মহাজগত কি নিয়ে গঠিত? এর উত্তর আমরা পেয়েছি ঊনবিংশ শতাব্দীতে। তবে আমাদের চারপাশ অথবা আমরা কি নিয়ে গঠিত এই প্রশ্নটা অনেক প্রাচীনকাল থেকেই বিজ্ঞদের ভুগিয়েছে।প্রকৃতপক্ষে আমরা এর উত্তর পাওয়ার ২৫০০ বছর আগে প্রশ্নটির উৎপত্তি।
প্রথমদিকের ধারণাগুলো জানলে অনেকে মুখ থুবরে হাসবেন। প্রাচীন গ্রিক ঋষিদের ধারণা যতটা ভুল তার থেকে বেশি হাস্যকর। যেমন- থেলিস(Thales) ঘোষণা করেছিলেন সবকিছুর উপাদানই হল জল, অ্যানাক্সিম্যান্ডর(Anaximander) বলেছিলেন বিশ্বজগত বায়ু থেকে সৃষ্ট, আবার হেরাক্লিটাস(Heraclitus) এর মতে সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে আগুন থেকে। এইসব অসামঞ্জস্যতায় ভরা ব্যাখ্যায় শেষে মৌল সংখ্যা দাড়াল ৪ টি আগুন, পানি, বায়ু, বাতাস। এর শেষ সংশোধন করলেন অ্যারিস্টটল(Aristotle)। তার ভাষ্যমতে সবকিছু একটি মাত্র উপাদানে গঠিত এবং তা বিভিন্ন গুণ অর্জনের ক্ষমতা রাখে।এই গুনের সংখ্যা হল চার । যথা- শীতল,উষ্ণ, আর্দ্র, শুষ্ক। আর এই গুনের দাড়াই আগের চারটি মৌল উৎপন্ন করে। যেমন- শুষ্ক যোগ শীতল মাটী, শুষ্ক যোগ উষ্ণ আগুন, শীতল যোগ আর্দ্র পানি এবং আর্দ্র যোগ উষ্ণ বাতাস। তবুও কিছু
উত্তর প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে গেল। তাই প্রাচীন দার্শনিকরা অতিরিক্ত “স্বর্গীয় সত্তা” যোগ করেন। নিঃসন্দেহে ভগবানের দোহাই দিয়ে যেকোন কিছু ব্যাখ্যা করা চলে।
এরপর শতাব্দীর পর শতাব্দী কেউ অ্যারিস্টটলের মতামত নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস দেখায় নি। সে সময়কার ক্যাথলিক চার্চ অ্যারিস্টটলের মতামতগুলি স্বাগত জানায় এবং এর সন্দেহকে অসিদ্ধ বলে গণ্য করা হত।কিন্তু তবুও সন্দেহের কথা উঠল। যার উৎপত্তি “আলকেমি” থেকে।
“আলকেমি” কি? প্রথম কথা এটা “কেমিস্ট্রি” বা রসায়ন নয়। আলকেমি অ্যারিস্টটলের “একটি মাত্র মৌল দিয়ে বিশ্বজগত গঠিত” এই নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যদি পৃথিবীর সবকিছুর গাঠনিক একক একই হয় তবে অবশ্যই কোন কৌশল প্রয়োগ করে যেকোন পদার্থকে অন্য পদার্থতে রুপান্তর সম্ভব। সেই পরশপাথর আবিষ্কার করা সম্ভব যার স্পর্শে সকল বস্তু সোনায় রুপ নিতে পারবে। সোনা তৈরি এবং এক বস্তুকে অন্য বস্তুতে রুপান্তর করার “পরশমণি” বিষয়ক বিজ্ঞান হল “আলকেমি”।
আলকেমিস্টরা সোনা তৈরির পরশপাথর আবিষ্কার করতে পারে নি, তবে সে ব্যার্থতা পূরণ হয়েছে বস্তুর পরিবর্তন সম্পর্কে গুরুত্বপুর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে। সেই সংগ্রহ তথ্যই আবার আলকেমির মৃত্যু ঘটিয়েছে। দহন (combustion), তাপপ্রয়োগে আটকে যাওয়া (Sintering) কিংবা ধাতুর গলন ইত্যদি প্রক্রিয়া আলকেমিতে প্রয়োগ করা হত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সপ্তদশ শতাব্দীতে এটা স্পষ্ট হয় যে মৌলের সংখ্যা চারের থেকে অনেক বেশি।দেখা যায় পারা, সীসা , গন্ধক, সোনা, অ্যান্টিমনি ইত্যাদি এমন ধরনের পদার্থ বিয়োজিত করা যায় না। কোনভাবেই বলা সম্ভব না এরা অন্য মৌল দ্বারা গঠিত। তাই সকলে এদের মৌল বলে ধরে নিতে বাধ্য হয়।
১৬৬১ সালে ইংলিশ বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েল(Robert Boyle) “SCEPTICAL CHEMIST” নামে একটি বই প্রকাশ করেন। যেখনে তিনি মৌলের সম্পূর্ণ নতুন এক সংজ্ঞা প্রদান করেন।সব মৌলকেই গ্রহন করা হল পদার্থ রুপে যা বিভিন্ন বস্তুর সংগঠক উপাদান। এই সংজ্ঞাটি আধুনিক সংজ্ঞার সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ।তবে এতে মৌলের সংখ্যা ছিল হতে গোনা। তার উপর আবার এই সংক্ষিপ্ত মৌলের তালিকায় ছিল আগুন। তাহলে আগুন একটি মৌলিক পদার্থ !!! এমনকি আধুনিক রসায়নের জনক অ্যান্তন ল্যাভয়সিয়ের(Antoine Lavoisier) মৌলের তালিকাতেও ছিল ‘তাপদায়ী’ এবং ‘আলোকদায়ীর’ মত মৌলিক পদার্থ। তবে ১৮ শতাব্দী শেষে মৌলিক পদার্থের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫; যদিও এর মধ্যে ২৩ টি ছিল মৌল আর বাকিগুলো হয়ত যৌগিক নয়তো শক্তির পদার্থ রুপ। তবে ১৯ শতকে রসায়নবিদরা ৫০ এর বেশি মৌল আবিষ্কার করে এবং রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডিলিফের পর্যায় সূত্র অনাবিষ্কৃত মৌল্গুলির সন্ধানে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।২০ শতকে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত প্রায় সব মৌল আবিষ্কার সম্ভব হয়।
এতো গেল মৌলের কথা পরমাণুর ইতিহাস কোথায়? পরমাণুর কথা সর্বপ্রথম শোনা যায় প্রায় ২৪০০ বছর আগে। প্রচীন গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস পরমাণু নিয়ে মতামত দেন। তার বক্তব্য অতিক্ষুদ্র কণা দ্বারা মহাজগত গঠিত। তিনি কিছু প্রাকৃতিক ঘটনা পর্যবেক্ষন করে তার এই মতামত ব্যাখ্যা করেন। যেমন- পানিকে তাপ দিলে বাষ্প হয়ে অদৃশ্য হয়। তার মানে পানি অতিক্ষুদ্র কণায় গঠিত যা তাপ প্রদানে উড়ে যায়। আবার ফুলের সুবাসের বিষয়ে প্রশ্ন করা চলে, “আমরা দূর থেকে কেন ফুলের গন্ধ পাই?”কারণ ফুলে অতিক্ষুদ্র কণা রয়েছে যা বায়ুতে প্রবাহিত হয়ে আমাদের নাকে এসে পৌছায়। এসব ঘটনা থেকে ডেমোক্রিটাস নিশ্চিত হন যে আমরা যে পদার্থই দেখি না কেন তা প্রকৃতপক্ষে অতিসূক্ষ কনিকা দ্বারা গঠিত। এসব ক্ষুদ্র কণিকা অবিভাজণক্ষম এবং এদের দ্বারাই সকল পদার্থ গঠিত । তিনি এই সূক্ষ কণিকার নাম দেন (atomos) বাংলায় যাকে আমরা পরমাণু বলি।
কিন্তু ডেমোক্রিটাসের এই মহান আবিষ্কার অ্যারিস্টটলের ভুল শিক্ষার প্রভাবে ঢাকা পড়ে যায়। অ্যারিস্টটল বলেন বস্তুকে অন্তহীন বিভাজন চলে এবং অ্যারিস্টটলের শিক্ষার প্রতিদ্বন্দীতা করায় অনেক বিজ্ঞানী যে শুলে চড়েছে তা সকলেরই জানা। তবে ১৬৪৭ সালে পিয়েরে গ্যাসেন্দি(Pierre Gassendi) একটি বই প্রকাশ করেন যাতে তিনি অতি সাহসে অ্যারিস্টটলের ভূল শিক্ষাকে অস্বীকার করেন এবং ঘোষণা করেন সকল পদার্থ অতি ক্ষুদ্র অবিভাজ্য কণিকা দ্বারা গঠিত এবং একই পরমাণু আকারে ও ভরে এক এবং ভিন্ন পদার্থের কণিকা আকারে ও ভরে ভিন্ন।
গ্যাসেন্দি দেখান যে কোটি কোটি পদার্থ গঠনে খুব বেশি পরমানু প্রয়োজন নেই। এগুলো ইট, তক্তা ,খুটির মত জিনিস। যা একত্রে একটি বাড়ি বানানোর জন্য যথেষ্ট।এর জন্য অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের ইট আর তক্তার প্রয়োজন নেই। তিনি অভিমত দেন পদার্থগুলো জটবদ্ধ হয়ে থাকে। একে তিনি অণু (moles) নাম দেন। তবে গ্যাসেন্দি মনে করতেন স্বাদ ,গন্ধ ,তাপের জন্য আলাদা পরমাণু রয়েছে। তার মস্তিষ্ক কিন্তু পুরোপুরি অ্যারিস্টটল মুক্ত ছিলো না!!!
এরপর রুশ বিজ্ঞানী এম. ডি. লোমনোসভের পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান যে অণু দুই ধরনের সমসত্ব ও অসমসত্ব। যাকে আজ আমরা মৌলিক অণু ও যৌগিক অণু বলে থাকি। এরপর বিট্রিশ বিজ্ঞানী জন ডাল্টন(John Dalton) পরমাণুবাদ তত্ত্ব প্রদান করলে পরমাণু বিজ্ঞান গবেষণার একটি বিশেষ শাখায় পরিণত হয়। ডাল্টন বলেন যে পরমাণু ্যৌগ গঠনের সময় নির্দিষ্ট কিছু নীতি মেনে চলে।
তবুও বহুকাল ধরে এমন বিজ্ঞানীদের দেখা মেলে যারা পরমাণুবাদকে অস্বীকার করতেন। এমনকি ১৯ শতকের শেষের দিকেও একজন বিজ্ঞানী লিখেছিলেন যে,” কয়েক দশক পরে পরমাণূকে লাইব্রেরির ধূলো ছাড়া আর কোথাও খুজে পাওয়া যাবে না।”
তথ্যসূত্রঃ কেলাসের গঠন, সকলের জন্য পদার্থবিদ্যা-২য় খন্ড, ল লানদাউ ও কিতাইগারোদস্কি;