কিছুদিন আগেই বিজ্ঞান যাত্রায় প্রকাশিত হল রেল আলোচনার প্রথম ভাগ ” রেলের গপ্পো -১ “। ভারত, বাংলাদেশের রেল জীবন নিয়ে একটি পরিষ্কার ছবি তুলে ধরার জন্যই আমার এই লেখা। প্রতিদিনের সাধারণ জীবনযাত্রাতে আমরা রেল কে খুব আপন করে নিয়েছি। বিজ্ঞানের এই অসামান্য দান আমাদের দেশ গুলির আর্থ-সামাজিক জীবনকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য আলাদা দাবি রেখে চলেছে বহু বছর ধরে। আগের লেখাতে ভারতীয় রেলের সিগনালিং ব্যবস্থাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রযুক্তি ও মেট্রো রেল নিয়ে লিখেছি। আজকের লেখা মূলত তথ্য ভিত্তিক। মূলত ভারতীয় রেলের বিভিন্ন পরিসেবা ও পরিসংখ্যান দিয়ে সাজিয়েছি এই লেখা। তবে প্রযুক্তির বিশ্লেষণও থাকছে অল্প করে হলেও শেষের দিকে। এই লেখাতে থাকছে আরো একটি ছোট কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশ – তা হলো বাংলাদেশে ব্যবহৃত বিজি লোকো সম্পর্কিত সামান্য কিছু তথ্য সমূহ। পরের ধাপের লেখা থাকবে মূলত বাংলাদেশ কেন্দ্রিক।
রেলের গপ্পো- ২
পরিসেবা ও পরিসংখ্যান
ভারতের প্রচুর জনসংখ্যা, একথা সর্বজনজ্ঞাত। গঙ্গাকে যেমন ভারতের জীবনদায়ী নদী বলা হয় তেমন রেলপথ ভারতের জীবনরেখা। মোট রেলপথের পরিমাপ ১১৫০০০ কি.মি. যার মধ্যে রুট দৈর্ঘ্য ৬৫০০০ কি.মি.। যা পৃথিবীর দীর্ঘ পরিসেবা প্রদানকারী রেলপথ যুক্ত দেশ গুলির মধ্যে চতুর্থ; আমেরিকা, চীন, ও রাশিয়ার পরেই। এর মধ্যে প্রায় ৪০% পথ বৈদ্যুতিক পরিসেবা যুক্ত। বাকী পথে ডিজেল চালিত ইঞ্জিন যুক্ত ট্রেন চলে। ভারতীয় রেলের দায়ভার ভারত সরকারের রেল মন্ত্রণালয়ের। ভারতীয় রেলের মোট কর্মচারী এর সংখ্যা ১৩ লক্ষ। সারা দেশে মোট ১৭ টি রেল জোন আছে। কলকাতা মেট্রো রেল একমাত্র মেট্রো রেল যা ভারতীয় রেলের অধীনস্থ। বাকি শহরের মেট্রো রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকারের নগরোন্নোয়ন দপ্তরের অধীনস্থ। পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব রেলের সদর দফতর হল কলকাতা। প্রতিটি জোনকে আবার অনেকগুলো বিভাগে বা ডিভিশনে ভাগ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের রেলের বিভাগ গুলি হল শিয়ালদহ, হাওড়া, আসানসোল, মালদহ, আদ্রা, খড়গপুর, ও আলিপুরদুয়ার। পশ্চিমবাংলার রেল পথ ভারতের রেল জোনগুলির মধ্যে ৪টি জোনের অধীনস্থ। পূর্ব রেল, দক্ষিণ পূর্ব রেল, উত্তর পূর্ব ফ্রন্টিয়ার রেল পথ ও কলকাতা মেট্রো।
বলাবাহুল্য যে কোন দেশের অর্থনীতিকে উন্নত করতে হলে প্রয়োজন উন্নত রেল ব্যবস্থা। বিশেষ করে পণ্য পরিবহনের জন্য। একসঙ্গে অনেক পরিমান পণ্য কম সময়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে রেলের জুড়ি মেলা ভার। সে যে দেশই হোক।
ভারতে রেলের জনপ্রিয়তা বোঝানো যাবে কিছু ভিড়ের তথ্যের মাধ্যমে। রেলের পরিসেবা এদেশে নানা রকম। শহরাঞ্চলের জন্য এক রকম, মফঃস্বল বা গ্রামীন এলাকার জন্য আর এক রকম। অঞ্চল বিশেষে নানা রকম ট্রেনও চালানো হয়। এই পরিসেবা মূলত নিত্য যাত্রীদের জন্য। শহরাঞ্চলে মেট্রো রেল চলার পাশাপাশি চলে সাবার্বান বা উপনগরীয় রেল। কলকাতার ক্ষেত্রে বাংলায় একে শহরতলি রেল বলা হয়। কলকাতা, দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই সহ আরো কয়েকটি শহরে এই পরিসেবা আছে।
কলকাতা শহরতলী রেলের দৈর্ঘ্য সব থেকে বেশি। ১১৮২ কিমি। মোট স্টেশনের সংখ্যা প্রায় ৩৫০ টি। এরপর চেন্নাই সাবার্বান রেলওয়ে। ৮৫৭ কি.মি. তে মোট স্টেশন ৭৫ টি মত। আর সব থেকে উন্নত প্রযুক্তি যুক্ত উপনগরীয় রেলওয়ে হল মুম্বাই সাবার্বান রেলওয়ে। এখানে ৪২৭ কিমি তে মোট ১৫০টি স্টেশনে পরিসেবা দেওয়া হয়।
প্রতিদিন পরিসেবা প্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা গুলো বেশ চমকপ্রদ। চেন্নাইতে প্রতিদিন ১৪ লক্ষ জন এই সেবা নেন, মুম্বাইতে ৭৫ লক্ষ। হ্যাঁ অবাক করা হলেও এটাই সত্যি। কলকাতাতে লোকাল ট্রেনের মোট যাত্রী সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লক্ষ। এর মধ্যে শিয়ালাদাতে ১৯ লক্ষ। হাওড়াতে ১১ লক্ষ। একটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনালে দৈনিক যাত্রী সংখ্যার বিচারে শিয়ালদা সব থেকে ব্যস্ত স্টেশন। অফিস টাইমে এই স্টেশন প্রতি ঘণ্টায় এক লক্ষ মানুষ ব্যবহার করেন। সারাদিনে ৮৫০টি লোকাল ট্রেন চলাচল করে এই স্টেশন থেকে। হাওড়া স্টেশনে লোকাল ট্রেনের ভীড় খানিকটা কম। লোকাল ট্রেনের সংখ্যা এখানে ওই ৫০০’র মত। কিন্তু এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রধান টার্মিনাস হওয়াতে এই স্টেশন ট্রেনের ফ্রিক্যুয়েন্সীর দিক দিয়ে দেশের ব্যস্ততম। সারাদিনে ৯৭৪ টি ট্রেন চলাচল করে এই স্টেশন থেকে। ভোর ৩টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত এই লোকাল ট্রেনের পরিসেবা শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশন থেকে পাওয়া যায়। মুম্বাই লোকাল ট্রেনের সংখ্যা সব থেকে বেশি। প্রায় ১৫০০।
মেট্রো রেলের মধ্যে সব থেকে বেশি দৈনিক যাত্রী দিল্লীতে। প্রায় ৩০ লক্ষ। এর পরেই কলকাতাতে দৈনিক সাড়ে ৬ লক্ষ। কলকাতাতে মেট্রো রেল পরিসেবা পাওয়া যায় ১৫ ঘণ্টা করে প্রতিদিন আর রবিবার ১২ ঘণ্টা করে। রেলের এই রকম দ্রুত সুবিধা প্রদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গে বহু মানুষ ২০০ কিমি পথ সাড়ে তিন ঘণ্টায়পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন আসানসোল থেকে কলকাতা, বহরমপুর থেকে কলকাতা বা ১০০ কিমি দূরের বর্ধমান, কৃষ্ণনগর থেকেও আসা যাওয়া করে অফিস করেন। এটাও একদম সত্যি ঘটনা। নিত্য যাত্রীদের কথা ভেবে অফিস টাইমে কলকাতা শহরে পৌঁছে যাওয়া যায় যাতে তার জন্য নানা রকম এক্সপ্রেস, সুপার লোকাল (নন স্টপ লোকাল ট্রেন), গ্যালোপিং লোকাল (যে লোকাল ট্রেন গ্যালপ করতে করতে বা ঘোড়ার মত লাফাতে লাফাতে যাবে, ইয়ে মানে কিছু স্টেশন বাদ দিয়ে কিছু কিছু স্টেশনে দাঁড়াবে। এগুলো কিন্তু এক্সপ্রেস ট্রেন না। সাধারণ ভাড়াতে চলে। নানারকম কম্বিনেশনে চলে। মানে আগের গ্যালোপিং যে যে স্টেশন দাঁড়ালো না, ১০ মিনিট পরের গ্যালোপিং সেই সেই স্টেশনে থামলো।) এবং সাধারণ লোকাল অর্থাৎ সব স্টপেজ দেবে এমন লোকাল। মুম্বাই এ গ্যালোপিং লোকাল কে “ফাস্ট লোকাল” বলা হয়। বাকী ট্রেনকে “স্লো লোকাল” বলা হয়।
এছাড়াও আরও দুই ধরনের বিশেষ রেল পরিসেবা এই দেশে বর্তমান, তা হল মাস র্যাপিড ট্রান্সিট সিস্টেম (MRTS)। এই ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত শুধু মাত্র চেন্নাই শহরে বর্তমান। এটি মেট্রো রেল না। সাধারণ লোকাল ট্রেনই চলে তবে ডেডিকেটেড এলিভেটেড বা সাধারণ করিডরে। ভারতে যখন শুধুই কলকাতাতে মেট্রো রেল চলছে প্রায় ১ দশক ধরে আর দিল্লীতে ভারতের দ্বিতীয় মেট্রোর প্রস্তাবনা চলছে তখন তামিলনাডু রাজ্য সরকার ও ভারতীয় রেলের যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে চেন্নাই শহরে এই প্রকল্প শুরু হয়। প্রায় ২০ কিমি রেলপথে ১৮ টি স্টেশনে পরিসেবা দেয় সেখানকার ই এম ইউ ৯ কোচের ট্রেন। দৈনিক যাত্রী সংখ্যা বর্তমানে ১ লক্ষ। সাফল্য লাভ করার জন্য কলকাতা ও দিল্লী শহরের এই প্রকল্পের পরিকল্পনা ইতিমধ্যে সরকার গ্রহণ করেছে।
আর ২য় পরিসেবা হল কলকাতা শহরের চক্র রেল পথ বা সার্কুলার রেলওয়ে। এই রেলপথ কলকাতার দমদম স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে গঙ্গার একদম ধার দিয়ে অফিস পাড়া ঘেঁষে, কলকাতা বন্দর এলাকা হয়ে, শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ পুরো ঘুরে এসে আবার দমদম স্টেশনেই এসে শেষ হয়ে বর্তমানে ঐ লাইনের সম্প্রসারণ কলকাতা বিমান বন্দর পর্যন্ত । এই লাইনের মোট দৈর্ঘ্য ৩৫ কিমি, আর মোট স্টেশনের সংখ্যা ২৩ টি। যার মধ্যে কিছু কিছু যায়গায় এই লাইন সাবার্বান লাইনের সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছে।
গঙ্গার একদম ধার দিয়ে চক্র রেল।
মহিলাদের জন্য সাবার্বান লোকালে বিশেষ সুবিধা বলতে প্রতিটি লোকালে সামনে ও পেছনের দিকে একটি করে মহিলা কোচ থাকে তাছাড়াও কলকাতায় মোট ৭ জোড়া লেডিস স্পেশাল ট্রেন চলে অফিস টাইমে। মুম্বাই, চেন্নাই শহরেও আছে এই পরিসেবা।
EMU, MEMU, & DEMU
এবারে একটু গল্প বলব ট্রেনগুলোর মানে, কী ধরনের ট্রেন কোন এলাকাতে, কেন চালানো হচ্ছে, কি বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে সেই সব নিয়ে। যেমন সাবার্বান রেলওয়েতে মূলত এমু (EMU) ট্রেন চালানো হয়। E নামেই বোঝা এই ট্রেন গুলি ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনে চলে। কিন্তু বিশেষত্ব হল এই ট্রেনগুলোর ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনের জন্য আলাদা লোকোমোটিভ লাগে না। ইঞ্জিন অংশটি খুব ইন্টিগ্রেটেড এবং ইঞ্জিন এর পেছনের অংশ থেকেই কামরা শুরু হয়। এই ট্রেনের দুদিকে দুটি ইঞ্জিন থাকে তাই ট্রেন ফেরার পথে ইঞ্জিন চেঞ্জ করার দরকার পড়ে না। আর এই EMU এর পুরো কথা হল ইলেক্ট্রিক্যাল মাল্টিপল ইউনিট। যেহেতু একাধিক বগী টানতে এই কোচগুলোতে একাধিক ইঞ্জিনের ব্যবহার হয় তাই এরকম নাম করন। সাধারনত এক একটি ইঞ্জিন বগী পরবর্তী ৩টে বগীকে টানে। ৯ কোচের ট্রেনের ক্ষেত্রে মাঝে একটি ও ১২ কোচের ক্ষেত্রে মাঝে দুটি করে ইঞ্জিন বগী থাকে। সজ্জাটা অনেকটা এরকম, ইঞ্জিনবগী তার পর ৩ টে সাধারন বগী এরপর আরেকটা ইঞ্জিন বগী ও পরে আরো ৪টে বগী যার মধ্যে শেষ বগীটি নিজেই একটি বিপরীতমুখী ইঞ্জিন বগী। এই ট্রেনটির সজ্জা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারবে ঢাকায় চালু হওয়া ডেমু (DEMU) ট্রেন দিয়ে। ডেমু (DEMU), এমু(EMU) – এই দুই ধরনের ট্রেনের ইঞ্জিনের বিশেষ ক্ষমতা হল অতি দ্রুত বেগ বৃদ্ধি করে ত্বরণ লাভ করতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে খুব নিপুণ ভাবে থামতে পারে যথেষ্ট বেশি বেগ থাকা সত্ত্বেও। আর এই ট্রেনের শব্দ দূষণ খুব কম। এই ট্রেনের কার্যকারিতা বুঝতে পারা যায় যখন দেখা যায় একটি স্টেশন থেকে প্লাটফর্ম পেরোনোর আগেই ৩৫-৪০ কি.মি. প্রতি ঘণ্টা বেগ তৈরি করে ফেলতে পারে এই ইঞ্জিন। সাধারণ ডিজেল ইঞ্জিনে কিন্তু এতো দ্রুত বেগ বেশি করা সম্ভব হয় না। এই EMU ট্রেন প্রধানত শহর ও শহরতলীতে চলাচল করে। কলকাতা শহরতলীর রেলে অন্তত মেট্রোপলিটন এলাকা পর্যন্ত দুটি স্টেশনের দূরত্ব ২ থেকে ৩ কিমি। এই স্বল্প দূরত্বের মধ্যেই এই ট্রেন খুব সহজে ত্বরণ লাভ করে এবং বেশ গতি থাকা সত্বেও নিপুণভাবে ব্রেক লাগাতে পারে। শহর বা শহরতলীতে অধিক যাত্রী সংখ্যার জন্য এই ট্রেনের বগি বেশ চওড়া এবং খোলামেলা হয়ে থাকে।
এরপর মেমু বা এম ই এম ইউ (MEMU)। এমু, মেমু, আর ডেমু এক জিনিস; শুধু চলাচলের ক্ষেত্র আর উদ্দেশ্য আলাদা। মেমু বা MEMU এর অতিরিক্ত M হল মেইনলাইন। আর ডেমু বা DEMU এর D হল ডিজেল। মেমু আর ডেমু, এমুর মতই একই প্রযুক্তির প্রায় শুধু মেমু এবং ডেমু চালানো হয় মূলত ছোট শহর থেকে অন্য শহর বা গ্রামে, বা বড় শহর থেকে শহরতলী পেরিয়ে অন্য ছোট শহর বা গ্রামে। সুতরাং এক্ষেত্রে যাত্রী সংখ্যা তুলনামূলক কম হবে কিন্তু দূরত্ব বেশি হবে। সেই জন্য এই ট্রেনের বগী খানিক কম চওড়া হয় আর দূরত্ব বেশি থাকার জন্য এই ট্রেনের বগীতে টয়লেট বর্তমান সঙ্গে সঙ্গে এই ট্রেনের এক বগী থেকে অন্য বগীর মধ্যে যাত্রী চলাচলের জন্য ভেস্টিউবলস থাকে। এগুলো এমু তে থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেমু ট্রেন চালানো হয় কিন্তু বৈদুতিক সংযোগ যুক্ত রেলপথ না হলে সেই এলাকার জন্য ডেমু ট্রেন চালানো হয়।
এবার একটা সঙ্গত প্রশ্ন আসতে পারে যে ডেমু নামে ডিজেল ইলেক্ট্রিক্যাল মাল্টিপল ইউনিট এ ডিজেল আবার ইলেক্ট্রিক্যাল একসঙ্গে কেন ব্যবহৃত হচ্ছে! সেটার কারণ হলো শুধু ডিজেল জ্বালিয়ে ট্রেন ইঞ্জিন চলে না। ডিজেল দিয়ে আসলে একটা সাধারণ ডিজেল ইঞ্জিন চলে যা আবার একটি বিদ্যুৎ জেনেরেটরকে চালনা করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। সেই বিদ্যুতে চাকার ট্রাকশন মোটরে প্রয়োগ করে ট্রেন চালানো হয়। তাই যে সমস্ত ইঞ্জিনকে আমরা ডিজেল ইঞ্জিন বলি ওগুলো সব আসলে ডিজেল ইলেক্ট্রিক্যাল লোকোমোটিভ। সাধারণ ডিজেল ইঞ্জিন এর ওপর ডেমুর সুবিধা হলো ওই সাধারণ ইঞ্জিন অপেক্ষা ডেমু অনেক তাড়াতাড়ি বেশি বেগ উঠিয়ে নিতে পারে।
অন্যান্য ট্রেন
সি এন জি ট্রেন।
লোকোমোটিভ সম্পর্কিত তথ্য
এবারে অল্প আকারে করে নেব লোকোমোটিভ সম্পর্কিত খুব ছোট্ট তথ্য উপস্থাপন। সমস্ত লোকোমোটিভ সম্পর্কে বলতে গেলে একাই একটি বড় গল্প হয়ে যাবে। সেই জন্য আমি এখানে শুধু বাংলাদেশে ব্যবহৃত ব্রড গেজ ডিজেল লোকোর কিছু তথ্যই দিচ্ছি। বাংলাদেশে যে বিজি লোকো চলে সেগুলো ভারতেও চলে।
এই লোকোর নাম দেওয়া হয় WDM দিয়ে। WDM সিরিজের এই লোকোর নানা ভার্সন আছে। WDM হলো Wide gauge Diesel Mixed traffic; অর্থাৎ মাল গাড়ি ও প্যাসেঞ্জার গাড়ি উভয় হিসেবেই চলতে পারে। এই সিরিজের নানা ভার্সনের ক্ষমতা নানা রকম। বাংলাদেশে চলা লোকোগুলির সর্বোচ্চ বেগ হতে পারে ১২০ কি.মি./ঘণ্টা। ক্ষমতা ৩৩০০ অশ্ব শক্তি সম্পন্ন। লোকোর ডিজেল ধারন ক্ষমতা ৫০০০ লিটার। দুই ধরনের ব্রেকিং সিস্টেম রয়েছে এই লোকোতে, এয়ার ও ভ্যাকিউম ব্রেকিং। লোকোর দৈর্ঘ্য ১৫,৮৬২ মিলিমিটার ও ওজন ১১২.৮ টন। এই লোকোর বগী হল CO-CO টাইপের। CO-CO হল একটি কোড যা দিয়ে বোঝানো হয় বগীটি ৬টি করে চাকার হয়। এরকম ৬ চাকার দুটি বগী থাকে এই লোকোতে আর প্রতিটি এক্সলের সঙ্গেই থাকে আলাদা আলাদা মোটর।
এই লোকো অনেক পুরোনো ভার্সন ভারতে এসেছিল ৬ এর দশকে আমেরিকার ALCO (American Locomotive Company) কোম্পানী থেকে। এর পর ভারত এই প্রযুক্তি কিনে নেয় এবং অনেক আধুনিক ভার্সন বের করে ফেলেছে। বর্তমানে ভারতের একমাত্র ডিজেল ইঞ্জিন বানানোর কারখানা ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কস (DLW), বারানসীতে বানানো হয়।
DLW থেকে প্রস্তুত হওয়া কোচ বাংলাদেশ যাওয়ার জন্য চলেছে।
এবারে কলকাতার শহরতলী ও মেট্রো রেলের নানা রকম আধুনিক পরিসেবার আলোচনা ও তার কিছু ছবি দিচ্ছি এখানে। এই সমস্ত পরিসেবার কারণে কলকাতার জীবনরেখা হয়ে উঠেছে আরো সুবিধাজনক।
কলকাতার মাটির তলার মেট্রো স্টেশন।
স্মার্ট টিকেটিং সিস্টেম ঃ
মেট্রো রেলের রিসাইকেলেবল টোকেন।
সাবার্বান ট্রেনের এপস বেসড এবং স্মার্ট কার্ড বেসড ও মেট্রো রেলের স্মার্ট কার্ড বেসড টিকেট।
ওপরের স্মার্ট কার্ড ও টোকেন টাইপ টিকেটের ছবি দেওয়ার উদ্দেশ্য হল এই টিকেটিং সিস্টেমের পেছনে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞানের ওপর আলোকপাত করা। এই কার্ড ও টোকেনের ভেতরে একটি NFC (Near Field Communication) ট্যাগ থাকে ইলেক্ট্রনিক সার্কিটের মাধ্যমে। NFC হল একটি communication protocol যার দ্বারা দুটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে যখন তাদের একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে(সাধারনত ৪ সেমি) বা সংস্পর্শে আনা হয়।
এখানে NFC কাজ করে Active-Passive Peer Interaction এর মাধ্যমে। Exit/Entry gate এর ভেতরে একটি মেশিন থাকে যাকে Active Element বলা হয়। এই Element সব সময় একটি তড়িৎ- চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরী করে চলে। এর প্রধান কাজ হল Passive element অর্থাৎ কার্ড বা টোকেনের ভেতরে থাকা NFC TAG এর সঙ্গে থাকা মেমরি চিপে যে তথ্য থাকে তা Read/Write করা। কার্ডের মেমরি চিপের মধ্যে আগে থেকে ভরিয়ে নেওয়া টাকার পরিমাণ সংরক্ষিত থাকে। আর টোকেন গন্তব্য স্টেশনে যাওয়ার ভাড়ার পরিমাণ দিয়ে কিনতে হয়। সেই ভাড়ার পরিমানের টাকার অংক টোকেনের মেমরি চিপে সংরক্ষণ করা হয়।
মেট্রো স্মার্ট কার্ডের ভেতরের সার্কিট।
যখনই কার্ড বা টোকেন মেশিনের সেন্সরের কাছাকাছি বা সংস্পর্শে আনা হয় সঙ্গে সঙ্গে গেটের মেশিন থেকে তৈরি হওয়া তড়িৎ- চুম্বকীয় ক্ষেত্র দ্বারা কার্ড/টোকনের মেমরি চিপ বিদ্যুৎ প্রবাহ পেয়ে শক্তিপ্রাপ্ত হয়। তখন মেমরি চিপ ও মেশিনের মধ্যে যোগাযোগ সম্পন্ন হয় এবং মেশিন মেমরি চিপের ডেটা READ/WRITE করে। READ/WRITE প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতেই মেশিন ও কার্ড/টোকেনের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মেশিনের সঙ্গে মেমোরি চিপের এই যোগাযোগের পদ্ধতির নাম হল RFId বা Radio Frequency Identification. (এই পদ্ধতিতে তড়িৎ- চুম্বকীয় ক্ষেত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো ট্যাগকে চিনতে পারে বা তাকে ট্র্যাক করে)। এই NFC তে Data Transfer প্রক্রিয়াতে Transmission Frequency 13.56 MHz। এই তথ্য পাঠানোর গতি 212 kbps। NFC চিপের coupling time খুব কম, ১০০ থেকে ১৫০ মিলি সেকেন্ড।
কলকাতা মেট্রোর স্মার্ট প্রবেশ ও নির্গমন গেট।
কার্ড/টোকেনগুলো AES(Advanced Encryption Standard) ব্যবহার করে। গেটের সেন্সরের কাছে বা স্পর্শে এসে মেশিনের সঙ্গে যোগাযোগ হলেই একটি Encryption Key তৈরী হয় যাতে পাশের NFC Enabled GAte ঐ কার্ডের তথ্য নিয়ে কাজ করতে না পারে।
প্রতিটি স্টেশনের একটি নির্দিষ্ট স্টেশন কোড থাকে। জাভা স্ক্রিপ্টে লেখা প্রোগ্রাম ও ডেটাবেসে এ রাখা স্টেশন গুলির কোড, দূরত্ব, জোন, ভাড়া এই সব তথ্য গেটের মেশিনের ভেতরে দেওয়া থাকে। স্টেশন কোড Encryption Key এর সঙ্গে জুড়ে যায়। ভ্রমন শেষে যখন আবার কার্ড গন্তব্য স্টেশনের নির্গমন গেটের মেশিনের সেন্সরের কাছে/স্পর্শে আনা হয় তখন Decryption হয়। এর তারপর ঐ স্টেশন কোড এবং ডেটাবেস থেকে দূরত্ব, ভাড়া, জোন এসব জাতীয় তথ্যের সাহায্যে জাভা স্ক্রিপ্টে রাখা প্রোগামের মাধ্যমে ভাড়া কতটা কাটা হবে তা নির্ধারিত হয়। এবং কার্ডের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত ব্যালান্স থেকে সেই পরিমাণ টাকা কেটে যায়। আর টোকেনের ক্ষেত্রে টোকেন কে নির্গমন গেটেই টোকেন ফেলার নির্দিষ্ট যায়গায় (কয়েন ফেলার ভাঁড়ে থাকা ফাঁকের মত) টোকেন ফেলে দেওয়া হলেই টোকেনের দামের সঙ্গে যাত্রা শুরুর স্টেশন থেকে গন্তব্য স্টেশন পর্যন্ত আসার ভাড়ার পরিমাণ যা কিনা প্রোগ্রাম থেকে পাওয়া যায় তার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয়। মিলে গেলে নির্গমন গেটের দরজা খুলবে না হলে খুলবে না। স্মার্ট কার্ডের ক্ষেত্রে একটি মেট্রো করিডরের প্রথম ও অন্তিম স্টেশন যেতে যত ভাড়া লাগে তত পরিমাণের কম ব্যালান্স থাকলে যাত্রা শুরুর স্টেশনের প্রবেশ গেটেই যাত্রীকে প্লাটফর্মে ঢোকার অনুমতি দেয় না স্মার্ট গেটগুলো।
গেটে স্মার্ট কার্ড/ টোকেন স্পর্শ ও নিচের দিকে টোকেন ফেলার যায়গার নির্দেশ।
এই টোকেন ও স্মার্ট কার্ডের ব্যালান্স জানার জন্য প্রতিটি স্টেশনে একাধিক কিয়স্ক আছে যেখানে স্পর্শ করালেই তথ্য নানা রকম তথ্য পাওয়া যায়। যেমন কোন কার্ডের বর্তমান ব্যালান্স, সেই কার্ড কোন কোন স্টেশনের প্রবেশ বা নির্গমন গেটে কবে কখন ব্যবহৃত হয়েছে এই সমস্ত তথ্য। এছাড়াও একাধিক নানা মূল্যের টোকেন কেনা হলে সব একই রকম হলে বুঝতে অসুবিধা হয়। সেক্ষেত্রে টোকেন স্পর্শ করিয়ে তার ভাড়ার পরিমাণ জেনে নেওয়া যায়। টোকেনগুলি মেট্রো রেল যাত্রা শেষে আবার নিয়ে নেয়, কারণ এই টোকেনগুলি পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। পরবর্তীতে মেশিন থেকে তুলে ওই টোকেনের সব সংরক্ষিত তথ্য মুছে দিয়ে নতুন করে ব্যবহার করা হয়। এক একটি টোকেন কে ১০০০০ বার ব্যবহার করা যায় এই পদ্ধতিতে।
সাবার্বান রেলের ক্ষেত্রে যেহেতু কোন স্মার্ট প্রবেশ বা নির্গমন গেট নেই তাই কার্ডে আগে থেকে ব্যালান্স ভরিয়ে রাখতে হয়। সেই কার্ড ATVM (Automatic Ticket Vending Machine) মেশিনে বসিয়ে টাচ স্ক্রিন থেকে গন্তব্য স্টেশন, রুট, বয়স অনুযায়ী যাত্রীর সংখ্যা (শিশু/প্রবীণ নাগরিক), যাত্রার ধরন (একমুখী/ দ্বিমুখী) এসব অপশন থেকে নির্বাচন করে টিকেট ছাপিয়ে নিতে হয়। বর্তমানে টিকিটের লম্বা লাইন এড়াতে নগদ টাকা ও কয়েন দিয়েও এই মেশিন থেকে টিকেট সংগ্রহ করা যায়।
এই পরিসেবা গুলি যাত্রীদের আগ্রহী করে তোলার জন্য মেট্রো রেল স্মার্ট কার্ডে তার রিচার্জ ভ্যালুর থেকে ১০% বেশি ও সাবার্বান রেল ৫% বেশি টাকার যাত্রা করার সুযোগ দেয়। এত পরিসেবা দিয়েও রেল ক্ষান্ত নয়। আসতে চলেছে আরো নানা উন্নত প্রযুক্তি, আরো সুবিধা। দিনে দিনে আরো জনপ্রিয়তর যোগাযোগ ব্যবস্থা হতে রেল নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এখন এই পর্যন্তই। পরবর্তী ধাপে আলোচনা করবো ভারত ও বাংলাদেশে ব্যবহৃত নানা রকম কোচ ও আধুনিক LHB কোচের নানা সুবিধা ও বিশেষ প্রযুক্তি নিয়ে।