১৯০৫ সালে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ্যলবার্ট আইনস্টাইন ভর-শক্তি তুল্যতা সূত্র প্রতিপাদন করেন। তাত্ত্বিকভাবে তখন থেকেই পারমাণবিক শক্তির যাত্রা শুরু। বস্তু বা পদার্থ এবং শক্তি যে দুটি ভিন্ন রূপ এবং পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায় – এই সূত্রের সাহায্যেই তা প্রথম প্রমাণিত হয়। পারমাণবিক শক্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটিই হল তার পরিমাণ। অতি অল্প পরিমাণ বস্তু থেকে যে বিপুল পরিমাণে শক্তি আহরণ করা যায়, তা ঐ সময়ে অচিন্তনীয় ছিলো। পারমাণবিক চুল্লি এই শক্তি আহরণ করেই মানব সভ্যতা বিকাশে অবদান রাখছে এবং প্রায় অফুরন্ত শক্তি ভাণ্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অন্যদিকে, একই সাথে পারমাণবিক অস্ত্র মানব সভ্যতা বিলীন হয়ে যাবার মত ভয়াবহতার হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রথম পর্বে পারমাণবিক শক্তির সাধারণ ধারণা, পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা, পারমাণবিক বিক্রিয়া এবং পারমাণবিক শক্তি উৎস হিসেবে পরিচিত অধিক ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের বিষয়বস্তু ছিলো সভ্যতার অগ্রগতিতে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার, পারমাণবিক শক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পারমাণবিক চুল্লি (Nuclear Reactor)। তৃতীয় পর্বে ছিল পারমাণবিক অস্ত্র পরিচিতি, ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের প্রকারভেদ, গঠন, ও কার্যপ্রণালীর বিবরণ। চতুর্থ পর্ব ছিলো পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা ও পারমাণবিক অস্ত্র কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে তার বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে। পঞ্চম ও শেষ পর্ব সাজানো হয়েছিল পারমাণবিক অস্ত্রের ইতিহাস, বর্তমান পৃথিবীতে মজুদকৃত পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণ, অতীত থেকে বর্তমানের অত্যাধুনিক পারমাণবিক বিস্ফোরকের তুলনামূলক শক্তিমাত্রার ধারণা এবং পারমাণবিক শক্তির ব্যাবহারের সাথে মানবজাতি তথা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত তথ্যাদি দিয়ে।
কিন্তু ইতোমধ্যে সমাপ্ত সিরিজটিতে দুটো অতিরিক্ত পর্ব সংযুক্ত করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত পর্ব দুটোর মূল উদ্দেশ্য – পারমাণবিক শক্তি সংশ্লিষ্ট অত্যাধুনিক এবং চোখ ধাঁধানো গবেষণার তথ্য সংযুক্ত করা। বর্তমানে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। এমনকি আমাদের দেশেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে। অপরদিকে পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়া প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে নক্ষত্রগুলোতে। আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে থাকা নক্ষত্র সূর্যেও ঘটে চলছে অনবরত এমন ফিউশন বিক্রিয়া। শুধুমাত্র কোটি ডিগ্রী তাপমাত্রার আয়নিত গ্যাসের মধ্যেই এই বিক্রিয়া ঘটা সম্ভব বলে একে তাপ-পারমাণবিক বিক্রিয়াও বলা হয়।
এই তাপ-পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়া কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করে সেখান থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে সক্ষম বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির দুঃসাহসী পরিকল্পনা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীগণ। তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও অবিশ্বাস্য গবেষণার সুবৃহৎ কর্মযজ্ঞ নিয়েই সাজানো হচ্ছে অতিরিক্ত প্রথম পর্ব।
তাপ-পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের মূলনীতি
ফিউশন বিক্রিয়ার প্রাথমিক ধারণা উল্লেখ করা হয়েছিল প্রথম পর্বের “পারমাণবিক বিক্রিয়া – ফিশন ও ফিউশন (Fission & Fusion)” অংশে। তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস ফিউশনিত হয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে পরিণত হবে। আর ফিউশনের ফলাফল হিসাবে পাওয়া যাবে জ্বালানীর অনুপাতে অবিশ্বাস্য পরিমাণ শক্তি।
হাইড্রোজেন ‘পর্যায় সারণী’র একেবারে প্রথম মৌল। এর পারমাণবিক ভর সবচেয়ে কম অর্থাৎ সবচেয়ে হালকা মৌল হাইড্রোজেন। তাই এর মোট পারমাণবিক বন্ধন শক্তিও সবচেয়ে কম। একারণে অন্য যেকোনো মৌলের তুলনায় হাইড্রোজেনে সবচেয়ে কম তাপমাত্রায় ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব। এজন্য তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানী হিসেবে সবচেয়ে কার্যকরী ও কর্মদক্ষ (Efficient) হিসেবে বিবেচিত হয়েছে হাইড্রোজেনের ভারী আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম এবং ট্রিটিয়াম।
প্রকৃতিতে কোনো মৌলের মুক্ত পরমাণু পাওয়া যায় না। অন্তত দুটো পরমাণু মিলে অণু তৈরি করে বিরাজ করে। হাইড্রোজেন গ্যাসের অণুতেও দুটি পরমাণু থাকে। হাইড্রোজেন গ্যাসকে ১০,০০০ কেলভিন তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে গ্যাসের অণু ভেঙ্গে পরমাণুসমূহ বিচ্ছিন্ন হয়ে মুক্তভাবে বিরাজ করতে শুরু করে। তাপমাত্রা ১৫,০০০-২১,০০০ কেলভিনে উন্নীত করলে পরমাণুর নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের মধ্যকার বন্ধনও ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে এবং নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন মুক্তভাবে বিচরণ করতে থাকে। তাপমাত্রা বাড়িয়ে ৫০,০০০-১,৫০,০০০ কেলভিনে নিয়ে গেলে গ্যাসের কোনো পরমাণু বিদ্যমান থাকে না। এ তাপমাত্রায় হাইড্রোজেনের সকল পরমাণুই ধনাত্মক আধানে আহিত নিউক্লিয়াস ও ঋণাত্মক আধানে আহিত ইলেকট্রনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে এবং পজেটিভ চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস ও নেগেটিভ চার্জযুক্ত ইলেকট্রন মুক্তভাবে উচ্চগতিতে ছোটাছুটি করতে থাকে। এ অবস্থায় এটি হাইড্রোজেন গ্যাসের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে না, বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। একে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা ‘প্লাজমা’ বলা হয়। প্লাজমাকে মুক্ত আয়নিত পারমাণবিক কণার স্যুপের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যখন মৌল প্লাজমা অবস্থায় পৌঁছে তখন নিউক্লিয়াস উন্মুক্ত হয় ফলে ফিউশন বিক্রিয়া সংঘটিত হওয়া সম্ভব হয়। তাই পদার্থ প্লাজমা অবস্থায় না পৌঁছালে কোনভাবেই ফিউশন বিক্রিয়া সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়।
হাইড্রোজেন প্লাজমা অবস্থায় গেলেই সেখানে ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয় না। কারণ তড়িৎ আধানের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সমধর্মী চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করবে। নিউক্লিয়াস পজেটিভ চার্জযুক্ত। তাই প্লাজমাতে মুক্তভাবে বিচরণকালে দুটি নিউক্লিয়াস সর্বদাই একে অপরকে দূরে ঠেলে দেবে। একে রিপালসিভ অ্যাকশন বলা হয়। প্লাজমাতে আয়নিত পারমাণবিক কণা উচ্চগতিতে ছোটাছুটি করে। প্লাজমার তাপমাত্রা যত বেশি, কণার গতিশক্তিও তত বেশি। কিন্তু রিপালসিভ ফোর্সের কারণে সমধর্মী আধান পরস্পরের সংস্পর্শে আসে না। রিপালসিভ ফোর্সের বাঁধা পেরিয়ে দুটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানোর জন্য নিউক্লিয়াসের গতিশক্তি রিপালসিভ এনার্জির চেয়ে বেশি হতে হয়। অর্থাৎ প্লাজমার তাপমাত্রা আরো বহুগুণ বাড়াতে হবে। ফিউশন রিঅ্যাক্টরে হাইড্রোজেন প্লাজমাকে ফিউশনের জন্য ১৫ কোটি কেলভিন তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করতে হবে। এতে প্লাজমাতে মুক্ত নিউক্লিয়াস যে গতিশক্তি অর্জন করবে তা রিপালসিভ ফোর্সের বাঁধাকে অতিক্রম করার জন্য উপযুক্ত। এই তাপমাত্রায় প্লাজমাতে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হবে এবং দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস মিলে তথা ফিউশনিত হয়ে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করবে।
দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের ভরের সমষ্টি অপেক্ষা একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর কিছুটা কম হয়। এই হারিয়ে যাওয়া ভরই ফিউশনের ফলে আইনস্টাইনের বিখ্যাত E=mc2 সূত্রানুযায়ী বিপুল শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে আলোক ও তাপশক্তি আকারে নির্গত হবে। এরপর হাইড্রোজেন ফিউশনে উৎপন্ন এই তাপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মত Steam Turbine ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে।
তাপ-পারমাণবিক গবেষণার ঐতিহাসিক সূচনা
১৯৫২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রথম হাইড্রোজেন বোমার (ফিউশন বোমা) সফল পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর পরাশক্তিগুলো তখন শীতল স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত (Cold war)। এসময় ১৯৫৫ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে একটি বৈঠক সম্পন্ন হয়। সে বৈঠকে প্রাপ্ত আমন্ত্রণে পরের বছর ১৯৫৬ সালের ১৮ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের Council of Ministers এর প্রেসিডেন্ট Nikolai Bulganin এবং কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি Nikita Khrushchev দুটি Destroyer যুদ্ধজাহাজের সশস্ত্র প্রহরায় একটি Cruiser যুদ্ধজাহাজে চেপে ব্রিটেনে আগমন করেন। ব্রিটেনে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতাদের আগমন ও বৈঠকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে পারস্পারিক সহযোগিতামূলক একটি চুক্তি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ।
এসময়টাতে সোভিয়েত নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের “Laboratory 2” এর দায়িত্বে ছিলেন Igor Vasilyevich Kurchatov. পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এর নাম পরিবর্তিত হয়েছে। I. V. Kurchatov এর নামানুসারে Kurchatov Institute করা হয়েছিল ১৯৬০ সালে। ২০১০ সালে পরিবর্তিত হয়ে এর নাম হয় National Research Center.
I. V. Kurchatov এর নেতৃত্বে এখানেই তৈরি হয়েছিল বিশ্বের প্রথম ফিউশন বোমা। একই সাথে তিনি কাজ করছিলেন নিয়ন্ত্রিত Thermo-Nuclear Fusion বিক্রিয়ার মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে।
অতঃপর ১৯৫৬ সালের ২৫ এপ্রিল Igor Kurchatov তৎকালীন যুক্তরাজ্যের Atomic Research Center, Harwell এ সেখানকার তিনশত পদার্থবিদের উপস্থিতিতে তাঁর “The possibility of producing thermonuclear reactions in a gaseous discharge” গবেষণার উপর বক্তব্য রাখেন। বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীগণ একত্রিত হয়ে নতুন ধরণের শান্তিপূর্ণ এই তাপ-পারমাণবিক শক্তির উৎস নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হন।
কিন্তু খানিকটা বাধ সাধে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ!! এটা যে একটা মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণা হতে যাচ্ছে এবং এর যে কোনো রাজনৈতিক কৌশলগত কিংবা সামরিক অবস্থান নেই সেটা আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দকে বোঝাতেই চলে গেছে দুই বছর।
১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাঁচ হাজার বিজ্ঞানীর উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে জাতিসংঘের স্পন্সরে জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয় “Second United Nations International Conference on the Peaceful Uses of Atomic Energy” যা সংক্ষেপে “Atoms for Peace conference” নামে পরিচিত। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পারমাণবিক গবেষণার প্রদর্শনী হয়। পৃথিবী এক নতুন পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করে যেখানে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য উন্মুক্তভাবে ফিউশন পারমাণবিক বিক্রিয়ার গবেষণা করা যায়।
তাপ-পারমাণবিক গবেষণার পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতি
Atoms for Peace Conference এ, অংশগ্রহণকারীদের থেকে তাপ পারমাণবিক গবেষণা সংক্রান্ত ২১০০ গবেষণাপত্র জমা পরে। সেখানকার Investigations of the Stability and Heating of Plasmas in Toroidal Chambers গবেষণা পত্রে থাকা ধারণা অনুযায়ী একটি পরীক্ষামূলক যান্ত্রিক সজ্জা প্রস্তুত করা হয় যেখানে হাইড্রোজেন প্লাজমা তৈরি করা সম্ভব হবে। এই ডিভাইসটিই পৃথিবীর প্রথম ফিউশন ডিভাইস। পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে ফিউশন গবেষণা ও ফিউশন যন্ত্রের বেশ উন্নতি সাধিত হয়েছে।
- ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের গবেষণাগারে তাদের তৈরি ফিউশন ডিভাইসে ফিউশন ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় সময় ধরে পর্যাপ্ত তাপমাত্রা প্রদান করা সম্ভব হয়। এই ফিউশন ডিভাইসের নাম দেয়া হয় এর পর থেকেই বিশ্বে ফিউশন গবেষণার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় টোকাম্যাক। গবেষণার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্লাজমা ল্যাবে টোকাম্যাক স্থাপিত হতে শুরু হয়।
- যুক্তরাজ্যের ৪০ টিরও বেশি গবেষণাগারের যৌথ উদ্যোগে তাপ-পারমাণবিক গবেষণাসংস্থা Joint European Torus (JET) এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। ১৯৯১ সালে JET Tokamak এ পৃথিবীর প্রথম নিয়ন্ত্রিত ফিউশন বিক্রিয়া সংঘটিত হয়।
- ফ্রান্সের Tore Supra Tokamak এ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে বিরতিহীনভাবে ফিউশন বিক্রিয়া সংঘটিত হয়েছে, ৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ড।
- জাপানের JT-60 Tokamak এর ফিউশন বিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি ঘনত্বের ফিউশন পার্টিকেল, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নিয়ে কাজ করেছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ফিউশন গবেষণাগারে প্লাজমার তাপমাত্রা কয়েকশ’ মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াসে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে।
আন্তর্জাতিক তাপ-পারমাণবিক গবেষণা সংস্থাসমূহ
১৯৫৮ সালে Thermo-Nuclear Fusion গবেষণা উন্মুক্ত হবার পর বিগত ৬০ বছরে বিভিন্ন দেশে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলেছে গবেষণা কার্যক্রম, বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছে জাতীয় পর্যায়ের গবেষণাগার এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বেশ কিছু সংখ্যক ফিউশন গবেষণা সংস্থা গড়ে উঠেছে, যারা ইতোমধ্যে বেশ কিছু উচ্চাভিলাষী প্রকল্পও হাতে নিয়েছে।
International Atomic Energy Agency (IAEA)
১৯৫৩ সালে তৎকালীন আমেরিকার সাধারণ পরিষদে রাষ্ট্রপতির “Atoms for Peach” ভাষণে উত্থাপিত প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৫৭ সালে গঠিত হয় International Atomic Energy Agency (IAEA). এ প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা করে যাচ্ছে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে। পারমাণবিক শক্তি গবেষণা ছাড়াও খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্য, কৃষি, চিকিৎসা, শিল্প, পারমাণবিক নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় নিয়েও এই সংস্থা কাজ করে আসছে সুদীর্ঘ ৬০ বছর ধরে।
International Energy Agency (IEA)
১৯৭৩-৭৪ সালে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সময় ১৭টি দেশ পারস্পারিক সহযোগিতামূলক জ্বালানী নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে নিজেদের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গড়ে তোলে International Energy Agency (IEA). পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আরো ১৩ টি দেশ যুক্ত হয়ে বর্তমানে এর সদস্য রাষ্ট্র সংখ্যা ৩০. এই সংস্থার লক্ষ্য এর সদস্য দেশগুলোতে সাশ্রয়ীমূল্যে পরিবেশবান্ধব নির্ভরযোগ্য শক্তির উৎস নিশ্চিত করা। সংস্থার Fusion Power Co-ordinating Committee (FPCC) অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফিউশন ভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থেকে গবেষণা সহযোগিতা প্রদান করে।
EUROfusion
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সুইজারল্যান্ডের ফিউশন গবেষণা সংস্থাগুলোর মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে একসাথে ফিউশন ও তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গবেষণা এগিয়ে নিতে ২০১৪ সালে গঠিত হয় EUROfusion. বর্তমানে ৩০ টি দেশের ফিউশন গবেষণা সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৬ টি স্টেট ও সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি ইউরো-ফিউশনের সদস্য। ইউরো-ফিউশন বর্তমানে EIROforum, Fusion for Energy এবং ITER এর সাথে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে ফিউশন ভিত্তিক তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির গবেষণায়।
EIROforum
আটটি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি গবেষণা সংস্থা এই সমন্বয়ক ফোরামের মধ্য দিয়ে পারস্পারিক কার্যক্রমের সংযোগ ও সমন্বয়ের কাজ করে আসছে। এতে গবেষণা কার্যক্রম একই সাথে বেগবান ও সহজ হয়ে উঠছে।
Fusion for Energy
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফিউশন ও ফিউশন রিঅ্যাক্টর বিষয়ক গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে ২০০৭ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় Fusion for Energy (F4E). এর প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্ববৃহৎ ফিউশন রিঅ্যাক্টর গবেষণা প্রকল্প ITER এর সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তাপ-পারমাণবিক গবেষণার সংযোগ ও সমন্বয় সাধন।
Tokamak Energy
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত Tokamak Energy কোনো জাতীয় গবেষণা সংস্থা নয়। এটি একটি ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠান। এটি তুলনামূলক ক্ষুদ্র পরিসরে অধিক কর্মদক্ষ (Efficient) টোকাম্যাক তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে। ডোনাট আকৃতির টোকাম্যাকের বদলে তারা আপেল শেপের টোকাম্যাক ডিজাইন করেছে যা compact Tokamak এর জন্য অধিক কর্মদক্ষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের মধ্যে টোকাম্যাকে ১০০ মিলিয়ন ডিগ্রী তাপমাত্রা তৈরি করে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ফিউশন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান।
সুবৃহৎ পরীক্ষামূলক ফিউশন ডিভাইস তৈরি প্রকল্প – ITER
১৯৮৫ সালের নভেম্বরে Geneva Superpower Summit এ সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের নিকট একটি নতুন ধারার, দূষণমুক্ত ও স্থায়ী শক্তির উৎস সৃষ্টির প্রকল্পের ব্যাপারে প্রস্তাব পেশ করা হয়। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবে সারা দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র একযোগে এমন শক্তির উৎস হিসেবে বৃহৎ পরিসরে ফিউশন গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলার আয়োজন করে। ১৯৮৮ সালে সুবৃহৎ পরীক্ষামূলক ফিউশন ডিভাইসের প্রাথমিক ধারণাগত ডিজাইন নিয়ে কাজ শুরু হয়। ২০০১ সালে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পরীক্ষামূলক ফিউশন যন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত ডিজাইন অনুমোদিত হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০৩ ও ২০০৫ সালে চীন, কোরিয়া ও ভারত এই গবেষণা কার্যক্রমের অংশীদার হয়। ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বর সাত সদস্যের (মোট ৩৫ টি রাষ্ট্র) মধ্যে প্রকল্পচুক্তি সম্পাদিত হয় ও ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর ITER দাপ্তরিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
ITER বর্তমান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এবং কার্যকরী পরীক্ষামূলক ফিউশন ডিভাইস তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। চলমান প্রকল্পে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ITER এর কার্যক্রম।
- JET টোকাম্যাকে ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মত নিয়ন্ত্রিত ফিউশন থেকে শক্তি উৎপাদন করা হয়েছিল। সেখানে ১৬ মেগাওয়াট শক্তি উৎপাদিত হয়েছিল। কিন্তু টোকাম্যাকে প্লাজমা তৈরি ও ফিউশনের তাপমাত্রায় উন্নীত করতে খরচ হয়েছিল ২৪ মেগাওয়াট শক্তি। অর্থাৎ সেখানে কোনো Net Energy তৈরি হয়নি। সেখানে সৃষ্ট ফিউশন, Energy Breakeven (Q=1) অর্জন করতে সমর্থ হয়নি। (Q = 0.67 in JET Tokamak)Energy Gain, Q = (Energy Produced by Fusion) / (Energy required to create fusion)এনার্জি গেইন তথা Q এর মান যখন ১ এর বেশি অর্থাৎ ফিউশন থেকে পাওয়া শক্তি যখন ফিউশন তৈরিতে ব্যয়িত শক্তির চেয়ে বেশি হবে তখনই প্রকৃতপক্ষে ফিউশন রিঅ্যাক্টর থেকে শক্তি সংগ্রহ করা যাবে।
তেমনই লক্ষ্য সামনে রেখে ITER ফিউশন ডিভাইস তৈরি করা হচ্ছে। ITER টোকাম্যাক এর আকার ও দক্ষতা এমনভাবে ডিজাইন করা হচ্ছে যাতে এর Q এর মান ১০ অথবা তার বেশি হয়। এর ডিজাইন এমন হচ্ছে যেখানে ৫০ মেগাওয়াট Heating power দিয়ে তা থেকে কমপক্ষে ৫০০ মেগাওয়াট Fusion power উৎপন্ন করা যাবে। পরীক্ষামূলক বিধায় এটি থেকে ফিউশনের ফলে উৎপন্ন তাপশক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করা হবে না। কিন্তু এটি সফলভাবে প্রস্তুত ও কার্যকর হলে প্রথমবারের মত কোনো ফিউশন রিঅ্যাক্টরের প্রকৃত Power gain অর্থাৎ Net Energy পাওয়া যাবে। Net Energy পাওয়া গেলে সেটি সংগ্রহ করে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা তুলনামূলক সহজ প্রক্রিয়া।
- এই পরীক্ষামূলক ফিউশন ডিভাইস সফল হলে বাস্তব ফিউশন রিঅ্যাক্টরের জন্য দরকারি বেশ কিছু বিষয়ের উচ্চতর গবেষণা এই ডিভাইসকে কেন্দ্র করেই করা সম্ভব হবে যা বাণিজ্যিক ফিউশন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- ITER এর প্লাজমার আয়তন বেশি হওয়ায় এতে বেশি তাপ উৎপন্ন হবে যা Deuterium-Tritium Plasma তৈরি করে ফিউশন বিক্রিয়াকে তুলনামূলক অধিক সময়ের জন্য স্থায়িত্ব এনে দিতে সক্ষম হবে।
- ফিউশন রিঅ্যাক্টরের জ্বালানী হিসেবে ট্রিটিয়াম প্রয়োজন। কিন্তু ট্রিটিয়াম তেজস্ক্রিয় ও অস্থিতিশীল হওয়ায় প্রকৃতিতে ট্রিটিয়াম সুলভ নয়। তাই ভবিষ্যৎ চাহিদার কথা বিবেচনায় এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ফিউশন রিঅ্যাক্টরের মধ্যেই ট্রিটিয়াম উৎপন্ন হতে পারে। এমনই একটি নিরীক্ষা Tritium Breeding পরিচালনা করা হবে ITER ফিউশন ডিভাইসে।
- ITER টোকাম্যাক এর পরীক্ষামূলক পরিচালনার মধ্য দিয়ে ফিউশনভিত্তিক শক্তি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও নিরাপত্তামূলক বিষয় নিয়েও গভীর তথা উঠে আসবে।
ITER প্রস্তাবিত ফিউশন ডিভাইসের গঠন ও কার্যপ্রণালী
ITER এর পরীক্ষামূলক টোকাম্যাকটি তৈরি করতে বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও প্রকৌশলগত বহুমুখী চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান দুটি হচ্ছে –
১. প্লাজমার তাপমাত্রা ১৫০ মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াসের মত এত উচ্চতাপমাত্রায় কিভাবে উন্নীত করা সম্ভব?
২. ১৫০ মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্লাজমা কিভাবে একটি চেম্বারে নিরাপদে আবদ্ধ রাখা সম্ভব যাতে সংশ্লিষ্ট চেম্বার এই তাপমাত্রার বস্তু ধরে রেখে টিকে থাকতে পারে?
মজার বিষয় হচ্ছে এখানে এমন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে যা প্লাজমাকে চেম্বারের দেয়াল থেকে নিরাপদ দূরত্বে পৃথক রাখবে এবং একই সাথে জ্বালানী হাইড্রোজেনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য কাজ করবে। প্লাজমা তাপমাত্রায় কোনো পদার্থই টিকে থাকে না। তাই প্লাজমা কোনোভাবেই ধারক চেম্বারের সরাসরি সংস্পর্শে আসতে পারবে না এবং চেম্বারের অভ্যন্তরীণ দেয়াল থেকে পর্যাপ্ত দূরত্বে থাকতে হবে। প্লাজমার ধারকের দেয়াল থেকে প্লাজমাকে বিচ্ছিন্ন রাখা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, নানাবিধ প্রযুক্তি ও পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছে। অবশেষে একাজে Magnetic Confinement পদ্ধতিটি সবচেয়ে উপযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অর্থাৎ শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে প্লাজমাকে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখা।
সহজভাবে বললে, প্লাজমাতে পরমাণুর নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন হয়ে আহিত কণা হিসেবে ছোটাছুটি করতে থাকে। আর গতিশীল আহিত কণা মাত্রই চৌম্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করবে। এই বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক চুম্বকের শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে প্লাজমাকে ভাসিয়ে রেখে ডোনাট আকৃতির ধারক চেম্বারের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট পথে উচ্চগতিতে গতিশীল করা হয়। এতে করে প্লাজমা, ধারক দেয়ালের সংস্পর্শে আসতে পারে না ও নিরাপদ দূরত্বে থাকে। চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তি যত বেশি হয় প্লাজমা-পার্টিকেলগুলো তত বেশি গতিশীল হয়। আর প্লাজমাতে উচ্চগতিতে চলমান কণাগুলোর গতিশক্তিই এখানে তাপশক্তি রূপে প্রতিভাত হয়। প্লাজমাতে থাকা আহিত কণাগুলো গতিশক্তি যত বেশি হবে প্লাজমার তাপমাত্রাও তত বৃদ্ধি পাবে। প্লাজমা কনফাইনমেন্ট এর পুরো ব্যবস্থাটি সুবৃহৎ ‘Superconducting Magnetic system’ দ্বারা পরিচালিত হবে।
এভাবে চৌম্বকীয় পদ্ধতিতে তাপমাত্রা বাড়িয়ে প্লাজমার তাপমাত্রা ফিউশনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা পর্যন্ত উত্তীর্ণ করা যায় না। তাই ফিউশনের কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রায় পৌঁছতে হলে চৌম্বক ক্ষেত্রের পাশাপাশি বাইরে থেকে প্লাজমায় অতিরিক্ত শক্তি সরবরাহ করতে হয়। ITER এ প্লাজমার তাপমাত্রা বাড়াতে উচ্চশক্তি সম্পন্ন আধানবিহীন পারমাণবিক কণা ছুঁড়ে দেয়া হবে এবং উচ্চশক্তি সম্পন্ন মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ প্রেরণ করা হবে প্লাজমাতে। শক্তিশালী তরঙ্গ ও উচ্চগতিশক্তি সম্পন্ন কণার সাথে মিথস্ক্রিয়া করে সেগুলো থেকে শক্তি সংগ্রহ করে প্লাজমা আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং একপর্যায়ে পৌঁছে যায় কাঙ্ক্ষিত শতাধিক মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। বাহ্যিক শক্তি সরবরাহ করে প্লাজমাকে কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রায় নিয়ে যেতে একাধিক বাহ্যিক তাপীয় ব্যবস্থার সমন্বয়ে সুসজ্জিত থাকে ‘External Heating system’.
এসকল জটিল যান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে এই যন্ত্রটি হতে যাচ্ছে একই সাথে অত্যন্ত sophisticated এবং complicated. দৈত্যাকৃতি ২৩,০০০ টন ওজনের যন্ত্রটিতে ৮৪০ ঘনমিটার প্লাজমা তৈরি হবে যার তাপমাত্রা থাকবে ১৫০ মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াস যা সূর্যের কেন্দ্রের ১০ গুণ! স্বভাবতই অতিসূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য অতিবৃহৎ গঠনের নানা যন্ত্র ও যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে গঠিত হবে এই টোকাম্যাক।
Vacuum Vessel
নিশ্ছিদ্র বায়ুরোধী ডোনাট আকৃতির ফাঁপা ভ্যাকুয়াম চেম্বারে তৈরি করা হয় প্লাজমা এবং সংঘটিত হয় ফিউশন বিক্রিয়া। প্লাজমার প্রাথমিক নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবেও কাজ করে এটি। ITER এর ভ্যাকুয়াম ভেসেলের বহিঃব্যাস ১৯.৪ মিটার এবং উচ্চতা ১১.৪ মিটার। এর ভেতরের আয়তন ১৪০০ ঘনমিটার। কিন্তু কার্যকরী অবস্থায় ১২.৪ মিটার ব্যাস পর্যন্ত ৮৪০ ঘনমিটার প্লাজমা তৈরি হয় ও ভেসেল দেয়ালের সংস্পর্শে না এসে উচ্চগতিতে ডোনাট চেম্বারের ভেতরে আবর্তিত হতে থাকে। ভ্যাকুয়াম ভেসেলের ভেতরের দেয়ালে ও বাইরে অন্যান্য যন্ত্রাংশ সংযুক্ত থাকে। স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি এই ভেসেলের ওজন ৫২০০ টন। আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ সংযুক্ত অবস্থায় ৮০০০ টন।
এর দেয়াল দুই স্তর বিশিষ্ট। দুই স্তরের মাঝে প্লাজমা ও ফিউশনে সৃষ্ট তাপকে সরিয়ে নিতে দু’ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকে। In-wall Shielding এ ভেসেল দেয়ালের দুই স্তরের মাঝে ৫৫ শতাংশ জায়গা ফেরোম্যাগনেটিক স্টেইনলেস স্টিলের মডিউল ব্লক দিয়ে পরিপূর্ণ থাকে। প্রতিটি ব্লকের ওজন ৫০০ কেজি। Thermal Shielding এ বিশেষ তাপরোধী স্টেইনলেস স্টিল প্যানেল বসানো থাকে যার সাথে সংযুক্ত থাকে কুলিং টিউব। এই টিউবের মধ্য দিয়ে ৮০-১০০ কেলভিন তাপমাত্রার হিলিয়াম গ্যাস প্রবাহিত হয়। থার্মাল শিল্ডিং এর একটি অংশ বসানো থাকে ভ্যাকুয়াম ভেসেল ও ম্যাগনেটের মাঝে, আরেকটি অংশ থাকে ম্যাগনেট ও Cryostat এর মাঝে।
এছাড়া দেয়ালের দুই স্তরের মাঝে কুলিং সিস্টেমের পানি প্রবাহিত হয় ভেসেলের দেয়াল ঠাণ্ডা রাখার জন্য। এর ভেতরের দেয়ালে Blanket এবং Divertor বসানো থাকে। ভ্যাকুয়াম ভেসেলে ৪৪ টি সংযোগমুখ (Port) থাকে যার সাহায্যে পর্যবেক্ষণ, পরিচালনা, কুলিং ইত্যাদি প্রক্রিয়ার জন্য নানাবিধ যন্ত্রাংশ সংযুক্ত থাকে।
Superconducting Magnet
ITER টোকাম্যাকে niobium-tin (Nb3Sn) এবং niobium-titanium (Nb-Ti) এর তৈরি ৫০০ টন Superconducting Magnet এর সাহায্যে ৫১ গিগাজুল চৌম্বকশক্তি প্রয়োগ করা হবে প্লাজমার উপর। এই চৌম্বক শক্তির প্রভাবে প্লাজমা নির্ধারিত আকৃতিতে ভ্যাকুয়াম ভেসেলের চেম্বারে ভেসে থাকবে ও নিয়ন্ত্রিতভাবে ভ্যাকুয়াম ভেসেলে আবর্তিত হবে।
সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেটের সুবিধা হল এটি নিম্ন তাপমাত্রায় উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। এই শক্তিশালী বৈদ্যুতিক-চুম্বকগুলোর তাপমাত্রা রাখা হবে পরমশূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি, মাত্র ৪ কেলভিন বা -২৬৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। চুম্বকগুলোর একটি অবস্থান থাকবে ডোনাট চেম্বারের কেন্দ্রে লম্বা সিলিন্ডার আকৃতিতে এবং আরেকটি হবে ভ্যাকুয়াম ভেসেলের বাইরের দেয়ালে চারদিক ঘিরে অনেকগুলো ব্লক আকারে। প্লাজমার প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করবে এই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন চৌম্বকক্ষেত্র।
Toroidal Field System, Poloidal Field System, Central Solenoid, Correction Coils, In-Vessel Coils, Magnet Feeders ইত্যাদি সাব-সিস্টেমের সমন্বয়ে গঠিত এই বিশাল সুপারকন্ডাকটিং ম্যাগনেটিক সিস্টেম।
Blanket
এই যন্ত্রাংশটি একই সাথে দুটো কাজ করে। প্রথমত টোকাম্যাককে ফিউশনে সৃষ্ট উচ্চ তাপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করে, দ্বিতীয়ত ফিউশনে উৎপাদিত শক্তি সংগ্রহ করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ফিউশন বিক্রিয়ায় উচ্চগতিশক্তি সম্পন্ন নিউট্রন উন্মুক্ত হয়। নিউট্রন আহিত কণা না হওয়ায় তা চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে প্রভাবিত হয় না ও ভ্যাকুয়াম ভেসেল দেয়ালে আঘাত করে যা তাপশক্তি আকারে ভেসেলের ভেতরের পৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে। উচ্চশক্তি সম্পন্ন নিউট্রন থেকে শক্তি সংগ্রহ করে ভ্যাকুয়াম ভেসেল, সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেট ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশকে রক্ষার জন্য ITER টোকাম্যাকের ভ্যাকুয়াম ভেসেলের ভেতরের পৃষ্ঠে Blanket Module ব্যবহার করা হবে।
ভ্যাকুয়াম ভেসেলের অভ্যন্তরভাগের বিভিন্ন অংশের আকৃতির উপর নির্ভর করে অবস্থানানুসারে ১৮০ টি ভিন্ন ডিজাইনের মোট ৪৪০ টি Blanket Module ভ্যাকুয়াম ভেসেলের ভেতরের সম্পূর্ণ পৃষ্ঠ ঢেকে রাখবে। ১×১.৫ মিটার আকারের প্রতিটি মডিউলের ওজন ৪.৬ টন। উত্তপ্ত হাইড্রোজেন প্লাজমার মুখোমুখি থাকতে হবে বলে এর সাথে বিক্রিয়া করে না এমন পদার্থ বেরিলিয়াম টাইলস দিয়ে প্রস্তুত করা হয় ব্ল্যাঙ্কেট মডিউলগুলোর সম্মুখভাগ। এগুলো যুক্ত থাকে স্টেইনলেস স্টিলের গাঠনিক কাঠামোর সঙ্গে, যে কাঠামো ভ্যাকুয়াম ভেসেলের ভেতরের গায়ে বোল্ট দিয়ে আটকানো থাকবে।
উচ্চশক্তি সম্পন্ন নিউট্রন Blanket Module এ বাধাপ্রাপ্ত হয় ও এর গতিশক্তি তাপশক্তি আকারে Blanket Module শোষণ করে। Blanket Module এর সাথে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন তাপ নির্গমন ব্যবস্থা (Cooling system) সংযুক্ত থাকে যা এই তাপশক্তিকে বাইরে প্রবাহিত করে ও Blanket Module কে ঠাণ্ডা রাখে। Blanket Module এর সাথে সংযুক্ত কুলিং সিস্টেমে ৪ মেগাপ্যাসকেল চাপে ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানি প্রবাহিত করা হয় যা উত্তপ্ত Blanket Module এর তাপ অপসারণ করে টোকাম্যাকের বাইরে নিয়ে আসে। ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ITER টোকাম্যাকের কুলিং সিস্টেমের সর্বোচ্চ থার্মাল লোড ডিজাইন করা হয়েছে ৭৩৬ মেগাওয়াট। এই সংগৃহীত তাপশক্তি থেকেই ভবিষ্যৎ তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।
Divertor
ভ্যাকুয়াম ভেসেলের ভেতরের পৃষ্ঠ Blanket Module দিয়ে আবৃত থাকলেও ভেসেলের নিচের দিকটাতে Blanket Module থাকে না। সেখানে ব্যবহার করা হয় Divertor. ভেসেলের নিচের পুরো অংশ মোট ৫৪ টি ডাইভারটর খণ্ড দিয়ে আবৃত থাকে। প্রতিটি খণ্ডকে Divertor cassette বলা হয়। প্লাজমা মূলত সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও এর নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ ও প্লাজমার অবস্থা পর্যবেক্ষণের কাজে সহায়তা করে Divertor. এর মূল কাঠামো স্টেইনলেস স্টিল দ্বারা নির্মিত। এই কাঠামোর ভেতর কিছু নিরীক্ষণ যন্ত্রাংশ (Diagnostic Component) সংযুক্ত থাকে। এছাড়া এটিও প্লাজমার মুখোমুখি থাকায় প্লাজমার উচ্চতাপ থেকে এসব যন্ত্রাংশকে সুরক্ষা দিতে এর বহিরাবরণে থাকে সর্বোচ্চ গলনাংক বিশিষ্ট পদার্থ টাংস্টেন। টাংস্টেন আবরণের সাথে সংযুক্ত থাকে কুলিং সিস্টেম যা প্রতি বর্গমিটারে ১০-২০ মেগাওয়াট তাপশক্তি অপসারণ করতে পারে। সামগ্রিকভাবে প্রতিটি Divertor Cassette এর ওজন ১০ টন।
Cryostat
মূল টোকাম্যাকের সামগ্রিক যান্ত্রিক সজ্জা একটি বৃহৎ ভারী ভ্যাকুয়াম চেম্বারের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। একে Cryostat বলা হয়। এটি সর্বশেষ নিরাপত্তাবেষ্টনী হিসেবেও কাজ করে। ৩০ মিটার ব্যাস ও ৩০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট ভ্যাকুয়াম চেম্বারটি তৈরি হবে ৩৮৫০ টন স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে যার পাদদেশই থাকবে ১২৫০ টনের বেস স্ট্রাকচার। এর ভেতরের ব্যাস ২৮ মিটার। বর্তমানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভ্যাকুয়াম চেম্বার হবে ITER টোকাম্যাকের Cryostat. কার্যকরী অবস্থায় ১৬,০০০ ঘনমিটার আয়তনের এই চেম্বার শূন্য চাপে (Vacuum Pressure) থাকবে যার মান হবে বায়ুমণ্ডলীয় চাপের এক মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। এই অতি নিম্নচাপ সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেটগুলোকে পরমশূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি তাপমাত্রার রাখার জন্য জরুরী।
ITER টোকাম্যাকে প্রধান এ অংশ গুলো ছাড়াও আরো অনেকগুলো দরকারি আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা সংযুক্ত থাকবে।
Vacuum System
ভ্যাকুয়াম ভেসেল এবং Cryostat কে কাঙ্ক্ষিত নিম্নচাপে রাখার জন্য বৃহৎ একাধিক ভ্যাকুয়াম পাম্প সংযুক্ত থাকবে। ছয়টি মেকানিক্যাল পাম্প ও ছয়টি ক্রায়োজেনিক পাম্পের সাহায্যে ডিভাইসে অতি নিম্নচাপ বজায় রাখা হবে। টোকাম্যাকের কার্যক্রম শুরু হবার আগে এই নিম্নচাপে নামিয়ে আনতে পাম্পগুলোর সময় লাগবে ২৪-৪৮ ঘণ্টা।
Cryogenic System
৪ কেলভিন তাপমাত্রার হিলিয়াম ও ৮০ কেলভিন তাপমাত্রার নাইট্রোজেনের অনবরত প্রবাহের মাধ্যমে Cryostat এর ভেতরের পরিবেশ এবং সুপারকন্ডাকটিং ম্যাগনেটগুলোর যথাযথ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হবে। Large Hadron Collider (LHC) এর পর ITER এর ক্রায়োজেনিক সিস্টেমই এতটা শক্তিশালী ক্রায়োজেনিক সিস্টেম।
Cooling Water System
১৫০ মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্লাজমা থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরের ভ্যাকুয়াম ভেসেলের দেয়ালকে মাত্র ২৪০ ডিগ্রী রাখার প্রয়োজন হয়। এছাড়া টোকাম্যাকের অন্যান্য যন্ত্রাংশকেও প্লাজমার উচ্চতাপ থেকে রক্ষা করে নির্ধারিত নিম্নতাপমাত্রায় রাখতে হয়। এই কাজটিই করে থাকে Tokamak Cooling Water System (TCWS). একাধিক closed loop heat transfer system এবং একটি open loop heat rejection system এর মধ্যদিয়ে অনবরত পানি প্রবাহের মাধ্যমে প্লাজমা ও ফিউশনে উৎপন্ন উচ্চতাপ টোকাম্যাকের বাইরে অপসারণ করা হয় ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশকে কার্যকরী তাপমাত্রায় রাখা হয়।
External Heating System
টোকাম্যাকের ভ্যাকুয়াম ভেসেলে প্লাজমা তৈরি হবার পর ফিউশন সংঘটিত হবার জন্য প্লাজমার তাপমাত্রা ১৫০ মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াস হওয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রভাবে প্লাজমাতে এই তাপমাত্রা উৎপন্ন করা সম্ভব হয় না। তাই কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রা পাবার জন্য ITER টোকাম্যাকে সংযুক্ত থাকবে তিন ধরণের বাহ্যিক তাপের উৎস। Neutral Beam Injection, Ion Cyclotron Heating, Electron Cyclotron Heating এই তিন পদ্ধতি ব্যবহার করে বাইরে থেকে ৫০ মেগাওয়াট শক্তি প্লাজমাতে সরবরাহ করে প্লাজমার তাপমাত্রা কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছানো হবে।
Natural Beam Injection পদ্ধতি অনেকটা কাপুচিনো মেশিনে দুধ গরম করার মত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে উচ্চগতিতে শক্তিশালী আধানবিহীন পারমাণবিক কণা ছুঁড়ে দেয়া হয় প্লাজমাতে। এই কণা প্লাজমা-পার্টিকেলের গুলোর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং এর শক্তি প্লাজমা-পার্টিকেলে স্থানান্তরিত হয় যা প্লাজমার তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে।
Ion Cyclotron Resonance Heating (ICRH) পদ্ধতি অনেকটা মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করার মত। এক্ষেত্রে ৪০-৫৫ মেগাহার্টজ কম্পাংকের শক্তিশালী বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ (Electro-magnetic wave) প্রয়োগ করে প্লাজমাতে তাপশক্তি সরবরাহ করা হয়।
Electron Cyclotron Resonance Heating পদ্ধতি অনেকটা ICRH পদ্ধতির মতই। এখানেও শক্তি সরবরাহ করা হয় বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে। তবে এখানে ইলেকট্রনের রেজোন্যান্স ফ্রিকোয়েন্সি ১৭০ গিগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতে তরঙ্গ প্রেরণ করা হয় যাতে প্লাজমাতে থাকা ইলেকট্রন আন্দোলিত হয় তথা ইলেকট্রনের শক্তি বৃদ্ধি পায়। এই শক্তি প্লাজমার তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে।
Fuel Cycle
ITER টোকাম্যাকের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হবে হাইড্রোজেন আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম। ফিউশন চক্রের শুরুতে ডিউটেরিয়াম ব্যবহার করে প্লাজমা তৈরি করে ফিউশন শুরু হবে এবং তারপর সেখানে ট্রিটিয়াম সরবরাহ করা হবে। শক্তিশালী গ্যাস পাম্পের সাহায্যে এবং কখনো কখনো কয়েক মিলিমিটার আকৃতির কঠিন হাইড্রোজেন কিউব আকারে প্লাজমায় জ্বালানী সরবরাহ করা হবে। ভ্যাকুয়াম ভেসেলের নিচে থাকা Divertor এর সাহায্যে অব্যবহৃত জ্বালানী সংগ্রহ করে নতুন জ্বালানীর সাথে মিশিয়ে পুনরায় প্লাজমাতে প্রয়োগ করা হবে। অপ্রতুল জ্বালানী ট্রিটিয়ামের সহজতর যোগান উদ্ভাবনে টোকাম্যাকের মধ্যেই ট্রিটিয়াম উৎপন্ন করার পদ্ধতি Tritium Breeding পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালিত হবে ITER টোকাম্যাকে।
Power Supply
ITER Plant পরিচালনায় ১১০ মেগাওয়াট থেকে শুরু করে প্লাজমা ফিউশন চলাকালীন বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজনীয়তা বেড়ে দাঁড়াবে ৬২০ মেগাওয়াট। এই শক্তির আশি শতাংশই খরচ হবে Cooling Water System এবং Cryogenic System চালু রাখতে। আর বাকি শক্তির বেশিরভাগ অংশ ব্যয় হবে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরিতে ও External Heating System পরিচালনায়। ITER Plant এর জরুরী পাওয়ার ব্যাকআপ এর জন্য দুটি ডিজেল জেনারেটর রয়েছে।
Diagnostics
ITER টোকাম্যাক একটি পরীক্ষামূলক যন্ত্র। স্বভাবতই গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের নিমিত্তে এতে সংযুক্ত থাকবে নানাবিধ নিরীক্ষাযন্ত্র। Magnetic, Neutron Diagnostic, Optical, Bolometric, Spectroscopic, Microwave ইত্যাদি নানা ধরণের প্রায় ৫০ টি উপাত্ত পরিমাপক ও সংগ্রাহক ব্যবস্থা সংযুক্ত থাকবে ITER টোকাম্যাকে।
ITER প্রকল্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
Tritium Breeding
ফিউশন রিঅ্যাক্টরের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হবে হাইড্রোজেনের ভারী আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম। সমুদ্রের পানিতে গড়ে প্রতি ঘনমিটারে ৩৩ মিলিগ্রাম ডিউটেরিয়াম আইসোটোপ পাওয়া যায় এবং তা সহজেই সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু ট্রিটিয়াম প্রকৃতিতে যথেষ্ট দুর্লভ। কসমিক রেডিয়েশনের প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বছরে মাত্র কয়েক কিলোগ্রাম ট্রিটিয়াম উৎপন্ন হয়। ট্রিটিয়াম দুর্লভ হলেও ডিউটেরিয়াম-ট্রিটিয়াম ফিউশনে সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় সর্বোচ্চ এনার্জি গেইন পাওয়া যায় বিধায় বৃহদায়তন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ট্রিটিয়াম আবশ্যক।
ট্রিটিয়ামের যোগান পেতে কিছুটা আশার আলো পাওয়া যায় CANDU টাইপ ফিশন রিঅ্যাক্টর থেকে। এধরণের রিঅ্যাক্টরগুলোতে প্রতি ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রিঅ্যাক্টরে প্রতিবছর ১০০ গ্রাম ট্রিটিয়াম উপজাত হিসেবে উৎপাদিত হয়। এভাবে সারা পৃথিবীতে বছরে মাত্র বিশ কেজি ট্রিটিয়ামের উৎপাদন হয়। গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় এই পরিমাণ ট্রিটিয়াম মোটামুটি পর্যাপ্ত হলেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফিউশন রিঅ্যাক্টরের জ্বালানী হিসেবে অপ্রতুল। বাণিজ্যিকভাবে ফিউশনভিত্তিক তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় প্রতিটি রিঅ্যাক্টরে বছরে আনুমানিক ১০০-২০০ কেজি ট্রিটিয়াম প্রয়োজন হবে। এই ট্রিটিয়ামের উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে ফিউশন রিঅ্যাক্টরের ভেতরেই। টোকাম্যাকের মধ্যে ট্রিটিয়ামের পর্যাপ্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী ফিউশন রিঅ্যাক্টর তৈরি করা সম্ভব হবে। আর টোকাম্যাকে ট্রিটিয়াম উৎপাদনের একটি পদ্ধতির প্রাথমিক পরীক্ষা সম্পাদিত হবে ITER প্রকল্পে।
ভ্যাকুয়াম ভেসেলের ভেতরের দেয়ালে সংযুক্ত ব্ল্যাংকেট মডিউলের কয়েকটি প্রস্তুত হবে বিশেষভাবে। এই বিশেষ ব্ল্যাংকেট মডিউলগুলোর বাইরের পৃষ্ঠে লিথিয়াম অণু মিশ্রিত থাকবে। ফিউশনে নির্গত উন্মুক্ত নিউট্রন উচ্চগতিতে যখন লিথিয়াম অণুতে আঘাত করবে তখন লিথিয়াম অণু ভেঙ্গে একটি হিলিয়াম ও একটি ট্রিটিয়াম অণুতে পরিণত হবে। এই ট্রিটিয়াম অণুগুলোই আবার ব্যবহৃত হবে ফিউশন বিক্রিয়ার জ্বালানী হিসেবে।
ভূপৃষ্ঠে যে পরিমাণ সংগ্রহযোগ্য লিথিয়ামের উৎস আছে তা থেকেই ফিউশন রিঅ্যাক্টরে পর্যাপ্ত লিথিয়াম সরবরাহ করা যাবে। আবার সমুদ্রের পানি থেকেও লিথিয়াম পৃথক করা যায়, ফলে লিথিয়াম থেকে ট্রিটিয়াম উৎপাদন পদ্ধতি সফল হলে জ্বালানী হিসেবে ট্রিটিয়ামের যোগানও প্রায় ডিউটেরিয়ামের মতই সহজলভ্য হয়ে উঠবে।
এভাবে টোকাম্যাকের ভেতরে ট্রিটিয়াম উৎপাদন পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে Tritium Breeding. একাধিক ডিজাইনে ট্রিটিয়াম ব্রিডিং পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। ITER প্রকল্পেই পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনা করা হবে এই পদ্ধতি। আর এ পদ্ধতিতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে ট্রিটিয়াম উৎপাদন করা গেলে তা ফিউশন রিঅ্যাক্টর গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ বলে বিবেচিত হবে। ট্রিটিয়াম ব্রিডিং ফিউশনকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং ফিউশন ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দীর্ঘস্থায়ী ফিউশন অত্যাবশ্যক।
DEMO
ITER এর বর্তমান প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হবার পর এটি এর পরবর্তী প্রকল্প DEMO নিয়ে পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করবে। এটি হবে বর্তমান ফিউশন ডিভাইসের উন্নত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ। DEMO প্রকল্পের ফিউশন মেশিনের দক্ষতা বেশি থাকবে। এনার্জি গেইনের মান হবে Q = 30-50. ফিউশনে উৎপাদিত তাপ শক্তি সংগ্রহ করার পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা সংযুক্ত হবে ও তা আরো উন্নত করার গবেষণা চলবে। টোকাম্যাকের মধ্যেই ফিউশন স্থিতিশীল রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ ট্রিটিয়াম ব্রিডিং পদ্ধতি যুক্ত থাকবে।
বর্তমানের ফিউশন ডিভাইসে ফিউশন বেশিক্ষণ স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয় না। টোকাম্যাকে ফিউশন চলার এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড ৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ড। বর্তমান প্রকল্পের গবেষণার ফলাফলকে কাজে লাগিয়ে DEMO প্রকল্পে ফিউশনকে স্থিতিশীল (Continues or Steady-state) রাখার ব্যবস্থা থাকবে। DEMO প্রকল্পের এই সামগ্রিক সমন্বিত পরীক্ষামূলক ব্যবস্থাকে একটি “ক্ষুদ্র ‘প্রায়’ ফিউশন রিঅ্যাক্টর” বলা যেতে পারে। আশা করা হচ্ছে বর্তমান প্রকল্পের গবেষণায় প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য সুফল হাতে নিয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ DEMO প্রকল্পের কাজ দাপ্তরিকভাবে শুরু হবে এবং ২০৪০ সাল নাগাদ DEMO প্রকল্পের উন্নততর ফিউশন মেশিন কার্যকর করা যাবে।
Prototype Fusion Reactor
DEMO প্রকল্প সফল হয়ে গেলে এর পর ধরা হবে “প্রোটোটাইপ রিঅ্যাক্টর” তৈরির কাজ। পূর্ণাঙ্গ তাপ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সকল ব্যবস্থা সমৃদ্ধ কিন্তু আকারে তুলনামূলক ছোট এই রিঅ্যাক্টর কাঙ্ক্ষিত ‘ফিউশন থেকে বিদ্যুৎ’ সফলভাবে তৈরি করতে সক্ষম হবে। যার মাধ্যমে বিশ্বের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জগতে এবং একই সাথে শক্তির উৎসের যোগানে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন তৈরি হবে।
তাপ-পারমাণবিক শক্তির সুবিধা ও প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান বিশ্বে যখন জীবাশ্ম জ্বালানী ফুরিয়ে যেতে বসেছে তখন ক্রমবর্ধমান শক্তির চাহিদা মেটাতে কেন পারমাণবিক শক্তির দিকে ধাবিত হওয়া একান্ত জরুরী সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছিল প্রথম পর্বের “পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা” অংশে।
পারমাণবিক শক্তি বলতে এতদিন শুধু ফিশনভিত্তিক শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থাই প্রচলিত ছিল। কিন্তু ফিশনভিত্তিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয় ভারী তেজস্ক্রিয় মৌল ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম। স্বভাবতই অতি অল্প পরিমাণ জ্বালানীতে বিপুল শক্তি উৎপাদন করা গেলেও এসব মৌল প্রকৃতিতে মোটামুটি দুর্লভ এবং তেজস্ক্রিয় হওয়ায় অস্থিতিশীল ও অস্থায়ী। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মধ্যদিয়ে ক্ষয় হয়ে সময়ের পরিক্রমায় এগুলো হালকা মৌলে পরিণত হয়। এভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার ও তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের কারণে সুদূর ভবিষ্যতে একদিন জীবাশ্ম জ্বালানীর মত পারমাণবিক শক্তি সমৃদ্ধ তেজস্ক্রিয় ভারী মৌলের মজুদও শেষ হয়ে আসবে। ততদিনে পৃথিবীতে শক্তির চাহিদা বেড়ে যাবে আরো বহুগুণ। প্রাকৃতিক নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের কর্মদক্ষতা (Efficiency) এখন পর্যন্ত যতটুকু তাতে শুধুমাত্র নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে ভবিষ্যতের বিশাল পরিমাণ শক্তির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় পদার্থ যার মারাত্মক বিধ্বংসী ক্ষমতা রয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আড়ালে পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধকরণের একটি সম্ভাবনা থেকেই যায় বর্তমান ক্ষমতালোভী মানব সমাজে, যা একটি ভয়ংকর দুশ্চিন্তার বিষয়। এছাড়া ফিশনভিত্তিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহৃত জ্বালানী প্রচুর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নির্গত করে এবং সেগুলোকে অনেক লম্বা সময়ের জন্য খুবই সতর্কতার সাথে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় Dispose করতে হয় পরিবেশে তেজস্ক্রিয় দূষণ রোধ করতে। বর্তমানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে সেক্ষেত্রে পরিবেশে তেজস্ক্রিয় দূষণ ছড়িয়ে পরার খানিকটা সম্ভাবনা রয়ে যায়।
অপরদিকে ফিউশন ভিত্তিক তাপ-পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে –
- বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানী হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহৃত হবে। এর আইসোটোপ ট্রিটিয়াম তেজস্ক্রিয়। তবে পর্যায় সারণীর প্রথম মৌল হাইড্রোজেন সবচেয়ে হালকা মৌল হিসেবে স্বভাবতই এর তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অতি নগণ্য। ট্রিটিয়ামের অর্ধায়ু (Half life) মাত্র ১২.৩ বছর। স্বল্প মাত্রার বেটা ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে ট্রিটিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা নির্গত হয়। এর শক্তি এতটাই কম যে মানুষের চামড়া এমনকি একটি পাতলা কাগজও এর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ আটকে দিতে সক্ষম। এটি ক্ষতিকর হতে পারে শুধু পানি বা অন্য কোন খাদ্যের সাথে মিশে দেহে প্রবেশ করলে। এই ক্ষতিকর অবস্থা রোধ করার জন্য যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োজন তা ইউরেনিয়াম কিংবা প্লুটোনিয়াম ব্যবস্থাপনার চেয়ে হাজার গুণ সহজ। রিঅ্যাক্টরের অভ্যন্তরে যেসকল অংশ ট্রিটিয়ামের তেজস্ক্রিয় দূষণে হালকা দূষিত হবে সেগুলোকে প্ল্যান্টে থাকা বিশেষ ভবনে ১০০ বছর আবদ্ধ রাখা হবে। ১০০ বছরে দূষিত পদার্থগুলোর দূষণের মাত্রা নেমে আসবে ঝুঁকিমুক্ত অবস্থায়। তখন সেগুলোকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবহার করা যাব।
- সমুদ্রের পানি থেকে ডিউটেরিয়াম ও লিথিয়াম সংগ্রহ করে লিথিয়াম থেকে টোকাম্যাকে ট্রিটিয়াম উৎপাদন করা গেলে ফিউশন রিঅ্যাক্টরের জ্বালানির পরিমাণ হবে কার্যত প্রায় অফুরন্ত। এক দিকে যেমন অতি সামান্য পরিমাণ জ্বালানী থেকে প্রচুর শক্তি উৎপাদন করা যাবে তেমন এই জ্বালানীর ধারক সমুদ্রের পানি। প্রায় ৬ মিলিয়ন বছরের জন্য মানুষকে আর শক্তির উৎস নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে হবে না। যেখানে ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করতে প্রতি বছর জ্বালানীর প্রয়োজন হয় আনুমানিক কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২ মিলিয়ন টন, জীবাশ্ম জ্বালানী তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১.৩ মিলিয়ন টন, ফিশনভিত্তিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩০ টন ইউরেনিয়াম অক্সাইড সেখানে ফিউশন ভিত্তিক তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানী প্রয়োজন হবে মাত্র ৬০০ কেজি; অর্ধেক ডিউটেরিয়াম এবং বাকি অর্ধেক ট্রিটিয়াম।
- ফিশনভিত্তিক পারমাণবিক অস্ত্রের শক্তি বৃদ্ধির জন্য ফিউশন সংযুক্ত করে থার্মো-নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরি করা গেলেও হাইড্রোজেন আইসোটোপের তেজস্ক্রিয়তা কম বলে শুধুমাত্র ফিউশনভিত্তিক কোনো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। এদিক দিয়ে ফিউশন গবেষণার কোনো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি নেই কিংবা ফিউশন রিঅ্যাক্টরের আড়ালে পরমাণু শক্তি সমৃদ্ধকরণের কোনো সুযোগ নেই।
- ফিউশন রিঅ্যাক্টরে জ্বালানী হাইড্রোজেন থেকে তাপ-পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন হবে হিলিয়াম যাকে বলা হয় নিষ্ক্রিয় গ্যাস। তেজস্ক্রিয় দূষণ তো দূরের কথা রাসায়নিক সংশ্লেষণের সম্ভাবনা পর্যন্ত নেই এই গ্যাসে। কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ বিহীন এই প্রযুক্তি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব।
- ভারী প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পরে পুরো শক্তিকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো বিস্ফোরণ কিংবা ফিশন রিঅ্যাক্টরের মত ‘কোর মেল্টডাউন’ জাতীয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই। ফিউশনের মৌলিক নীতি এবং উন্নত Thermal Technology এর কারণেই এটি এতটা নিরাপদ। টোকাম্যাক কার্যকরী অবস্থায় ফিউশন চলার সময় যেকোনো মুহূর্তে জ্বালানী থাকবে ৪ গ্রামের কম। কোনো কারণে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বসে পরলেও টোকাম্যাকের ভ্যাকুয়াম ভেসেল তাপের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে না বা গলে যাবে না।
ITER Preliminary safety report এ দেখানো হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রে স্বাভাবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন চলাকালে উন্মুক্ত সবচেয়ে নিকটবর্তী স্থানে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা Natural Background Radiation এর মাত্রার এক সহস্রাংশ। এমনকি ‘worst-case scenario’ তে যেমন প্ল্যান্টে বড় ধরণের অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি ক্ষেত্রেও প্ল্যান্টের আশেপাশে বসবাসরত মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার প্রয়োজন নেই।
Fusion Power এর অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর সারসংক্ষেপ এবং ITER প্রকল্পের মৌলিক কিছু বিষয় নিয়ে ৫ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও তৈরি করেছে ITER. এই ভিডিওটি সাধারণের কাছে ফিউশনভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পুরো বিষয়টিকে আরো সহজভাবে বোধগম্য করতে ভূমিকা রাখবে।
নির্দ্বিধায় বলা যায় শক্তি উৎপাদনে তাপ-পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়ার ব্যবহার নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত, পরিবেশবান্ধব এবং পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের অনন্য সুযোগ। প্রতিটি ফিউশনভিত্তিক তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যেন ‘পৃথিবীর বুকে এক খণ্ড সূর্য’। জ্বালানী সীমাবদ্ধতার একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নিয়ে আসতে সক্ষম ফিউশনভিত্তিক তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীগণের অদম্য প্রচেষ্টায় হয়ত এই শতাব্দীতেই প্রোটোটাইপ তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে মানব সভ্যতা ফিউশনভিত্তিক বিদ্যুতের জগতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।
তবে এই সময়কাল বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতির উপর অনেকাংশে নির্ভর করছে। তাত্ত্বিকভাবে ‘প্রোটোটাইপ ফিউশন রিঅ্যাক্টর তৈরি করা সম্ভব’ ঘোষণা আসার পরেও সেটি বাস্তবায়ন বৃহৎ পরিসরে নির্ভর করবে বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সিদ্ধান্তের উপর। কিন্তু এই সময়কালটাও হয়ত এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের দিকেই হবে এমন পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র
১. Dissociation and ionization of warm dense hydrogen – Materials and Process Simulation Center, Caltech University
২. Plasma: a strange state of matter – ITER Magazine
৩. What is Fusion? – ITER
৪. East Meets West At Geneva (1955) – British Pathé News
৫. B & K Arrive Aka Bulganin And Khrushchev Arrive (1956) – British Pathé News
৬. About Igor Kurchatov – National Research Center (Kurchatov Institute)
৭. Brief History of Kurchatov Institute – National Research Center (Kurchatov Institute)
৮. The possibility of producing thermonuclear reactions in a gaseous discharge – Journal of Nuclear Energy (ScienceDirect link)
DOI: 10.1016/0891-3919(57)90054-2 , BAK link
৯. 60 years ago: the speech that changed everything – ITER News
১০. Two weeks in September, 1958: Atoms for Peace conference in Geneva – ITER News
১১. Investigations of the Stability and Heating of Plasmas in Toroidal Chambers – IAEA, BAK link
১২. 60 Years of Progress – ITER
১৩. Worldwide Fusion Links – ITER
১৪. The ITER Tokamak – ITER
১৫. Tritium: Changing lead into gold – ITER Magazine
১৬. Fuelling the Fusion Reaction – ITER
১৭. Tritium Breeding – ITER
১৮. After ITER – ITER
১৯. The Nuclear Fusion Energy and the Project ITER – EFDA Presentation by Alberto Loarte, Plasma Operation Directorate, ITER Organization; BAK link
২০. Safety and Environment – ITER
২১. ITER
২২. International Atomic Energy Agency (IAEA)
২৩. National Research Center “Kurchatov Institute”
২৪. The path to fusion power – The Royal Society
DOI: 10.1098/rsta.2009.0216, PMCID: PMC3263804 (NCBI link), PMID: 20123748