রেল নিয়ে আলোচনার আগের দুটি অংশ বিজ্ঞানযাত্রায় প্রকাশ পেয়েছে কিছুদিন আগেই রেলের গপ্পো -১ এবং রেলের গপ্পো -২ নামে। ভারত, বাংলাদেশের রেলজীবনের এক ছবি আঁকতে গিয়ে নানা তথ্যের সমাহার হয়ে উঠেছে এই লেখাটি। আগের দুই পর্বে মূলত ভারতীয় রেলে ব্যবহৃত প্রযুক্তি, পরিসেবা নিয়ে লিখেছি। বাংলাদেশের রেল জীবন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকায় সেই ভাবে তার পরিসেবা, পরিসংখ্যান, প্রযুক্তি নিয়ে বলা সম্ভব হলো না। কিন্তু এবারের প্রতিবেদন থাকছে একদম বাংলাদেশের টাটকা খবর। যাকে বলা যেতেই পারে হাতে গরম খাবার। এবারের লেখায় থাকছে কিছু রেল কোচের আলোচনা আর অবশ্যয় বাংলাদেশের রেলজীবনের নতুন সদস্য এল এইচ বি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। এই লেখায় তুলে ধরেছি এল এইচ বি কী, তার জন্ম, ইতিহাস, প্রযুক্তি এসব বিষয়ক নানা তথ্য। এ লেখা পড়লে বোঝা যাবে এল এইচ বি কীভাবে বাংলাদেশের রেলকে আরো একধাপ এগিয়ে দিল সামনের দিকে। অতএব শুরু করা যাক রেল আলোচনার ৩য় বা আপাতত শেষ ভাগ।
রেলের গপ্পো -৩
বিভিন্ন কোচ সম্পর্কিত তথ্য
আলোচনা করব ভারত ও বাংলাদেশে ব্যবহৃত নানারকম কোচের প্রযুক্তি, ক্ষমতা এসব নিয়ে। বর্তমানে ভারতে প্রধাণত দুই ধরনের রেল কামরা ব্যবহৃত হয়।
১) আই সি এফ কোচ (ICF COACH)
এবং এল এইচ বি কোচ (LHB COACH)।
আর সঙ্গে চলে অভিনব ইন্দোনেশিয়ান কোচ।
আগের দুই পর্বে ভারতের রেল, সিগনালিং ব্যবস্থায় ব্যবহৃত প্রযুক্তি, পরিসেবা, ভিড়ের পরিসংখ্যান ইত্যাদি কিছু তথ্য দিয়েছি। এবারে যা আলোচনা করবো, তা অবশ্যই বাংলাদেশ সম্পর্কিত। সম্প্রতি বাংলাদেশ মোট ১৫০টি নতুন আধুনিক রেল কোচ কিনেছে। সেগুলো সব জাতীয় পতাকার রঙ লাল সবুজে রাঙানো। এর মধ্যে ১২০ টি কোচ ভারতে তৈরি আধুনিক প্রযুক্তি সমন্বিত।
এর জন্য বাংলাদেশ সরকারের রেল মন্ত্রণালয় প্রায় ৩৭০ কোটি রুপি খরচ করেছে। মার্চ, ২০১৬ তে বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে ৪০টি কোচ। বাকী আসছে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকা (PT INKA) কোম্পানীর বানানো যে প্রচলিত সাদা কোচগুলি বাংলাদেশে চলে, যা দিয়ে কলকাতা ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস চালায় বাংলাদেশে রেল। সেই সাদা বগিগুলির বদলে আসবে লাল-সবুজ কোচ ।
মৈত্রী এক্সপ্রেস। বাংলাদেশ PT INKA COACH.
সাদার বদলে বাংলাদেশে আসা লাল সবুজ ইন্দোনেশিয়ান PT INKA COACH.
আর ভারতে অধিক প্রচলিত আই সি এফ (ICF) কোচ দিয়ে চালানো হয় মৈত্রী এক্সপ্রেস, ভারতীয় রেলের তরফ থেকে। আই সি এফ (ICF) এর অর্থ হল ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি (INTEGRAL COACH FACTORY). এটি ভারতীয় রেলের একটি কোচ নির্মাণ কারখানা যা তামিলনাডু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাই শহরের কাছে পেরাম্বুরে অবস্থিত।
মৈত্রী এক্সপ্রেস। ভারতীয় ICF COACH.
LHB কোচের উচ্চ গতির ট্রেনের তথ্যঃ
ICF কোচের বাইরে ভারতে বর্তমানে উচ্চ গতি সম্পন্ন বিভিন্ন ট্রেন চালু হয়েছে। যা LHB কোচে চলে। যেমন রাজধানী এক্সপ্রেস যার গড় গতি ঘণ্টায় ১২০ কি.মি.। এই ট্রেন মূলত রাজ্যগুলির রাজধানী শহর থেকে জাতীয় রাজধানী দিল্লীর ‘নতুন দিল্লী’ টার্মিনালে চলাচল করে। সম্পূর্ণ বাতানুকুল এই ট্রেন ১৫০০ কি.মি .দূরের দিল্লী যেতে সময় নেয় ১৭ ঘণ্টা।
এরপর চলে দুরন্ত এক্সপ্রেস। এর গতিবেগ ঘন্টায় ১৩০ কি.মি.। কলকাতা থেকে নন স্টপ দিল্লী যেতে সময় নেয় ১৫ ঘণ্টা। কিন্তু এতো দূর রাস্তা একদম বিনা বিরতিতে আদৌ সম্ভব ছিল না। ৫০০ কি.মি. দূরে দূরে দুটি Operational Halt ছিল মূলত খাওয়ার ও টয়লেটের জল ভরার জন্য ও সঙ্গে ইঞ্জিন বদলানোর জন্য। সুতরাং এই বিরতি থাকা সত্বেও এই স্টেশন গুলিতে কোন যাত্রী ওঠা বা নামার নিয়ম ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সে ব্যবস্থা হওয়াতে এই ট্রেন আর নন স্টপ ট্রেন নেই।
এরপর আছে উচ্চ গতি সম্পন্ন সম্পূর্ণ বাতানুকূল শতাব্দী এক্সপ্রেস। এটি কম দূরত্বের শহরের মধ্যে ইন্টারসিটি ট্রেনের পরিসেবা দেয়। এর কোন শয়ন যান(Sleeper Coach) নেই। সমস্ত কোচই কুর্সী যান (Chair Car)।
এছাড়াও খূব সম্প্রতি চালু হয়েছে সম্পুর্ণ বাতানুকূল ও কুর্সী যান যুক্ত সেমি বুলেট গতিমান এক্সপ্রেস। যা দিল্লী থেকে আগ্রা এই ২০০ কি.মি. রাস্তা পাড়ি দিচ্ছে ৯০ মিনিটে। এমকি দোতলা কোচের ট্রেনগুলিও একই ধরনের কোচ নির্মিত।
এই সব ট্রেনগুলিতেই টিকেটের সঙ্গে খাবারের দাম ধরা থাকে। এগুলো বলতে গেলে ভারতের প্রথম শ্রেণীর ট্রেন। এছাড়াও সারা দেশের সমস্ত সুপার ফাস্ট ট্রেনের কোচ এই কোচ দ্বারা পরিবর্তিত হচ্ছে। এই সমস্ত ট্রেনের এত গতির জন্য এগুলো বিশেষ প্রযুক্তিতে বানানো LHB কোচ দিয়ে চালানো হয়। ধীরে ধীরে সমস্ত ICF কোচ কেই পরিবর্তিত করে LHB কোচ দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে LHB COACH:
বাংলাদেশে ভারতের কাছে থেকে যে ১২০ টি কোচ কিনছে সেগুলি সব LHB কোচ। এর মধ্যে ১৭ টা বাতানুকূল প্রথম শ্রেণীর স্লিপার কোচ, ১৭টি বাতানুকূল চেয়ার কার, ৩৪ টি সাধারণ চেয়ার কার কিছু রন্ধন কক্ষ সহ, ৩৩ টি সাধারণ চেয়ার কার প্রার্থনা কক্ষ সহ ও ১৯ টি পাওয়ার কার। এখন এই কোচ গুলি সম্পর্কে আলোচনা করব যে, কী বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় এতে, কোথায় জন্ম এর, কী কী সুবিধা বেশি আছে এই কোচগুলিতে। কারণ, বাংলাদেশে আগামী ডিসেম্বর থেকেই চলবে এই কোচ সমন্বিত ট্রেন দেশের Broad Gauge (1676mm) সেকশনে ।
RCF, KAPURTHALA তে নির্মিয়মাণ LHB COACH FOR BANGLADESH.
পশ্চিমবঙ্গের কল্যানী স্টেশনে অপেক্ষারত। বাংলাদেশে যাওয়ার পথে LHB COACH.
২০১৬ সালের ঈদের সময় থেকেই বাংলাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ শহর চট্টগ্রাম ও রাজশাহী যথাক্রমে মিটার গেজ লাল সবুক পিটি ইনকা কোচ ও ব্রড এল এইচ বি কোচ সমন্বিত ট্রেনের পরিসেবা পেতে শুরু করেছে রাজধানী শহর ঢাকা থেকে। ট্রেনের নাম সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ও পদ্মা/ধুমকেতু/সিল্কসিটি এক্সপ্রেস।
এল এইচ বি এর উদ্বোধনে মাননীয়া শেখ হাসিনা, প্রধান মন্ত্রী, বাংলাদেশ।
LHB এর জন্মঃ
১৯৯৩ থেকে ৯৪ সালের দিকে ভারতীয় রেল প্রথম ভাবনা চিন্তা করে নতুন প্রযুক্তির বেশি নিরাপত্তা যুক্ত, উচ্চ গতিতে চলতে সক্ষম কোচ ব্যবহারের কথা। জার্মান কোম্পানী LINKE HOFFMAN BUSCH কে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় এ ধরনের কোচের নির্মাণের জন্য। তারা এই কোচের নক্সা ও প্রযুক্তি নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এবং চুক্তি হয় এই কোচের পরীক্ষামূলক চালনা সফল হলে সমস্ত প্রযুক্তি ও নক্সা ভারতীয় রেলকে হস্তান্তর করা হবে। এরপর সমস্ত সফলতার সাথে ২০০০ সাল থেকে ভারতীয় রেলপথে যাত্রা শুরু করে এই বিশেষ কোচ। ১৯৯৮ সালে ওই কোম্পানী কে কিনে নিয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত কোম্পানী Alstom. ওই কোম্পানির নাম অনুসারেই এই কোচের নাম হয়েছিল LHB COACH. এখন একে ALSTOM LHB বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে ALSTOM INDIA LIMITED ও ভারতীয় রেলের যৌথ উদ্যোগে, ভারতের পাঞ্জাবের RAILWAY COACH FACTORY, KPURTHALA ও উত্তর প্রদেশের RAILWAY COACH FACTORY, RAIBARELI এবং তামিলনাডুর INTEGRAL COACH FACTORY, PERAMBUR থেকে নির্মিত হয় এই কোচ গুলি।
এই কোচের বিবিধ সুবিধাগুলি হলো –
১) অন্যান্য কোচের মত সাধারণ ইস্পাতের বদলে শুধুমাত্র উচ্চমানের স্টেইনলেস স্টীল দিয়ে নির্মাণ করা হয় এই কোচের বাইরের অতি মজবুত দেওয়াল। আর ভেতরের দেওয়াল তৈরি হয় মূলত উচ্চ মানের সেমি স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে। এতে কোচ মজবুত ও হয় সঙ্গে হালকা ওজনের হয়। ফলে উচ্চ গতিতে চলতে সক্ষম। এই কোচকে ঘণ্টায় ২০০ কি.মি. বেগেও চালানো সম্ভব। যদিও ভারতে পরীক্ষিত গতি ঘণ্টায় ১৮০ কিমি।
২) এই কোচের দৈর্ঘ্য প্রচলিত ICF COACH বা PT INKA BANGLADESH PASSENGER CAR এর থেকে ১.৭ মিটার বেশি লম্বা। তাই এই কোচের সীট সংখ্যা বেশি, প্রয়োজনীয় ফাঁকা জায়গা বর্তমান, করিডর চওড়া বেশি। চেয়ার কারে সীট সংখ্যা ৭৮ টি।
৩) এই কোচ চলাকালীন উৎপন্ন শব্দের ডেসিবল মাত্রা কোচের ভেতরে ৬০ ডেসিবল এর কম। ফলে শব্দ দূষণ কম।
৪) বাইরের তাপ ভেতরে কম ঢোকার জন্য POLYEURETHANE জাতীয় তাপ রোধে সক্ষম ফোমের স্প্রে ব্যবহার করা হয় । উচ্চ স্থিতিস্থাপকতা যুক্ত EPOXY জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করে ভেতরের দেওয়ালের বাইরের ফ্রেমে মোটা স্তর তৈরি করা হয়। এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে তাপ রোধ বৃদ্ধি ও বিভিন্ন রাসায়নিক ক্ষয় প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৫) এছাড়াও দরজার সঙ্গে যুক্ত ফ্লাস ব্যবস্থার দ্বারা বাইরের দেওয়াল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিষ্কার করা সম্ভব।
৬) জানলাগুলি (বাতানুকুল কোচে) দ্বিস্তরীয়। বাইরের দিকের কাচের ওপর প্রতিফলন সক্ষম পদার্থের স্তর বর্তমান এবং ভেতরের কাঁচটি বিশেষভাবে তাপ রোধে সক্ষম। এছাড়াও দুই কাঁচের মাঝে আর্গন গ্যাস ব্যবহার করা হয় তাপের পরিবহনের অতিরিক্ত অন্তরায় ব্যবস্থা হিসেবে। এছাড়াও জানলার সঙ্গে পর্দার পরিবর্তে ROLLER BLINDS নামক এক বিশেষ ধরনের SUN PROTECTION FABRIC ব্যবহার করা হয়।
দ্বিস্তরীয় জানালা পদ্ধতির গ্রাফিক্স।
LHB AC CHAIR CAR. WINDOWS WITH ROLLER BLINDS.
৭) কোচের মেঝে RUBBER সহযোগে CORK PANNEL ও MEKORE কাঠ দ্বারা গঠিত ১৬ মি.মি. পুরুত্বের বোর্ড নির্মিত। ফলে মেঝে তাপ ও শব্দ শোষক হিসেবে কাজ করে তার সঙ্গে। এছাড়াও এই বোর্ড বিশেষভাবে অগ্নি নিরোধ করার মত করে প্রস্তুত করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের মেঝে অত্যন্ত শক্ত, বেঁকে যাওয়াকে প্রতিরোধ করতে পারে ও ঘর্ষণ ও কম্পনে কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই মেঝের ওপর PVC MAT পাতা থাকে।
৮) ভেতরের দেওয়ালের নীচের অংশে MINERAL MAT ব্যবহার করা হয় জল বয়ে যাওয়া ঠেকাতে। তাছাড়াও ওপরের দেওয়াল ও ছাদে ANTI- TRICKLING COAT থাকে কোনো ছোট জলের প্রবাহ বা চুঁইয়ে পড়া জল আটকাতে।
৯) কোচের ভেতরের এই অন্তর্সজ্জা বেশিরভাগই আগুন কম ছড়ায় এমন জিনিস দিয়েই নির্মিত। তাই অগ্নি সংযোগে কম ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদিও কোচে একাধিক অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র বর্তমান।
১০) কোচের বাতানুকুল যন্ত্র ছাদের সঙ্গে সংযুক্ত এবং MICROPROCESSOR CONTROLLED. ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আর্দ্রতা, গ্রীষ্মের তাপ, শীত কালের তাপ অনুযায়ী তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
১১) কোচের ভেতরে জল সরবরাহের জন্য ২ টি ইস্পাত নির্মিত জলাধার রয়েছে। যাদের মোট ধারণ ক্ষমতা ১৩৭০ লিটার। ৩ টি TOILET WITH EUROPEAN AND ORIENTAL STYLE আছে, যাদের প্রত্যকের জন্য ৩০ লিটার জলধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাঙ্ক রয়েছে।
বিশেষ প্রযুক্তি ১
এই কোচে TOILET সম্পর্কিত এক বিশেষ প্রযুক্তি আছে। তার নাম “CONTROL DISCHARGE TOILET SYSTEM” বা CDTS. এই প্রযুক্তি হল PROCESSOR CONTROLLED এমন একটি পদ্ধতি যাতে স্টেশনে থেমে থাকা অবস্থায় কোচের বর্জ্য বাইরে আসবে না। কোচে কারণের জন্য ৪০ লিটারের একটি বর্জ্য ধারক আছে। কেবল মাত্র ট্রেন ঘণ্টায় ৩০ কি.মি. এর বেশি গতিতে থাকলে তবেই বর্জ্য ওই ধারক থেকে বেরিয়ে বাইরে আসবে। এতে স্টেশন চত্ত্বর পরিস্কার থাকবে।
BANGLADESH LHB AC CHAIR CAR. বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর।
BANGLADESH LHB NON AC CHAIR CAR. বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর।
নিরাপত্তার দিকগুলি হল ব্রেকিং ও আরো দু একটি বিশেষ প্রযুক্তি। যেগুলো নিয়ে এবার লিখছি।
বিশেষ প্রযুক্তি ২
কোচের ব্রেক হল উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন AIR DISC BRAKE WITH ANTI SKID DEVICE AND ELECTRO PNEUMATIC CONTROL SYSTEM. এই কোচের EMERGENCY BRAKE, EMERGENCY BRAKE ACCELERATOR সহযোগে বর্তমান।
AIR BRAKE একধরনের ব্রেকিং পদ্ধতি যেখানে COMPRESSOR বা একধরনের পাম্পের সাহায্যে বাইরের পরিবেশ থেকে বাতাস কে টেনে এনে COMPRESSED করে সেই COMPRESSED AIR ব্রেকিং পাইপের মাধ্যমে গোটা ট্রেনের সমস্ত কোচের ব্রেকিং পদ্ধতির সঙ্গে জড়িত সিস্টেমের বায়ু আধারে যুক্ত থাকে। ট্রেনের চাকার ঘূর্ণনের জন্য গতি শক্তির সৃষ্টি হয়। এই গতিশক্তিকে তাপশক্তিতে রুপান্তরিত করার মাধ্যমে গতি শক্তির পরিমাণ কমাতে থাকা হয় ফলে একসময় ট্রেন থেমে যায়। আর এই শক্তির রুপান্তর ঘটানো হয় চাকার সঙ্গে যুক্ত ব্রেক প্যাড ও চাকার মধ্যে স্পর্শ করিয়ে ঘর্ষণ সৃষ্টি করে। এখন এয়ার ব্রেকের ক্ষেত্রে ওই কম্প্রেসড এয়ারের দ্বারা একটি পিস্টনকে ঠেলা হয় যা ব্রেক প্যাডকে সরিয়ে চাকার সঙ্গে স্পর্শ করায়। LHB কোচের ক্ষেত্রে সরাসরি চাকাতে স্পর্শ করবে এমন কোন ব্রেক প্যাড থাকে না। তার বদলে চাকার সঙ্গে যুক্ত এক্সেলের ওপর লাগানো ডিস্কের সঙ্গে স্পর্শ করবে তেমন ব্রেক প্যাড লাগানো থাকে।
এই কোচের ব্রেকগুলি ELECTRO PNEUMATIC AIR DISC BRAKE, যেখানে প্রচলিত মেকানিক্যাল ব্রেকিং সিস্টেমের বদলে বৈদ্যুতিক সংযোগ সমস্ত কোচের ব্রেকিং সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত। ফলে ড্রাইভার ব্রেক করতে চাইলে সমস্ত কোচের ব্রেকিং সিস্টেমে দ্রুত সঙ্কেত পৌছে যায় এবং মুহূর্তের মধ্যে ব্রেকিং পদ্ধতি চালু হয়। এছাড়াও এই পদ্ধতিতে ব্রেকের প্রায় ৭ টি লেভেল বর্তমান, মৃদু থেকে অত্যন্ত জোর পর্যন্ত। ফলে ড্রাইভারের পক্ষে নিপুণ ভাবে ব্রেক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব যাতে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়াও স্বয়ংক্রিয় এবং ম্যানুয়াল জরুরি বা এমারজেন্সি ব্রেক সিস্টেম বর্তমান। এয়ার ব্রেক পদ্ধতিতে ব্রেকিং পাইপের কম্প্রেসড বাতাসের চাপ কখনই শুন্য একক(প্যাস্কেল) হয় না। যদি হয় তাহলে তা বিপদের সঙ্কেত। কারণ ব্রেক পাইপে বাতাসের চাপ না থাকলে পরবর্তী ব্রেক ধরবে না। এই অবস্থায় অত্যন্ত দ্রুত পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয় জরুরি ব্রেক কাজ করে গাড়ি থামিয়ে দেয়। আর অন্য বিশেষ কারণে চালক ট্রেনকে জরুরি অবস্থায় থামানোর জন্য ম্যানুয়াল এমারজেন্সি ব্রেক প্রয়োগ করে। একটি মজার তথ্য দিচ্ছি এখানে। ভারতীয় রেলের নিয়ম অনুসারে চলমান ট্রেনের সামনে কোনো পশু বা বন্য প্রাণী এসে গেলে চালককে গাড়ির গতি কমাতে হবে, হর্ন দিতে থাকতে হবে। সেরকম বুঝলে থামাতেও হবে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম নেই। শুধু হর্ণ বাজাবে কিন্তু গাড়ির কোন গতি কমবে না বা ব্রেক পড়বে না। এই এমারজেন্সি ব্রেকের একটি ত্বরণ সৃষ্টিকারী যন্ত্রও থাকে এই কোচে যা এই ব্রেককে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করে।
বিশেষ প্রযুক্তি ৩
এই কোচের আরো একটি বিশেষ প্রযুক্তি হল WHEEL SLIDE PROTECTION (WSP). এই প্রযুক্তিতে ব্রেকিং এর সময় চাকার ঘষা খেয়ে যাওয়া বা স্লিপ করে যাওয়ার ঘটনাকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ধরে ফেলা এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ব্রেক প্যাড ও ডিস্কের উপাদানের পার্থক্যে তৈরি হয় ঘর্ষণ গুনাঙ্কের তারতম্য। এটি এবং অন্যান্য নানা কারনে একি কোচের বিভিন্ন চাকার AXLE এর মধ্যে RPM (ROTATION PER MINUTE) এর পার্থক্য সৃষ্টি হয় ফলে চাকা স্লিপ করে বা ঘষা খেয়ে যায় রেলের সঙ্গে।
WSP পদ্ধতিতে চাকার AXLE এর সঙ্গে MICRO COMPUTER WITH SPEED SENSOR লাগানো থাকে। যা চাকার RPM পরিমাপ করে। ওই MICRO COMPUTER এর মধ্যে সর্বোচ্চ গতির চাকার RPM কে রেফারেন্স সেট করার কোড করা থাকে। ফলে MICRO COMPUTER সব চাকার RPM এর মধ্যে রেফারেন্সের সঙ্গে তুলনা করে যদি খুঁজে পায় কোনো চাকার RPM কম, তাহলে তৎক্ষণাৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে WSP সেই চাকার ব্রেক RELEASE করে ও ধীরে ধীরে যাতে ওই চাকার RPM বৃদ্ধি পায় এবং বাকী চাকার RPM সঙ্গে সমতা তৈরি করে এবং চাকা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া থেকে বাঁচে এবং দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কমে।
বিশেষ প্রযুক্তি ৪
এছাড়াও প্রতিটি কোচে ৪ টি করে চাকার মোট ২ টি বগি থাকে। এখানে বগি বলতে চাকা এবং হাইড্রোলিক স্প্রীং সহ পুরো ফ্রেম স্ট্রাকচার কে বলছি। এই বগিতে উচ্চ মানের নানা রকম DAMPER থাকে যা লাইনের যে কোনো রকম অপ্রতিসমতার জন্য সৃষ্ট ধাক্কা বা ঝাঁকুনিকে নিপুণ হাতে নিয়ন্ত্রণ করে যাত্রাপথে যাত্রীদের আসুবিধা বোধের থেকে মুক্তি দেয়।
বগিতে বিভিন্ন DAMPER ও স্প্রীং এর অবস্থান নীচের গ্রাফিক্সে দেখানো হয়েছে
বিশেষ প্রযুক্তি ৫
আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো AUTOMATIC CENTER BUFFER COUPLER OF AAR TIGHT LOCK TYPE এর ব্যবহার করা হয় দুটি কোচের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে। যা থেকে এক বিশেষ এক প্রযুক্তি উপলব্ধ হয় এই কোচের ট্রেনে। সেটা হল ANTI CLIMBING PROTECTION বা ANTI TELESCOPIC প্রযুক্তি। যার ফলে ধাক্কা বা লাইনচ্যুতি ঘটলেও এই কোচগুলি একটির ওপর আরেকটি উঠে যায় না বা পুরো পাল্টি খেয়ে উল্টে যায় না। তার সঙ্গে উচ্চ মানের উপাদানে কোচ নির্মিত বলে এই কোচ কখনই দৈর্ঘ্য অনুযায়ী দুমড়ে মুচড়ে যায় না। এই রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য যাত্রীরা অনেক সুরক্ষিত থাকেন তাদের যাত্রাপথে।
একটা উদাহরণ দিয়ে বলি ২০১৪ এর ২৫ জুন ভারতের বিহার রাজ্যের ছাপড়া জেলাতে মাওবাদীরা রেল লাইন কেটে রাখে। যার ফলে সেই সময় ঘণ্টায় ১০০ কি.মি. এর বেশি গতিতে ছুটে আসা নতুন দিল্লী- গুয়াহাটি- ডিব্রুগড় লিঙ্ক রাজধানী এক্সপ্রেস ভয়াবহ দুর্ঘটনার বলি হয়। কিন্তু বেশির ভাগ বগি লাইনচ্যুত হয় এবং উল্টে না গিয়ে মাটিতে গেঁথে বসে যায় এবং কিছু কোচ একটি পাল্টি খায় বা কাত হয়ে যায়। কিন্তু কোনো কোচ একদম উল্টে যায়নি বা একে অপরের ওপরে উঠে গিয়ে উভয় বগির ক্ষতি হয়নি বা দুমড়ে মুচড়ে যায়নি। ফলাফল হিসেবে মৃত্যু ঘটেছিল মাত্র ৪ জন মানুষের। মাত্র ৪ জন এই কারণে বলছি যে অন্য কোচ অর্থাৎ ICF কোচের ট্রেন হলে এই দুর্ঘটনাতে অন্তত শতাধিক মানুষের প্রাণ যেতে পারতো বলে বলেছিলেন রেল ইঞ্জিনিয়াররা। শুধু মাত্র উন্নত প্রযুক্তি এতো মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল।
দুটি ট্রেন দুর্ঘটনার ছবিঃ
ICF COACH ACCIDENT. কোচ একে অপরের ওপর উঠে গেছে। দুমড়ে মুচড়ে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে।
LHB COACH ACCIDENT. একটি ছাড়া আর কোনো কোচই পাল্টি খায়নি। সমস্ত কোচ কাত হলেও দাঁড়িয়ে আছে। একে অপরের ওপর উঠে যায়নি। ক্ষতি অনেক কম।
শেষ করি দুটি ভাল ছবি দিয়ে।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের অসাধারণ একটি ছবি।
কলকাতা টার্মিনাল। কলকাতার ৪র্থ ও শিয়ালদহের পরিপূরক রেল টার্মিনাল। উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া- শ্যামবাজার এলাকার মাঝে এই প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল অবস্থিত। কলকাতাতে শিয়ালদহ, হাওড়া, ও শালিমার (হাওড়ার পরিপূরক টার্মিনাল) ছাড়া কলকাতা নামে কোনো টার্মিনাল না থাকাতে চিতপুর ফ্রেইট টার্মিনাল ও সাধারণ চিতপুর স্টেশনকে টার্মিনাল স্টেশনে রুপান্তরিত করার পর “কলকাতা” নামে আখ্যায়িত করা হয়। কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছেড়ে এই টার্মিনালেই যাত্রাপথ শেষ করে। আমার লেখাও তবে এখানেই শেষ হোক। ধন্যবাদ।
ছবি কৃতজ্ঞতা – কয়েকটি বাদ সমস্ত ছবিই গুগল ইমেজ থেকে সংগৃহীত।