মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগ বা অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিজ
অতিরিক্ত মদ পান করলে লিভারে চর্বি জমে, প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে লিভারের ক্ষত শুকিয়ে গুটি গুটি ফাইব্রোসিস এবং শেষ পর্যন্ত লিভার সিরোসিস হয়। পশ্চিমা জগতে লিভারের রোগসমূহের মধ্যে মদ্যপানজনিত লিভারের রোগই প্রধান। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে লিভারের রোগের প্রধান কারণ ভাইরাসজনিত যকৃত প্রদাহ।
লিভারের কাজ এবং গুরুত্ব
মানুষের শরীরে মস্তিষ্কের পরে গঠন এবং কাজের দিক দিয়ে লিভার অতি জটিল। লিভার পাঁচশোরও বেশী কাজ করে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
• রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধকারী প্রোটিন তৈরি করে
• রক্তের বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান বা টক্সিন পরিশোধন করে
• হরমোন, প্রোটিন এবং বিভিন্ন রকম রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে
• রক্তের কোলেস্টেরল এবং গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে
• রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করে
• গ্লাইকোজেন সহ দেশের জন্য প্রয়োজনীয় আরও উপাদান সঞ্চিত রাখে।
লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হলে সারা দেহের কাজকর্মের উপর তার প্রভাব পড়ে। তবে লিভারে ক্ষত শুরু হলে তার প্রভাব প্রকাশিত হতে অনেক সময় লাগে। কারণ লিভারে ঘটা যেকোনো ক্ষত দ্রুত নিরাময় হয় এবং নষ্ট লিভার টিস্যুর পুনর্জননের ক্ষমতা রয়েছে। এজন্য লিভারের ক্ষতের লক্ষণ-উপসর্গ ধরা পড়া কিংবা প্রকাশিত হওয়ার মানে হলো, ক্ষতের অবস্থা শোচনীয়।
মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগের কারণ
অনেকেই মদ পান করে থাকে, কিন্তু সকলের লিভারে সমস্যা হয় না। মদ খেলে কারও লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হয়, আবার কারও লিভারে কোন সমস্যা হয় না। কেন এমন হয় তার সঠিক কারণ এখনো জানা নেই।
অ্যালকোহল বা ইথানল লিভারে বিপাকের পরে অ্যাসিটালডিহাইডে পরিণত হয়। ক্রমাগত মদ পান করলে এটা লিভারের কোষকে নষ্ট করে ফেলে এবং এক পর্যায়ে লিভারের গাঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। লিভারের নষ্ট অংশ শুকিয়ে গেলে সেখানে যে scar টিস্যু তৈরি হয়, তা আর লিভারের কাজ করতে পারে না। এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে একসময় পুরো লিভার অকেজো হয়ে যায়। লিভারের এই নষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়াটি কারও ক্ষেত্রে খুব দ্রুত ঘটে, কারও ক্ষেত্রে তেমনভাবে দেখা যায় না। কেন এমন হয়, তা এখনও জানা যায়নি।
মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগের ঝুঁকিসমুহ
সব ধরণের মদ দ্বারা লিভারের একই রকমের ক্ষতি হয় না। ওয়াইন পান করার চেয়ে যারা বিয়ার, লিকার অথবা স্পিরিট পান করে, তাদের লিভার বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মহিলাদের শরীরে পুরুষদের চেয়ে ধীরে ধীরে মদের বিপাক ক্রিয়া ঘটে। এজন্য মদ খেলে মহিলাদের লিভার সহজে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মহিলাদের লিভার মদের প্রতি পুরুষদের চেয়ে দ্বিগুণ সংবেদনশীল।
যারা বেশী পরিমাণে মদ পান করে এবং যাদের ওজন বেশী, তাদের ক্রনিক লিভারের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা যেমন বেশী, তেমনি এর কারণে মৃত্যুর সম্ভাবনাও বেশী। যারা নিয়মিত মদ পান করে, তাদের হেপাটাইটিস সি ভাইরাস সংক্রমণ থাকলে লিভারের ক্রনিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। বংশগতি বা জিনের গঠনের কারণেও ক্রনিক লিভারের রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে। সাধারণত লিভারে বিপাক ক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এনজাইমের জিন গঠনে কোন পরিবর্তন ঘটলে এমন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগের পর্যায়সমূহ
অ্যালকোহলিক লিভারের রোগ সাধারণত কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করেঃ
অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার
অতিরক্ত মদ পান করলে লিভারে ফ্যাটি অ্যাসিড জমতে শুরু করে। অনেক সময় অতিরিক্ত মদ পান করলে এমনকি সপ্তাহ খানেকের মধ্যেও এমন হতে পারে। এ পর্যায়ে লিভারের সমস্যার কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ প্রকাশ পায় না। এ পর্যায়ে মদ পান করা থেকে বিরত থাকলে লিভারের চর্বি জমা থেমে যায় এবং সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যে লিভার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। কিন্তু লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমলে ক্রমশ বিভিন্ন লক্ষণ, উপসর্গ প্রকাশিত হতে থাকে, যেমনঃ শরীর অতিরক্ত দুর্বল হয়ে পড়ে, বমি বমি ভাব হয়, পেটে ব্যথা হতে পারে, ক্ষুধা কমে যায় এবং সার্বিকভাবে অসুস্থ বোধ হতে পারে।
অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস বা মদ্যপানজনিত যকৃত প্রদাহ
“হেপাটাইটিস” শব্দের অর্থ লিভার বা যকৃতের প্রদাহ। অ্যালকোহল লিভারের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। যারা নিয়মিতভাবে অতিরিক্ত পরিমাণে মদ খান, তাদের এ সমস্যা হয়। তবে অল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণে মদ খেলেও এ প্রদাহ হতে পারে। কয়েকমাস মদ পান করা থেকে বিরত থাকলে অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস নিরাময় হতে পারে। অনেকের প্রদাহ প্রশমিত হতে হতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগে।
অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিসের লক্ষণ এবং উপসর্গের মধ্যে রয়েছে পেটে ব্যথা, জন্ডিস, অতিরিক্ত দুর্বলতা, জ্বর, বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি।
লিভার ফাইব্রোসিস
ফাইব্রোসিস এমন একটি প্রক্রিয়া, যার ফলে কোলাজেন নামক এক ধরণের প্রোটিন লিভারে অতিরিক্ত পরিমাণে জমতে থাকে। অধিকাংশ ক্রনিক লিভারের সমস্যার ক্ষেত্রেই এটা ঘটে থাকে। ফাইব্রোসিস প্রক্রিয়া অনেকদূর অগ্রসর হলে তা সিরোসিসে রূপ নেয়।
লিভার সিরোসিস
লিভারে অনেকদিন ধরে প্রদাহ চলতে থাকলে কোষসমূহ নষ্ট হয়ে লিভারের গাঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। লিভারের নষ্ট হয়ে যাওয়া অংশে অতিরিক্ত কোলাজেন জমে অসংখ্য গুটি গুটি তৈরি হয়। এভাবে নষ্ট হয়ে শুকিয়ে যাওয়া লিভার আর প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে না। ফলে একটি মারাত্মক প্রাণঘাতী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা সিরোসিস নামে পরিচিত। সিরোসিসের ক্ষতি অপূরণীয়। অর্থাৎ একবার সিরোসিস হলে লিভারে যে পরিবর্তনগুলি ঘটে, সেগুলো আর কখনও পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। তবে এ পর্যায়ে মদ পান বন্ধ করলে লিভারকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। লিভারের ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশী হলে লিভার ট্রান্সপ্লানটেশন করতে হয়।
লিভার সিরোসিসের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী অবসন্নতা এবং দুর্বলতা অনুভব করে। খাওয়ার রুচি কমে যায়, ওজন হ্রাস পায়, হাতের তালু রক্ত বর্ণের হতে পারে, শরীর চুলকায়, পেটে ব্যথা হয় এবং ঘুমের অনিয়ম হয়। সিরোসিস আরও অগ্রসর হলে শরীরের বিভিন্ন স্থানের চুল পড়ে যায়, ওজন কমতে থাকে, জন্ডিস হতে পারে, প্রসাবের রঙ গাঢ় হলুদ হয়, শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণের প্রবণতা দেখা দেয়, যৌন ক্ষমতা কমে যায়, হাত-পায়ে পানি জমে যায়, রক্ত বমি হয়, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যায়, পেটে পানি জমে ফুলে যায়, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হয়, চেতনা লোপ পায়, শরীরে বিভিন্ন রকম জীবাণুর সংক্রমণসহ নানারকম সমস্যা হতে থাকে।
লিভার মদ, ওষুধ এবং অন্যান্য বিষাক্ত উপাদানের বিপাক এবং নিষ্কাশন ঘটিয়ে থাকে। সিরোসিস হলে লিভার আর তা করতে পারে না। ফলে খুব সহজেই দেহে ওষুধ এবং বিষাক্ত উপাদানের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে থাকে।
মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগ প্রতিরোধের উপায়
অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিজ প্রতিরোধ করার সহজ উপায় হলো, মদ পান থেকে বিরত থাকা। যারা মদ পান ছাড়তে পারেন না, তাদের অবশ্যই পানের পরিমাণ মেনে চলতে হবে। মদ পানের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসারে ২১ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশী বয়সী একজন মহিলা দিনে এক সার্ভ এবং একজন পুরুষ দুই সার্ভ মদ পান করতে পারেন। ওয়ান ড্রিঙ্ক বা এক সার্ভ মদ ৫% অ্যালকোহলযুক্ত ১২ আউন্স (৩৬০ মিলিলিটার) বিয়ার, ১২% অ্যালকোহলযুক্ত ৫ আউন্স (১৫০ মিলিলিটার) ওয়াইন বা ৪০% অ্যালকোহলযুক্ত দেড় আউন্স (৪৫ মিলিলিটার) স্পিরিটের সমতুল্য।
মহিলাদের জন্য দিনে চার সার্ভ কিংবা সপ্তাহে আট সার্ভের বেশী এবং পুরুষদের জন্য দিনে পাঁচ সার্ভ কিংবা সপ্তাহে পনের সার্ভের বেশী মদ পান করা অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়।
দুই ঘণ্টার মধ্যে কোনো মহিলা চার সার্ভ কিংবা তার চেয়ে বেশী এবং কোন পুরুষ পাঁচ সার্ভ কিংবা তার চেয়ে বেশী মদ খেলে সেটাকে “বিনজ ড্রিংকিং” (Binge drinking) বলা হয়। সকলের শরীরের গঠন একরকম নয় এবং মদ বিপাক করার ক্ষমতাও একরকম নয়। এজন্য একই পরিমাণ মদ পান করে একজন সহ্য করতে পারলেও, অন্য আরেকজন অসুস্থ বোধ করতে পারেন।