১৯০৫ সালে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ্যলবার্ট আইনস্টাইন ভর–শক্তি তুল্যতা সূত্র প্রতিপাদন করেন। তাত্ত্বিকভাবে তখন থেকেই পারমাণবিক শক্তির যাত্রা শুরু। বস্তু বা পদার্থ এবং শক্তি যে দুটি ভিন্ন রূপ এবং পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায় – এই সূত্রের সাহায্যেই তা প্রথম প্রমাণিত হয়। পারমাণবিক শক্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটিই হল তার পরিমাণ। অতি অল্প পরিমাণ বস্তু থেকে যে বিপুল পরিমাণে শক্তি আহরণ করা যায়, তা ঐ সময়ে অচিন্তনীয় ছিলো। পারমাণবিক চুল্লি এই শক্তি আহরণ করেই মানব সভ্যতা বিকাশে অবদান রাখছে এবং প্রায় অফুরন্ত শক্তি ভাণ্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অন্যদিকে, একই সাথে পারমাণবিক অস্ত্র মানব সভ্যতা বিলীন হয়ে যাবার মত ভয়াবহতার হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
প্রথম পর্বে পারমাণবিক শক্তির সাধারণ ধারণা, পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা, পারমাণবিক বিক্রিয়া এবং পারমাণবিক শক্তি উৎস হিসেবে পরিচিত অধিক ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের বিষয়বস্তু ছিলো সভ্যতার অগ্রগতিতে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার, পারমাণবিক শক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পারমাণবিক চুল্লি (Nuclear Reactor)। তৃতীয় পর্বে ছিল পারমাণবিক অস্ত্র পরিচিতি, ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের প্রকারভেদ, গঠন, ও কার্যপ্রণালীর বিবরণ। চতুর্থ পর্ব ছিলো পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা ও পারমাণবিক অস্ত্র কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে তার বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে। পঞ্চম ও শেষ পর্ব সাজানো হয়েছিল পারমাণবিক অস্ত্রের ইতিহাস, বর্তমান পৃথিবীতে মজুদকৃত পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণ, অতীত থেকে বর্তমানের অত্যাধুনিক পারমাণবিক বিস্ফোরকের তুলনামূলক শক্তিমাত্রার ধারণা এবং পারমাণবিক শক্তির ব্যাবহারের সাথে মানবজাতি তথা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত তথ্যাদি দিয়ে।
কিন্তু ইতোমধ্যে সমাপ্ত সিরিজটিতে দুটো অতিরিক্ত পর্ব সংযুক্ত করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত পর্ব দুটোর মূল উদ্দেশ্য – পারমাণবিক শক্তি সংশ্লিষ্ট অত্যাধুনিক এবং চোখ ধাঁধানো গবেষণার তথ্য সংযুক্ত করা। তাপ-পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়া কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করে সেখান থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে সক্ষম বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির দুঃসাহসী পরিকল্পনা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীগণ। তাপ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও অবিশ্বাস্য গবেষণার সুবৃহৎ কর্মযজ্ঞ নিয়েই সাজানো হয়েছিলো অতিরিক্ত প্রথম পর্ব। অতিরিক্ত দ্বিতীয় ও সমাপনী পর্ব কোনো অত্যাধুনিক গবেষণা কার্যক্রম নিয়ে নয়, বরং Natural Nuclear Reactor এর অতিপ্রাচীন ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ নিয়ে সাজানো যা ছিল পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মাবলীর সমন্বয়ে সম্ভাবনাময় এক বিস্ময়কর ঘটনা।
প্রকৃতির বিস্ময় – Natural Nuclear Reactor
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ১৯৪২ সালে Enrico Fermi ও তাঁর গবেষকদলের হাত ধরে মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মত তৈরি ও পরিচালিত হয় পারমাণবিক চুল্লি বা Nuclear Reactor. অত্যাধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার পারমাণবিক চুল্লি। আবিষ্কারের প্রায় ত্রিশবছর পর্যন্ত স্বভাবতই ধরে নেয়া হয়েছিল Enrico Fermi ‘র নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরটিই পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক চুল্লি। কিন্তু সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় তিন যুগ পার হবার আগেই। মানবসৃষ্ট পারমাণবিক চুল্লির ইতিহাস শতবছরের কম হলেও প্রকৃতিতে বিলিয়ন বছরের পুরনো পারমাণবিক চুল্লির ইতিহাস আবিষ্কৃত হয়। প্রায় ১.৮ বিলিয়ন বছর বা ১৮০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বুকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হয়েছিল কিছু প্রাকৃতিক পারমাণবিক চুল্লি, যেগুলো বিস্ময়করভাবে এতটাই নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ ছিল যে কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই সচল ছিল প্রায় এক লক্ষ বছর।
একটি রিপোর্ট – পরমাণু বিজ্ঞানীদের মাথা চুলকানোর কারণ
১৯৭২ সালে ফ্রান্সের একটি পারমাণবিক জ্বালানী প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের (Nuclear Fuel processing Plant) একজন কর্মী, H. Bouzigues রুটিন এনালিসিসের সময় তার হাতে থাকা একটি রিপোর্টের একটি বিশেষ মানে এসে থমকে গেলেন। মানটি ছিল খনি থেকে উত্তোলিত ইউরেনিয়াম আকরিকের মধ্যে ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপের শতকরা হার। রিপোর্টে U-235 আইসোটোপ ছিল ০.৭১৭১%. কিন্তু এই মানটি হবার কথা ছিল ০.৭২০২%. এই মান ভূপৃষ্ঠের যে কোনো স্থানে যেকোনো প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের নমুনা খণ্ডে (sample) একই হবার কথা। শুধু পৃথিবীতেই নয়, চাঁদে, উল্কাপিণ্ডে এমনকি সৌরজগতের যেকোনো স্থানে এই মান একই থাকবে। কিন্তু দেখা গেল আফ্রিকার Gabon এর Oklo খনি থেকে প্রাপ্ত একটি নমুনায় এই মান ০.০০৩১% কম। আপাত দৃষ্টিতে এই পার্থক্য নগণ্য মনে হলেও তা যখন পারমাণবিক জ্বালানী সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার একটি অংশ, তখন এটিকে একেবারেই তাচ্ছিল্য করার উপায় নেই। শুধুমাত্র U-235 আইসোটোপই স্থায়ী ফিশন চেইন রিঅ্যাকশন তৈরি করতে পারে ও পারমাণবিক জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
ফ্রান্সের পারমাণবিক শক্তি কমিশন খনির এই অংশের আকরিকের নমুনা নিয়ে আরো নির্ভুলভাবে নিরীক্ষা করেও একই ফলাফল পেল। Oklo খনির কাছাকাছি অবস্থিত একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার উৎপাদন রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গেল ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে তখন পর্যন্ত সেখানে আসা Oklo খনির আকরিকগুলোতে U-235 আইসোটোপের পরিমাণে কিছু না কিছু ঘাটতি আছেই। বিগত দুই বছরের অধিক সময়ে সেখানে Oklo খনির ইউরেনিয়াম আকরিক প্রক্রিয়াজাত করে ৭০০ টন ইউরেনিয়াম থেকে ফিশনযোগ্য U-235 আইসোটোপ সংগ্রহ করা হয়েছে। হিসেব কষে দেখা গেল এই অতি সামান্য ঘাটতির জন্যই ততদিনে প্রায় ২০০ কেজি U-235 কম পাওয়া গেছে আকরিক থেকে যা দিয়ে আধ-ডজন পারমাণবিক বোমা প্রস্তুত করা যায় অনায়াসে। কোনোভাবেই এটিকে আর হেলাফেলার বিষয় বলে ভাবা চলে না। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীগণ মাথাঘামাতে শুরু করলেন। হারিয়ে যাওয়া U-235 আইসোটোপ কবে, কখন, কোথায় ও কিভাবে হারিয়ে গেলো? Oklo খনির বিভিন্ন অংশ থেকে নমুনা আকরিক সংগ্রহ করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হল। কোথাও কোথাও U-235 আইসোটোপের পরিমাণ পাওয়া গেল ০.৪৪% মাত্র। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন ঘনীভূত হচ্ছে সমস্যা। ততই যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছেন পরমাণু বিজ্ঞানীগণ।
রহস্য উদঘাটনে জোরদার গবেষণা
বিজ্ঞানীগণ উঠেপড়ে লাগলেন; যেভাবেই হোক এই রহস্য উন্মোচন করতেই হবে। প্রথমে চিন্তা করা হল কৃত্রিম উপায়ে কখনো কোনোভাবে খনিতে ফিশন বিক্রিয়া ঘটানো হয়েছিল কিনা। কিন্তু কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেল খনিতে থাকা ইউরেনিয়াম সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। তখন তারা Oklo খনির বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনা আকরিক সংগ্রহ করে নানারকম রাসায়নিক ও ভৌত পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে লাগলেন। পরমাণুর নিউক্লিয়াস রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয়। রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে U-235 আইসোটোপ হারিয়ে যেতে পারে না। তবুও আকরিকে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, তাদের ধরন, পরিমাণ, খনির বিভিন্ন স্থানে এদের পরিবর্তনের পার্থক্য ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করতে লাগলেন বিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্ট রসায়নবিদগণ।
এসব তথ্য থেকে হঠাৎ যেন আলোর ঝলকানির মত রহস্য সমাধানের একটি সূত্র চোখের সামনে ভেসে উঠল। খনির যেসব অঞ্চলে U-235 আইসোটোপের ঘাটতি আছে সেসব অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে এমন সব রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে খুবই দুষ্প্রাপ্য এবং পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ার ফলাফল হিসেবেই এত বেশি পরিমাণে একত্রে পাওয়া সম্ভব। এছাড়া U-235 এর ঘাটতি থাকা অংশ বাদে আকরিকের অন্যান্য অংশে এসকল পদার্থের অনুপস্থিতি বিষয়টিকে আরো জোরালো করে তোলে। কয়েক সপ্তাহ অন্ধকারে থাকার পর ফ্রান্সের পারমাণবিক শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীগণ যেন রহস্যের জট খোলার একটি সুতো হাতে পেলেন। আকরিকে থাকা এসকল বিশেষ পদার্থ ছিল ঐতিহাসিক ঘটনার ‘ফুটপ্রিন্ট’। প্রাথমিক ধারণা হিসেবে পাওয়া গেল খনিতে ‘হয়তো’ প্রাকৃতিক উপায়ে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ার মাধ্যমেই হারিয়ে গেছে কিছু পরিমাণে U-235 আইসোটোপ।
দু’টো পুরনো গবেষণাপত্র – কালের অতলে লুকানো রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠি
এমন সময় বিজ্ঞানীগণ চোখ কপালে তুলে তাকালেন ১৯ বছর আগে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রের দিকে। American Physical Society এর Physical Review জার্নালে প্রকাশিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের George W. Wetherill এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের Mark G. Inghram এর একটি গবেষণা পত্রে তারা দেখিয়েছিলেন তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম আকরিকে প্রাকৃতিক উপায়ে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত হওয়া সম্ভব। এর তিন বছর পর ১৯৫৬ সালে Journal of Chemical Physics এ আরকানসা’ (Arkansas) বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ Paul Kazuo Kuroda সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর ভিত্তি করে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তিনি কিছু পরিমাণগত ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বিবৃত করেছিলেন, যে শর্তগুলো পূরণ হলেই কেবল প্রকৃতিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া ঘটা সম্ভব।
অনেকটাই যেন রহস্য সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাওয়া গেল। এই দু’টো গবেষণাকে সামনে রেখে এমন কিছুই ঘটেছিলো কিনা Oklo খনিতে তা খুঁজে বের করতে লেগে গেলেন গবেষকগণ। আশাব্যঞ্জকভাবে একের পর এক উঠে আসতে থাকল সুদূর অতীতে ঘটা স্বতঃস্ফূর্ত পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ার নানাবিধ কালের সাক্ষী ও পরোক্ষ প্রমাণ।
হারানো আইসোটোপের প্রাকৃতিকভাবে ফিশন বিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের প্রমাণসমূহ
এ অবস্থায় বিজ্ঞানীগণের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল দু’টো। প্রথমত Oklo খনিতে প্রাকৃতিক উপায়ে সংঘটিত পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ার ফলেই U-235 আইসোটোপের ঘাটতি দেখা দিয়েছে কিনা তা প্রামাণ্য ভাবে নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত খনিতে প্রাকৃতিকভাবে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া ঘটে থাকলে ঠিক কী কী প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে কিভাবে ঘটেছিল তার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা।
যখন U-235 আইসোটোপ একটি নিউট্রন শোষণ করে তখন এটি ফিশন প্রক্রিয়ায় ভেঙ্গে দুটো অসমান নিউক্লিয়াসে পরিণত হয় যাদের ভর হয় সাধারণত ৯৯ এবং ১৩৩. এগুলো নিজেরাও তেজস্ক্রিয় ও অস্থায়ী। এদের বলা হয় ‘ফিশন প্রডাক্ট’। এগুলোও সময়ের সাথে সাথে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে হালকা মৌলের স্থায়ী আইসোটোপে পরিণত হয়। এদেরকে ‘Daughter Fission Product’ বলা হয়। ফিশন প্রডাক্টগুলোর স্থায়িত্ব কয়েক সেকেন্ড থেকে বহু বছর পর্যন্ত হতে পারে, যাতে করে সর্বশেষ হালকা স্থায়ী আইসোটোপ পাওয়া যেতে পারে ত্রিশ ধরনের। Oklo খনির যেসকল অঞ্চলের আকরিকে U-235 আইসোটোপের পরিমাণ কম সেসকল অঞ্চলের আকরিকে থাকা অন্যান্য পদার্থের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে Fission Product ও Daughter Fission Product এর যে প্রাচুর্য পাওয়া গেছে তাতে নিশ্চিতভাবে বলা যায় হারিয়ে যাওয়া U-235 আইসোটোপ ফিশনের মাধ্যমেই হারিয়ে গেছে।
৩০ ধরনের Daughter fission product এর মধ্যে অন্তত ১৫ টি পদার্থের প্রাচুর্য দেখা গেছে Oklo খনির আকরিকে। lanthanum, cerium, praseodymium, neodymium, europium, samarium, gadolinium and also yttrium এসকল পদার্থ প্রকৃতিতে একেবারেই বিরল ও দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু এগুলোর আধিক্য দেখা গেছে Oklo খনির আকরিকে। এছাড়া খনির যেসকল অংশের আকরিকে U-235 এর মান কম সেসকল অংশে এদের পাওয়া গেলেও খনির অন্যান্য অংশে এগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। যা আরো সুস্পষ্টভাবে সুদূর অতীতে ঘটা কোনো পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়াকেই নির্দেশ করে।
রিঅ্যাক্টর জোনে Kuroda Condition
প্রাকৃতিক পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া সংঘটনের প্রমাণ হাতে পাবার পর গবেষকদল নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে Oklo এবং পার্শ্ববর্তী Okelobondo খনির ১৬ টি আলাদা আলাদা বিশেষ স্থান সুনির্দিষ্ট করেন যেগুলো Paul Kazuo Kuroda এর বিবৃত অবস্থা ও শর্তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই অংশগুলোতেই সংঘটিত হয়েছিল সেই অতিপ্রাচীন পারমাণবিক বিক্রিয়া। এদের সাধারণ নামকরণ করা হয় Natural Reactor Zone. খনিতে ‘রিঅ্যাক্টর জোন’ নির্ধারণের পর নির্দিষ্টভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে উঠে আসতে থাকে Natural Nuclear Reactor সম্পর্কিত নানা চমকপ্রদ তথ্য।
প্রাকৃতিকভাবে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া সংঘটনের জন্য Paul Kazuo Kuroda কয়েকটি শর্তের কথা উল্লেখ করেছিলেন তাঁর গবেষণাপত্রে।
প্রথম শর্তানুযায়ী, তেজস্ক্রিয় পদার্থের খনিতে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের কারণে মুক্ত গতিশীল নিউট্রন থাকে। উন্মুক্ত নিউট্রন ইউরেনিয়াম কর্তৃক শোষিত হবার সর্বোচ্চ সম্ভাবনার জন্য খনিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ অংশের প্রস্থ হতে হবে কমপক্ষে এক মিটারের দুই তৃতীয়াংশ। Oklo খনিতে ইউরেনিয়াম মজুদ থাকা অংশের এমন প্রশস্ততা পাওয়া গেছে এবং ‘রিঅ্যাক্টর জোন’ গুলো নির্ধারণে এই ফ্যাক্টরটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় শর্ত ছিল খনিতে U-235 আইসোটোপের পর্যাপ্ত ঘনীভবন (Concentration) থাকতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত হতে হলে ইউরেনিয়ামে U-235 আইসোটোপ কমপক্ষে ১% থাকতে হবে।
৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে যখন পৃথিবী গঠিত হয় তখন পৃথিবীতে থাকা ইউরেনিয়ামে U-235 আইসোটোপের অনুপাত ছিল ২০ শতাংশের বেশি যা সময়ের পরিক্রমায় ‘এক্সপোনেনশিয়াল’ ধারায় তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে বর্তমানে ০.৭২০২ শতাংশ। খনিতে থাকা বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের অনুপাত থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় Oklo ইউরেনিয়াম খনি তৈরি হয় ১.৮ বিলিয়ন বছর (১৮০ কোটি বছর) আগে। সে হিসেবে তখন খনিতে U-235 আইসোটোপের অনুপাত ছিল প্রায় ৩ শতাংশ; যা প্রাকৃতিক পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ার জন্য যথেষ্ট। এমনকি বর্তমানে বিভিন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানী হিসেবে যে ‘Enrich’ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয় সেখানেও এই অনুপাত ৩ শতাংশ। এদিক বিবেচনায় দু’টো বিষয় পাওয়া যায়। প্রথমত বর্তমানে আর কোনো খনিতে প্রাকৃতিকভাবে ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত হবার সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত Oklo খনিতে শুধু স্বল্প সময়ের জন্য অস্থায়ী পারমাণবিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়নি বরং সেটি বর্তমান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের মতই নিয়ন্ত্রিত উপায়ে সংঘটিত হয়েছিল বহু বছর ধরে যা এমন বিপুল পরিমাণ U-235 আইসোটোপের ভাঙনের জন্য দায়ী।
তৃতীয় শর্ত ছিল তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের নিউট্রনকে অন্য আইসোটোপের সাথে সংযুক্ত হয়ে ফিশন ঘটানোর জন্য নিউট্রনের গতি কমিয়ে আনতে হবে যার জন্য এমন কোনো পদার্থের অস্তিত্ব থাকতে হবে যা নিউট্রনের গতিকে কমিয়ে এনে ফিশনের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলবে। মানবসৃষ্ট পারমাণবিক চুল্লিতে একে বলা হয় ‘Moderator’. বিস্ময়করভাবে দেখা যায় ১.৮ বিলিয়ন বছর আগে Oklo খনিতে এই ‘মডারেটর’ হিসেবে কাজ করেছিল ভূপৃষ্ঠের পানি। পানি এখানে নিউট্রনের গতিশক্তি শিথিল করে পার্শ্ববর্তী U-235 এ ফিশন বিক্রিয়া সংঘটনের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
চতুর্থ শর্ত ছিল খনিতে অথবা মডারেটরে এমন কোন পদার্থের আধিক্য থাকা যাবে না যেগুলো ‘নিউট্রন পয়জন’ হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ কোনো পারমাণবিক বিক্রিয়া তৈরি না করেই অনায়াসে প্রচুর নিউট্রন শোষণ করে নিতে পারে। তাহলে এরাই নিউট্রন শোষণ করে ফিশন বিক্রিয়া স্থগিত করে দেবে। স্বাভাবিকভাবেই Oklo খনিতে এমন পদার্থের দৃষ্টিগ্রাহ্য অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি যা ফিশন বিক্রিয়া বন্ধ করে দিতে সক্ষম।
The Oklo Phenomenon Conference
Bouzigues এর সন্দেহ পোষণের পর তিন মাসের মধ্যেই বিজ্ঞানীগণ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন Oklo খনিতে প্রাকৃতিকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত হয়েছিল। পরবর্তীতে এ নিয়ে আরো বিস্তর গবেষণা করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন গবেষক। ঘটনার তিন বছর পর ১৯৭৫ সালে Gabon এর রাজধানী Librevill এ একটি বিশেষ বিজ্ঞান সম্মেলনের আয়োজন করা হয় সম্মিলিতভাবে International Atomic Energy Agency (IAEA), ফ্রান্সের পারমাণবিক শক্তি কমিশন C.E.A. এবং Gabon সরকারের উদ্যোগে। সেখানে ২০ টি দেশের ৭০ জন গবেষক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু ও ফলাফল উত্থাপন করেন। এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন Santa Fe Institute এর প্রতিষ্ঠাতা, গবেষক George A. Cowan. পরের বছর ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে তিনি Scientific American ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন ‘A Natural Fission Reactor’ শিরোনামে। নিবন্ধে তিনি Oklo এর অতিপ্রাচীন প্রাকৃতিক পারমাণবিক চুল্লির কার্যপ্রণালী নিয়ে সংশ্লিষ্ট গবেষকগণের এতদিনের গবেষণার ফলাফলের সারাংশ তুলে ধরেন। এখান থেকে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে Oklo ইউরেনিয়াম খনিতে সুপ্রাচীন ‘Natural Nuclear Reactor’ এর অস্তিত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
Oklo Natural Nuclear Reactor এর বৈশিষ্ট্য ও মূলনীতি
রিঅ্যাক্টরের গাঠনিক ও ভৌত বৈশিষ্ট্য
গবেষণার শুরুর দিকে প্রথমে ছয়টি, পরে একে একে মোট ষোলটি Natural Reactor খুঁজে পাওয়া যায় Oklo ও পার্শ্ববর্তী Okelobondo ইউরেনিয়াম খনিতে। পরবর্তীতে প্রায় ৩৫ কিঃমিঃ দূরে Bangombe ইউরেনিয়াম খনিতে আরেকটি ন্যাচারাল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর সাইট আবিষ্কৃত হয়েছে। বিস্ময়করভাবে Oklo খনি তৈরি হবার কাছাকাছি সময়েই Oklo খনির ন্যাচারাল রিঅ্যাক্টরগুলো তৈরি হয়েছিল এবং প্রতিটি প্রায় এক লক্ষ বছর পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত করেছিল। এতে মোট 15,000 MegaWatt-Year শক্তি উৎপাদিত হয়েছে ফিশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে। রিঅ্যাক্টরগুলোর গড় পাওয়ার আউটপুট ছিল প্রায় ১০০ কিলোওয়াট।
রিঅ্যাক্টরের পারমাণবিক ঘটনাক্রম
১. খনিতে পর্যাপ্ত ফিশনযোগ্য U-235 আইসোটোপ বিদ্যমান ছিল অন্যান্য তেজস্ক্রিয় পদার্থের সাথে।
২. তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষয়ের কারণে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত শক্তিশালী নিউট্রন সেখানে বিদ্যমান ছিল।
৩. ভূপৃষ্ঠস্থ পানি মডারেটর হিসেবে উচ্চগতির নিউট্রনের গতিকে শিথিল করে।
৪. এই কম গতিশক্তির নিউট্রন পার্শ্ববর্তী U-235 আইসোটোপ কর্তৃক শোষিত হয়ে ফিশন বিক্রিয়া ঘটায়।
৫. লক্ষাধিক বছর এভাবে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া চলার ফলে ফিশনযোগ্য U-235 আইসোটোপের পরিমাণ যথেষ্ট হ্রাস পেয়ে গেলে ‘জ্বালানীর অভাবে’ একসময় বন্ধ হয়ে যায় Natural Nuclear Reactor এর স্বতঃস্ফূর্ত ফিশন বিক্রিয়া।
রিঅ্যাক্টরে চমকপ্রদ স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ
ন্যাচারাল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর সংক্রান্ত প্রচুর তথ্যাদি জানা গেলেও একটি প্রশ্নের উত্তর থেকে যাচ্ছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এত দীর্ঘ সময় ধরে সংবেদনশীল ফিশন বিক্রিয়া চললেও এখানে কখনো কোর মেল্ট-ডাউনের মত পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটেনি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিঅ্যাক্টরগুলোতে পারমাণবিক বিক্রিয়া সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেই যেখানে এমন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা প্রবল সেখানে কিভাবে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে লক্ষ বছর ধরে এতটা নিরাপদ ছিল Oklo খনি ন্যাচারাল রিঅ্যাক্টরগুলো?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় তিন যুগ। পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ায় Fission Product হিসেবে উৎপাদিত হয় জেনন এবং ক্রিপটনের মত নিষ্ক্রিয় গ্যাস। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের বিভিন্ন ধাপে জেননের প্রায় নয় ধরনের স্থিতিশীল আইসোটোপ তৈরি হতে পারে। নিষ্ক্রিয় গ্যাস হওয়ায় এগুলো অন্য পদার্থের সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া না করেই গ্যাসীয় বুদবুদ হিসেবে জমা থাকতে পারে খনিজ উপাদানের দানার ভেতর। Oklo খনিতে থাকা ইউরেনিয়াম মুক্ত খনিজ অ্যালুমিনিয়াম ফসফেটের দানার ভেতর আটকে পড়া জেনন আইসোটোপের গাঠনিক বিশ্লেষণ থেকে রিঅ্যাক্টরে Cyclic Operation বা পর্যায়ক্রমিকভাবে থেমে থেমে ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত হবার প্রমাণ পাওয়া যায়। আর এভাবে থেমে থেমে পারমাণবিক বিক্রিয়া সংঘটিত হওয়াই ছিল ন্যাচারাল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র।
এই শতাব্দীর শুরুতে ২০০৪ সালে Physical Review Letters জার্নালে ‘Record of Cycling Operation of the Natural Nuclear Reactor in the Oklo/Okelobondo Area in Gabon’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের তিনজন গবেষক A. P. Meshik, C. M. Hohenberg এবং O. V. Pravdivtseva অ্যালুমিনিয়াম ফসফেটের দানার ভেতর থাকা জেনন আইসোটোপের গাঠনিক বিশ্লেষণ থেকে প্রামাণ্যভাবে উপস্থাপন করেন কিভাবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর থেমে থেমে চলে ফিশন বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত ছিল ন্যাচারাল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর গুলোতে। তারা গাণিতিকভাবে নির্ণয় করেতে সক্ষম হয়েছেন Oklo ন্যাচারাল রিঅ্যাক্টরগুলো ৩০ মিনিট ফিশন বিক্রিয়া সংঘটিত করতো, পরবর্তী ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট বিক্রিয়া স্থগিত থাকতো, তারপর আবার ৩০ মিনিট বিক্রিয়া সংঘটিত হত। এভাবে বারবার ‘সুইচ অন/অফ’ এর মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত উপায়ে লক্ষ বছর ধরে চলেছে ন্যাচারাল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের ফিশন বিক্রিয়া।
পরের বছর ২০০৫ সালে এই গবেষণাপত্রেরই একজন Author, Alex P. Meshik, Scientific American ম্যাগাজিনে এই গবেষণার ফলাফলকে কেন্দ্র করে ন্যাচারাল রিঅ্যাক্টরের স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন ‘The Workings of An Ancient Nuclear Reactor’ শিরোনামে। দুটি পর্যায়ক্রমিক ধাপে নিয়ন্ত্রিত হয়ে রিঅ্যাক্টরে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া নির্দিষ্ট সময় পরপর সংঘটিত হতো, যাকে রিঅ্যাক্টর সুইচ অন-অফ এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
১. রিঅ্যাক্টর জোনে থাকা ভূপৃষ্ঠস্থ পানি শুধু ‘মডারেটর’ হিসেবেই কাজ করতো না, নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপাদানও ছিল এই পানি। রিঅ্যাক্টরে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়ার ফলে তাপশক্তি উৎপাদিত হত। সেই তাপ শোষণ করে পানি উত্তপ্ত হয়ে উঠত। পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে স্ফুটনাংকে পৌঁছালে রিঅ্যাক্টর জোনে থাকা পানি বাষ্পীভূত হতে শুরু করে। বাষ্পীভূত হয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি কমে গেলে ‘মডারেটর’ এর অভাবে রিঅ্যাক্টর জোনে পারমাণবিক বিক্রিয়া স্থগিত হয়ে যেত বিক্রিয়া শুরুর ৩০ মিনিট পর।
২. ফিশন বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা কমতে থাকে ও প্রবাহমান ধারা হওয়ায় ঘটনাস্থলে পুনরায় পানির পরিমাণ বাড়তে থাকে। এভাবে বিক্রিয়া বন্ধ হবার ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি জমে গেলে ‘মডারেটর’ এর উপস্থিতিতে পুনরায় রিঅ্যাক্টরে পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া শুরু হয়ে আবার ৩০ মিনিট চলতে পারে।
এভাবে বারবার বিক্রিয়া সংঘটিত ও বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে তাপমাত্রার স্বয়ংক্রিয় প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যদিয়েই জ্বালানীর প্রাচুর্য হ্রাস পাবার পূর্ব পর্যন্ত লক্ষ বছর ধরে কার্যকর ছিল Oklo খনির Natural Nuclear Reactor গুলো।
আফ্রিকার Oklo খনি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় প্রাচীন ন্যাচারাল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের সন্ধান পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন কোনো রিঅ্যাক্টরের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আর কোথাও প্রাকৃতিকভাবে এমন পারমাণবিক চুল্লি তৈরি হয়নি। বরং Oklo খনির ন্যাচারাল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর আবিষ্কার সংক্রান্ত ও পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট নানা গবেষণায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে সুপ্রাচীনকালে অর্থাৎ আজ থেকে বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পারমাণবিক বিক্রিয়া ঘটার সম্ভাব্যতা ছিল অত্যন্ত বেশি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশও ছিল এমন পারমাণবিক চুল্লি তৈরির জন্য উপযুক্ত। হয়ত এমন আরো ন্যাচারাল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর ভবিষ্যতে আমরা খুঁজে পাবো। Oklo গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি এধরণের প্রাকৃতিক পারমাণবিক চুল্লি খুঁজে পেতে যথেষ্ট সহায়ক হবে।
আবার Oklo খনিকে মৃত ন্যাচারাল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের ‘ফসিল কেন্দ্র’ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ১৮০ কোটি বছরের প্রাকৃতিক পরিবর্তন হতে নিরাপদ থেকে হয়ত এগুলোই এখনো স্তরে স্তরে বহন করে চলছে বিলিয়ন বছরের পুরনো পারমাণবিক বিক্রিয়ার পদচিহ্ন। হয়ত তৎকালীন সৃষ্টি হওয়া অন্য রিঅ্যাক্টরগুলোর রাসায়নিক সাক্ষী সময়ের পরিক্রমায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হয়ত কোনো কোনো রিঅ্যাক্টরের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে অনিয়ন্ত্রিত ফিশন বিক্রিয়ার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে পারমাণবিক দুর্ঘটনার মধ্যদিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে রিঅ্যাক্টরের স্মৃতিচিহ্নগুলোও; যেগুলো হয়ত আমরা আর কখনোই খুঁজে পাব না।
তথ্যসূত্র
১. A Natural Fission Reactor – Scientific American Magazine
DOI: 10.1038/scientificamerican0776-36, BAK link
২. Meet Oklo, the Earth’s Two-billion-year-old only Known Natural Nuclear Reactor – IAEA News
৩. Spontaneous Fission Yields from Uranium and Thorium – Physical Review Journal, American Physical Society
DOI: 10.1103/PhysRev.92.907, BAK link
৪. On the Nuclear Physical Stability of the Uranium Minerals – The Journal of Chemical Physics
DOI: 10.1063/1.1743058, BAK link
৫. The Workings of an Ancient Nuclear Reactor – Scientific American Magazine
DOI: 10.1038/scientificamerican1105-82, PMID: 16318030, NCBI link, BAK link
৬. Record of Cycling Operation of the Natural Nuclear Reactor in the Oklo/Okelobondo Area in Gabon –Physical Review Letters, American Physical Society
DOI: 10.1103/PhysRevLett.93.182302, PMID: 15525157, NCBI link, BAK link
৭. Ancient nuclear power controlled by water – Nature News
DOI: 10.1038/news041101-2
অনেক সুন্দর আলোচনা করেছেন। কিন্তু অনেক কিছু মাথার উপর দিয়ে গেছে 🙂
nice info!!