সবচেয়ে, সবচাইতে বড় গ্রহ আমাদের সোলার সিস্টেমে এই জুপিটার। সূর্য থেকে পঞ্চম কক্ষপথে অবিরাম ঘূর্ণনরত অবস্থায় আছে এটি। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম অথবা অষ্টম শতাব্দীতে ব্যাবিলনীয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম এই গ্রহ অবলোকন করেন। এটি একটি গ্যাসীয় গ্রহ। এর বায়ুমণ্ডলের মোট শতাংশের ৮১ ভাগ হাইড্রোজেন, ১৭ ভাগ হিলিয়াম এবং ০.১ ভাগ পানিও আছে। এর মেঘগুলো পাতলা পুরুত্বের এবং ৫০ কিঃমিঃ ঘনত্ব জুড়ে বিস্তৃত। গ্রহটা পুরোটা বলতে গেলে গ্যাস দিয়েই তৈরি, তবে একেবারে কেন্দ্রের দিকে অতিরিক্ত চাপের ফলে সৃষ্ট তরল হাইড্রোজেন আছে।
এই পর্যন্ত আটটি মহাশূন্যযান বৃহস্পতির পাশ দিয়ে ভ্রমণ করেছে। তারা হলো, Pioneer 10 & 11, Voyager 1 & 2, Galileo, Cassini, Ulysses, এবং New horizons mission. আর এই বছর জুলাই এর দিকে Juno নামক আরেকটি মিশন জুপিটার ভ্রমণে রওনা হবে আশা করা যাচ্ছে।
বৃহস্পতি কত বড়?
তুলনা করার জন্য আমরা পৃথিবীকে নিতে পারি। জুপিটার এর ভর ১.৯০ * ১০২৭ কেজি, অর্থাৎ পৃথিবীর ভরের তুলনায় প্রায় ৩১৮ গুণ বেশি। দাঁড়ান, ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করি। সূর্য যে কত বিশাল, তা নিয়ে তো সবরকম তুলনা জানা আছে, তাই না? বৃহস্পতির ভর সূর্যের ভরের মাত্র ১০৪৭ ভাগের এক ভাগ। মানে, এর ভর যদি আরেকটু বেশি হতো, তাহলে এর আভ্যন্তরীণ মহাকর্ষ হাইড্রোজেন পরমাণুগুলোকে ধরে হিলিয়াম বানিয়ে দিতো, আর তার সাথে উৎপাদিত হতো ফোটন বা আলো। অর্থাৎ, আরেকটু হলেই নক্ষত্রে পরিণত হতো বৃহস্পতি। কার্ল সেগান তার কসমস সিরিজের (ষষ্ঠ এপিসোডের) মধ্যে বৃহস্পতিকে বলেছিলেন “ব্যর্থ নক্ষত্র (a star that failed)”। উনি বলেছিলেন, বৃহস্পতির ভর আরেকটু বেশি হলে হয়তো আমরা দ্বি-নাক্ষত্রিক সৌরজগতের বাসিন্দা হতাম, রাত জিনিসটা এখনকার চেয়ে আরো দুর্লভ হয়ে যেতো।
বৃহস্পতির ব্যাস প্রায় ১,৪২,৮০০ কিলোমিটার। এর আয়তন ১.৪৩১৩ * ১০১৫ ঘনকিলোমিটার, যা পৃথিবীর আয়তনের চেয়ে প্রায় ১৩২১ গুণ বড়। সোজা কথায়, ১৩২১ টি পৃথিবী খুব সহজেই এর মধ্যে এঁটে যাবে। আসুন, গ্রহগুলোর আকারের মধ্যে একটা তুলনামূলক/আনুপাতিক চিত্র দেখি।
ভরটা আসলেই কত বেশি, সেটা বোঝার জন্য আরেকটা তথ্য দেই। কোনো গ্রহের মায়া কাটিয়ে মহাশূন্যে চলে যাওয়ার জন্য যে বেগ লাগে, সেটা হচ্ছে সেই গ্রহের মুক্তি বেগ। নিশ্চিতভাবেই এটা গ্রহের ভরের ওপর নির্ভর করে। যে গ্রহের ভর যত বেশি, সে আপনাকে তত বেশি মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে রাখতে পারবে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে, এই মায়া কাটাতে চাইলে সেকেন্ডে ১১ কিলোমিটার মুক্তিবেগ লাগবে। আর বৃহস্পতির জন্য লাগবে সেকেন্ডে ৫৯ কিলোমিটার, নইলে বৃহস্পতিতেই আটকে থাকতে হবে।
বৃহস্পতির গতি
আমাদের সৌরজগতে যতগুলো গ্রহ আছে, সেগুলোর মধ্যে নিজ অক্ষে সবচেয়ে দ্রুত প্রদক্ষিণ করে এই গ্রহটা, এতে সময় লাগে মাত্র ৯ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট। অর্থাৎ এর এক দিনের (বা এক রাতের) স্থায়িত্বকাল হচ্ছে প্রায় দশ ঘণ্টা। যেহেতু বৃহস্পতির দিন আর রাত দুটোই ছোটো, তাই কেউ যদি বৃহস্পতিতে থাকে, সে দেখবে যে – সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আবার আগের জায়গায় আসতে আসতে সাড়ে দশ হাজার বার দিন হয়েছে, সূর্যাস্ত গেছে প্রায় সাড়ে দশ হাজার বার।
এর বিশালতার কথা চিন্তা করে দেখুন কী দ্রুত বেগে নিজেকে প্রদক্ষিণ করছে সে! আর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে এর সময় লাগে পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১২ গুণ বেশি সময়, অর্থাৎ আমাদের হিসেবে প্রায় ১২ বছর।
Great Red Spot
কিছু কিছু মজার ব্যাপার আছে এই জুপিটারকে নিয়ে। জুপিটারে একটি লাল বিশাল বৃত্তাকার অংশ ঘূর্ণনরত অবস্থায় দেখা যায়। এটি হচ্ছে একটি দৈত্যকার ঘূর্ণিঝড়। একে “Great Red Spot” বলা হয়। জুপিটার এর তুলনায় ঘূর্ণিঝড়ের আকৃতিটি অনেক ছোট হলেও এটি পৃথিবী থেকে বৃহত্তর। মানে, পৃথিবীর মত ২/৩টা গ্রহ শুধু ঐ ঘূর্ণির মধ্যেই ঢুকে যাবে, বুঝতেই পারছেন কি অবস্থা! এই ঝড়টি প্রায় ৩৫০ বছর ধরে চলছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতির উপগ্রহ
শনির মত বৃহস্পতিরও বলয় আছে যা চারটি ধাপে বিভক্ত। কিন্তু এগুলোর ঘনত্ব এতই পাতলা যে যা খালি চোখে দেখা যায় না। বৃহস্পতির যে বলয় আছে, সেটা অনেকদিন আমরা জানতেও পারিনি। প্রথমবারের মত এই তথ্য পাওয়া গেছে ১৯৭৯ সালে, যখন ভয়েজার ১ মহাশূন্যযানটি সৌরজগত অতিক্রম করে আরো দূরে চলে যাওয়ার সময় যাত্রাপথে এটার পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো।
বৃহস্পতির চাঁদ আছে মোট ৬৭ টি। ভাবতেই কেমন জেনে লেগে ওঠে, তাই না? এদের মধ্যে চারটি প্রধান চাঁদ আছে। এদের নাম হলো ইও, ক্যালিস্টো, ইউরোপা, এবং গ্যানিমিড (Io, Callisto, Europa, and Ganymede). এদেরকে গ্যালিলীয় চাঁদ বলা হয়, কারণ এদেরকে প্রথমবারের মত দেখেছিলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি। ১৬১০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি তাঁর টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন বৃহস্পতির চারদিকে এরা ঘুরছে। তিনি এদের নামকরণ করেন “Medicean stars”. পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা তাঁর নামানুসারে এদের একত্রে নাম দেন “Galilean satellites”.
এখানে একটি ব্যাপার উলেখ্য যে, Ganymede নামক চাঁদটি জুপিটার এর সবচেয়ে বড় চাঁদ এবং একই সাথে আমাদের পুরো সৌরজগতেরও সবচাইতে বড়। আর তাছাড়া Europa নিয়েও বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্ত নেই। কারণ, আমাদের এই সৌরজগতে, পৃথিবী ছাড়া আর যে জগতগুলোতে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা আছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, তার মধ্যে অন্যতম প্রার্থী হচ্ছে ইউরোপা।
কেন বৃহস্পতির কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ?
আপনারা সবাই হয়তো জানেন যে, আদি সৌরজগতের ইতিহাস বেশ হিংস্র। সবদিকে মহাজাগতিক বস্তু (গ্রহাণু, ধূমকেতু) উড়ে বেড়াচ্ছিলো, এ ওর সাথে ধাক্কা খাচ্ছিলো। মোটামুটি শান্ত হয়ে আসার পরেই, আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিলো। এর পরেও বেশ কয়েকবার মহাজাগতিক বস্তুসমূহ উড়ে এসে জুড়ে বসে ছাড়খার করে দিয়েছিলো। মাঝের বিরতিগুলোতে বারবারই প্রাণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই বিরতিগুলো আরো দুর্লভ হতে পারতো, অর্থাৎ আরো বেশি সংখ্যক হিংস্র অতিথি পৃথিবীতে আঘাত করতে পারতো, যদি বৃহস্পতি না থাকতো।
সূর্যের পরেই এই সৌরজগতের সবচেয়ে বড় জগৎ হচ্ছে বৃহস্পতি। আর যখনই কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতু উড়তে উড়তে সৌরজগতের ভেতরের দিকে ঢুকে পড়ে, তখন বিভিন্ন গ্রহের মহাকর্ষ তাকে নিজের দিকে টানে। সেগুলোর অনেকগুলোই নিশ্চিতভাবে শনি আর বৃহস্পতির দিকে ছুটে গেছে, তাদের দানবীয় আকারের কারণে। এরা নিজেরা অনেক বুলেট খেয়েছে, অন্যান্য ছোটো ভাইদেরকে বাঁচানোর জন্য। বৃহস্পতি আমাদের বাংলা সিনেমার আত্মত্যাগকারী বড় ভাই। আমরা বড় ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ!
চমৎকার। পরের লেখাটার অপেক্ষায় থাকবো।
খুব সুন্দর লাগলো।
https://mahakashcharona.blogspot.com/2019/02/jupiter-planet.html
This is correct