকের লাইনে চলে যাবে। এভাবে সফল লাইন বদলানোর কাজটি সম্পন্ন হয়।
প্রসঙ্গত বলা উচিৎ, ওই পয়েন্টের পয়েন্ট ব্লেড এর ডান দিক বাম দিকের স্টক রেলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য যে একটি স্ট্রেচার থাকে তার নড়া চড়া নির্ভির করে ওর সঙ্গে যুক্ত ইলেক্ট্রো-মেকানিকাল লিভারের ওপর। RRI কেবিন থেকে ইলেক্ট্রনিক সিগনাল এলে পয়েন্টের পাশে থাকা মোটর কাজ করে এবং লিভার দিয়ে পয়েন্ট ব্লেডকে সরায়।
এখন যদি কোনো কারণে পয়েন্ট ব্লেড ও যেদিকে সেটা সরবে সেই দিকের স্টক রেলের মাঝে কোন বাধা তৈরি হলো। যেমন ধরা যাক, কোনোভাবে একটা পাথর বা বড় লোহার টুকরো ঢুকে গেছে সেক্ষেত্রে স্ট্রেচার কয়েবার লাইন সেট করার চেষ্টা করে থেমে যাবে। ফলে কাজটি অসফল থাকবে। এখন এই অসফলতার বার্তা কেবিনে পৌঁছানো দরকার। তার জন্য পয়েন্টের দুপাশেই দুটি সুইচ থাকে। লাইন বদলানো সফল বা বিফল যাই হোক পয়েন্ট ব্লেডের সঙ্গে লাগানো থাকে একটা লিভার। যেপাশে স্টক রেলের সঙ্গে পয়েন্ট ব্লেড অবস্থান করবে সেই পাশের সুইচ কে চাপ দিয়ে ধরে থাকবে ওই লিভার। যার ফলে কেবিনে বার্তা চলে যাবে সফলতার বা বিফলতার।
এক্ষেত্রে লাইন MAKE (লাইন সেট + রুট লক) সফল ভাবে সম্পন্ন করা গেলে তবেই সামনের সিগনাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হবে এবং এগোনোর অনুমতি দেবে, নচেৎ নয়।
তবে সাবধানতা এই নিতে হবে যে লাইন পার করবার সময় আমরা যেন ওই খাঁজের মাঝে পা না দিয়ে ফেলি। এতে পুরোনো বাংলা সিনেমার নায়কের মত মরব না কিন্তু স্ট্রেচারের ওই কয়েকবার নড়াচড়াতে কিছু হাড় ভেঙে যাবে তো বটেই।
RRI Vs PI
অনেক রকম ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে। ইন্টারলকিং সিস্টেমের কাজ হল এই লাইন তৈরি, সিগনাল বানানো ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। ছোট স্টেশন, যেখানে কম ক্রস পয়েন্ট আছে সেখানে অল্প দেখভাল করার মাধ্যমেই সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই সব যায়গায় প্যানেল ইন্টারলকিং বা PI পদ্ধতি তে কাজ করা হয়। কিন্তু যেখানে অনেক পয়েন্ট, অনেক সিগনাল, অনেক লাইন ওভারল্যাপিং সেখানে RRI পদ্ধতিতে কাজ হয়। যেমন শিয়ালদহ। ৪+২ = ৬ টি মোট লাইন এসে ২০ টি প্লাটফর্মে ভাগ হয়ে যাচ্ছে সেখানে গুচ্ছের লাইন ওভার ল্যাপ। প্রচুর জটিলতা।
RRI পদ্ধতিতে কন্ট্রোল প্যানেলে শুধু লাইন মেক করার সুইচ চাপলেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সেট এবং লক হয়ে সিগনাল প্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু PI এর ক্ষেত্রে সমস্ত লাইন ক্রস ওভারে পয়েণ্টের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হয় আলাদা আলদা করে তার পর লাইন সেট রুট লক করা হলে সিগনাল প্রস্তুত করা যায়।
এরপর একটু বলবো – বর্তমানে দ্রুত ও বেশি ট্রেন চালানোর জন্য দরকার সম্পূর্ন অটোমেটিক সিগনাল ব্যবস্থা।
অটোমেটিক সিগনাল ব্যবস্থাঃ
এবারে বেশি ভীড়, ট্রেনের অনেক ফ্রিকুয়েন্সি, গতি, সময় সব নিয়ন্ত্রণ সাধারণ সেমি অটোমেটিক সিস্টেমে সম্ভব না। সম্ভব হলেও ব্যবস্থাতে বিপুল সমস্যার উদ্ভব হয়। যেমন সেমি অটোমেটিক সিস্টেমে লাইন অক্যুপেন্সির খবর পাওয়া যাবে আগের উল্লেখ করা সিগন্যাল সিস্টেমগুলো থেকে, লোকো পাইলটের সঙ্গে কথা বলে, আগের স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারপর সুবিধা মত সিগন্যাল তৈরি করে একটা একটা করে ট্রেন বের করতে হবে। এতগুলো প্রসেস করে, কনফার্মেশন করে গাড়ি বের করানো খুব সময় সাপেক্ষ। ফলে কম দূরত্বের যেমন মাত্র ২-৩ কিমি পর পর পর এক একটি স্টেশন থাকে সাধারণত শহরতলীর রেলে এই ব্যবস্থা ছাড়া ট্রেন চালানো খুব ঝামেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। শহরতলীর এই রেল নিয়ে পরের পর্যায়ে আলোচনা করবো।
এখন বিপদ এড়াতে একটি স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকলে তার পরের ট্রেন আগের স্টেশনে অপেক্ষা করবে যতক্ষণ না পর্যন্ত সামনের ট্রেন স্টেশন না ছাড়ে। কিন্তু অটোমেটিক ব্যবস্থাতে এই অপেক্ষা করতে হয় না। আগের ট্রেন বর্তমানে যে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে থাকুক, পরের ট্রেন একটি নির্দিষ্ট সিগনাল পর্যন্ত চলে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যায়। ঘটনাটা অনেকটা এরকম। একটি স্টেশনে একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে যখন তার ছেড়ে যাওয়ার জন্য ঐ স্টেশনের একটা স্টার্টার সিগনাল থাকে। যেটাকে স্টেশনের সিগনাল অপারেটর নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ কোনো ট্রেন কোনো স্টেশনে দাঁড়াবে কিনা মানে স্টপেজ আছে কিনা, থাকলে কোন প্লাটফর্মে জায়গা খালি আছে এগুলো জানা যায় স্টেশন থেকেই। যদিও সাবার্বান রেলের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বড় স্টেশন বা জংশন স্টেশনেই শুধু প্লাটফর্ম বদলাতে হতে পারে, নাহলে নির্দিষ্ট যে ডেডিকেটেড লাইন যা আগের বড় বা জংশনে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে সেই লাইন ধরেই এগোতে হয়। তাই স্টেশনে ঢোকা এবং বেরোনোটা অটোমেটিক ব্যবস্থাতেও ম্যানুয়াল করা হয়, সতর্কতার সার্থে। না করলে অবশ্য অটোমেটিক ব্যবস্থা নিজেই নিরন্তর পরিসেবা দিয়ে যাবে।
এবারে অটোমেটিক সিগনাল ব্যবস্থার মূল কার্য্যপ্রণালী হল স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার জন্য অপারেটরের কাছে থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে গেলে এগোতে থাকবে এবং গতি বাড়াতে থাকবে নির্দিষ্ট সীমা (প্রদত্ত) পর্যন্ত।
১) ট্রেনের ইঞ্জিন বা প্রথম বগি যেই সিগনাল দণ্ড ছেড়ে দেবে সেই সঙ্গে সঙ্গে সেন্সরের পাঠানো বার্তাতে ওই সিগনাল সবুজ থেকে লাল হয়ে যাবে। এই সিগনাল দন্ডকে আমি ১ম সিগনাল বলছি। ওই সিগনাল থেকে পরবর্তী স্টেশনে ঢোকার সিগনালের আগে পর্যন্ত লাইন হল অটোমেটিক ব্লক।
২) এই অটোমেটিক ব্লকে ঢুকে ট্রেন যখন পরের সিগনাল (২য়) সবুজ পেল এবং সেটা পেরোল এবং সেটাও সবুজ থেকে লাল হয়ে গেল।
৩) এরপর ৩য় সবুজ সিগনাল পেরোতে সেটি যখন সবুজ থেকে লাল হল তখন ১ম সিগনাল হলুদ হয়ে গেল। কিন্তু ২য় টি লালই থাকল।
৪) ট্রেন যখন আরো একটি (৪র্থ) সিগনাল পেরোল তখন ১ম সিগনালে দুটো হলুদ আলো জ্বলবে আর ২য় তে একটা হলুদ হবে।
৫) এরপর পঞ্চমটি পেরোলে, ১ম সিগনাল সবুজ হয়ে যাবে, ২য় সিগনাল ডবল হলুদ ও ৩য় শুধু হলুদ হবে।
অর্থাৎ এই ব্যবস্থাতে চলমান দুটি ট্রেনের মধ্যে মাঝে মাত্র দুটি সিগনালের ব্যবধানই যথেষ্ট। ২-৩ কিমি দূরের দুটো স্টেশনে থেমে থাকার দরকার নেই। এই পদ্ধতিতে গতি, সময় দুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অনেক বেশি সংখ্যক ট্রেন কম সময়ে সঠিক ও নিরাপদ ভাবে এগিয়ে যেতে পারছে।
পরবর্তীতে বাকী দুই অংশ নিয়ে আলোচনা করব। এখন এই পর্যন্তই।