১৯০৫ সালে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ্যলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র প্রতিপাদন করেন। তাত্ত্বিকভাবে তখন থেকেই পারমাণবিক শক্তির যাত্রা শুরু। বস্তু বা পদার্থ এবং শক্তি যে দুটি ভিন্ন রূপ এবং পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায় এই সূত্রের সাহায্যেই তা প্রথম প্রমাণিত হয়।
পারমাণবিক শক্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটিই হল তাঁর পরিমাণ। অতি অল্প পরিমাণ বস্তু থেকে বিপুল পরিমাণে শক্তি আহরণ করা যায় যেটি অচিন্তনীয় ছিল তখনকার সময়ে। এই শক্তির ব্যবহারে পারমাণবিক চুল্লী মানব সভ্যতা বিকাশে অবদান রাখছে প্রায় অফুরন্ত শক্তি ভাণ্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে; একই সাথে পারমাণবিক অস্ত্র মানব সভ্যতা বিলীন হয়ে যাবার মত ভয়াবহতার হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রথম পর্বে পারমাণবিক শক্তির সাধারণ ধারণা, পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা, পারমাণবিক বিক্রিয়া, এবং পারমাণবিক শক্তি উৎস হিসেবে পরিচিত অধিক ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হচ্ছে।
পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা
উনবিংশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতকের শুরু এই সময়ে যখন ‘শিল্প বিপ্লব’ হলো, তখন প্রায় হঠাৎ করেই শক্তির প্রয়োজনীয়তা হয়ে উঠল আকাশচুম্বী। শিল্প কারখানার দ্রুত উন্নয়ন ও কারখানার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে দেখা দিল প্রচুর শক্তির প্রয়োজনীয়তা। যেখানে শিল্প বিপ্লবের আগে মানব সভ্যতায় প্রাকৃতিক এবং নবায়নযোগ্য শক্তি কাজে লাগালেই চলতো, সেখানে শক্তির প্রয়োজনীয়তায় উদ্ভাবিত হল একের পর এক কয়লা, তেল, গ্যাস, ইত্যাদি খনিজ শক্তির উৎস।
বর্তমান পৃথিবীতে যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন হচ্ছে এবং এর জন্য যে হারে জীবাশ্ম জ্বালানি কাজে লাগানো হচ্ছে তাতে মনে করা হচ্ছে ভূগর্ভে সঞ্চিত উত্তোলনযোগ্য জীবাশ্ম জ্বালানি এই শতকেই শেষ হয়ে যাবে। এতে দেখা দেবে তীব্র জ্বালানি ও শক্তি সঙ্কট। এই সঙ্কট কাটাতে দুটি উত্তম শক্তির উৎসের দিকে নজর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
১. পারমাণবিক শক্তি
২. প্রাকৃতিক ও নবায়নযোগ্য শক্তি
পারমাণবিক শক্তির উন্নত ও ধ্বংসাত্মক উভয় দিক নিয়েই এই নিবন্ধ।
আইনস্টাইনের ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র
তাত্ত্বিক বিজ্ঞান বলে এখানে আমি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের গণিত দিয়ে বিশ্লেষণে যাব না। প্রাথমিক স্তরের যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ এর ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবো।
আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্রটি হল E = MC2
এখানে,
E = Energy বা মোট শক্তির পরিমাণ
M = Mass বা মোট যে ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে
C = আলোর গতি, যা সর্বদা, সর্বাবস্থায়েই ধ্রুবক, 3×108 m/s বা তিন লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডে বা ৩০,০০,০০,০০০ মিটার প্রতি সেকেন্ড
তাহলে ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে কোন বস্তু যখন শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, শক্তির পরিমাণ হয়ে দাঁড়ায় ভরের সাথে আলোর গতির বর্গের গুণফলের সমান!
অর্থাৎ ভরের সাথে যে সংখ্যাটা গুণ হচ্ছে তা হল “৯০০০০০০০০০০০০০০০০” কথায় লিখলে হবে “নব্বই কোটি কোটি”। তাহলে ভর অতি ক্ষুদ্র হলেও যখন তাঁর সাথে এত বড় একটা সংখ্যা গুণ হয়ে যায় তখন আর তা অল্প থাকে না। ভর থেকে শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে অতি অতি অল্প পদার্থকেও যদি শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয় সেখান থেকে পাওয়া যায় অকল্পনীয় পরিমাণে শক্তি। তাই বর্তমানে যখন জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্কট এবং জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ শেষ হবার আশংকা তখন শক্তির সঙ্কট নিরসনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার।
এইতো গেল কিভাবে অতি অল্প ভর থেকে বিপুল শক্তি পাওয়া যেতে পারে তাঁর গাণিতিক ধারণা। এখন দেখার চেষ্টা করা যাক ঠিক কী প্রক্রিয়ায় ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব।
পারমাণবিক বিক্রিয়া – ফিশন ও ফিউশন (Fission & Fusion)
ফিশন বিক্রিয়া (Fission Reaction)
মূলত ভারী মৌল ভেঙ্গে হালকা মৌলে পরিণত হবার প্রক্রিয়াকেই ফিশন বিক্রিয়া বলা হয়।
কোনো ভারী মৌলের নিউক্লিয়াসে যদি নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হয় তখন সেটি উত্তেজিত হয়ে ভেঙ্গে দুটি তুলনামূলক হালকা মৌলে পরিণত হয়। এসময় কিছু নিউট্রন বিচ্ছিন্নভাবে নির্গত হয়। দেখা যায় প্রাথমিক ভারী মৌলের পরমাণুর ভর অপেক্ষা নতুন সৃষ্ট দুটি মৌলের পরমাণু ও অতিরিক্ত নিউট্রনের ভরের যোগফল কিছুটা কম। অর্থাৎ ভারী মৌল ভেঙ্গে হালকা মৌলে পরিণত হবার সময় কিছুটা ভর হারায়। এই হারানো ভরই ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র অনুযায়ী শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, তাপ ইত্যাদি রুপে ছড়িয়ে পরে।
এই পদ্ধতিকে কেন্দ্র করেই ইউরেনিয়ামের মত ভারী ধাতব কে কাজে লাগিয়ে পারমাণবিক চুল্লীতে (Nuclear Reactor) শক্তি সংগ্রহ করা হয়।
উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক –
n + U235 → Ba144 + Kr89 + 3n
(এখানে সুপারস্ক্রিপ্ট সংখ্যাগুলো মৌলের ভর সংখ্যা অর্থাৎ প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা নির্দেশ করছে)
এই বিক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম২৩৫ কে নিউট্রন দ্বারা উত্তেজিত করার ফলে বেরিয়াম১৪৪ এবং ক্রিপটন৮৯ এই দুটি তুলনামূলক হালকা মৌল তৈরি হল। এই বিক্রিয়ায় বাইরে থেকে একটি নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হচ্ছে এবং বিক্রিয়া শেষে দুটি হালকা মৌল তৈরি হবার পরেও তিনটি অতিরিক্ত নিউট্রন এবং কিছুটা শক্তি পাওয়া যাচ্ছে।
শৃঙ্খল বিক্রিয়া বা চেইন রি-এ্যাকশান (Chain Reaction)
এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে একটি পরমাণুতে একটি নিউট্রন দিয়ে আঘাত করা হলে বিক্রিয়া শেষে তিনটি মুক্ত নিউট্রন থেকে যাচ্ছে। এই নিউট্রনগুলো কি করছে? সেগুলো তাঁর গতিশক্তির কারণে পার্শ্ববর্তী পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আঘাত করছে অর্থাৎ আরো তিনটি পরমাণুতে একই বিক্রিয়া ঘটছে। সেখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৯টি নিউট্রন। এভাবে একবার পারমাণবিক বিক্রিয়া শুরু করে দেয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা চলছে এবং বর্গীয় অনুপাতে পরমাণু ভাঙছে ও শক্তি নির্গমনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা ঘটছে অতীব দ্রুত।
এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া বা চেইন রিএ্যাকশান। এই Chain Reaction এর উপর ভিত্তি করেই গঠিত Nuclear Reactor সমূহ।
ফিউশন বিক্রিয়া (Fusion Reaction)
ফিউশন বিক্রিয়া মূলত ফিশন বিক্রিয়ার ঠিক উল্টো প্রক্রিয়া। এক কথায় বললে, ফিশনে ভারী মৌল ভেঙ্গে একাধিক হাল্কা মৌল তৈরি করে আর ফিউশনে একাধিক হাল্কা মৌল মিলিত হয়ে তৈরি করে তুলনামূলক ভারী মৌল।
সাধারণত দুটি হালকা ভিন্ন মৌল বা একই মৌলের একাধিক পরমাণু বা একই মৌলের একাধিক আইসোটোপ মিলিত হয়ে তুলনামূলক ভারী মৌল গঠন করে এবং ফিশন বিক্রিয়ার মতই কিছুটা ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই পারমাণবিক বিক্রিয়াকেই বলা হয় ফিউশন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়া প্রধানত সূর্য সহ অন্যান্য নক্ষত্রে ঘটে থাকে। নক্ষত্রে তাপ-পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম, হিলিয়াম থেকে কার্বন, এবং কার্বন থেকে লোহা পর্যন্ত উৎপন্ন হয় নক্ষত্রের আকার ও ভরের উপর নির্ভর করে।
হাইড্রোজেনের প্রধানত তিন ধরনের আইসোটোপ বেশি দেখা যায় প্রোটিয়াম, ডিউটেরিয়াম, এবং ট্রিটিয়াম।
নক্ষত্রে ফিউশন বিক্রিয়ায় ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম মিলিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে এবং সাথে পাওয়া যায় আইনস্টাইনের ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র অনুসারে কিছু শক্তি ও একটি বিচ্ছিন্ন নিউট্রন। আমাদের সৌরজগতের নক্ষত্র সূর্যের কেন্দ্রে ঠিক এই বিক্রিয়াটিই ঘটছে এবং সেই ফিউশন বিক্রিয়া থেকে উৎপন্ন পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করেই পৃথিবীতে প্রাণের টিকে থাকা। সূর্যে ঘটা তাপ-পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়াটি এভাবে প্রকাশ করা হয় –
H2 + H3 → He4 + n
পারমাণবিক শক্তির উৎস – তেজস্ক্রিয় পদার্থ
ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনের জন্য বিক্রিয়া শুরু হতে যে উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় (প্রায় ১ কোটি কেলভিন!) তা নক্ষত্রের কেন্দ্র ব্যতীত অন্য কোথাও তৈরি হওয়া সম্ভব হয় না, ফলে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ফিউশন বিক্রিয়া ব্যবহার উপযোগী নয়। তাই ফিশন বিক্রিয়া ও চেইন রিএকশন কে কাজে লাগিয়ে নিউক্লিয়ার রিএ্যাক্টরে শক্তি উৎপাদন করা হয় এবং এজন্য ফিশন বিক্রিয়া সংঘটনের জন্য উপযোগী তেজস্ক্রিয় ও ভারী মৌল সমূহ পারমাণবিক শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
এ ধরনের পদার্থকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।
১. ফিসাইল (Fissile Material) :
যে সকল মৌল বা আইসোটোপ গতিশক্তিহীন সাধারণ নিউট্রনের সংস্পর্শে আসলেই ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত হয় তাদের Fissile Material বলা হয়। যেমন ইউরেনিয়াম২৩৫ (U235), ইউরেনিয়াম২৩৩ (U233), প্লুটোনিয়াম২৩৯ (Pu239) ইত্যাদি।
২. ফিশনেবল (Fissionable Material) :
যে সকল মৌল বা আইসোটোপ এর ফিশন সাধারণ নিউট্রনের সংস্পর্শে সংঘটিত না হলেও উচ্চ গতিশক্তি সম্পন্ন নিউট্রনের আঘাতে শুরু হয় তাদেরকে এই ধারার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সকল Fissile Material কেও এর অন্তর্ভূক্ত ধরা হয়ে থাকে। যেমনঃ ইউরেনিয়াম২৩৮ (U238), প্লুটোনিয়াম২৪০ (Pu240) ইত্যাদি।
৩. ফার্টাইল (Fertile Material)
শক্তি আহরণ এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালনা উভয় ক্ষেত্রেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌল গুলো হল Fertile Material. বেশ কিছু তেজস্ক্রিয় মৌল প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, সেগুলো কোন আরো ভারী মৌলের বিশেষ পারমাণবিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়। এই ‘আরো ভারী মৌল’ সমূহকেই বলা হয় Fertile Material.
যেমনঃ দুটি Fertile Materiel থোরিয়াম২৩২ (Th232) এবং ইউরেনিয়াম২৩৮ (U238) থেকে পাওয়া যায় যথাক্রমে দুটি Fissionable Material ইউরেনিয়াম২৩৩ (U233), প্লুটোনিয়াম২৩৯ (Pu239)।
কিছু বিশেষভাবে তৈরি পারমাণবিক চুল্লিতে fertile material ব্যবহার করা হলে ব্যবহৃত জ্বালানি আরেকটি Fissionable Material এ পরিণত হয় যেটিকে পুনরায় সাধারণ পারমাণবিক চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে দ্বিতীয়বার শক্তি সংগ্রহ করা যায়।
এই হচ্ছে সংক্ষেপে পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা। পরবর্তী পর্বসমূহে যথাক্রমে পারমাণবিক শক্তির গঠনমূলক ব্যবহার পারমাণবিক চুল্লি এবং সভ্যতার অগ্রগতিতে শক্তির যোগানদাতা হিসাবে পারমাণবিক শক্তির ভূমিকা এবং তারপর ধ্বংসাত্মক ব্যবহার; পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার কেমন করে মানব সভ্যতা, প্রকৃতপক্ষে মানব জাতি এবং প্রায় পুরো পৃথিবীর অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয় তা নিয়ে বিস্তারিত থাকবে।
তথ্যসূত্রঃ –
১. Nuclear Energy: Principles, Practices And Prospects_Second Edition by David Bodansky (Book)
২. http://www.atomicarchive.com/
৩. http://www.bbc.co.uk/
৪. The University of Arizona
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি পোস্ট। ধন্যবাদ। 🙂