প্রথম পর্ব || দ্বিতীয় পর্ব || তৃতীয় পর্ব
১৯০৫ সালে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ্যলবার্ট আইনস্টাইন তার ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র প্রতিপাদন করেন। তাত্ত্বিকভাবে তখন থেকেই পারমাণবিক শক্তির যাত্রা শুরু। বস্তু বা পদার্থ এবং শক্তি যে দুটি ভিন্ন রূপ এবং পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায় এই সূত্রের সাহায্যেই তা প্রথম প্রমাণিত হয়।
পারমাণবিক শক্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটিই হল তাঁর পরিমাণ। অতি অল্প পরিমাণ বস্তু থেকে বিপুল পরিমাণে শক্তি আহরণ করা যায় যেটি অচিন্তনীয় ছিল তখনকার সময়ে। এই শক্তির ব্যবহারে পারমাণবিক চুল্লি মানব সভ্যতা বিকাশে অবদান রাখছে প্রায় অফুরন্ত শক্তি ভাণ্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে; একই সাথে পারমাণবিক অস্ত্র মানব সভ্যতা বিলীন হয়ে যাবার মত ভয়াবহতার হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রথম পর্বে পারমাণবিক শক্তির সাধারণ ধারণা, পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা, পারমাণবিক বিক্রিয়া এবং পারমাণবিক শক্তি উৎস হিসেবে পরিচিত অধিক ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের বিষয়বস্তু ছিল সভ্যতার অগ্রগতিতে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার, পারমাণবিক শক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পারমাণবিক চুল্লি (Nuclear Reactor). তৃতীয় পর্বে ছিল পারমাণবিক অস্ত্র পরিচিতি, ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের প্রকারভেদ, গঠন ও কার্যপ্রণালীর বিবরণ। চতুর্থ পর্বে থাকছে পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা। পারমাণবিক অস্ত্র কেন এত ধ্বংসাত্মক? একটা পারমাণবিক বোমা বা মিসাইলের বিস্ফোরণ কেন ও কিভাবে পুরো একটা শহরকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারে? পারমাণবিক বিস্ফোরকের বিস্ফোরণের ফলে কী ঘটে যাতে এর ফলাফল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বয়ে বেড়াতে হয়?
বিস্ফোরণ মাত্রার পরিমাপ ও সাধারণ বিস্ফোরকের সাপেক্ষে তুলনামূলক ধারণা
পারমাণবিক বিস্ফোরকের ক্ষমতা বুঝতে হলে আমাদের সাধারণ বিস্ফোরকের মাত্রা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকতে হবে। ট্রাই-নাইট্রো-টলুইন সংক্ষেপে TNT একটি মারাত্মক বিস্ফোরক পদার্থ। সাধারণত বড়সড় বোমা, কামানের গোলা, ট্যাঙ্কের গোলা ইত্যাদিতে TNT ব্যবহৃত হয়। এর রাসায়নিক সংকেত C7H5N3O6. একটি কামানের ১২৫-১৫৫ মিমি হাই এক্সপ্লোসিভ গোলায় ৫-১০ কিলোগ্রাম TNT ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে সেই বিস্ফোরকের দ্বারা প্রতিপক্ষ যুদ্ধযান, রসদ গুদাম, অস্ত্রাগার ইত্যাদি ধ্বংস করা সম্ভব। এধরনের গোলার বিস্ফোরণে বিস্ফোরণ স্থলের কেন্দ্র থেকে ১০ মিটার ব্যাসার্ধে থাকা সব কিছু সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ২৫-৫০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা সবকিছু মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই TNT এর ভরের হিসেবেই পারমাণবিক বিস্ফোরকের বিস্ফোরণের মাত্রার হিসেব করা হয়ে থাকে।
হিরোশিমায় ব্যবহৃত ‘লিটল বয়’ এর বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার টন TNT এর সমান। একেবারে সরল হিসেবে ১৫ লক্ষ 155mm M795 Artillery Shell এর সমান। নাগাসাকিতে ব্যবহৃত ‘ফ্যাট ম্যান’এর বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল ২১ হাজার টন TNT এর সমান। একেবারে সরল হিসেবে ২১ লক্ষ 155mm M795 Artillery Shell এর সমান। প্রকৃতপক্ষে পারমাণবিক বিস্ফোরকের বিস্ফোরণের ধ্বংসাত্মক প্রভাব আর্টিলারি শেল থেকে অনেক বেশি হয় তার থার্মাল রেডিয়েশন এবং তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে।
পারমাণবিক বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ক্ষমতার একক ‘Kilo-ton TNT’. অর্থাৎ কত কিলোটন বা হাজার টন TNT বিস্ফোরকের সমান। সাধারণত নিউক্লিয়ার ফিশন এক্সপ্লোসিভ এর ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম তাই তাদের বিস্ফোরণ ক্ষমতা হিসেব করা হয় ‘Kilo-ton TNT’ এককে। কিন্তু ফিউশন বোমা যাকে আমরা হাইড্রোজেন বোমা বলে জানি সেগুলোর ক্ষমতা ফিশন বোমা থেকে হাজার গুন বেশি হয়। ফিউশন বিস্ফোরকের বিস্ফোরণের মাত্রা হিসেব করা হয় ‘Mega-ton TNT’ এককে। এখানে ১ মেগাটন টিএনটি = ১০০০ কিলোটন টিএনটি।
পারমাণবিক বিস্ফোরণের ধ্বংসযজ্ঞ
একটি সাধারণ কামানের গোলার বিস্ফোরণে কী ঘটে? একটা অগ্নিকুণ্ডের সৃষ্টি হয়, গোলার স্প্লিনটার ও TNT বিস্ফোরণের ব্লাস্ট ইফেক্ট সৃষ্ট উচ্চ চাপ ও ভাঙ্গা ধাতব টুকরা আশেপাশের বস্তুকে ধ্বংস করে এবং উত্তাপে কাছাকাছি দাহ্যবস্তুতে আগুন ধরে যায়। ৫০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা জীব ও জড় বস্তুর ক্ষতি সাধিত হয়। বিস্ফোরণ আওতার বাইরে এর তেমন কোনো প্রভাবই পড়ে না।
কিন্তু পারমাণবিক বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে বিস্ফোরণের প্রভাব মোটেই এত স্বল্প পরিসরে নয়। পারমাণবিক বিস্ফোরণের তাৎক্ষণিক প্রাণঘাতী প্রভাব বিস্ফোরকের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে বিস্ফোরণ স্থলের সর্বনিম্ন কয়েক কিলোমিটার থেকে শুরু করে ৫০ কিঃমিঃ এর বেশি দূরত্বের এলাকা পর্যন্ত হতে পারে। সেই সাথে বিস্ফোরণ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া তো আছেই।
পৃথিবীর প্রথম ব্যবহৃত পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ আসলে বলা চলে একেবারেই পরীক্ষামূলক ও পারমাণবিক বোমার প্রজন্মের ‘বাচ্চা শিশু’। ২১ কিলোটনের ‘ফ্যাট ম্যান’ বর্তমান সময়ের পারমাণবিক বোমা বা মিসাইলের তুলনায় ক্ষুদ্র একটা অস্ত্র। বর্তমানে কত বড় বড় ও শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্র আছে সে সম্পর্কিত তথ্য থাকবে পরবর্তী পর্বে।
এখন এখানে পারমাণবিক অস্ত্রের ধ্বংস ক্ষমতা বোঝার জন্য বর্তমান প্রজন্মের পারমাণবিক অস্ত্রের সাপেক্ষে নিম্ন-মধ্য ক্ষমতার মধ্যে ১ মেগাটন TNT ক্ষমতার একটি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বা ফিশন মিসাইল এর বিস্ফোরণে কেমন ক্ষতিসাধিত হতে পারে তার একটি আনুমানিক অবস্থা দেখা যাক। কয়েক ধাপে পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কতটুকু স্থান জুড়ে বিস্ফোরণের কী ধরনের প্রভাব দেখা যেতে পারে তা থেকে পারমাণবিক বিস্ফোরণের ভয়াবহতা সহজে বোঝা যাবে।
গর্ত
১ মেগাটন ক্ষমতার একটি পারমাণবিক বিস্ফোরক যেখানে পড়বে সেখানে দৈত্যাকৃতির গর্ত সৃষ্টি হবে। গর্তের ব্যাস প্রায় ৪০০ মিটার। অর্থাৎ চারটি ফুটবল মাঠ লম্বালম্বিভাবে সাজালে যে দৈর্ঘ্য হবে তেমন ব্যাসের গর্ত। আর গভীরতা হবে প্রায় ৩০০ ফুট; যা প্রায় ৩০ তলা ভবনের সমান। শুধুমাত্র ভূমিতে বিস্ফোরণের (Surface Blast) এর ফলেই Crater তৈরি হয়। বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত (Air Blast) হলে Ground Zero অর্থাৎ বিস্ফোরণস্থলের ঠিক নিচে ভূপৃষ্ঠে ছোটখাটো গর্ত হলেও দৈত্যাকৃতি Crater তৈরি হয় না।
অগ্নিকুণ্ড এবং মাশরুম মেঘ
পারমাণবিক বিস্ফোরকের বিস্ফোরণের সাথে সাথে একটি বিশাল অগ্নিকুণ্ড তৈরি হয়। এই অগ্নিকুণ্ডের তাপমাত্রা একেবারে শুরুর মুহূর্তে সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রার কাছাকাছি। এই তাপমাত্রায় ফায়ারবল বা অগ্নিকুণ্ডের ভেতরে থাকা সব কিছু মুহূর্তের মধ্যে বাষ্পে পরিণত হয়। বিস্ফোরণের ফলে ছত্রাক আকৃতির ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়। এর আকৃতির জন্য একে বলা হয় ‘মাশরুম ক্লাউড’। অগ্নিকুণ্ডের কারণে সৃষ্ট বাষ্পীভূত গ্যাস ও ধূলিকণার সমন্বয়েই তৈরি হয় সেই মাশরুম ক্লাউড।
১ মেগাটন ক্ষমতার একটি বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে সাথে সাথে এক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে অগ্নিকুণ্ডের ব্যাপ্তি হয় ৪৪০ ফুট এবং দশ সেকেন্ডের মধ্যে এর ব্যাস বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭০০ ফুট বা প্রায় ১.৭ কিঃমিঃ। ঠাণ্ডা হতে হতে দশ সেকেন্ড পরে এতে যে তাপমাত্রা থাকে তা মানুষের চোখে সংবেদী আলো ছড়ায় না। আর এই দশ সেকেন্ডে অগ্নিকুণ্ডের বাইরের অংশে ঘটে যাবে সর্বোচ্চ ওভারপ্রেসারের শক ওয়েভের তাণ্ডব।
ভূ-পৃষ্ঠে বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে বিস্ফোরণস্থল থেকে চারদিকে প্রায় ০.৮ কিঃমিঃ এর ভেতরে থাকা সব কিছু সেকেন্ডের মধ্যে বাষ্পীভূত হয়ে যাবে। ১.৭ কিঃমিঃ ব্যাসের বৃত্তাকার প্রায় ৫ বর্গ কিঃমিঃ একটি এলাকা বিস্ফোরণের প্রায় সাথে সাথেই আক্ষরিক অর্থেই বাতাসে মিলিয়ে যাবে। এই এলাকায় যে চাপ তৈরি হবে তা একটি স্টিম বয়লার এর ভেতরের চাপের কাছাকাছি, প্রায় 200 PSI.
বিস্ফোরণের ফায়ারবলের মধ্যে যারা থাকবে তাদেরকেই সবচেয়ে ‘ভাগ্যবান’ বলা যাবে। কারণ এই অংশের মানুষেরা এমনভাবে চোখের পলকেই মারা যাবে, যে তাদের ‘ভূত’ও দ্বিধায় পড়ে যাবে আসলে ঘটনাটা কী ঘটলো, কখনই বা মারা পড়লো। (* sarcasm alert!)
বিস্ফোরণের ঝলকানি এবং অন্ধত্ব
পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরপরই একটি অতি উচ্চ ক্ষমতার ও উজ্জ্বল চোখ ঝলসানো আলোর ঝলকানি দেখা যায়।
১ মেগাটনের একটি বিস্ফোরকের বিস্ফোরণে দিনের আলোতে প্রায় ২০ কিঃমিঃ দুর থেকে এবং রাতের অন্ধকারে প্রায় ৮৫ কিঃমিঃ দুর থেকে এই আলোর ঝলকানি দেখা যায়।
এই আলোক ঝলকানি দেখার সাথে সাথে অল্প সময়ের জন্য অস্থায়ী অন্ধত্ব দেখা দেয়। অতিরিক্ত আলোর ঝলকানি চোখে পড়ার সাথে সাথে ১০ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট পর্যন্ত সময়ের জন্য চোখ দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে। ফলে আক্রান্ত লোকজন আশ্রয়স্থল খুঁজে বের করতে পারে না এবং এরই মধ্যে Blast Shock Wave এবং Thermal Radiation এ আক্রান্ত হয়ে আহত-নিহত হতে শুরু করে।
বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে বিস্ফোরণ স্থলের দিকে সরাসরি তাকালে চোখের রেটিনা পুড়ে গিয়ে স্থায়ী অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে রেটিনায় ফায়ারবলের বিম্ব গঠিত হয় এবং উত্তাপে রেটিনা পুড়ে যায়। এই ঘটনা খুবই বিরল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পারমাণবিক বিস্ফোরণে আক্রান্ত মাত্র একজন ব্যক্তি পাওয়া গেছে যার রেটিনার স্থায়ী অন্ধত্ব ঘটেছে।
বিস্ফোরণের আঘাত তরঙ্গ বা Blast Shock Wave
ফায়ারবলের ভেতরে সবকিছু তাৎক্ষণিকভাবে বাষ্পীভূত হয়ে যাওয়ায় এবং বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শক্তিতে চারদিকে ব্যাপক চাপে শক ওয়েভ ছড়িয়ে পড়ে। এটির বৈশিষ্ট্য অনেকটা এমন যেন প্রচণ্ড ঝড়ো গতিতে উচ্চচাপে থাকা বাতাসের একটা দেয়াল সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে এগিয়ে যেতে থাকে।
যদি ভূ-পৃষ্ঠে বিস্ফোরণ হয় তবে শক্তিশালী একটি শক ওয়েভই কার্যকরী হয়। কিন্তু যদি বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরণ ঘটে, অর্থাৎ যদি ভূমি থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে বিস্ফোরণ ঘটে তবে প্রাথমিক বিস্ফোরণের শক ওয়েভ তো ছড়িয়ে পড়বেই, তার সাথে যুক্ত হবে ভূমি থেকে প্রতিফলিত আরেকটি ধাক্কা। এদের মিলিত চাপকে ওভারপ্রেশার বলে। এই ওভার প্রেশারের পরিমাপের উপরেই কতটুকু অঞ্চল কি পরিমাণে বিধ্বস্ত হবে তা নির্ভর করে।
সর্বোচ্চ চাপের আঘাত তরঙ্গ
১ মেগাটনের বিস্ফোরণে বিস্ফোরণ কেন্দ্র থেকে ২.২৫ কিঃমিঃ ব্যাসার্ধের দূরত্বে (অগ্নিকুণ্ডের সীমানার বাইরে আরো এক কিঃমিঃ বেশি ব্যাসার্ধে) প্রায় ১৫ বর্গ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে (৪.৫ কিঃমঃ ব্যাসের বৃত্তাকার এলাকা) শক ওয়েভের তাণ্ডব দেখা যাবে। এই শক ওয়েভে বাতাসের চাপ থাকে আনুমানিক 20 PSI এবং গতিবেগ প্রায় ৮০০ কিঃমিঃ প্রতি ঘণ্টা। প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ২০ পাউন্ড মানে প্রায় ৯ কেজি বলে আঘাত করবে ঝড়ো গতির বাতাসের ধাক্কা। সহজে বোঝার জন্য মনে করুন আপনার ৫ ইঞ্চি স্ক্রিনের স্মার্টফোনের উপর একটা ৪৫ কেজির পাথর আছড়ে পড়লে যে অবস্থা হবে এই শক ওয়েভ আওতার ভেতরে থাকা সবকিছুর একই অবস্থা হবে। বিস্ফোরণের দশ সেকেন্ডের মধ্যে শক ওয়েভের এই আঘাতে এ অঞ্চলের সব মানুষ মারা যাবে। ছোটখাটো ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, মাঝারি থেকে বড়সড় স্থাপনা পুরোপুরিভাবে বিধ্বস্ত হবে। অতি উচ্চ মানের নিরাপত্তা বিশিষ্ট ও উচ্চ শক্তির কংক্রিট নির্মিত স্থাপনা গুরুতরভাবে অনেকাংশে ভেঙ্গে পড়বে। এই শক ওয়েভ ছড়িয়ে পড়তে থাকবে এবং এর চাপ ও গতি কমে আসবে।
মধ্যম চাপের আঘাত তরঙ্গ
সর্বোচ্চ ওভারপ্রেশারের সীমানার বাইরে গতি ও চাপ ক্রমাগত কমে শক ওয়েভের কিছুটা দুর্বল অংশে চাপ ও গতি দাঁড়াবে যথাক্রমে 5 PSI এবং ২২০ কিঃমিঃ প্রতি ঘণ্টা এবং আরো কমতে কমতে এর সীমানার বাইরে ক্ষতিকর মাত্রার নিচে নেমে যাবে। উল্লেখ্য, 3 PSI চাপের শক ওয়েভ এর ধাক্কাই সকল সাধারণ আবাসিক ভবন বিধ্বস্ত হবার জন্য যথেষ্ট।
অর্থাৎ আবাসিক এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটালে মিডিয়াম ওভারপ্রেশারের সীমানার মধ্যে থাকা অল্প কিছু অতিরিক্ত সুরক্ষিত ও শক্তিশালী ভবন ব্যতীত সকল ভবন ধসে যাবে ও প্রাণহানি ঘটবে। ১ মেগাটনের একটি বিস্ফোরণে মিডিয়াম ওভারপ্রেশারের কার্যকর বিস্তৃতি বিস্ফোরণ কেন্দ্র থেকে ৪.৫ কিঃমিঃ পর্যন্ত। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ওভারপ্রেশারের সীমানার বাইরে আরো ২.২৫ কিঃমিঃ বেশি দুরত্বে ছড়িয়ে পরবে মিডিয়াম ওভারপ্রেশার শক ওয়েভ। মিডিয়াম ওভারপ্রেসারের ধাক্কায় ধ্বংস হবে প্রায় ৯ কিঃমিঃ ব্যাসের ৬৫ বর্গ কিঃমিঃ এলাকা।
নিম্ন চাপের আঘাত তরঙ্গ
মিডিয়াম ওভারপ্রেশারের শক ওয়েভ দূরত্বের সাথে আরো দুর্বল হয়ে ক্রমান্বয়ে চাপ কমে 1.5 PSI চাপে নেমে আসে। এই শক ওয়েভ দরজা জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলার জন্য যথেষ্ট। উজ্জ্বল চোখ ঝলসানো আলো যেহেতু শক ওয়েভের চেয়ে দ্রুতগামী তাই সেই আলোর ঝলকানি এবং মাশরুম ক্লাউড দেখে দূরের মানুষেরাও দরজা জানালার কাছে যায় এবং তখন কাঁচ ভেঙ্গে প্রচুর লোক আহত হয়। এই শক ওয়েভ কাঁচের দরজা জানালা এবং হালকা ও মাটির সাথে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ নয় এমন স্থাপনা দূরে ছুঁড়ে ফেলতে সক্ষম। এই শক ওয়েভের কার্যকারিতা হতে পারে প্রায় কেন্দ্র থেকে ৯.৭৫ কিঃমিঃ দুর পর্যন্ত। বিস্ফোরণ কেন্দ্রের চারিদিকে ১৯.৫ কিঃমিঃ ব্যাসের বৃত্তের এলাকায় দরজা-জানালার কাঁচ অবশিষ্ট থাকবে না। বিস্ফোরণ কেন্দ্র থেকে চারিদিকে প্রায় ২০ কিঃমিঃ ব্যাসের বৃত্তাকার এলাকা সরাসরি বিস্ফোরণের শক ওয়েভ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
তাপজনিত বিকিরণ
পারমাণবিক বিস্ফোরকের বিস্ফোরণের পরবর্তী ধ্বংসাত্মক ধাপ হলো Thermal Radiation বা তাপজনিত বিকিরণ। বিস্ফোরণের কেন্দ্রে সৃষ্ট অগ্নিকুণ্ডে যে অতি উচ্চ তাপের সৃষ্টি হবে তা তাপীয় বিকিরণ প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে থাকবে চারিদিকে অতি দ্রুত। এই বিকিরণের অত্যাধিক তাপীয় শক্তি, বিকিরণের কার্যকরী অঞ্চলকে অল্প সময়ের মধ্যেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করবে।
অগ্নিকাণ্ড এবং অগ্নিঝড়
বিস্ফোরণে সৃষ্ট তাপ চারিদিকে বিকিরিত হতে থাকবে এবং যত দূরত্ব বাড়বে এর শক্তিমাত্রা তত কমতে থাকবে। বিস্ফোরণ কেন্দ্রের চারিদিকে ৬.৫ কিঃমিঃ পর্যন্ত এলাকায় এই তাপ বিকিরণের মান সর্বোচ্চ প্রায় ৩৫ ক্যালরি/বর্গ সেঃমিঃ বা তার বেশি। এখানেই তাপজনিত বিকিরণ সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে থাকে। এতে তাপের পরিমাণ এতই বেশি থাকে যে এর পথে থাকা যে কোনো খোলা দাহ্য বস্তু যেমন শুকনো কাপড়, কাঠ, কাগজ, শুকনো পাতা, গাছ ইত্যাদি এই তাপীয় বিকিরণের উষ্ণতার প্রভাবে নিজে নিজেই জ্বলে উঠবে। শক ওয়েভে ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকায় জ্বালানী ও রাসায়নিক পদার্থের সংরক্ষণাগার, গ্যাস ও তেল সরবরাহ লাইন উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় এগুলোতে আগুন ধরে যাবে এবং বৃহৎ সংরক্ষণাগার গুলোতে আগুন লেগে যাবার ফলে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকবে। ঘরের ভেতরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে দাহ্য সকল বস্তুতে আগুন লেগে যাবে। অর্থাৎ ফায়ারবলের বাইরেও প্রায় ১৩ কিঃমিঃ ব্যাসের ৪০ বর্গ কিঃমিঃ বৃত্তাকার এলাকা পুরোপুরি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবে। এই ঘটনাকে বলা হয় Firestorm.
সর্বোচ্চ দগ্ধকরণ বা Third Degree Burn
মানবদেহের প্রতি বর্গ সেঃমিঃ এ ৯.৫-১০ ক্যালরি বিকিরিত তাপ পতিত হলে সেখানে থার্ড ডিগ্রী বার্ন হয়ে থাকে। ১ মেগাটন বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ কেন্দ্রের চারিদিকে প্রায় ১০ কিঃমিঃ ব্যাসার্ধের এলাকায় প্রায় শতভাগ মানুষের থার্ড ডিগ্রী বার্ন হবে। থার্ড ডিগ্রী বার্ন সবচেয়ে গভীর পোড়া। কিন্তু এক্ষেত্রে তাপজনিত বিকিরণ সবচেয়ে ব্যথাহীন ও অনুভূতিহীন পোড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাপজনিত বিকিরণ চোখের পলকে চামড়ার স্তর ভেদ করে নার্ভ টিস্যু বা স্নায়ু কলা পুড়িয়ে দেবে যাকে বলা হয়ে থাকে থার্ড ডিগ্রী বার্ন। চামড়ার নিচের স্নায়ু কলা ও ব্যথাসংবেদী কোষ (Pain receptor) পুড়ে নষ্ট হয়ে যাবার ফলে ব্যক্তি পোড়ার ক্ষত থেকে কোনো ব্যথা অনুভব করবে না। কিন্তু এই ব্যথাহীন থার্ড ডিগ্রী বার্ন এর গভীর পোড়া ক্ষত, কখনো কখনো বিকলাঙ্গতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এমনকি অঙ্গচ্ছেদন এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। বিস্ফোরণ স্থলকে কেন্দ্র করে প্রায় ২০ কিঃমিঃ ব্যাসের এলাকার সকল মানুষের চামড়া পুরোপুরি ঝলসে যাবে ও সবাইকে মারাত্মক আহত করবে।
মধ্যম দগ্ধকরণ বা Second Degree Burn
থার্ড ডিগ্রী বার্নের সীমানার পরে বিকিরণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে কমে প্রায় অর্ধেকে অর্থাৎ ৬ ক্যালরি/বর্গ সেঃমিঃ এ চলে আসে। এই তাপে চামড়ায় সেকেন্ড ডিগ্রী বার্ন দেখা দেয়। সেকেন্ড ডিগ্রী বার্ন সবচেয়ে কষ্টদায়ক পোড়া। এটি যথেষ্ট গভীর পোড়া। চামড়ার কয়েকস্তর পুরোপুরি ঝলসে যায় তবে স্নায়ু কোষ ও ব্যথাসংবেদী কোষ ঝলসে না যাওয়াতে পুড়ে যাবার অনুভূতি ও তীব্র যন্ত্রণা চরমভাবে উপলব্ধি করা যায়। সেকেন্ড ডিগ্রী বার্ন এর ফলে গভীর ক্ষত ও পোড়া দাগ এর সৃষ্টি হয়। এটির চিকিৎসায় স্কিন গ্রাফটিং অর্থাৎ শরীরের অন্য অংশের চামড়া বসিয়ে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। কিন্তু পারমাণবিক বিস্ফোরণের সেকেন্ড ডিগ্রী বার্ন এর ক্ষেত্রে কাপড়ের বাইরে থাকা বেশিরভাগ উন্মুক্ত অংশের চামড়া পুড়ে যাওয়াতে স্কিন গ্রাফটিং করার সুযোগটি সহজে পাওয়া যায় না। যথাযথ চিকিৎসায় সেকেন্ড ডিগ্রী বার্ন থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে। কিন্তু পারমাণবিক বিস্ফোরণে আক্রান্ত অঞ্চলে যথাযথ চিকিৎসা বাতুলতা মাত্র। তাতে দেখা যায় সেকেন্ড ডিগ্রী বার্ন এর ঘটনাও প্রাণঘাতী। বিস্ফোরণ স্থলের প্রায় ১২ কিঃমিঃ পর্যন্ত দূরত্ব পর্যন্ত এলাকার বেশিরভাগ মানুষ সেকেন্ড ডিগ্রী বার্ন এ আক্রান্ত হবে।
সর্বনিম্ন দগ্ধকরণ বা First Degree Burn
ফার্স্ট ডিগ্রী বার্ন সবচেয়ে কম এবং ক্ষতহীন পোড়া বলা যেতে পাড়ে। এটি শুধু চামড়ার উপরের স্তর পুড়িয়ে ফেলে। এতে কিছুটা পুড়ে যাবার ব্যথা অনুভব করা গেলেও এটাকে মোটামুটি অতিরিক্ত ‘সান বার্ন’ বলা যেতে পারে। ‘সান বার্ন’ হলে যেমন চামড়া পুড়ে কালো হয়ে যায় ফার্স্ট ডিগ্রী বার্ন তেমনটাই তবে পরিমাণে আরেকটু বেশি হয়। এক্ষেত্রে কোনো ক্ষত হয় না এবং ৫-১০ দিনের মধ্যে সেরে ওঠে। সেকেন্ড ডিগ্রী বার্নের আওতার বাইরে বিস্ফোরণ স্থলের চারিদিকে পরে ১৪-১৫ কিঃমিঃ দূরত্ব পর্যন্ত ফার্স্ট ডিগ্রী বার্ন এর ঘটনা ঘটে থাকে। অর্থাৎ, বিস্ফোরণ কেন্দ্রের চারিদিকে প্রায় ৩০-৩৫ কিঃমিঃ ব্যাসের বৃত্তাকার এলাকা বিস্ফোরণের তাপজনিত বিকিরণের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তেজস্ক্রিয় বিপর্যয় এবং দূষণ
পারমাণবিক বিস্ফোরণের বেশ বিস্তৃত একটি প্রভাব হচ্ছে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ও দূষণ। বিস্ফোরণের ব্লাস্ট ওয়েভ ও থার্মাল রেডিয়েশনের সংকটাপন্ন অঞ্চলের বাইরের বৃহৎ একটা অঞ্চলের মানুষ ও পরিবেশ আক্রান্ত হয় তেজস্ক্রিয় দূষণে।
পারমাণবিক বিস্ফোরণের সাথে সাথে যে বিকিরণ নির্গত হয় সেটি গামা রশ্মির বিকিরণ, নিউট্রন বিকিরণ এবং আয়নাইজড বস্তুকণার বিকিরণ। যতক্ষণ বিস্ফোরকের পারমাণবিক বিক্রিয়া চলে এই বিকিরণ ততক্ষণ স্থায়ী হয় এবং এই বিকিরণের পরিমাণ প্রাণঘাতী। তবে এই বিকিরণের পাল্লা খুব বেশি হয় না। অগ্নিকুণ্ডের দ্বিগুণ ব্যাসের বৃত্তাকার অংশে প্রাণঘাতী এই মাত্রাতিরিক্ত বিকিরণ আঘাত হানে। এই পরিমাণের বিকিরণে আক্রান্ত মানুষ কয়েক ঘণ্টা থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যায়। তবে পারমাণবিক বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের মানুষ ব্লাস্ট শক ওয়েভ এবং তাপজনিত বিকিরণেই মারা পড়ে।
কিন্তু এই প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এই অংশের সব বস্তুকে উচ্চ তেজস্ক্রিয় দূষণে দূষিত করে। বিস্ফোরকের অব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ ও উচ্চ দূষণে দূষিত বস্তুকণা শক ওয়েভের কারণে উড়ে গিয়ে বায়ুমণ্ডলে মেশে এবং দূরে গিয়ে ভূপৃষ্ঠে ছিটকে পড়ে।
অগ্নিকুণ্ডের ভেতরে থাকা বাষ্পীভীত গ্যাস ও ধূলিকণা মাশরুম ক্লাউড এর সাথে উপরে ওঠে ও ছড়িয়ে পড়ে। এই কণার বৃহৎ অংশ আশেপাশেই ভূপাতিত হয় কিন্তু মিলিমিটারের ভগ্নাংশ থেকে কয়েক মিলিমিটারের বস্তুকণা উচ্চচাপের বায়ু প্রবাহের সাথে উড়ে গিয়ে বায়ু প্রবাহের দিকের অঞ্চলে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পরে। এসকল তেজস্ক্রিয় দূষণে দূষিত কণা যে সকল স্থানে উড়ে গিয়ে পরে সেখানে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে থাকে। এভাবে বিস্ফোরণের সরাসরি প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাইরেও ব্যাপক এলাকায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পরে।
তেজস্ক্রিয় দূষণে দূষিত বস্তুকণার বিস্তৃত অঞ্চলে বায়ুপ্রবাহের সাথে ছড়িয়ে পড়াকে বলা হয় Radioactive Fallout বা তেজস্ক্রিয় বিপর্যয়। বিস্ফোরণ পরবর্তী তাৎক্ষণিক বিপর্যয় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে অস্ত্রের ডিজাইন, বিস্ফোরণের অবস্থান মাটির কতটা কাছাকাছি বা কতটা উপরে, বিস্ফোরকে ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থের ধরনের উপর নির্ভর করে তেজস্ক্রিয় বিপর্যয় সপ্তাহ, মাস এমনকি বছরকাল ব্যাপী স্থায়ী হতে পারে। তবে প্রথমদিকেই বিপর্যয়ের পরিমাণ বেশি থাকে। যত দিন যায় বিপর্যয় চললেও মাত্রা কমে আসে।
১ মেগাটনের একটি বিস্ফোরকের ব্লাস্ট শক ওয়েভ ও থার্মাল ওয়েভে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বিস্ফোরণ কেন্দ্র থেকে চারিদিকে সর্বোচ্চ ২০ কিঃমিঃ পর্যন্ত হয়। কিন্তু একটি জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভূপৃষ্ঠে এই বিস্ফোরণ ঘটালে তার Radioactive Fallout বিস্ফোরণ স্থল থেকে বায়ুপ্রবাহের দিকে ৩৭৫ কিঃমিঃ দূরত্বে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেক্ষেত্রে আক্রান্ত অঞ্চল মারাত্মক তেজস্ক্রিয় দূষণে দূষিত হবে।
ভূ-পৃষ্ঠে বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে প্রচুর বস্তুকণা মাশরুম ক্লাউডের সাথে উপরে উঠে যায় ও ফল-আউট এর মাধ্যমে পতিত হয়। এজন্য ভূ-পৃষ্ঠে বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে রেডিওএ্যাকটিভ ফল-আউটের ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় প্রভাব বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরণের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে থাকে।
পারমাণবিক বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব
Radioactive Fallout এর সীমানার ভেতর যে অঞ্চল বিস্ফোরণ স্থলের যত কাছে হবে সেখানে তেজস্ক্রিয় দূষণের মাত্রা ও প্রভাব তত বেশি হবে এবং দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে দূষণের মাত্রা ও ক্ষতিকর প্রভাব তত কমে আসবে।
বিস্ফোরণস্থলের কাছাকাছি এলাকায় তুলনামূলক বেশি তেজস্ক্রিয় দূষণের ফলে সেখানে তেজস্ক্রিয় বিকরণের সংস্পর্শে আসা মানুষদের চুল পড়ে যাওয়া, রক্তের শ্বেত রক্তকণিকা কমে যাওয়া, থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি অসুস্থতা দেখা দেয়। শ্বেত কণিকা কমে যাওয়ায় ফ্লু জাতীয় রোগে সহজেই আক্রান্ত হয়ে পরে মানুষ। এছাড়া শরীরের তেজস্ক্রিয় দূষণে দূষিত অংশের কোষ এর কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে টিউমার ও ক্যান্সার এর উৎপত্তি ঘটতে পারে।
তেজস্ক্রিয়তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব
বিস্ফোরণ স্থল থেকে বেশ কিছুটা দূরবর্তী স্থানে; শক ওয়েভ ও থার্মাল রেডিয়েশনের ক্ষতিকর দূরত্বের বাইরের বিস্তৃত অঞ্চলে এবং রেডিওএ্যাকটিভ ফল-আউট আক্রান্ত স্থানের তেজস্ক্রিয় দূষণের তাৎক্ষনিক প্রভাব নজরে না পরলেও দীর্ঘমেয়াদী ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল ঠিকই পরিলক্ষিত হয়। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাবে মানবদেহের ক্রোমোজোম প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরিত হতে পারে। এজন্য তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক বা একাধিক প্রজন্ম পরেও কখনো কখনো তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়।
বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়তা ও Radioactive Fallout এর তেজস্ক্রিয় দূষণের প্রভাবে বিস্তীর্ণ অঞ্চল এমনকি পুরো একটি শহর বা দেশের ভৌগলিক পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান, আবহাওয়া ইত্যাদি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়। এমনকি কখনো কখনো বিস্ফোরণ স্থলের উপরের বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তরের ভাঙ্গন ঘটতে পারে।
এই হলো পারমাণবিক বিস্ফোরণের বিস্তীর্ণ ধ্বংসলীলা ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল। এখানে যে দূরত্বে যতটুকু ক্ষতিকর তাণ্ডবের বর্ণনা রয়েছে সেটি হল একটি ১ মেগাটন ক্ষমতার নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড বা মিসাইল এর বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা। সর্বশেষ সর্বোচ্চ ক্ষমতার যে ফিউশন বোমার (হাইড্রোজেন বোমা) পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে সেটির ক্ষমতা ছিল ৫০ মেগাটন এবং সর্ববৃহৎ ফিউশন বিস্ফোরক যেটি তৈরির গবেষণা চলছে সেটি হতে যাচ্ছে ১০০ মেগাটন ক্ষমতা সম্পন্ন।
হিরোশিমায় ফেলা হয়েছিল ১৫ কিলোটন এর গান টাইপ ফিশন বোমা। সেই ঐতিহাসিক বিস্ফোরণের সাক্ষী ও বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে BBC একটি শ্রুতি ডকুফিল্ম তৈরি করেছে। এখান থেকে কিছুটা হলেও অনুমান করা যাবে এর হাজার গুণ শক্তিশালী অর্ধশত বা শত মেগাটনের ফিউশন বোমা বা মিসাইলের ধ্বংসক্ষমতা কত।
পরবর্তী পর্বে থাকছে পারমাণবিক অস্ত্রের ইতিহাস, বর্তমান পৃথিবীতে মজুদকৃত পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণ, অতীত থেকে বর্তমানের অত্যাধুনিক পারমাণবিক বিস্ফোরকের তুলনামূলক শক্তিমাত্রার ধারণা এবং পারমাণবিক শক্তির ব্যাবহারের সাথে মানবজাতি তথা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত তথ্যাদি।
তথ্যসূত্র
Lecture of Professor Alexander Glaser, Princeton University