মেরুজ্যোতি

মাঝে মধ্যেই প্রকৃতি তার শৈল্পিক আচরণের চরমতম প্রকাশ ঘটায়। সেরকমই একটি ঘটনা হচ্ছে  মেরুজ্যোতি। মেরু এবং জ্যোতি শব্দ দুটিকে আলাদাভাবে বিবেচনা করলে ঘটনাটির ধরন সম্পর্কে সামান্য ধারণা পাওয়া যায়। মেরুজ্যোতি হচ্ছে আকাশে আলোর দ্যুতিময় (জ্যোতি) ঘটনা যা মূলত মেরু অঞ্চল থেকে অবলোকন করা যায়। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান বিষুব অঞ্চলে হওয়ায় আমরা দৃষ্টিনন্দন এই প্রাকৃতিক ঘটনাটি থেকে বঞ্চিত হই। মেরুজ্যোতি নিয়ে মানুষের ভাবনা আজকের নয়। যুগ যুগ ধরে স্বর্গীয় বস্তুগুলো কীরূপে মানুষের মনকে অবৈজ্ঞানিক চিন্তায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেতো আমাদের অজানা নয়। মেরুজ্যোতি নিয়ে তৎকালীন মানুষের চিন্তা ভাবনায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আগেই বলেছি, মেরুজ্যোতি দেখার জন্য ভৌগলিক অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই ভৌগলিক সীমানার ভেতরে অবস্থানরত প্রাচীন মানুষগুলো মেরুজ্যোতি নিয়ে নানা ধরনের গল্প ফেঁদেছে; তাদের সীমিত জ্ঞান দ্বারা যেভাবে সম্ভব সেভাবেই এর ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। উত্তর-পূর্ব কানাডার অধিবাসীরা পৃথিবীকে সমতল মনে করতো আর আকাশকে ভাবতো ঢাকনা দেয়া তাঁবু যার মধ্যে আছে অসংখ্য ফুটো। মানুষ মারা গেলে তাদের  আত্মা এই ফুটোর মধ্য দিয়ে স্বর্গে চলে যায় আর যাত্রার সময় অন্য আত্মাগুলো আলো ফেলে তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। এভাবেই তৈরি হয় মেরুজ্যোতি। অনেকে আবার মেরুজ্যোতিকে মৃত পশুর আত্মার নাচনের ফল বলে মনে করতো। উত্তর আমেরিকার উপজাতিরাও মেরুজ্যোতির সাথে মৃত আত্মার সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। যেমন তারা মনে করতো, মেরুজ্যোতির মাধ্যমে তাদের পরিচিত মৃত আত্মারা তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। আইসল্যান্ড ও গ্রিনল্যান্ডের অধিবাসীরা মেরুজ্যোতির সাথে সন্তান প্রসবের উদ্ভট সব সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছিল। ফিনিশীয়রা মেরুজ্যোতির কারণ হিসেবে অগ্নি শিয়ালের লেজের দ্যুতিকে দায়ী করতো। অগ্নি শিয়ালের অস্তিত্ব ফিনিশীয় পুরাণে ছিল এবং ধারণাটি যে সেখান থেকেই এসেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ইউরোপে মেরুজ্যোতিকে মহামারি রোগ ও মৃত্যুর সতর্কবার্তা বলে ভাবা হতো। মেরুজ্যোতির রক্তিম আলোকে দেখা হতো আসন্ন যুদ্ধের সতর্কবার্তারূপে। চৈনিক পুরাণে মেরুজ্যোতিকে ড্রাগনের রূপকথার সাথে মিলিয়ে আরো আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।

দর্শনের স্বর্ণযুগে মেরুজ্যোতিকে এইসব উদ্ভট কল্পনার বাইরে এনে কিছুটা যৌক্তিক উপায়ে দেখার চেষ্টা করা হয়। সেক্ষেত্রে দার্শনিক অ্যানাক্সিমেনেস ও জেনোফেনস এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বলা হয় ৫৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের চতুর্থ মাসে গ্রিসের আকাশে মেরুজ্যোতি দেখা যায়। সে কথা অ্যানাক্সিমেনেস তাঁর একটি বইতে উল্লেখ করেন। জেনোফেনস সেই মেরুজ্যোতিকে বলেছেন “চলমান দগ্ধ মেঘ এর একীভ’ত হওয়া” আর সমসাময়িক আরেক দার্শনিক হিপোক্রেটিস এটাকে দেখেছেন সূর্যালোকের প্রতিফলনজনিত ঘটনা হিসেবে। অ্যারিস্টটল মেরুজ্যোতিকে বর্ণনা করেছেন দীপ্তমান মেঘ হিসেবে যার মূল কারণ জ্বলনক্ষম বস্তুর প্রজ্বলন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে থিয়োফ্রাস্টাস মেরুজ্যোতির সাথে সৌরকলঙ্কের সম্পর্ক থাকার কথা বলেন। এরও প্রায় দুই হাজার বছর পর গ্যালিলিও তাঁর বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে প্রথমবারের মতো সৌরকলঙ্ক পর্যবেক্ষণ করেন। সতের শতকে জ্যোতির্বিদ এডমন্ড হ্যালি মেরুজ্যোতির কারণস্বরূপ চৌম্বক ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেন। প্রায় কাছাকাছি সময়ে বিজ্ঞানী আন্দ্রেস সেলসিয়াস হ্যালির কথার পুনরাবৃত্তি করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মেরুজ্যোতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য একটি পরীক্ষা চালান নরওয়ের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান বার্কল্যান্ড। তিনি তাঁর নিজের বানানো একটি যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখান যে, চৌম্বকক্ষেত্রে একটি আলোকরশ্মি ফেললে তা চৌম্বক বলরেখা অনুসরণ করে দুটি চৌম্বক মেরুতে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং সেই মেরুকে ঘিরে একটি আলোর বলয় তৈরি করে। তিনি বললেন, সৌরকলঙ্ক থেকে উৎপন্ন ইলেকট্রন ঠিক এভাবেই পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রকে অনুসরণ করে মেরুতে গিয়ে মেরুজ্যোতি গঠন করে। মেরুজ্যোতির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পথে এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ।

এবার আসা যাক মেরুজ্যোতি কীভাবে সৃষ্টি হয় তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়। সূর্য থেকে সৌরবায়ুর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কণা বাহিত হয়ে  বুধ ও শুক্র গ্রহ অতিক্রম করে পৃথিবীর সীমানায় প্রবেশ করে। কণার মধ্যে থাকে ইলেকট্রন, প্রোটন ও আলফা কণা। সৌরঝড়ের সময় কণা নির্গমন এর হার অনেক বেড়ে যায়। এ সময় সৌরবায়ুতে আহিত কণার সাথে থাকে চৌম্বক মেঘ। এগুলোকে একত্রে বিকিরণ বলা চলে। উচ্চ শক্তির এই বিকিরণ মানুষ ও অন্য সকল প্রাণীর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।  তাছাড়া এ সময় বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ত্র“টিও দেখা যায়। তবে অধিকাংশ কণাই পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারে না। অর্থাৎ পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র পৃথিবীর উপরস্থ প্রাণীকুলের জন্য বর্ম হিসেবে কাজ করে। কিছু কণা ভেতরে ঢুকে যায় এবং চৌম্বকক্ষেত্রের একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে জমা হয়। কণাসমৃদ্ধ এই অঞ্চলকে বিকিরণ বলয় বলে। পরবর্তী সৌরঝড়ের উপর ভিত্তি করে এই কণাগুলো শক্তি অর্জন করে এবং চৌম্বক বলরেখার পথ অনুসরণ করে মেরু অঞ্চলে চলে যায়। সেখানে এই শক্তিসম্পন্ন কণাগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ও আমাদের পরিচিত অণুর (অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি) সাথে বিক্রিয়া করে সেগুলোকে উত্তেজিত করে। ফলে পরমাণুর অভ্যন্তরস্থ ইলেক্ট্রন উচ্চ শক্তিস্তরে পৌছে যায়। পরে যখন উত্তেজিত অবস্থা শিথিল

হয়ে আসে তখন ইলেক্ট্রন আবার তাদের স্বাভাবিক নিম্ন শক্তিস্তরে চলে আসে এবং কোয়ান্টাম নীতি অনুসারে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নির্গমন করে। অণুর বৈশিষ্ট্য অনুসারে এইসকল বিকিরিত তরঙ্গের রঙ-ও ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন মেরুজ্যোতির সবচেয়ে পরিচিত রং হচ্ছে সবুজ যেটা অক্সিজেন অণুর মাধ্যমে হয়। গোলাপী রং হয় নাইট্রোজেনের জন্য। নীল হয় আয়নিত নাইট্রোজেনের জন্য। গাঢ় লালের জন্য দায়ী হচ্ছে ২০০ কিলোমিটার উপরের অক্সিজেন। এখন দেখা যাক আমরা যারা বিষুবীয় অঞ্চলের বাসিন্দা তারা কেন মেরুজ্যোতি দেখতে পাই না। মনে করে দেখুন আমি বলেছিলাম বিকিরণ বলয় থেকে শক্তিসম্পন্ন কণাগুলো চৌম্বক বলরেখার দেখানো পথ ধরে অগ্রসর হয়। এই বলরেখা হচ্ছে কাল্পনিক বলরেখা। আকাশের দিকে তাকিয়ে এই বলরেখা দেখার চেষ্টা করা বৃথা। বোঝার সুবিধার্থ প্রথম ছবিতে এই বলরেখাগুলোকে নীল রং দ্বারা দেখানো হয়েছে। চিত্রে ¯পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে বলরেখাগুলোর প্রান্তিক বিন্দু সব দুই মেরু অঞ্চলের দিকে গিয়ে শেষ হয়েছে। ফলে শক্তিসম্পন্ন কণাগুলোও মেরু অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয় এবং সেখানকার অণুগুলোর সাথে বিক্রিয়া করে সেগুলোকে উত্তেজিত করে।

অরোরা বা মেরুজ্যোতিকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়- অরোরা বোরিয়ালিস এবং অরোরা অস্ট্রালিস। সমুদ্র অভিযানের পূর্বে অরোরা অস্ট্রালিস মানুষের কাছে অজানা ছিল। এর আগে যত যৌক্তিক ব্যাখ্যা ও কাহিনী বা রূপকথা বানানো হয়েছে তার সবই ছিল অরোরা বোরিয়ালিসকে কেন্দ্র করে। বলা হয় জেমস কুক এর প্রশান্ত মহাসাগর ও অস্ট্রেলিয়ার উপকূল অভিযানের সময় দক্ষিন অংশের মেরুজ্যোতি সম্পর্কে জানা যায়। এজন্য দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের মেরুজ্যোতিকে অরোরা অস্ট্রালিস নামে অভিহিত করা হয়েছে। তবে মেরুজ্যোতি যেখানেই ঘটুক না কেন, মূল বৈশিষ্ট্যে কোন পার্থক্য থাকে না। মেরুজ্যোতি আকাশের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকে না বরং কম্পমান থাকে। রঙিন আলোর ধনুকাকৃতির একটা অংশকে ধীরে ধীরে দিগন্তে উদিত হতে দেখা যায় এবং একসময় মাথার উপরের আকাশে বিরাট একটা অংশ দখল করে অবস্থান করে। মেরুজ্যোতি দিনে বা রাতে উভয় সময়েই দেখা যেতে পারে।

মেরুজ্যোতি কেবলমাত্র পৃথিবীর জন্য অনন্য কোন ঘটনা নয়, শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র আছে এরূপ প্রতিটি গ্রহে মেরুজ্যোতির ঘটনা ঘটে থাকে। বিশেষ করে সৌরজগতে যে চারটি গ্যাসীয় দানব (বৃহ¯পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন) আছে সেগুলোতে মেরুজ্যোতি অতি স্বাভাবিক ঘটনা। তবে ম্যাগনেটোস্ফেয়ার এবং বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান উপাদানে ভিন্নতার কারণে গঠন কৌশল ও রঙে সামান্য পার্থক্য দেখা যায়। ২০১৬ এর জুন মাসে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ বৃহ¯পতির উত্তর মেরুতে দৃশ্যমান মেরুজ্যোতির ছবি তুলে পাঠায়। মেরুজ্যোতির রঙগুলো যে সব সময় দৃশ্যমান আলোয় ধরা পড়বে তা কিন্তু নয়। তড়িৎচৌম্বক বর্ণালীর অন্য সকল বর্ণেও মেরুজ্যোতি হতে পারে। যেমন শনি গ্রহের মেরুজ্যোতির বর্ণালী হয় অধিকাংশ সময় অতিবেগুনী এবং অবলোহিত সীমার ভেতরে। এই বর্ণ আমাদের চোখে দৃশ্যমান নয়।

তথ্যসূত্রঃ

  1. http://www.bivrost.com/history/
  2. http://www.space.com/22215-solar-wind.html
  3. http://earthsky.org/space/are-solar-storms-dangerous-to-us
  4. http://www.space.com/11506-space-weather-sunspots-solar-flares-coronal-mass-ejections.html
  5. https://www.theaurorazone.com/about-the-aurora/aurora-legends
  6. http://www.luminarium.org/mythology/revontulet.htm
  7. http://theconversation.com/whats-it-like-to-see-auroras-on-other-planets-50341
  8. http://spaceplace.nasa.gov/aurora/en/
  9. http://pwg.gsfc.nasa.gov/polar/EPO/auroral_poster/aurora_all.pdf
  10. https://www.nasa.gov/feature/goddard/2016/hubble-captures-vivid-auroras-in-jupiter-s-atmosphere

Comments

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x