১৯০৫ সালে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ্যলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র প্রতিপাদন করেন। তাত্ত্বিকভাবে তখন থেকেই পারমাণবিক শক্তির যাত্রা শুরু। বস্তু বা পদার্থ এবং শক্তি যে দুটি ভিন্ন রূপ এবং পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায় এই সূত্রের সাহায্যেই তা প্রথম প্রমাণিত হয়। পারমাণবিক শক্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটিই হল তাঁর পরিমাণ। অতি অল্প পরিমাণ বস্তু থেকে বিপুল পরিমাণে শক্তি আহরণ করা যায় যেটি অচিন্তনীয় ছিল তখনকার সময়ে। এই শক্তির ব্যবহারে পারমাণবিক চুল্লি মানব সভ্যতা বিকাশে অবদান রাখছে প্রায় অফুরন্ত শক্তি ভাণ্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে; একই সাথে পারমাণবিক অস্ত্র মানব সভ্যতা বিলীন হয়ে যাবার মত ভয়াবহতার হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এই সিরিজের প্রথম পর্বে পারমানবিক শক্তির সাধারণ ধারণা, পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা, পারমাণবিক বিক্রিয়া এবং পারমাণবিক শক্তি উৎস হিসেবে পরিচিত অধিক ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের বিষয়বস্তু ছিল সভ্যতার অগ্রগতিতে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার, পারমাণবিক শক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পারমাণবিক চুল্লি (Nuclear Reactor). তৃতীয় পর্ব সাজানো হচ্ছে পারমাণবিক শক্তির সবচেয়ে অমানবিক এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যবহার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে; সংক্ষেপে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রকারভেদ, গঠন, ও কার্যপ্রণালী নিয়ে।
পারমাণবিক অস্ত্র কী?
WMD (Weapon of Mass Destruction) হচ্ছে এমন এক ধরনের অস্ত্র যা একটা বৃহৎ ভৌগলিক অংশে বৃহৎ জৈব, পরিবেশগত বা ধ্বংসাত্মক ক্ষতি সাধিত করতে সক্ষম। সাধারণত জৈব অস্ত্র, রাসায়নিক অস্ত্র এবং পারমাণবিক ও তেজস্ক্রিয় অস্ত্র এই ধরনের অস্ত্রের আওতাধীন। বলতে গেলে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারাত্মক ও শক্তিশালী হল পারমাণবিক অস্ত্র। জৈব অস্ত্রের প্রভাবে একটি বড়সড় ভৌগলিক এলাকার জীববৈচিত্র বিলুপ্ত হতে পারে, এমনকি সকল জীবের মৃত্যু ঘটতে পারে। রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগে জীববৈচিত্র সহ সেখানকার পরিবেশগত বড় ধরনের ক্ষতিকর পরিবর্তন ঘটতে পারে যাতে সেখানে বসবাস অনুপযুক্ত অবস্থা বিরাজ করতে পারে। এই দুটোই তুলনামূলক ধীর প্রক্রিয়া। প্রয়োগের পরে কিছু সময় লাগে কার্যকরী হতে ও ফলাফল পেতে। অপরদিকে পারমাণবিক অস্ত্র এককথায় বললে বিশাল এলাকায় এই দুটো ফলাফল সহ পুরো সভ্যতার বিলীন ঘটাতে সক্ষম কয়েক সেকেন্ডে। এমনকি এর রেশ থেকে যায় প্রজন্মের পর প্রজন্মে। পারমাণবিক অস্ত্র গুলো WMD, এগুলো বিস্ফোরক অস্ত্রের আওতাধীন এবং অচিন্তনীয় বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতেই ব্যবহার করা হয়। বোমা, মিসাইল ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে হতে পারে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ। আপাতত লেখা ও বোঝার সুবিধার্থে ‘পারমাণবিক বিস্ফোরক’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করছি।
পারমাণবিক চুল্লিতে পারমাণবিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করা হয়। পারমাণবিক বিক্রিয়া ও শৃঙ্খল বিক্রিয়া (চেইন রিএ্যাকশন)-কে কাজে লাগিয়ে যে পারমাণবিক শক্তি আহরণ করা হয়; একই পদ্ধতিতেই পারমাণবিক অস্ত্রেও শক্তি উৎপাদন করা হয় শুধু পার্থক্য হল পারমাণবিক চুল্লিতে এই বিক্রিয়া ও শক্তি উৎপাদন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় আর পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে এই শক্তি উৎপাদন ও বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয় বিস্ফোরণের মাত্রা অনুযায়ী।
প্রথম পর্বে আইনস্টাইনের ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র অংশে দেখানো হয়েছিল কিভাবে খুবই অল্প পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে প্রচুর পরিমাণে শক্তি পাওয়া যায় পারমাণবিক বিক্রিয়ায় যার বেশিরভাগই তাপশক্তি আকারে নির্গত হয়। এই অত্যধিক শক্তি যখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে নির্গত হয় তখন সেটাই হয়ে ওঠে ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক অস্ত্র। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে শুধু মাত্র পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া থেকেই শক্তি উৎপাদন করা হয়। প্রথম দিককার পারমাণবিক অস্ত্রের জন্যও শুধু ফিশন বিক্রিয়াই ব্যবহৃত হত। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষে বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্রে ফিউশন বিক্রিয়াও ব্যবহৃত হচ্ছে যা পূর্বের ফিশন ভিত্তিক অস্ত্রের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক।
পারমানবিক বিস্ফোরকের মূলনীতি
পারমাণবিক বিক্রিয়ক বিয়োজনযোগ্য পদার্থের (fissionable material) একটি বৈশিষ্ট্য হলো ক্রান্তীয় ভর (Critical Mass). ক্রান্তীয় ভর হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু পারিপার্শ্বিক অবস্থার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট ফিশনেবল ম্যাটারিয়ালের এমন একটি নূন্যতম ভর, যে ভরে পৌঁছালে তা শুরু হবার পর শৃঙ্খল বিক্রিয়া স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে পারে। নির্দিষ্ট ফিশনেবল ম্যাটেরিয়াল এর ক্রান্তীয় ভর যেসব বিষয়ের উপর নির্ভরশীল সেগুলোর মধ্যে রয়েছে আকার-আকৃতি, ঘনত্ব, বিশুদ্ধতা, পারিপার্শ্বিক নিউট্রন রিফ্লেক্টরের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি।
কোনো ফিশনেবল ম্যাটেরিয়ালের ভর যদি ক্রিটিক্যাল ভরের চেয়ে কম হয় (Sub critical Mass) তাহলে সেখানে চেইন রিএ্যাকশন স্থায়ী হবে না। যখনই সেখানে আরো ভর সংযুক্ত করে অর্থাৎ একাধিক সাব-ক্রিটিক্যাল ভরবিশিষ্ট মৌলের খণ্ড একত্র করা হবে তখনি সেখানে ভর ক্রিটিক্যাল ভরের চেয়ে বেশি হবে (Super critical mass) এবং চেইন রিএ্যাকশন স্থায়ী হবে ফলে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হবে যা বিস্ফোরক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
পারমাণবিক বিস্ফোরকে প্রধান ফিশন ফুয়েল হিসাবে ব্যবহৃত হয় তেজস্ক্রিয় মৌল ইউরেনিয়াম২৩৫ এবং প্লুটোনিয়াম২৩৯ । ছোট আকারের ও কম ধ্বংসাত্মক বিস্ফোরকের ক্ষেত্রে ইউরেনিয়াম২৩৫ এবং অধিক শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক বিস্ফোরকের জন্য প্লুটোনিয়াম২৩৯ ব্যবহৃত হয়।
পারমাণবিক বিস্ফোরকের প্রকারভেদ, গঠন ও কার্যপ্রণালী
সাব-ক্রিটিক্যাল ভর থেকে সুপার-ক্রিটিক্যাল ভরে নিয়ে আসার পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে পারমাণবিক ফিশন বিস্ফোরক (Nuclear Fission Explosive) দুই ভাগে বিভক্ত।
১. গান টাইপ (Gun Type) – হিরোশিমায় ব্যবহৃত Little Boy এ ধরনের বোমা
২. ইমপ্লোশন টাইপ (Implosion Type) – নাগাসাকিতে ব্যবহৃত Fat Man এ ধরনের বোমা
Gun Type Explosive
গান টাইপ পারমাণবিক বিস্ফোরক মূলত তুলনামূলক ছোট ও কম শক্তিশালী পারমাণবিক বিস্ফোরক। এটিতে সাব-ক্রিটিক্যাল ভরের একাধিক খণ্ড মিলে সুপার-ক্রিটিক্যাল ভরে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া তুলনামূলক ধীর। এজন্য এধরনের বিস্ফোরকে ইউরেনিয়াম২৩৫ ব্যবহৃত হয়, এখানে প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করা যায় না।
এধরনের পারমাণবিক বিস্ফোরকে একটি ব্যারেলের এক প্রান্তে Chain Reaction Initiator এর উপর বসানো থাকে সাব-ক্রিটিক্যাল ভরের ইউরেনিয়াম খণ্ড যা ডিস্ক বা ফাঁপা টিউব আকৃতির হতে পারে। এটা এক বা একাধিক ভাগে কিছুটা দূরে দূরে থাকতে পারে। একে ইউরেনিয়াম কোর বলা হয়। অপর প্রান্তে ডেটোনেটরের সামনে বসানো থাকে সাব-ক্রিটিক্যাল ভরের আরেক অংশ। এটিও এক বা একাধিক খণ্ডে থাকতে পারে। একে বলা হয় ইউরেনিয়াম বুলেট।
ইউরেনিয়াম কোর এবং বুলেটের সকল অংশ পৃথক পৃথক ভাবে ক্রিটিক্যাল ভরের চেয়ে কম ভর বিশিষ্ট হয় এবং এখানে চেইন রিএ্যাকশন স্থায়ী হয় না। যখনই এগুলো একত্রিত হয় তখন সেখানে ক্রিটিক্যাল ভরের চেয়ে অনেক বেশি ভর পাওয়া যায় যা চেইন রিএ্যাকশনের স্থায়িত্বের জন্য যথেষ্ট।
বিস্ফোরক যখন ডেটোনেট করা হয় তখন ডেটোনেটর এক্সপ্লোসিভ বিস্ফোরিত হয় এবং সেই প্রান্তের ইউরেনিয়াম বুলেটকে উচ্চগতিতে ব্যারেলের অপর প্রান্তে থাকা ইউরেনিয়াম কোরের দিকে ঠেলে দেয়। ইউরেনিয়াম বুলেট ও ইউরেনিয়াম কোর মিলিত হয়ে সুপার-ক্রিটিক্যাল ভরের ইউরেনিয়াম কোর তৈরি হয়। তখন কোরের সাথে থাকা Chain Reaction Initiator উক্ত কোরে নিউট্রন নিক্ষেপ করে চেইন রিএ্যাকশন শুরু করে দেয়। সুপার ক্রিটিক্যাল ভর বিশিষ্ট হওয়ায় শুরু হওয়া চেইন রিএ্যাকশন চলতে থাকে এবং বাড়তে থাকে। এই ইউরেনিয়াম কোর চারদিক থেকে নিউট্রন রিফ্লেক্টর দিয়ে ঘেরা থাকে। ফলে ফিশন থেকে সৃষ্ট নিউট্রন, রিফ্লেক্টরে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে ও চেইন রিএ্যাকশনে অংশ নেয় যাতে ফিশন আরো দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে। এই ফিশন চেইন রিএ্যাকশনের ফলে সৃষ্ট বিপুল শক্তি বিস্ফোরণের মাধ্যমে তাপ, আলোক শক্তির ধ্বংসাত্মক রূপে দেখা দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় আঘাত হানে পারমাণবিক বোমা Little Boy যা ছিল Gun Type Atomic Bomb. গান টাইপ এক্সপ্লোসিভ এর শক্তি ও দক্ষতা কম হওয়ায় বর্তমানে বড় ধরনের পারমাণবিক অস্ত্রে এটা ব্যবহৃত হয় না। সেগুলোতে ইমপ্লোশন টাইপ এক্সপ্লোসিভ ব্যবহৃত হয়।
Implosion Type Explosive
ইমপ্লোশন টাইপ বিস্ফোরকের দক্ষতা বেশি হওয়ায় এটি বেশি শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক হয়ে থাকে। বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্রে এই ধরণের বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়। ইমপ্লোশন টাইপ বিস্ফোরকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ হিসেবে প্লুটোনিয়াম২৩৯ ব্যবহৃত হয় যা ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক শক্তি উৎপাদনে সক্ষম।
ইমপ্লোশন টাইপ বিস্ফোরকে প্লুটোনিয়ামের বদলে ইউরেনিয়াম২৩৫ ব্যবহার করা যেতে পারে যেখানে গান টাইপ বিস্ফোরকে প্লুটোনিয়াম ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। বেশি শক্তিশালী ও দক্ষতা সম্পন্ন হবার কারণে এর গঠন এবং বিস্ফোরণ প্রক্রিয়াও গান টাইপ বিস্ফোরকের চেয়ে জটিল।
ইমপ্লোশন টাইপ বিস্ফোরকের গঠন
এধরনের বিস্ফোরকের কেন্দ্রে থাকে Neutron Initiator যা যথাসময়ে নিউট্রন ছুড়ে দিয়ে মূল ফিশন বিক্রিয়া শুরু করে। এই Initiator এর চারদিকে গোলক আকৃতিতে থাকে প্রধান নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোসিভ চার্জ বা প্লুটোনিয়ামের গোলক। এই গোলক এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে এর আকার-আকৃতি ও আয়তন এর সাপেক্ষে এর ভর সাব-ক্রিটিক্যাল ভরে থাকে, যেখানে পারমাণবিক বিক্রিয়া স্থায়ী হবে না। মূল চার্জের চারিদিকে তুলনামূলক পাতলা স্তরে থাকে ইউরেনিয়াম যাকে টেম্পার বলা হয়। টেম্পারের বাইরে বসানো হয় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন রাসায়নিক বিস্ফোরক। আর এই পুরো এসেম্বলি একটি ধাতব বাক্স বা কেসিং এর ভেতর থাকে।
ইমপ্লোশন টাইপ বিস্ফোরকের কার্যপ্রণালী
বিস্ফোরণ ঘটানোর মুল প্রক্রিয়া শুরু হয় বাইরের স্তরের রাসায়নিক বিস্ফোরক এর বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। প্রথমে এই বাইরের স্তরের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাসায়নিক বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এই বিস্ফোরণের ধাক্কা ও শকওয়েভ অভ্যন্তরস্থ ইউরেনিয়াম টেম্পার ও প্লুটোনিয়াম কোরের উপর উচ্চচাপের সৃষ্টি করে। ফলে অভ্যন্তরস্থ মূল প্লুটোনিয়াম চার্জ সংকুচিত হয়ে আয়তনে কমে যায়, কিন্তু ভর একই থাকে। এতে ফায়ারিং এর পূর্বে যে চার্জ কোর সাব-ক্রিটিক্যাল ভর বিশিষ্ট ছিল আয়তন কমে যাবার ফলে একই ভর বিশিষ্ট সংকুচিত চার্জ গোলক তখন হয়ে ওঠে সুপার-ক্রিটিক্যাল ভরের নিউক্লিয়ার চার্জ। এই সময় প্লুটোনিয়াম কোরের কেন্দ্রে থাকা Neutron Initiator নিউট্রন ছুড়ে দিয়ে সুপার ক্রিটিক্যাল প্লুটোনিয়াম কোরে ফিশন বিক্রিয়া শুরু করে।
এই ফিশন বিক্রিয়া পুরো চার্জে সংগঠিত হয় এবং বিপুল শক্তিতে বিস্ফোরিত হয় ইমপ্লোশন টাইপ পারমাণবিক বিস্ফোরক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাগাসাকিতে আঘাত হানে পারমাণবিক বোমা Fat Man যা ছিল Implosion Type Atomic Bomb.
এই হল মূলত পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে তৈরি পারমাণবিক বিস্ফোরক। এই বিস্ফোরকগুলোর আকার, আয়তন, বিস্ফোরণ মাত্রা এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা তাপ-পারমাণবিক অস্ত্রের তুলনায় কম।
তাপ-পারমাণবিক অস্ত্র (Thermo-Nuclear Weapon)
পারমাণবিক বিস্ফোরক বিষয়ক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত আরো উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক বিস্ফোরকগুলো হল ফিউশন বিস্ফোরক। পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়া যেটা মূলত সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রের কেন্দ্রে হয়ে থাকে সে বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে ফিশন বিস্ফোরকের চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী পারমাণবিক বিস্ফোরক তৈরি করা যায় যেগুলো পারমাণবিক ফিউশন বিস্ফোরক, প্রচলিত শব্দে ‘হাইড্রোজেন বোমা’ বা ‘H-Bomb’. ফিউশন বিস্ফোরক এর একটি হচ্ছে ‘হাইড্রোজেন বোমা’ তবে এর আরো রকমফের রয়েছে।
ফিউশন বিক্রিয়ার আরেক নাম তাপ-পারমাণবিক বিক্রিয়া। তাই ফিউশন বিস্ফোরক জাতীয় পারমাণবিক অস্ত্রসমূহকে (Thermo-Nuclear Weapon) তাপ-পারমানবিক অস্ত্রও বলা হয়ে থাকে। তাপ-পারমাণবিক বিস্ফোরক মূলত ফিশন ও ফিউশন বিস্ফোরকের সমন্বয়ে গঠিত অত্যধিক শক্তিশালী বিস্ফোরক, যার বিস্ফোরণের মাত্রা ফিশন পারমাণবিক বিস্ফোরক এর চেয়ে বহুগুণ বেশি।
তাপ-পারমাণবিক বিস্ফোরকের শক্তি ও রেঞ্জ অনেক বেশি হওয়ায় এগুলো বর্তমানে যুদ্ধবিমানে বহনযোগ্য বোমা আকারের পাশাপাশি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে নিক্ষেপ উপযোগী করে তৈরি করা হয়, যাদের আমরা পারমাণবিক মিসাইল, নিউক্লিয়ার ব্যালাস্টিক মিসাইল, নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড (Nulcear Missile, Ballistic Missile, Nuclear Warhead) ইত্যাদি নামে জানি।
পারমাণবিক ফিশন বিস্ফোরকের মূল বিস্ফোরক উপাদান যেমন ইউরেনিয়াম কিংবা প্লুটোনিয়াম; ফিউশন বিস্ফোরকের মূল বিস্ফোরক উপাদান হল হাইড্রোজেন এবং হাইড্রোজেনের ভারী আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম। এজন্য ফিউশন বিস্ফোরক বা তাপ-পারমাণবিক বিস্ফোরককে হাইড্রোজেন বিস্ফোরক বলা হয়ে থাকে।
তাপ-পারমাণবিক বিস্ফোরকের মূলনীতি, গঠন ও কার্যপ্রণালী
তাপ-পারমাণবিক বিস্ফোরক মূলত ফিশন এবং ফিউশন বিস্ফোরকের সম্মিলিত একটি বিস্ফোরক অবস্থা। হাইড্রোজেনে ফিউশন বিক্রিয়া শুরু করতে অতি উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়, প্রায় কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াস তা মুহূর্তের মধ্যে অন্য কোনোভাবেই উৎপন্ন করা সম্ভব নয়; কোনো না কোনো পারমাণবিক বিক্রিয়া ছাড়া। তাই ফিউশন বিস্ফোরকের মূল বিস্ফোরকের বিস্ফোরণের সূচনা ঘটাতে প্রয়োজন হয় আরেকটি ফিশন বিস্ফোরক।
তাপ-পারমাণবিক বিস্ফোরকের দুটি বিস্ফোরক অংশ থাকে একটি প্রাইমারি ফিশন বিস্ফোরক এবং অপরটি সেকেন্ডারি মূল ফিউশন বিস্ফোরক অংশ। প্রাইমারি ফিশন বিস্ফোরকটি মূলত এক প্রকার ইমপ্লোশন টাইপ ফিশন বিস্ফোরক। এটির বিস্ফোরণ মূল সেকেন্ডারি ফিউশন বিস্ফোরকে বিস্ফোরণের ট্রিগার হিসাবে কাজ করে। উৎপন্ন করে হাইড্রোজেন আইসোটোপে ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হবার মত তাপমাত্রা। সেকেন্ডারি ফিউশন বিস্ফোরকের বাইরের স্তরে থাকে ফিশনেবল ইউরেনিয়াম টেম্পার এবং ভেতরে কেন্দ্রে থাকে ফিশনেবল ইউরেনিয়াম অথবা প্লুটোনিয়াম স্পার্ক প্লাগ। এই দুই স্তরের মাঝে থাকে তরল হাইড্রোজেন আইসোটোপ যা তাপ-পারমাণবিক অস্ত্রের মূল ফিউশন জ্বালানী (Fusion Fuel) রূপে কাজ করে।
প্রাইমারি ফিশন বিস্ফোরকের বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট উচ্চতাপ, X-Ray এবং Gama Radiation সেকেন্ডারি বিস্ফোরকের বাইরের ইউরেনিয়াম টেম্পারে ফিশন বিক্রিয়া শুরু করে যা ফিউশন ফুয়েলের বাইরের দিক উত্তপ্ত করে তোলে। এই সময় ভেতরের ফিশনেবল ইউরেনিয়াম স্পার্ক প্লাগ এ ফিশন বিক্রিয়া শুরু করা হয় যা ফিউশন ফুয়েলের ভেতরের দিকেও উত্তপ্ত করে তোলে। এভাবে চারদিক থেকে ফিশন বিক্রিয়ায় সৃষ্ট অতি উচ্চ তাপ নূন্যতম সময়ের মধ্যে সেকেন্ডারি বিস্ফোরকে থাকা হাইড্রোজেন এর তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে তোলে ফিউশনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রায়। এতে হাইড্রোজেনের আইসোটোপ, মূল ফিউশন ফুয়েল জ্বলে ওঠে ও শুরু হয় হাইড্রোজেনের ফিউশন বিক্রিয়া। হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ফিউশনিত হয়ে তৈরি করে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস এবং সেই সাথে নিঃসৃত করে বৃহৎ পরিমাণে শক্তি।
ফিউশন বিক্রিয়ায় সৃষ্ট অবিশ্বাস্য শক্তি তাপ, রেডিয়েশন, শক ওয়েভ ইত্যাদি আকারে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হয় এবং সৃষ্টি করে এক বিপুল ধ্বংসলীলা।
প্রাইমারি ফিশন বিস্ফোরক এখানে মূল ফিউশন বিস্ফোরকের ট্রিগার হিসেবে কাজ করছে মাত্র; অথচ এটি নিজে একাই একটি বিশাল পারমাণবিক অস্ত্র হিসাবে কাজ করতে সক্ষম। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্রের তুলনায় তাপ-পারমাণবিক অস্ত্র কত বেশি শক্তিশালী, ধ্বংসাত্মক ও মারাত্মক হতে পারে!
সুটকেস নিউক (Suitcase Nuke)
সুটকেস নিউক আসলে খুবই ছোট আকৃতির পারমাণবিক অস্ত্র। তবে এটিও বিস্ফোরক পর্যায়েরই আওতাভুক্ত। সুটকেস নিউক কে WMD (Weapon of Mass Destruction) এর মধ্যে গণ্য করা হয় না। একে বলা হয় ADM বা Atomic Demolition Munition. ধারণা করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়ন কোল্ড ওয়ার এর সময় এই প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটে এবং সুটকেস নিউক সহ এমন আরো পোর্টেবল নিউক্লিয়ার ডিভাইস হয়ত পরীক্ষাধীন রয়েছে।
সুটকেস নিউক ২৪×১২×১০ ইঞ্চি একটি বহনযোগ্য বাক্স আকারে প্রস্তুত করা হয় যার ভর ৫০ পাউন্ডের বেশি হবে না। এটি তৈরির জন্য সবচেয়ে ভাল বিস্ফোরক উপাদান হল প্লুটোনিয়াম। কারণ নূন্যতম ২২ পাউন্ড প্লুটোনিয়াম হলেই তাতে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া ঘটানো ও চেইন রিএ্যাকশন স্থায়ী করা সম্ভব। অল্প শক্তির বিধায় এটি সাধারণত Gun Type বিস্ফোরক হয়ে থাকে।
বিশাল পরিসরে এর ধ্বংসক্ষমতা না থাকলেও অল্পপরিসরে বিস্তৃত ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড চালাতে এর পারদর্শিতা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। এ কারণে অবৈধভাবে পাচার হয়ে অথবা অন্য কোনোভাবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছে গেলে পোর্টেবল নিউক্লিয়ার ডিভাইস অন্যতম একটি ভয়ের কারণ হয়ে উঠবে।
ডার্টি বম্ব (Dirty Bomb)
এটিকে আসলে মূলধারার পারমাণবিক অস্ত্রের পর্যায়ে ধরা যায় না, কারণ এখানে পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট শক্তি বিস্ফোরণের জন্য কাজ করে না। আর এজন্যই হয়ত এর এই অদ্ভুত নামকরণ। এটি এক প্রকার Radiological dispersion devices (RDD).
কোনো সাধারণ রাসায়নিক বিস্ফোরকে যদি ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের মত তেজস্ক্রিয় পদার্থ মিশিয়ে দেয়া হয় তখন সেই বিস্ফোরকের বিস্ফোরণের ফলে সেটার স্বাভাবিক ক্ষয়ক্ষতির বাইরে অতিরিক্ত যে ঘটনাটা ঘটে তা হল বিস্ফোরণ-আক্রান্ত অঞ্চল ও বস্তুতে তেজস্ক্রিয় দূষণ। বিস্ফোরণ অঞ্চল ও বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ ও বস্তুতে তেজস্ক্রিয় দূষণ দেখা দেয়। আক্রান্ত অঞ্চলের মানুষ বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পরে। তেজস্ক্রিয় দূষণে দূষিত বস্তু থেকেও অল্প মাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নির্গত হয় যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর।
এভাবে সাধারণ বিস্ফোরক অস্ত্রের সাথে তেজস্ক্রিয়তার মিশেলে তৈরি হয় ‘ডার্টি বম্ব’। এটির প্রস্তুতপ্রণালী অন্য যে কোন পারমাণবিক অস্ত্রের তুলনায় একবারেই সহজ। তেজস্ক্রিয় পদার্থ সংশ্লিষ্ট যে কোন ব্যক্তি এই ধরণের অস্ত্র তৈরি করতে পারে। এ অস্ত্র ব্যবহারের মূল কারণ বৃহৎ পরিসরে ক্ষতি সাধন করা নয়, বরং সাধারণ বিস্ফোরণের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয় দূষণ ছড়িয়ে দেয়াই এর উদ্দেশ্য।
এই হলো প্রধান ও মূলধারার পারমাণবিক অস্ত্রের ধরন ও গঠন পরিচিতি। পরবর্তী পর্বে এসব অস্ত্রের বিস্ফোরণ মাত্রা, ধ্বংসলীলার সীমা, সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াও পারমাণবিক অস্ত্র কিভাবে বৈশ্বিক রাজনীতি ও মানবসভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
তথ্যসূত্রঃ –
১. Nuclear Energy: Principles, Practices and Prospects – Second Edition by David Bodansky (Book)
২. Nuclear Energy: An Introduction to the Concepts, Systems and Applications of Nuclear Processes – Sixth Edition by Raymond L. Murray (Book)
৫. Union of Concerned Scientists
৬. ABC News
আরেকটা প্রকার আছে, হাইব্রিড বম্ব বা বুস্টেড ফিশন বম্ব। থার্মোনিউক্লিয়ার বম্ব বানানোর আগে অনেক দেশই এটা বানায়।
এক্ষেত্রে নরমাল ইমপ্লোশন টাইপ প্লুটোনিয়াম বোমার কোর এ অল্প ডিউটেরিয়াম বা ট্রিটিয়াম রেখে দেয়া হয়, মূল বোমা ফাটলে এটার রেডিয়েশন এ ঐটুকু ফিউশন হয়ে এফিশিয়েন্সি ৫০-১০০% বেড়ে যায়। এছাড়া সহজে থোরিয়াম থেকে u233 বানিয়ে সেটা দিয়েও gun বা implosion বোমা বানানো যায়