চলতি করোনা প্যান্ডেমিক থামানোর জন্য সবাই আশায় আশায় তাকিয়ে আছে ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের দিকে। বিভিন্ন দেশে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে চলছে প্রায় ১৫০টা আলাদা প্রজাতির ভ্যাক্সিন নিয়ে গবেষণা। বিভিন্ন দেশের মধ্যে, বিভিন্ন ভার্সিটির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে–কে আগে কার্যকর ভ্যাক্সিন বানাতে পারে। গবেষকদের উৎসাহিত করতে নোবেল প্রাইজসহ বিভিন্ন পুরষ্কার, নগদ অর্থসাহায্য ইত্যাদি ইত্যাদি- বলতে গেলে প্রায় রাজ্যসহ রাজকন্যার লোভ দেখানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ফাইজার, মডার্না, ইত্যাদি কোম্পানি বেশ কিছু ভ্যাকসিন হাজির করে ফেলেছে।
তবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংগঠন আছে, যারা ভ্যাক্সিনকে মানবশরীরের জন্য বিপজ্জনক মনে করে। এ কারণে তারা নিজেরা ভ্যাক্সিন নেয় না, অন্যকেও ভ্যাক্সিন নিতে নিরুৎসাহিত করে। একেকটা সংগঠনের যুক্তি একেক রকম। কেউ শুধু নির্দিষ্ট কোনো ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার কেউ সব ধরণের ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধেই কথা বলে। এদেরকে anti vaccination organization বা anti vaxxers বলে সংক্ষেপে ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO বলছে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চলমান ভ্যাক্সিনেশন ক্যাম্পেইনের কারণে প্রতিবছর ৩০ লাখ মানুষের জীবন বেঁচে যাচ্ছে। তবে একই সাথে, ১৫ লাখ মানুষ খামাখাই মারা যাচ্ছে ভ্যাক্সিন না নেওয়ার কারণে। এই ১৫ লাখ মানুষকে খুব সহজেই ভ্যাক্সিন দিয়ে বাঁচানো যেত, কিন্তু এ্যান্টি ভ্যাক্সিনেশন ক্যাম্পেইনের কারণে তারা ভ্যাক্সিন নেয়নি।
এই আর্টিকেলে উল্লেখযোগ্য ১০টি এ্যান্টি ভ্যাক্সার গ্রুপ বা ব্যক্তির কথা আলোচনা করবো। তবে শুরু করার আগে একটু জেনে নেওয়া যাক, ভ্যাক্সিন কী?
কোনো রোগ হওয়ার পরে ওষুধ খাই আমরা। যেমন জ্বর হওয়ার পরে প্যারাসিটামল খাই। আর টিকা বা ভ্যাক্সিন হলো কোনো এক ধরণের ওষুধ, যেটা রোগ হওয়ার আগেই খেতে হয়। পোলিও রোগ হওয়ার আগেই যদি আমরা পোলিওর ভ্যাক্সিন খেয়ে ফেলি, তাহলে আর কখনো আমাদের পোলিও হয় না। কিছু রোগের ভ্যাক্সিন ট্যাবলেটের মত গিলে খেতে হয়,আর কিছু রোগের ভ্যাক্সিন ইঞ্জেকশন এর মাধ্যমে শরীরে দেয়। প্রতিবছর লাখ লাখ শিশুকে মৃত্যুর হার থেকে বাঁচাচ্ছে এই টিকাদান কর্মসূচী।
তো চলুন , ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে এ্যান্টি ভ্যাক্সারদের লজিকগুলো বোঝার চেষ্টা করি।
ইংল্যান্ডের ডাক্তার । লেখাপড়া করেছেন ইংল্যান্ডে এবং কানাডায়। ১৯৯৮ সালে তার একটি মেডিকাল জার্নাল প্রকাশিত হয় বিখ্যাত Lancet ম্যাগাজিনে। (সারাহ গিলবার্টের করোনা ভ্যাক্সিনের গবেষণার পেপারও পাবলিশ হয়েছে এই ম্যাগাজিনেই, গত সোমবার)। পেপারটায় তিনি দেখান- measles, mumps and rubella (MMR) vaccine নিলে বাচ্চাদের অটিজম হচ্ছে।
অটিজম হচ্ছে, মস্তিষ্কের বিকাশজনিক সমস্যা। অটিস্টিক শিশুদের বুদ্ধি অন্য শিশুদের মতো হয় না। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের চিন্তাভাবনা এবং কর্মপদ্ধতি সাধারণ শিশুদের থেকে আলাদা হয়।
ল্যানসেট ম্যাগাজিন খুবই নির্ভরযোগ্য, পিয়ার রিভিউড জার্নাল। তাই এই জার্নালের কথা অনেকেই মেনে নিলেন। অনেক বাবা মা তাদের বাচ্চাদেরকে এই ভ্যাক্সিন দিলেন না। বাংলাদেশের বাচ্চাদের যেমন ৬ টি রোগের টিকা একসাথে দেওয়া হয় জন্মের পরপরই কিছুদিনের মধ্যে, তেমনি ইংল্যান্ড আমেরিকার বাচ্চাদের হাম, মাম্পস আর রুবেলা রোগের টিকা একসাথে দেওয়া হয়।
যাই হোক, ওয়েকফিল্ডের গবেষণা প্রকাশ হওয়ার পরে সে বছর ইংল্যান্ডে মাত্র ২০% বাচ্চাকে তাদের বাবা মা টিকা দিয়েছিলো, অটিস্টিক হওয়ার ভয়ে । তবে, রেজাল্ট হিসেবে পরবর্তী কয়েক বছরে ইংল্যান্ডের বাচ্চাদের প্রচুর হাম, রুবেলা এবং মাম্পস হতে লাগল। এই অসুখগুলো খুব সহজেই ভ্যাক্সিন দিয়ে বন্ধ করা যেত।
ওয়েকফিল্ডের পেপারটা সহজে সবাই মেনে নেননি। অন্যান্য ডাক্তাররা গবেষণা করে দেখলেন, অটিজম রোগের কারণটা জেনেটিক। কোনো ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণের কারণে এই রোগ হয় না। জন্মগতভাবেই এটা হয়। জন্মের পর থেকে শিশু অটিস্টিক হিসেবেই বড় হতে থাকে । সুতরাং ৯ মাস বয়সে কোনো ভ্যাক্সিনের কারণে বাচ্চাটার অটিজম হতে পারে না।
সুতরাং, ল্যানসেটের ওই পেপারে দেখানো গবেষণা ভুল। একের পর এক অন্যান্য গবেষণায় সেটাই প্রমাণিত হলো।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো, ওয়েকফিল্ডের ওই পেপারে মাত্র ১২টা বাচ্চার উপর গবেষণা চালানো হয়েছিলো এবং এদের অনেকেরই অটিজম ছিলো না। ওয়েকফিল্ড গবেষণার প্রকৃত তথ্য না দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো ডাটা সাজিয়ে জার্নালে পাঠিয়েছিলেন।
কেন এইরকম ভুয়া গবেষনার রেজাল্ট পাঠালেন তিনি?
কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ পাওয়া গেলো। ডাক্তার ওয়েকফিল্ড নিজে আরেকটা ভ্যাক্সিনের কোম্পানি খুলতে চেয়েছিলেন। ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং বিশ্বের অন্য সব জায়গায় যেসব বাচ্চা MMR ভ্যাক্সিন নিয়েছে, এবং অটিজম হয়নি, তাদেরকে ভয় দেখাতেন এই বলে যে, তোমার যে কোনো দিন অটিজম হতে পারে। আমি একটা নতুন ভ্যাক্সিন বানিয়েছি। এই ভ্যাক্সিন নিলে তোমার অটিজম আর হবে না।
এইভাবে তার ব্যবসা করার ধান্ধা ছিল। তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা তার সেই চেষ্টা নষ্ট করে দিলো ।
সব কিছু প্রমাণ হয়ে যাওয়ার পরে ল্যানসেট ম্যাগাজিন তাদের জার্নাল থেকে ওয়েকফিল্ড এর পেপারটা সরিয়ে দিলো। ডাক্তার ওয়েকফিল্ডকে মেডিকেল প্রাকটিস থেকে নিষিদ্ধ করা হলো। তার অর্জিত সকল সম্মান, পদক ফেরত নেওয়া হলো। জালিয়াতির মামলাও হলো তার বিরুদ্ধে।
তবে ওয়েকফিল্ড এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, আমার গবেষণায় আমি যা পেয়েছি, সেটাই লিখেছি। কোনো দুর্নীতি করিনি। ২০১৬ সালে তিনি Vaxxed: From Cover-Up to Catastrophe নামে একটি সিনেমাও বানিয়েছেন (পরিচালনা করেছেন)। ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে তার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
২০০২ সালে তার সন্তান ইভান্স এর জন্ম হয়। বাচ্চাটা একটু অস্বাভাবিক ছিল। ২০০৫ সালে ডাক্তাররা নিশ্চিত হয়, বাচ্চাটা অটিস্টিক। ২০০৭ সালে জেনি ম্যাককার্থি বলা শুরু করেন, আমার বাচ্চার অটিজম এর পিছনে ভ্যাক্সিন দায়ী। ছোটবেলায়, ৯ মাস বয়সে আমি ওকে MMR ভ্যাক্সিন দিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই ভ্যাক্সিনের কারনেই আমার বাচ্চাটা অটিস্টিক হয়ে গেছে।
২০০৭ সালে তিনি ভ্যাক্সিন এবং অটিজম এর সম্পর্ক এবং তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে Louder than Words: A Mother’s Journey in Healing Autism বইটা লেখেন। বইটা বেশ পপুলার হয়। তার অনেক ভক্ত -সমর্থক জুটে যায়। প্রচুর টিভি টক শো তে ডাক পেতে থাকেন তিনি। সবজায়গাতেই তিনি ভ্যাক্সিন বিরোধী ক্যাম্পেইন চালান। সব টক শোতে গিয়েই তিনি বলেন, তোমরা বাচ্চাদের ভ্যাক্সিন দিয়ো না। এটা তোমার বাচ্চাদের অটিস্টিক বানিয়ে ফেলবে। আমার বাচ্চার ক্ষেত্রে যা হয়েছে , তোমাদের বাচ্চার ক্ষেত্রে সেটা করোনা।
Generation Rescue নামে একটি এনজিও খুলে ফেললেন তিনি। এই এনজিও প্রচার করে–ভ্যাক্সিনের কারনে অটিজম হয়। তার নামডাক আরো ছড়িয়ে পড়তে লাগল । তাকে আমেরিকার most prominent purveyor of anti-vaxxer ideology” এবং “the face of the anti-vaxx movement” বলে প্রচার করা হতে লাগল ।
জেমস র্যান্ডির ফাউন্ডেশন প্রতিবছর সেরা ধান্দাবাজ/প্রতারকদের Pigasus Award দেয়। ২০০৮ সালে এই পুরষ্কার পান জেনি ম্যাককার্থি । কারন, জেমস রান্ডির ভাষায়, She Fooled the Greatest Number of People with the Least Amount of Effort
জেন ম্যাককার্থি একা নয়, আরো অনেক সেলিব্রেটি এইরকম ভ্যাক্সিন বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন। এদের মধ্যে আছে অভিনেত্রী kristin cavallari, গায়িকা টনি ব্রাক্সটন, অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো, অভিনেতা জিম ক্যারি এবং প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাতিজা রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র।
ফেসবুকে এই নামে একটা সিক্রেট গ্রুপ আছে। গ্রুপের মেম্বর ১৭৮ হাজার । গ্রুপের হেড হচ্ছেন Larry Cook নামের এক লোক। তার কোন মেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তবে Naturopath নামের একটা অল্টারনেটিভ মেডিসিন শাখার তিনি ডাক্তার। হোমিওপ্যাথির মতই একটা মেডিসিন সিস্টেম হচ্ছে এই ন্যাচারোপ্যাথ, যেটাকে মূলধারার ডাক্তাররা বলেন ভুয়া। উইকিপিডিয়ায় একে সিউডোসায়েন্স (অপবিজ্ঞান) বলা হয়েছে।
কোনো বাচ্চা যে কোনো রোগে ভুগেই মারা যাক না কেন, ল্যারি কুক দাবি করেন, ভ্যাক্সিন নেওয়ার কারণে এই বাচ্চা মারা গেছে। সেই বাচ্চাদের শোক সন্তপ্ত বাবা মায়েদেরকে নিজের গ্রুপে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন তিনি, এবং তাদের কাছে ন্যাচারোপ্যাথের ওষুধ বিক্রি করার ধান্ধা করেন।
ফেসবুকে এ্যান্টি ভ্যাক্সিন ক্যাম্পেইনের অনেক বিজ্ঞাপন ও দেন তিনি। ফেসবুক অবশ্য করোনার পরে এই বিষয়ে নীতিমালা কঠোর করেছে।
ভাল কথা, COVID-19 সম্পর্কে ল্যারি কুক বলেছে, জনগন যেন করোনার ভয়ে ভ্যাক্সিন নেয়, সেজন্য সরকার করোনা মহামারীর গুজব ছড়িয়েছে। আসলে এগুলা কিছুই না।
বর্তমানে সে আমেরিকায় এ্যান্টি মাস্ক ক্যাম্পেইন করছে। বলছে, মাস্ক পরার কোনো দরকার নেই। হুদাই ।
করোনার ভ্যাক্সিন বের হলে সে এ্যান্টি ভ্যাক্সিন ক্যাম্পেইনও শুরু করবে বলে দিয়েছে। কারণ, তার মতে, ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু হয়েছিল বেশি ভ্যাক্সিন দেওয়ার কারনেই। এবারও করোনার ভ্যাক্সিন দেওয়া হলে করোনা বা অন্যান্য রোগ বালাই আরো বেশি করে ছড়াবে।
ল্যারি কুকের স্টপ ম্যান্ডেটরি ভ্যাক্সিনেশন ছাড়াও আরো অনেক সংগঠন ভ্যাক্সিনের বিরোধিতা করে মিটিং মিছিল সেমিনার করছে রেগুলার। যেমন- রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র এর Children’s health defense, ক্যালিফোর্নিয়ার তিন নারীর বানানো Freedom Angels Foundation, ডেল বিগট্রি এর Informed Consent Action Network, ব্রান্ডি ভন এর Learn the risk, কানাডার vaccine choice Canada ইত্যাদি সংগঠন উল্লেখযোগ্য।
৪। অল্টারনেটিভ মেডিসিন গ্রুপগুলো
হোমিওপ্যাথি, ন্যাচারোপ্যাথি, চিরোপ্রাকটিস এবং এই ধরনের অলটারনেটিভ মেডিসিন গ্রুপগুলোতে ভ্যাক্সিন নামে কোনো কিছু নেই। এমনকি এদের চিকিৎসা বিদ্যায় ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার কথাও নেই। রোগ হওয়ার পরেই রোগের চিকিৎসা করে এরা । অন্যদিকে ভ্যাক্সিন নিলে রোগ হওয়ারই চান্স থাকে না।
আর রোগ না হলে, রোগী আসবে কম। তখন মূলধারার ডাক্তারদের আয় যেমন কমবে, অল্টারনেটিভ মেডিসিনের ডাক্তারদের আয় ও কমে যাবে। এই কারনে তারা চায়, লোকের যেন বেশি বেশি রোগ হয়। ভ্যাক্সিন যদি না নেয় লোকজন, তাহলে তাদেরই সুবিধা
কিছু কিছু অলটারনেটিভ মেডিসিন সিস্টেম বর্তমানে এমন কিছু মেডিসিন বিক্রি করছে, যেগুলা , তাদের ভাষায় , ভ্যাক্সিনের বিষ শরীর থেকে বের করে দেয় । যেমন- Chelation therapy। বা হাইপারবারিক অক্সিজেন থেরাপি । যারা অতীতে ছোটবেলায় ভ্যাক্সিন নিয়েছে, তাদের কাছে এই সব ওষুধ বিক্রি করার চেষ্টা করে তারা।
শরীরে ভ্যাক্সিন নিলে মাঝে মাঝে কিছু সাইড ইফেক্ট দেখা দেয় । যেমন হামের টীকা নিলে জ্বর বা ছোট ছোট ফুসকুঁড়ি দেখা দেয়। অনেক অভিভাবক এই সব সাইড ইফেক্টে ভয় পায়। ভাবে , ভ্যাক্সিন নেওয়ার ফলে আমার বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে । ফলে তার জ্বর আসছে। এ কারনে তারা ভ্যাক্সিনের পরবর্তী ডোজ নিতে যায়না। বা অন্য বাচ্চাদের অভিভাবকেও নিরুৎসাহিত করে। মূলধারার ডাক্তার এবং গবেষকরা ”ভ্যাক্সিন নিলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে” এমন কোনো প্রমাণ পাননি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বাস করে যে , MMR ভ্যাক্সিনের ফলে অটিজম তৈরি হয়। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের আগে একটা লাইভ টিভি বিতর্কতে তিনি বলেছিলেন, আমার পরিচিত ২ বছরের একটা বাচ্চা আছে, ভ্যাক্সিনের কারণে সে এখন অটিস্টিক।
আমেরিকায় যে গ্রুপগুলো ভ্যাক্সিনবিরোধী ক্যাম্পেইন করে ( যেমন- ল্যারি কুক) তারা সবাই রিপাবলিকান দল করে, ট্রাম্পের দলকে চাঁদা-টাদা দেয় , মাঝে মাঝে ট্রাম্পের সাথে তাদের মিটিং এর ছবিও ছাপা হয় পেপারে। ট্রাম্প নিজে এক্টিভলি এদের কোনো গ্রুপের সাথে জড়িত হয়নি কখনো।
করোনা প্যান্ডেমিকের শুরুতে ট্রাম্প অনেকদিন মাস্ক পরেনি। মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াত। ২০শে জুলাই থেকে সে একটু মানুষ হয়েছে। মাস্ক পরছে ইদানিং। করোনার ভ্যাক্সিন বানানোর জন্যও সে আগ্রহী। এইটার বিরোধিতা করেনি সে এখনো পর্যন্ত।
৭। Reverend Edmund Massey
১৭২২ সালে ইংল্যান্ডের খৃষ্টান ধর্মগুরু Reverend Edmund Massey বলেছিলেন, ঈশ্বর মাঝে মাঝে তার কোনো কোনো বান্দাকে তার পাপের শাস্তি গিসেবে স্মল পক্স বা অন্য কোনো দুরারোগ্য রোগ দেন। সবারই উচিত তার পাপের শাস্তি মাথা পেতে নেওয়া। ভ্যাক্সিন দিয়ে যদি স্মল পক্স ঠেকিয়া দেওয়া হয়, তার মানে তো ঈশ্বরকে তার শাস্তি দিতে বাধা দেওয়া ! এটা তার কাজে হস্তক্ষেপ করা হয়ে যায়। সুতরাং সকল প্রকার ভ্যাক্সিনেশন বন্ধ করা উচিত। ঈশ্বরের কাজে বাধা দেওয়া উচিত না। যার ভাগ্যে যা আছে, তাইই হবে।
৩০০ বছর আগে শুরু হওয়া এই বিতর্ক এখনো চলছে। এখনো অনেকে এই লজিক ব্যবহার করেন ভ্যাক্সিন বিরোধী ক্যাম্পেইনে। আমেরিকায় Amish নামে একটা কট্টরপন্থী খৃষ্টান গ্রুপ আছে, যারা ১৬ শতকের জীবন যাপন করে। তারা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, মোবাইল সহ কোনো ইকেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে না এবং বলাই বাহুল্য, ভ্যাক্সিন নেয় না।
কিছু কিছু ভ্যাক্সিন ( যেমন রুবেলা ভ্যাক্সিন) বানাতে ব্যবহার করা হয় ভ্রূনের স্টেম সেল। গোড়া ক্যাথলিক ধর্ম স্টেম সেল নিয়ে সকল গবেষণা নিষেধ করে। এ কারণে এই সকল ভ্যাক্সিনও তারা নিষেধ করেছে। ইহুদি এবং মুসলিম সমাজের মধ্যেও অনেকে জেলাটিন সমৃদ্ধ ভ্যাক্সিন নিতে চান না। কারন এই জেলাটিনের মধ্যে শূকরের চর্বি থাকে, যেটা এই দুই ধর্মের মানুষদের জন্য নিষিদ্ধ। অবশ্য অনেক আধুনিক মুসলিম স্কলার বলেন, চিকিৎসার জন্য এ্যালকোহল বা শূকরের মাংসের ব্যবহারে সমস্যা নেই।
স্মল পক্স একসময়য় পৃথিবীতে খুব ভয়ংকর রোগ ছিল। প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ মারা যেত এই রোগে। বর্তমানে এই রোগ আর নেই । কারণ কী? ১৯৮০ সালের পর এই রোগ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ বিশ্বের সব মানুষকে এই রোগের টিকা দেওয়া হয়েচ্ছিল। রোগের আর এক পিস জীবাণুও বেঁচে নেই পৃথিবীতে। সব ঝাড়ে বংশে মরে গেছে। এইভাবে , কোনো একটা রোগকে নির্মূল করতে হলে বিশ্বের সব জায়গা থেকে সবাইকে টীকা দিতে হবে। এক জন দুই জনও যদি টীকার বাইরে থেকে যায়, তাহলেই তার কাছ থেকে অন্যদের মধ্যেও ওই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। দেখেছেন তো, চীনের উহান থেকে পুরা বিশ্বে কিভাবে করোনা ছড়াল?
বর্তমান বিশ্বের একটা বড় রোগ পোলিও। বাংলাদেশে প্রতিবছর পোলিও খাওয়ানো হয় বাচ্চাদের। ”বাদ যাবে না একটি শিশুও” স্লোগান নিয়ে এই ক্যাম্পেইন এ ১০০% বাচ্চাকে টীকার আওতায় আনা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এইভাবে পোলিও টীকা খাওয়ানো হয়। কেবলমাত্র পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে এই পোলিও কর্ম সূচী চালানো যায় না। কারন সেখানে তালেবান এবং আল কায়েদা গ্রুপের দাবি, এই টীকা খৃষ্টান মিশনারিরা খাওয়াচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। যে খৃষ্টান মিশনারিদের এই টীকা খাবে, তার ঈমান থাকবে না, সে খৃস্টান হয়ে যাবে। ভ্যাক্সিনের সাথে অন্য ক্ষতিকর জিনিস ও মিশিয়ে দিচ্ছে। এই ভ্যাক্সিন নিলে ছেলেমেয়েরা বন্ধ্যা হয়ে যাবে — এমন গুজব চালু সেখানে।
পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে যেখানে যেখানে টীকা ক্যাম্প বসায়, সেখানে তালিবানরা গিয়ে বোমা হামলা করে নিয়মিত। এলাকার মানুষদেরকেও তারা হুমকি ধামকি দেয়, কেউ যেন টীকা খেতে না যায়। স্থানীয় তালেবানরা “ভ্যাক্সিন নেওয়া হারাম” জানিয়ে ফতোয়া জারি করে। টীকা দান কর্মী এবং ডাক্তার দের তারা খুন করে। এভাবে ওই সব এলাকায় ভ্যাক্সিনেশন বন্ধ করে রেখেছে তারা। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম গ্রুপ ও পশ্চিমাদের ভ্যাক্সিন বয়কট করেছে। সেখানে ভ্যাক্সিনেশন বন্ধ। এ সকল গ্রুপের কারণেই এইসব এলাকায় পোলিও রোগ হচ্ছে। প্রতিবছর কয়েক হাজার পোলিও রোগী পাওয়া যাচ্ছে ওই জায়গা থেকে। এবং এ কারণেই বিশ্ব কে পোলিওমুক্ত করা যাচ্ছে না।
২০১৮ সালে ভারতে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে, MR-VAC ভ্যক্সিন ( হাম এবং রুবেলা) এর মধ্যে বিশেষ কিছু কেমিকাল মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুসলিমদের শরীরে এই ভ্যাক্সিন দেওয়া হলে মুসলিমরা বন্ধ্যা হয়ে যাবে। তাদের আর বাচ্চাকাচ্চা হবে না। ফলে দেশটাতে মুসলিম পপুলেশন কমবে। নরেন্দ্র মোদি এইভাবে দেশে মুসলমানদের জনসংখ্যা কমাতে চায়
সংবাদমাধ্যম এটাকে ফেক নিউজ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তবে অনেক মুসলিম তখন ভ্যাক্সিন নেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। টীকা দান কেন্দ্র হিসেবে উত্তর প্রদেশে অনেকগুলি মাদ্রাসা ব্যবহৃত হয়েছিল, সেই মাদ্রাসা গুলাতে কেউই ভ্যাক্সিন নিতে আসেনি।
২০১৩ সালে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর সময় খবর পাওয়া গেল, এই ক্যাপসুল খেয়ে অনেক বাচ্চা অসূস্থ হয়ে পড়ছে। কারন -এই ক্যাপসুল ইন্ডিয়ার তৈরি। ইন্ডিয়া নিম্নমানের ক্যাপসুল দিয়ে বাচ্চাদের মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে–এমন কথা ফেসবুকে ঘুরছিল। ২০১৭ সালে, রাজনৈতিকভাবে শান্ত সময়ে, কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানোর সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাচ্চাদের অসূস্থতার খবর আসে। ঘটনাটাকে তখন মাস হিস্টেরিয়া বলে মনে করা হয়। তবে অভিভাবকরা বেশ নিরুৎসাহিত হন তখন। ( মাস হিস্ট্রিয়া হচ্ছে সেই রোগ, যেখানে কোনো কারণ ছাড়াই কমবয়সী বাচ্চারা অজ্ঞান হয়ে যায়, বা অন্যান্য অসুস্থতা দেখা যায়)
সাম্প্রতিককালে, করোনা প্যান্ডেমিক আসার পরে জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা কাজী ইব্রাহিম বলেছেন, “ইহুদি বিল গেটস ভ্যাক্সিন বানাচ্ছে সবাইকে ইহুদি বানানোর জন্য। এই ইহুদি পণ্য বর্জন করা উচিত। পশ্চিমারা এর আগেও ভ্যাক্সিনের মধ্যে খারাপ জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছে। আফ্রিকায় পোলিওর ভ্যাক্সিনের মধ্যে এইডস এর জীবাণু মিশিয়েছিল। বাংলাদেশের ভ্যাক্সিনেও এরা বিষ ঢুকিয়ে দেবে।”
তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মুসলিম ভ্যাক্সিন কে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখেন। ভ্যাক্সিন নিতে তারা সবাইকে উৎসাহিত করেন।
———
মাত্র ১০ টার কথা বললাম। এই ধরনের শত শত ভ্যাক্সিনবিরোধী গ্রুপ আছে। নিচের লিংক গুলা থেকে বা অন্য উতস থেকে একটু গুগল করলে আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন।
আমেরিকা বা ইউরোপের আইনে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমার ইচ্ছা হলে ভাত খাব, আমার ইচ্ছা হলে মদ খাব, তাতে তোমার কী! কিংবা আমার ইচ্ছা অনুযায়ী আমি কতটুকু কাপড় পরব, সেটা নিয়ে তুমি চেঁচামেচি করতে পারবে না। সরকার তো কোনো আইন করতেই পারবে না এই সম্পর্কে। ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে এই কমন কথা খাটে না। কারণ, একজন যদি নিজের ইচ্ছায় ভ্যাক্সিন না নেয়, তাহলে পুরা কমুনিটির জন্যই সে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তার একার কারণেই অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে ওই রোগটা। একারণে সবার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে ভ্যাক্সিন নেওয়ার আইন করার কথা উঠেছে আমেরিকায়। এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক প্রতিবাদ হচ্ছে।
আপনি কি মনে করেন? ভ্যাক্সিন যার যার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত? যার ইচ্ছা হয় সে নিবে, যার ইচ্ছা হয় না সে নিবে না? নাকি রাষ্ট্রীয় আইন করে দেওয়া উচিত যে সবাইকেই বাধ্যতামূলকভাবে ভ্যাক্সিন নিতে হবে?
একটা পেপারে অল্প ডাটা দিয়ে, ভুলভাল মনগড়া লিখেই পিয়ার রিভিউড হয় কিভাবে?
এরকম হলে তো মানুষ পিয়ার রিভিউড জার্নালের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে!
করোনাভ্যাকসিন তৈরিতে গরুর রক্ত ব্যবহার করা হয়েছে: স্বামী চক্রপানি
https://www.uttarbangasambad.com/corona-vaccine-contains-cows-blood-chakrapani-controversial-remark-member-hindu-mahasabha.html
ভ্যাকসিনে গোরক্ত! ধর্মের ক্ষতি হতে দেব না! বিতর্কের মুখে হিন্দু মহাসভার স্বামী চক্রপানি
https://bengali.abplive.com/news/corona-vaccine-contains-cows-blood-chakrapani-controversial-remark-member-hindu-mahasabha-775964