ভিগানদের সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ভুল ধারনা আছে। ভিগান যারা তাদের পিছনে অনেক সময় ধর্ম, অনেক সময় স্বাস্থ্য, অনেক সময় নৈতিকতা, আবার অনেক সময় পরিবেশ সচেতনতা কাজ করে। এটা বলাবাহুল্য যে ভিগানরা তাদের খাদ্যঅভ্যাসের মাধ্যমেই নিজের ও পরিবেশের অনেক উপকার করছে।
আমি এখানে ধর্মনিরপেক্ষ ভিগানদের নিয়েই কথা বলবো কারন ধর্মীয় ভিগানদের খাদ্যঅভ্যাসের পিছনে কিছু স্পিরিচুয়াল ব্যাপার আছে (যেমন আত্মার পরিশুদ্ধি) এই ব্যাপারগুলো সার্বজনীনভাবে গ্রহনযোগ্য নয়। বৈজ্ঞানিক , নৈতিক ও পরিবেশগত ব্যাপারই এখানে আলোচনা করা হবে যা পাঠক সহজের গ্রহন করতে পারবে। আমি খেয়াল করলাম প্রশ্নউত্তরের মাধ্যমে লিখলে কোন বিষয়কে সহজে ব্যাখা করা যায়। এই নতুন সিরিজে আমি তাই করার চেষ্টা করবো।
.
১. ভিগান কারা?
মেরিয়াম-ওয়েবস্টার ডিকশনারি অনুযায়ী ভিগানরা শুধুমাত্র উদ্ভিদজাত খাবার খেয়ে থাকে (অর্থাৎ ফলমূল, সবজি, শস্যজাত খাবার ইত্যাদি) ভিগানদের অনেকগুলো ধরন আছে। আমি এখানে শুধুমাত্র যারা ভিগান (যারা ১০০% উদ্ভিজ খাবার খায়), তাদের কথাই বলবো।
.
২. কেন তারা ভিগান?
এর অনেক কারন কাছে। প্রানিবাদিরা স্বাস্থ্যসচেতনতা, পরিবেশ সচেতনতা, প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও নৈতিক কারনে প্রানিবাদি। প্রাণীবাদীরা প্রাণীদের ব্যবহারের ব্যাপারে খুবই আপেক্ষিক। মানে সবচেয়ে কম প্রানের ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি মানবিকতার মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করাই তাদের উদ্দেশ্য। (তথ্যসুত্রঃ ভিগান সোসাইটি)
নৈতিক কারণঃ প্রাণীদের হত্যা করা হয় মূলত বেচে থাকার তাগিদে, প্রকৃতি থেকে সকল পুষ্টিগুণ পাওয়ার জন্য। কিন্তু কোন প্রাণীকে ব্যথা না দিয়েই উদ্ভিদ থেকে সকল পুষ্টিগুণ পাওয়া গেলে (যেটা পুষ্টিবিদদের গবেষণায় প্রমাণিত) সেক্ষেত্রে প্রাণীদের ব্যবহার করা অপ্রয়োজনীয় ও অনৈতিক। প্রাণীদের কষ্ট দিয়ে বা হত্যা করে পণ্য তৈরি করাও অপ্রয়োজনীয় ও অনৈতিক।
স্বাস্থ্যগত কারণঃ সকল নন-ভিগান খাবারের মধ্যে রয়েছে ক্যান্সারের ঝুঁকি, উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি, হৃদরোগের ঝুঁকি, আরও নানা প্রাণঘাতী রোগের প্রধান কারণ। যেখানে একই পুষ্টিগুন আমরা ভিগান খাবারে পেতে পারি, খুবই কম বা প্রায় শূন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়।
স্বাস্থ্যগত কারণঃ সকল নন-ভিগান খাবারের মধ্যে রয়েছে ক্যান্সারের ঝুঁকি, উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি, হৃদরোগের ঝুঁকি, আরও নানা প্রাণঘাতী রোগের প্রধান কারণ। যেখানে একই পুষ্টিগুন আমরা ভিগান খাবারে পেতে পারি, খুবই কম বা প্রায় শূন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়।
পরিবেশগত কারণঃ পৃথিবীর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পিছনে Animal Industry প্রায় একটা বিরাট অংশে দায়ি। পৃথিবীর মোট যানবাহন, ট্রেন, জাহাজ সবকিছু মিলেও যে পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয় Animal Industry একাই এর থেকে বেশি নির্গত করে। তাও মিথেন গ্যাস যা কিনা কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে প্রায় ২০ গুন বেশি কার্যকর ও ক্ষতিকারক।
প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতাঃ ফারমিং এর জন্য প্রাণীদের প্রতি পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়, জন্ম থেকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত। আমরা কোনভাবেই নিজেদের মানবিক বলতে পারি না যদি না আমাদের খাবার প্লেটের কোন একটা জিনিসও এমন পাশবিক পদ্ধতির মাধ্যমে এসে থাকে। ভিগানরা তাদের খাদ্যাভ্যাস ও পণ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান পৈশাচিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে, মানবতার সংগ্রামের জন্য।
৩. যেখানে প্রোটিনের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে মাছ-মাংস-ডিম সেখানে ভিগানরা প্রোটিনের চাহিদা পুরন করে কিভাবে ?
এটা খুবই সাধারণ একটা ভুল ধারণা। মাংস-মাছ-ডিমে অবশ্যই অনেক প্রোটিন আছে। তার মানে এই না যে, অন্য কোথাও পর্যাপ্ত প্রোটিন নেই। বোরো চাল, চিনাবাদাম, ডাল, পানি ফল, গমের রুটি, পাস্তা, ফুলকপি, বাধাকপি, পালং শাকে প্রচুর প্রোটিন আছে। অনেকে মনে করে, ভিগানরা প্রোটিনের অভাবে ভুগে। তবে চালে যে পরিমাণ প্রোটিন আছে, তা আমাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করার জন্য যথেষ্ট। আর এইসব সুলভ খাবার তুলনামূলকভাবে কম খরচে পাওয়া যায়।
(তথ্যসুত্রঃ নোমিটএথলেথ)
.
৪. কী নৈতিক কারণে ভিগানরা প্রাণীজ খাবার (মাছ-মাংস-ডিম-দুধ) খায় না?
বেশ কিছু নৈতিক কারণ আছে, যার কারণে তারা প্রাণীজ খাবার খায় না।
ক। আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য প্রাণীকে ব্যথা দিয়ে হত্যা করা হয়, যেখানে এই ব্যাপারটা থেকে দূরে থেকেও আমাদের খাবারের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। (সুত্রঃ প্রভিগান)
খ। প্রাণীদের সারা জীবন কষ্ট দিয়ে শুধু আমাদের কয়েক বেলার খাবারের ব্যবস্থা করা খুবই পাশবিক, অমিতব্যয়ী একটা সিদ্ধান্ত।
গ। আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য প্রাণীদের ফার্মে পালন করতে যে পরিমাণ জমি প্রয়োজন (খাবারের জমি, ফার্ম ইত্যাদি ), শস্য প্রয়োজন (প্রাণীর সারা জীবনের খাবার, প্রাণীজ খাবারের ডিশে সাপ্লিমেন্টারি মশলা, সবজি ইত্যাদি) তার থেকে কমপক্ষে ৮ গুণ কম জমি খরচ করেই সেই পরিমাণ খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
ঘ। দুধ, ডিম প্রাণীর প্রয়োজনে তারা উৎপন্ন করে। গরুর ক্ষেত্রে যদি বলি, তাদের দুধগ্রন্থি সক্রিয় থাকে তাদের বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য। সেটাকে মানুষ মেনুপুলেট করে সময় দীর্ঘায়িত করে দুধের ব্যবসা করার জন্য। এটা গরুর জন্য খুবই কষ্টকর। একটা স্বাভাবিক গরুর প্রায় ২০ বছরের আয়ু থাকে। কিন্তু ডেইরি ফার্মে দুধের জন্য ব্যবহৃত গরুর আয়ু থাকে গড়ে প্রায় ৫ বছর। খুবই দুঃখজনক। (তথ্যসুত্র রবার্ট টেইলর- সাইন্টেফিক ফার্ম এনিমেল প্রোডাকশন- ১০ম সংস্করন )
ঙ। পৃথিবীর প্রায় ৭০% মানুষ “ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স”-এ ভুগে। (তথ্যসুত্রঃ ফিজিকাল কমিটি ফর রেসপন্সিবল মেডিসিন) গরুর দুধে ল্যাক্টেজ এনজাইম না থাকার কারণে ল্যাক্টোজ ইন্টলারেন্স ঘটে না। বরং মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্রে ল্যাক্টেজ এনজাইম না থাকলে সে যেকোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুধে উপস্থিত ল্যাক্টোজ নামক কার্বোহাইড্রেটটি হজম করতে পারে না। ফলে ল্যাক্টোজ ইন্টলারেন্স (ল্যাক্টোজের প্রতি অসহনশীলতা) ঘটে। (তথ্যসুত্রঃ পেডিয়াট্রিক্স জার্নাল ) যে খাদ্য আমাদের অধিকাংশ হজম করতে পারি না, তার জন্য অন্য প্রাণীকে জীবনভর কষ্ট দেয়া নৈতিক মনে করে না ভিগানরা।
.
৫. উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তাদের লতা, পাতা, ফল খাওয়া কি অনৈতিক হবে না?
অনেকে প্রাণীর হাত, পা, মাথার সাথে উদ্ভিদের অংশের তুলনা দেয়। এটা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়।
জীববিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উপসংহারে এসেছেন যে, উদ্ভিদের ব্যথার অনুভূতি নেই। এমনকি কিছু জলজ প্রাণী, পোকামাকড়েরও ব্যথা অনুভব করার ক্ষমতা নেই। কারণ তাদের ব্রেইনে কর্টেক্স অংশটি নেই, যেটা ব্যথাকে অনুভব করবে। এমনকি উদ্ভিদের কিছু অংশ কেটে দিলে তাদের জন্য উপকার হয়, তারা আরও বাড়তে পারে। যারা ব্যথা অনুভব করে, তাদের বলা হয় sentient being।
(তথ্যসুত্রঃ ভিগানস ডেইলি কমপেনিয়ন, পৃষ্ঠা নং ২৭৩) এক প্রজাতির ভিগান আছেন যারা ১০০% ভিগান না হয়ে শুধুমাত্র sentient প্রাণীদের পরিহার করেন। তাদের বলা হয় pescatarian ।
তার মানে উদ্ভিদের কোনো অংশ কাটলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। মানে সেটা অনৈতিক হবে না।
.
৬. আমাদের দাঁতই প্রমাণ করে আমরা সর্বভুক। তাহলে কেন শুধু উদ্ভিজ খাবার খাব?
আমাদের দাঁত মোটেই প্রমাণ করে না যে, আমরা সর্বভুক। সর্বভুক প্রাণীর পাশের দাঁত অনেক ধারালো ও বড় থাকে যা কাঁচা মাংস কেটে ফেলতে সাহায্য করে। বরং আমাদের শরীরের অনেক অংশ প্রমাণ করে যে, কয়েক মিলিয়ন বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা ভিগান ছিল। তবে পরিস্থিতিগত কারণে পরবর্তীতে কিছু এপ মাংস ও উদ্ভিদ – উভয়কে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করে, আর আমাদের ন্যাচারাল সিলেকশনও সেটায় সায় দেয়।
ভিগানদের প্রাণীজ খাবার ত্যাগ করার কারণ স্বাস্থ্য, নৈতিকতা ও পরিবেশ। তারা প্রাণীজ খাবার ত্যাগ করাই উত্তম মনে করে। এতে প্রাকৃতিক নিয়মকে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে না। বরং পরিবেশবিদরা মনে করেন, পৃথিবীর সবাই যদি নিরামিষ খায়, তাহলে মাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিকাজে ব্যবহৃত জমির মধ্যেই পৃথিবীর সকল মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণ করা যাবে। বরঞ্চ আরও ৪ বিলিয়ন মানুষের খাবার বেশি থাকবে।
(তথ্যসুত্রঃ সাইন্টেফিক আমেরিকা)
.
৭. বাজারে এত এত প্রাণীজ খাবার, অনেক প্রোডাক্টের মধ্যে প্রাণীজ জাতীয় উপাদান ব্যবহার করা হয় যা লেবেল না দেখলে বুঝাই যায় না, অনেকগুলো তো লেবেল দেখলেও বুঝা যায় না। এমন পরিস্থিতিতে ভিগান হওয়া খুবই কঠিন নয় কি ?
Imperfect পৃথিবীতে perfect থাকা অনেক কঠিন। ভিগানদের মূল ফিলোসফিকে যদি এক লাইনে বলি তাহলে হবে –
.
A way of living which seeks to exclude, as far as is possible and practicable, all forms of exploitation of, and cruelty to, animals for food, clothing or any other purpose.
.
৮. উদ্ভিজ খাদ্য খুবই “নিরামিষ” (Boring)। শুধু উদ্ভিজ খাবার খেয়ে আমি থাকতে পারবো বলে মনে হয় না।
যাদের জন্ম হয়েছে ভিগান পরিবারে, তাদের এই সমস্যা নেই। কারন তারা বড় হয়েছে সেভাবে। তাদের কাছে সবচেয়ে মুখরোচক খাবার উদ্ভিজ ডিশই। কিন্তু যারা প্রাণীভোজী, তাদের কাছে প্রাণীজ খাবার ভাল লাগেনি – এটা হয়। যারা জীবনের এক পর্যায়ে প্রাণীজ খাবারের সঠিক বিকল্প জেনে ভিগান হয়েছে, তাদের কাছে ভিগান হওয়া মোটেই “আমিষ” (boring) মনে হয়নি।
গরুর দুধের বিকল্প হিসেবে আছে Rice Milk, Coconut Milk, Macadamia Nut Milk, Oat Milk, Flax Milk, Hemp Milk, Hazelnut Milk, Soy Milk, Almond Milk। তাছাড়া ডিম, দই, এমনকি মাংসেরও বিকল্প আছে। আপনি যে খাবারই খেতে চান না কেন, সেটার কম করে হলেও ১০ টা উদ্ভিজ বিকল্প আছে।
.
৯. প্রাণীজ খাবারে কি স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে? সব প্রাণীজ খাবারকে কেন একই সারিতে ফেলা হচ্ছে? উপকারি প্রাণীজ খাবার কি নেই?
প্রাণীজ খাবারের প্রতিটিতেই কম বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে। আর আমি এখানে খাবারে ভেজালের কথা বলছি না, বলছি ঝুঁকিটা প্রাকৃতিকভাবেই প্রাণীর শরীরে থাকে। লাল মাংস প্রচুর ক্ষতিকর। হৃদরোগ, রক্তচাপ এমনকি ক্যান্সারের জন্য লাল মাংস দায়ী। প্রক্রিয়াজাত মাংস কিছু রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে, যেটা আমাদের পরিপাকতন্ত্র সঠিকভাবে হজম করতে পারে না, যা পরে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। মাছে, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছে পারদ থাকে। অধিকাংশ মানুষ দুধ হজম করতে পারে না। ডিমের মধ্যে ক্ষতিকারক উপাদান আছে। অথচ এই সব খাবারের উদ্ভিজ বিকল্পে খুবই কম বা শূন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে।
(তথ্যসুত্রঃ ফিজিকাল কমিটি ফর রেসপন্সিবল মেডিসিন
[১] [২] [৩] )
১০. ভিগানরা কোনো দুর্গম মরুভূমি বা দ্বীপে আটকা পড়লে কী করবে?
এ ধরনের ঘটনা খুবই আনকমন। কিন্তু এই প্রশ্নটা খুবই কমন। কোন দ্বীপে আটকা পড়লে উদ্ভিজ খাবার পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সঠিক পাতা, ফল চিনে নিতে হবে। আর মরুভূমিতেও সঠিক পথে হাঁটলে অনেক আগাছা পাওয়া যাবে, যেটা বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। গুগলে Desert Survival Tips বা Island Survival Tips লিখে সার্চ করলে অনেক ভাল ভাল আর্টিকেল পাবেন। খেয়াল করলে দেখবেন প্রাণীজ খাবারের থেকে উদ্ভিজ খাবারই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বেশি কমন।
আর এমন এক্সট্রিম সময়ে বেঁচে থাকাটাই যখন মুখ্য, তখন কোনো উপায় না থাকলে প্রাণীজ খাবারের শরণাপন্ন হওয়া ভুল কিছু হবে না। তবে এমন ঘটনার সাথে দৈনন্দিনের তুলনা করা মোটেই যৌক্তিক নয়।
.
১১. গবাদি পশু দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। তাদের খাবার হিসেবে খেয়ে আমরা পশুসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখছি বলে আমার মনে হয়।
গবাদি পশুর অতিরিক্ত বংশবৃদ্ধির পিছনে আসলে ফার্মিং দায়ী। ফার্মে প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা হওয়ার সাথে সাথে তাদেরকে বংশবৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করে দেয়। স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধি মোটেই এত বেশি না, কৃত্রিমভাবে করায় সেই প্রবৃদ্ধি কয়েক গুণ ছাড়িয়ে যায়।
.
১২. যদি প্রাণী হত্যা ভুল হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবীর অন্য প্রাণীরা যে অন্য প্রাণীদেরকে হত্যা করছে, এটাও ভুল। ভিগানরা কি ভবিষ্যতে এটাকেও বাধাগ্রস্থ করবে? তারা কি আমাদের পুরো খাদ্যচক্র নষ্ট করে দিতে চায়?
পৃথিবীর সব মানুষ ভিগান হয়ে গেলেও খাদ্যচক্রে কোন বাধা আসবে না। বরং সেটা মানুষের জন্য ভাল হবে। কারণ খাদ্যবণ্টন ঠিক হলে পৃথিবীর কোন মানুষ আর অনাহারে মরবে না। প্রত্যেকের চাহিদার থেকে দ্বিগুণ উৎপাদন সম্ভব। যেসব প্রাণীকে আমরা খাই, সেই প্রাণীদের সারা জীবন কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা যাবে। সাথে স্বাস্থ্যরক্ষাও করা হবে।
অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মাংসাশী, আর তৃণভোজী প্রাণীদের ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব না। কারণ তাদের পরিপাকতন্ত্র সেটা নিতে পারবে না। কিন্তু মানুষ পারবে। আমাদের এই শারীরিক ক্ষমতা আছে আর আমরা নিজেদের পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত প্রাণী বলার দাবিদার। তাহলে কেন আমরা এই সিদ্ধান্ত নেবো না যা সবার জন্যই ভাল হয়?
.
১৩. আমি খুব খেলাধুলা করি, আর জিমও প্রতিনিয়ত করি। আমার প্রচুর প্রোটিন দরকার হয়। আমি মনে করি না এথলেটরা ভিগান হতে পারে। আপনার কোন জবাব আছে?
আপনি ভিগান হলেও খুব সহজে আপনার স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পারবেন, এমনকি আপনি এথলেটিক ক্যারিয়ার বেছে নিলেও কোন সমস্যা হবে না। অনেক টেনিস প্লেয়ার (ভেনাস উইলিয়াম সেলেনা উইলিয়াম), অনেক অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী, ম্যারাথন প্রতিযোগী, ব্যালে ড্যান্সার, সাইক্লিস্ট, বাস্কেটবল প্লেয়ার, দৌড়বিদ, হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন রেস্লার-বক্সাররা, এমনকি ক্রিকেট বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়ার পেস বলার পিটার সিডেল ভিগান খাদ্যাভ্যাস মেনে চলেন। ভিগানদের এথলেটিক ক্যারিয়ারে তাদের খাদ্যাভ্যাস কোন সমস্যাই করে না।
১৪. উদ্ভিজ খাবারের মধ্যেও অনেক খাবার আছে যেটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। স্বাস্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে ভিগান হওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত?
যারা প্রাণীজ খাবার খায় তারা অবশ্যই গরুর মলদ্বার খাওয়ার চেষ্টা করে না। উদ্ভিজ খাবারের ক্ষেত্রেও তাই। আমরা ভাল জিনিসগুলো গ্রহণ করবো, খারাপ জিনিসগুলো পরিহার। তামাকও শস্য, ধানও শস্য। একটা জীবন ঘাতক, একটা জীবন রক্ষক।
.
১৫. ভিগানরা মনে করে পশু খেলে নাকি পশুর মত আচরণ করে মানুষ। এর পিছনে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিক্তি নেই। আপনারা কিভাবে এটাকে সমর্থন করেন?
ভিগানদের এক অংশ ধর্মীয় কারণে ভিগান। তারা সকল ভিগানদের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাদের ধারণার মূল প্রেরণা ধর্ম। ধর্মনিরপেক্ষভাবে যারা ভিগান তারা এই কথার সমর্থন দেয় না। সচেতনতা তাদের ভিগান হওয়ার মূল প্রেরণা, আত্মিকতা নয়।
.
১৬. কৃষিকাজে প্রাণীর ব্যবহারকে ভিগানরা কীভাবে দেখে ? সেটা কি প্রাণীদের কষ্ট দেয়া নয়?
এটা ঠিক যে কৃষিকাজের জন্য প্রাণীদের ব্যবহার করা হয়। যে হারে প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য মারা হচ্ছে (প্রতি বছর ১০ বিলিয়নেরও বেশি গবাদি প্রাণী), সেই তুলনায় এটা কিছুই না। আর চাষাবাদের ফলে যে হারে প্রাণী মারা যায়, তা নিতান্তই নগণ্য। প্রাণীদের চাষাবাদে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা সচেতন হলে তাদের এই ব্যাপারেও কষ্ট হ্রাস পাবে। মানুষের প্রয়োজনে প্রাণীর ব্যবহার করা এক জিনিস আর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কষ্ট নিয়ে মারা অন্য। যুগ পাল্টানোর সাথে সাথে নতুন প্রযুক্তি আমাদের কাছে এসেছে। পৃথিবীতে ভিগানর সংখ্যা বাড়লে এই ব্যাপারে মানুষ আরও সচেতন হবে। এক সময় কৃষিকাজে প্রাণী আর দরকার হবে না।
(
তথ্যসুত্র রবার্ট টেইলর- সাইন্টেফিক ফার্ম এনিমেল প্রোডাকশন- ১০ম সংস্করন )
.
১৭. আমাদের কি গরুর দুধ দরকার হয় না শক্ত হাড়ের জন্য?
ডেইরি ইন্ডাস্ট্রির প্রমোশনের কারণে ভোক্তাদের মাঝে যে অনেক সময় ভুল ধারণা কাজ করে, এটা তার একটা উদাহরণ। যে পরিমাণ ভিটামিন ডি আমাদের দরকার, তা খুব সহজেই উদ্ভিজ খাবারের মধ্যে পাওয়া যায়।
.
১৮. বাচ্চারা উদ্ভিজ খাবার খেতে পছন্দ করে না। তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করার জন্য আমার কাছে প্রাণীজ খাবারই মোক্ষম মনে হয়।
যে পরিবারে প্রাণীজ খাবার থাকে, সেখানে মূলত এই সমস্যা হয়। বিকল্প যে খাবারের কথা ৮ নাম্বারে বলা হয়েছে, এমন কিছু বিকল্প খাবার অবশ্যই তাদের ভাল লাগবে। গবেষণা বলে, বিকল্প খাবার আরও বেশি সাড়া ফেলেছে তাদের মাঝে। তাদের পছন্দের খাবার ও পুষ্টি চাহিদা – দুটিই পূরণ করা সম্ভব উদ্ভিজ খাবার দ্বারা।
আশা করি কমেন্ট সেকশনে আরও প্রশ্ন পাব। কমেন্টে করা প্রশ্নগুলোর সাথে আমার নির্বাচিত আরও ১৫ টি প্রশ্ন যুক্ত করে পরবর্তী পর্ব লিখবো। আশা করি সবার সহযোগিতার মাধ্যমে সবার ভ্রমঘাত হবে।
সবাইকে ধন্যবাদ।
এই পোস্টের সর্বমোট পাঠকসংখ্যা:
7,464
Comments
সবাইকে নিরামিষ ভোজী হতে উত্সাহিত করি। that means more meat for me 😀
হাহাহা। ভাল বলেছেন 🙂
দারুণ লিখেছেন! আমার ওয়াইফ ভিগান ডায়েটে আছে। এখানে সমস্যা একটাই, ভিগান খাবার পাওয়া যায়না, গেলেও অনেক দাম!
বেশীরভাগ খাবার ঘরে তৈরি করে নিতে হচ্ছে। সুপার ষ্টোরে নারকেলের দুধ পাওয়া যায়, সাধারণ দুধের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী দামে।
লিখা চালিয়ে যান! ধন্যবাদ!
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সব চেয়ে বড় ব্যাপারটা হল নিজের স্বার্থের উপর ওঠা অনেক বড় ব্যাপার। যেমন অন্য প্রাণীর কষ্টে সমব্যথী হয়ে নিজের স্বার্থ বিসর্জন খুব কঠিন। অত্যন্ত প্রানবন্ত লিখেছেন। চালিয়ে যাবেন আশা করি।
ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য। খুব শিগ্রি নতুন পর্ব আসবে। আশা করি পড়বেন 🙂
পোস্টটিতে কিছু তথ্যগত ভুল আছে। ১) গরুর দুধে ল্যাক্টেজ এনজাইম না থাকার কারণে ল্যাক্টোজ ইন্টলারেন্স ঘটে না। বরং মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্রে ল্যাক্টেজ এনজাইম না থাকলে সে যেকোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুধে উপস্থিত ল্যাক্টোজ নামক কার্বোহাইড্রেটটি হজম করতে পারে না। ফলে ল্যাক্টোজ ইন্টলারেন্স (ল্যাক্টোজের প্রতি অসহনশীলতা) ঘটে। ২) ল্যাক্টোজ ইন্টলারেন্স হলে মায়ের দুধও হজম করা সম্ভব নয়। কারণ যেকোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুধে ল্যাক্টোজ নামক কার্বোহাইড্রেট থাকে। মায়ের দুধে থাকে সবচেয়ে বেশি! এখন যদি বলা হয়, মায়ের দুধ খেলে হবে না, কিন্তু গরুর দুধ খেলে হবে – সেটা ভুল। যেসব সন্তান জন্ম থেকে এই ল্যাক্টোজ ইন্টলারেন্সে ভুগে, তাদেরকে ব্রেস্ট ফিড করানো হয় না। বরং… আরো পড়ুন
সংশোধিত। ধন্যবাদ। 🙂