১৯০৫ সালে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ্যলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র প্রতিপাদন করেন। তাত্ত্বিকভাবে তখন থেকেই পারমাণবিক শক্তির যাত্রা শুরু। বস্তু বা পদার্থ এবং শক্তি যে দুটি ভিন্ন রূপ এবং পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায় এই সূত্রের সাহায্যেই তা প্রথম প্রমাণিত হয়। পারমাণবিক শক্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটিই হল তাঁর পরিমাণ। অতি অল্প পরিমাণ বস্তু থেকে বিপুল পরিমাণে শক্তি আহরণ করা যায় যেটি অচিন্তনীয় ছিল তখনকার সময়ে। এই শক্তির ব্যবহারে পারমাণবিক চুল্লি মানব সভ্যতা বিকাশে অবদান রাখছে প্রায় অফুরন্ত শক্তি ভাণ্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে; একই সাথে পারমাণবিক অস্ত্র মানব সভ্যতা বিলীন হয়ে যাবার মত ভয়াবহতার হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রথম পর্বে পারমাণবিক শক্তির সাধারণ ধারণা, পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা, পারমাণবিক বিক্রিয়া এবং পারমাণবিক শক্তি উৎস হিসেবে পরিচিত অধিক ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের বিষয়বস্তু হল সভ্যতার অগ্রগতিতে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার, পারমাণবিক শক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পারমাণবিক চুল্লি (Nuclear Reactor).
পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন হয় প্রচুর শক্তি। এই শক্তির বেশিরভাগ অংশ তাপ এবং বাকিটা রেডিয়েশন আকারে পাওয়া যায়। ফিশন বিক্রিয়ার চেইন রিএ্যাকশনকে যদি নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ঘটানো যায় এবং সেখান থেকে উৎপন্ন তাপকে যদি অন্য ব্যবহার্য শক্তিতে রূপান্তর করা যায় তাহলেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার্য রূপান্তর পেয়ে যাই। সামষ্টিকভাবে এই ঘটনাগুলোই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঘটানো হয় এবং পারমাণবিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করা হয়।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূলনীতি
- পারমাণবিক চুল্লিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ফিশন (ভাঙন) বিক্রিয়া ও চেইন রিএ্যাকশন (শেকল বিক্রিয়া) সংঘটিত করা হয়। এতে প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। (শক্তির রূপান্তরঃ পারমাণবিক শক্তি → তাপ শক্তি)
- এই তাপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পানিকে বাষ্পে (Steam) পরিণত করা হয়। (শক্তির রূপান্তরঃ তাপ শক্তি → বিভব শক্তি, Potential Energy )
- উচ্চচাপে এই স্টিম চালনা করা হয় টার্বাইনে। উচ্চচাপের স্টিম, টার্বাইনকে ঘোরায়। (শক্তির রূপান্তরঃ বিভব শক্তি → গতি শক্তি → যান্ত্রিক শক্তি)
- টার্বাইন ঘোরায় জেনারেটরের রোটরকে। যা থেকে জেনারেটরে উৎপন্ন হয় কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ শক্তি। (শক্তির রূপান্তরঃ যান্ত্রিক শক্তি → বিদ্যুৎ শক্তি)
এভাবেই কয়েকধাপে শক্তির রূপান্তরের সম্মিলিত ফলাফলে পারমাণবিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
পারমাণবিক চুল্লি (Nuclear Reactor)
শুনতে একইরকম শোনালেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পারমাণবিক চুল্লি এক নয়। পারমাণবিক চুল্লি হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি অংশ। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান অংশ হচ্ছে এই চুল্লি বা Reactor. বৃহৎ পরিসরে উচ্চক্ষমতার পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে প্রধানত Light Water Reactor (LWR) ব্যবহৃত হয়। ফিশন বিক্রিয়ার উৎপাদিত তাপশক্তি আহরণ করে পানিকে বাষ্পে পরিণত করার পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে LWR কে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।
১. Boiling Water Reactor (BWR)
২. Pressurized Water Reactor (PWR)
Boiling Water Reactor (BWR)
এতে পানিকে সরাসরি চুল্লিতে প্রবেশ করানো হয়। চুল্লিতে উৎপাদিত তাপশক্তি পানিকে বাষ্পে পরিণত করে। সেই বাষ্প টার্বাইনে চালনা করা হয়। টার্বাইন থেকে বেরিয়ে আসা তুলনামূলক ঠাণ্ডা বাষ্পকে কনডেনসার বা শীতকের ভেতর দিয়ে নিয়ে পানিতে পরিণত করে আবার চুল্লিতে প্রবেশ করানো হয়।
এই পদ্ধতিটি পুরনো পদ্ধতি। এতে চুল্লির তেজস্ক্রিয় পদার্থ ও বিকিরণ থেকে পানিতে, এবং পানি থেকে টার্বাইন ও কুলিং সিস্টেমের মধ্য দিয়ে তেজস্ক্রিয়তা বাইরে তুলনামূলক বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পরার সুযোগ থাকে। তাই বর্তমানে তৈরি বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না।
Pressurized Water Reactor (PWR)
এই পদ্ধতিতে চুল্লির পারমাণবিক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন তাপশক্তি সংগ্রহ করে উচ্চচাপে থাকা পানি। এই পানি বাষ্পে পরিণত হয় না এবং উচ্চচাপে থাকার কারণে পানির সাধারণ স্ফুটনাংকের (100° C) চেয়ে অনেক বেশি তাপমাত্রায় তাপশক্তি ধরে রাখে। এই উচ্চচাপের উত্তপ্ত পানি একটি স্টিম জেনারেটরে অপর সাইকেলে থাকা পানিকে বাষ্পে পরিণত করে। স্টিম জেনারেটরে তাপ হারিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে উচ্চচাপের পানি পুনরায় চুল্লিতে ফেরত যায় এবং শক্তি সংগ্রহ করে।
অপরদিকে স্টিম জেনারেটর থেকে যে বাষ্প উৎপন্ন হয় সেটি টারবাইনে চালনা করা হয়, এবং একটি কনডেনসার বা শীতকের ভেতর দিয়ে পানিতে পরিণত করে আবার স্টিম জেনারেটরে পাঠানো হয়। এই পদ্ধতিতে চুল্লি থেকে সরাসরি তাপ সংগ্রহকারী উচ্চচাপের পানি এবং টারবাইনে চালিত স্টিম এই দুটি পানির ধারার মধ্যে স্টিম জেনারেটরে প্রতিনিয়ত তাপের আদান-প্রদান ঘটলেও কখনোই এরা মিশ্রিত হয় না। ফলে তেজস্ক্রিয়তা চুল্লির বাইরে তেমন ছড়ায় না। বর্তমানে PWR চুল্লিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
(PWR) পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গঠন ও কার্যপ্রণালী
Containment Building
পারমাণবিক চুল্লি ও স্টিম জেনারেটর মিলিয়ে পুরো অংশকে একত্রে সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়। একে Containment Structure অথবা Containment Building বলা হয়। এখানে তেজস্ক্রিয় পদার্থে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত হয় ও বিক্রিয়ায় উৎপন্ন তাপের সাহায্যে বাষ্প তৈরি করা হয়। এটি একইসাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সংবেদনশীল, সুরক্ষিত, ও ঝুঁকিপূর্ণ অংশ। এখানে কার্যক্রমের সামান্যতম হেরফের বা ত্রুটিতেই ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। তাই এটিকেই সবচেয়ে বেশি তত্ত্বাবধানে ও নিরাপত্তায় রাখা হয়। এর দেয়াল প্রায় ১-১.৫ মিটার বা প্রায় ৩-৫ ফুট পুরু হয়ে থাকে। দেয়াল কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে তৈরি করা হয়। দেয়ালের ভেতরে Containment Structure কে ঠাণ্ডা করার জন্য কুলিং সিস্টেম থাকে। Containment Building এর ইনপুটে থাকে ফিড পাম্পের পানি এবং আউটপুটে থাকে স্টিম। Containment Building এর ভেতরে থাকে দুটি প্রধান অংশ – Reactor Pressure Vessel এবং Steam Generator
Reactor Pressure Vessel
এটিই মূলত পারমাণবিক বিক্রিয়া সংঘটন স্থল। এখানে ‘ফুয়েল রড’ থাকে যাতে ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। ফিশন বিক্রিয়ার চেইন রিএ্যাকশনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখানে ‘কন্ট্রোল রড’ ব্যবহার করা হয়। সাধারণত বোরন অথবা ক্যাডমিয়াম যৌগের দণ্ড ‘কন্ট্রোল রড’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এসব যৌগের দণ্ড নিউট্রন শোষণ করে চেইন রিএ্যকশনের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখে। আবার নিউট্রনের পরিমাণ বেশি কমে গেলে যাতে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি না হয় সেজন্য ‘নিউট্রন রিফ্লেক্টর’ থাকে যা প্রয়োজনে বিক্রিয়া অঞ্চল ছেড়ে দূরে সরে আসা নিউট্রনকে ‘ধাক্কা’ দিয়ে আবার বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে ফেরত পাঠায়। Reactor Vessel এর চারপাশে উচ্চচাপের পানি প্রবাহিত হতে থাকে যা পারমাণবিক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন তাপ শোষণ করে ‘ভেসেল কোর’ কে ঠাণ্ডা করে এবং এই তাপশক্তি সংগ্রহ করে নিয়ে যায় স্টিম জেনারেটরে।
Steam Generator
রিএ্যাক্টর ভেসেল থেকে তাপ নিয়ে আসা উচ্চচাপে থাকা উত্তপ্ত পানি এখানে তাপ হারিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে আবার ভেসেলে ফিরে যায় কুল্যান্ট হিসাবে। আর এই নিঃসরিত তাপ স্টিম সাইকেলের পানিকে বাষ্পে পরিণত করে। এই বাষ্প উচ্চচাপে প্রেরণ করা হয় টার্বাইনে। টার্বাইন ঘোরানোর পরে এই বাষ্পকে একটি কনডেনসার বা শীতক প্রকোষ্ঠের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে পানিতে পরিণত করে ‘ফিড পাম্প’ এর সাহায্যে আবার স্টিম জেনারেটরে প্রেরণ করা হয়।
Turbine & Generator
এক্ষেত্রে যেহেতু বাষ্প কাজে লাগানো হচ্ছে তাই এখানে ব্যবহৃত হয় উপযুক্ত Steam Turbine. এই Steam Turbine ঘূর্ণনের সাথে সাথে জেনারেটরের রোটরকে ঘোরায়। ফলে জেনারেটরে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন হয়।
Internal Sub-Power Plant
সাধারণত পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ছোট পরিসরে আরেকটি ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থাকে। এর কাজ হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট অংশের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, পাম্প ইত্যাদিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা।
যে কোন দুর্ঘটনায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলেও যাতে কুলিং সিস্টেম, পানির পাম্প ও অন্যান্য জরুরী যন্ত্রপাতি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা অকেজো হয়ে না পরে তার জন্য এগুলোতে ঐ পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ কাজে না লাগিয়ে আলাদা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়।
পারমাণবিক দুর্ঘটনা
যখন রিএ্যাক্টরে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত হয়, তখন অনিয়ন্ত্রিত বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন হয় অত্যধিক তাপ। এই তাপ যখন কুলিং সিস্টেমের সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যায় তখন দুটো ঘটনা ঘটতে পারে।
১. রিএ্যাক্টরে ফুয়েল রড অর্থাৎ ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম দণ্ড গলে যায়।
২. অতিরিক্ত তাপে কুলিং সিস্টেমের উচ্চচাপের পানি যা কখনো বাষ্প হবার কথা না সেটি কুলিং ভেসেলের ভেতরে বাষ্প হয়ে যায়; কখনো অতি উচ্চতাপে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনে বিভক্ত হয় পরতে পারে যা অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবে দুর্ঘটনা কবলিত হলে যদি বিস্ফোরণের ফলে Containment Building ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ফুয়েল বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে আসে তবে তা থেকে ছড়িয়ে পরে প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয়তা ও তেজস্ক্রিয় কণা যা আশেপাশের সামগ্রিক পরিবেশে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র খুবই সংবেদনশীল হওয়ায় এর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও কঠোর।
- রিএ্যাক্টর ভেসেল এবং অন্যান্য উত্তপ্ত অংশে অতিরিক্ত ইমার্জেন্সী কুলিং সিস্টেম সংযুক্ত থাকে যা আপদকালীন সময়ে দুর্ঘটনা হতে রক্ষা করে।
- বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বৈদ্যুতিক কার্যক্রম বিশেষ করে চুল্লি ও সংশ্লিষ্ট অংশের পাম্প, কুলিং সিস্টেম ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় প্ল্যান্টের নিজস্ব আলাদা ডিজেল জেনারেটরের সাহায্যে। এতে দুর্যোগের সময় পারমাণবিক চুল্লি বন্ধ হয়ে গেলেও নিরাপত্তা অংশ সক্রিয় থাকে।
- তেজস্ক্রিয় জ্বালানী যথেষ্ট সতর্কতার সাথে পরিবহন ও ব্যবহার করা হয় যাতে Containment Building এর বাইরে ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ না ছড়ায়।
- পারমাণবিক শক্তির উৎস এসব তেজস্ক্রিয় মৌল খুবই মূল্যবান এবং একই সাথে বিপজ্জনক হওয়ায়; চুরি, ডাকাতি বা অন্য উপায়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে যাতে না পরে সেজন্য অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সশস্ত্র প্রতিরক্ষা বাহিনী নিয়োজিত থাকে এবং নিয়মিত মহড়ার মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রাখা হয়।
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (Radioactive Waste Management)
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত জ্বালানী, চুল্লির আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ, ফিল্টার, মেশিন টুলস, সুরক্ষামুলক পোশাক ইত্যাদি ব্যবহারের পরে তেজস্ক্রিয় দূষণে দূষিত থাকে এবং এগুলো থেকেও বিভিন্ন মাত্রায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নির্গত হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এ ধরনের বর্জ্য পদার্থকে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য বলা হয়। যেহেতু তেজস্ক্রিয় বিকিরণ খুবই ক্ষতিকর তাই এধরনের বর্জ্যও খুব সতর্কতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রধানত তিন ধরনের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয়।
1. High-level waste (HLW)
2. Low-level waste (LLW)
3. Transuranic waste (TRU) / Intermediate Level Waste
High-level waste (HLW)
সবচেয়ে বেশি মাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিঃসরণকারী বর্জ্য গুলোকে এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করা হয়। এই বর্জ্যগুলো সবচেয়ে বিপদজনক হয়ে থাকে। সাধারণত পারমাণবিক চুল্লির ব্যবহৃত/পোড়া জ্বালানীকেই এই শ্রেণীর বর্জ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। এই বর্জ্যগুলোকে কোনোভাবেই পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করে তেজস্ক্রিয়তা দূর করা যায় না। হাজার হাজার বছরের বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষয় হয়ে এগুলোর তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা হ্রাস পায়। তাই এগুলোকে মনুষ্য বসতি থেকে অনেক দূরে মাটির নিচে শক্তিশালী প্রতিরোধক কন্টেইনারের ভেতর রেখে দেয়া হয়। বিভিন্ন দেশ তাদের এই বর্জ্য সুবিধাজনক স্থানে Dispose করে থাকে। তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের Permanent Disposal Plant গুলোকে Repository বলা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম হল Yucca Mountain Nuclear Waste Repository.
Low-level waste (LLW)
সবচেয়ে কম মাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিঃসরণকারী বর্জ্য গুলোই হল Low-level waste. বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন চলাকালে High-level waste দ্বারা দূষিত পারিপার্শ্বিক বস্তুগুলো যেগুলো বহুদিন ব্যবহারের ফলে খানিকটা তেজস্ক্রিয় উপাদানের মত আচরণ করে সেগুলো এই শ্রেণীর বর্জ্যের অন্তর্গত। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়োজিত কর্মীদের নিরাপত্তামূলক পোশাক, জুতা, গ্লোভস, কাপড়-চোপড়; পানি শোধনাগারের যন্ত্রপাতি, অন্যান্য যন্ত্র, চুল্লির কাছাকাছি থাকা যন্ত্রপাতি ইত্যাদি এ ধরনের বর্জ্যের উদাহরণ। এই বর্জ্য High-level waste এর মত মারাত্মক না হলেও Background Radiation Level এর চেয়ে বেশি মাত্রার বিকিরণ নিঃসরণ করে।
এই বর্জ্যগুলো সাধারণত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরেই নির্ধারিত স্থানে নিরাপদভাবে সংরক্ষণ করা হয় যতদিন না এগুলো বিকিরণ নিঃসরণ করে এদের তেজস্ক্রিয়তা Background Radiation Level এ নেমে আসে। তেজস্ক্রিয়তা Background Radiation Level এ নেমে আসলে এগুলোকে অন্য সাধারণ আবর্জনার মত ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা যায়, সম্ভব হলে রিসাইকেল করা যায় অথবা অনেক বেশি পরিমাণে হলে কোন “Low level Waste Disposal Plant” এ পাঠিয়ে দেয়া হয়।
Intermediate-level waste
যে সকল বর্জ্য High Level এবং Low Level Waste এর মাঝামাঝি পর্যায়ের তেজস্ক্রিয় দূষক সেগুলোকে এই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এগুলো High-level waste এর মত ততটা নিরাপত্তার সাথে Dispose করা না হলেও Low-level waste এর চেয়ে বেশি সতর্কতার সাথে বিশেষ কন্টেইনারে আবদ্ধ করে মাটির নিচে পুতে রাখা হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা
সুবিধা
১. খুবই অল্প জ্বালানী ব্যবহারে প্রচুর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়।
২. অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তুলনামূলক কম যায়গায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যায়।
৩. বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরিবেশ দূষণ হয় না বললেই চলে।
৪. জীবাশ্ম জ্বালানী ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে পরিবেশ দূষণকারী গ্যাস নির্গত হয় তা এখানে নেই। এখানে একটি তথ্য দেয়া যেতে পারে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিশাল বিশাল চিমনী দিয়ে যে ধোঁয়া নির্গত হয় তা শুধুই জলীয় বাষ্প বা স্টিম। এতে তেজস্ক্রিয়তাও প্রায় থাকেই না। সুতরাং এটি অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানী ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব।
অসুবিধা
১. প্রথম ও প্রধান অসুবিধাই হচ্ছে খুবই সংবেদনশীল ও অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় জ্বালানী ব্যবহার করতে হয়।
২. বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডিজাইন থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ পর্যন্ত খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ এতে সামান্য ত্রুটিতেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে মিনিটের মধ্যে; যে ত্রুটি তাৎক্ষণিকভাবে মেরামত করা সম্ভব নাও হতে পারে।
৩. প্রাথমিক স্থাপনা ও জ্বালানী খরচ তুলনামূলক বেশি। তবে এককালীন খরচ করে স্থাপনের পর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা বাদে বহু বছর জ্বালানী খরচ হয় না।
৪. তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (Radioactive Waste Management) ঝুঁকিপূর্ণ এবং সংবেদনশীল।
৫. দুর্ঘটনা ঘটলে পরিবেশ এবং আশেপাশের জীব জগতে মারাত্মক প্রভাব পরে। দুর্ঘটনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী ও সুদূরপ্রসারী।
৬. এটাই একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র যার রাজনৈতিক প্রভাব, উদ্দেশ্য, এবং ব্যবহার রয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আড়ালে কোনো রাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তিধর হচ্ছে কিনা, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্য ইউরেনিয়াম/প্লুটোনিয়াম যোগাড় করছে কিনা তা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বর্তমানে বড় একটি মাথাব্যথার কারণ।
এই হচ্ছে সামগ্রিকভাবে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার যা মানবসভ্যতার অদূর ভবিষ্যতের জীবাশ্ম জ্বালানী ভিত্তিক শক্তির উৎসের অপ্রতুলতার চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে সক্ষম। পরবর্তী পর্বে থাকবে পারমাণবিক শক্তির ধ্বংসাত্মক রূপ; পারমাণবিক বোমা ও পরমাণু অস্ত্র, যেগুলো আসলে শুধু মানবসভ্যতার জন্যই না পুরো পৃথিবীর জীবজগতের অস্তিত্বের জন্যও হুমকি স্বরূপ।
তথ্যসূত্রঃ –
১. Nuclear Energy: Principles, Practices And Prospects – Second Edition by David Bodansky (Book)
২. United States Nuclear Regulatory Commission
৩. Nuclear Energy Institute
৪. World Nuclear Association