অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুতে শোকাহত এবং ক্ষুব্ধ। মুক্তমনা, যুক্তিবাদী এই লেখকের মৃত্যু বাংলাদেশের বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক অপূরণীয় ক্ষতি। ক্ষণজন্মা এই লেখক এবং বিজ্ঞানীর জীবন স্বল্পায়ু হলেও ছিলো বর্ণাঢ্য। আসুন, তার ব্যাপারে জানি।
১৯৭২ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর, অভিজিৎ রায়ের জন্ম। তাঁর পিতা অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য ২০১২ সালে অজয় রায় একুশে পদকের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হন।
অভিজিৎ রায় পড়াশোনায় একজন যন্ত্র প্রকৌশলী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগ হতে তিনি ব্যাচেলরস ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী অভিজিতের ফলাফল ছিল ঈর্ষণীয়। এর পরে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর (NUS) থেকে তিনি বায়োমেডিক্যালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে যন্ত্র-প্রকৌশলী অভিজিৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া প্রদেশের আটলান্টা শহরে বসবাস করতেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংবেদনশীল বিষয়ে অকপটে যুক্তিনির্ভর লেখালেখিতে অভিজিৎ রায় ছিলেন অগ্রগণ্য। তার লেখার ভিত্তি ছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ। যাবতীয় কুসংস্কার, সামাজিক নিপীড়ন ও অনাচারের নির্মোহ বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে মানবতাবাদী অভিজিৎ সোচ্চার হয়েছেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনায়, যেখানে মানবতা বিপন্ন হয়েছে। অভিজিৎ রায় বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তচিন্তার জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তার লেখা বইগুলোর প্রতিটিতেই যুক্তি, কার্যকারণ এবং পর্যবেক্ষণের বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
পেশায় প্রকৌশলী হবার পাশাপাশি অভিজিৎ ছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির জগতে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে তার লেখা “আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী” বইটি ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। এর দু’বছর পর ২০০৭ সালে “মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে” শীর্ষক বইতে তিনি ও সহলেখক ফরিদ আহমেদ পৃথিবীতে প্রাণের উৎস কীভাবে হলো তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে লিখেছেন। আমাদের এই পৃথিবীর বাইরেও অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা, কিংবা এর সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এই বইতে। আধুনিক জীববিজ্ঞান ও বিবর্তন নিয়ে প্রবল আগ্রহ ছিল অভিজিৎ রায়ের। এই বিষয়ের ওপর অসংখ্য ব্লগ লিখেছেন তিনি। এছাড়াও ২০১০ সালে “সমকামিতা” শীর্ষক বইয়ে সমকামিতার জীববৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
২০১১ সালে তিনি ও সহলেখক রায়হান আবীর মিলে লিখেছেন ” অবিশ্বাসের দর্শন”। স্রষ্টাবিশ্বাসী থেকে শুরু করে সংশয়বাদী, অজ্ঞেয়বাদী, নিরীশ্বরবাদী, বা মানবতাবাদী, সর্বোপরি বিজ্ঞানমনস্ক প্রতিটি বাংলাভাষী পাঠকের জন্য এই বইটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজনা। ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনের মাধ্যমে জাত-প্রথা-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণীবৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে এই বইটি মানুষকে প্রেরণা যুগিয়েছে। একইসাথে যেমন এখানে ধর্মবিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তেমনি আলোচনা করা হয়েছে চলমান কুসংস্কার নিয়ে, প্রসঙ্গক্রমেই এসেছে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের স্বরূপ নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা। প্রকাশের সাথে সাথেই মননশীল পাঠকদের মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিল এই বইটি। এই বছর বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিতও হয়েছে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অভিজিৎ এর পরে প্রকাশ করেন “ভালোবাসা কারে কয়” বইটি। এই বইয়ে তিনি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতা ইত্যাদি মানবীয় অনুভূতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মানব-অনুভূতির বিবর্তনীয় ব্যাখ্যার এই অভূতপূর্ব বইটিও পাঠক-সমাদর পেয়েছিল। তার লেখা অন্যান্য বইগুলো হচ্ছে – স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, বিশ্বাস ও বিজ্ঞান, শূন্য থেকে মহাবিশ্ব, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে।
২০০১ সালে মুক্তচিন্তার প্রসারের লক্ষ্যে, আরো কিছু মুক্তমনা মানুষকে সাথে নিয়ে তিনি একটি ব্লগ ওয়েবসাইট চালু করেন, নাম – মুক্তমনা। বিজ্ঞানচর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্য এটি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক অর্জন করেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তার ছিলো তীব্র অবস্থান। আর সে “অপরাধেই” তিনি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর চক্ষুশূলে পরিণত হন। ২০১৪ সালে অনলাইনে বই কেনার ওয়েবসাইট ‘রকমারি’-তে তার বই বিক্রি না করার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে হুমকি দেয়া হয়। ভয় পেয়ে ওনার বইগুলো সরিয়ে ফেলে রকমারি। ধর্মান্ধ বেশ কিছু দল তাকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছে বহুবার, অনলাইনে সেগুলোর প্রমাণ বিদ্যমান। অনবরত প্রাণনাশের হুমকি পেলেও নির্ভীক এই লেখক এ বছর (২০১৫ সালের) বইমেলায় তার নতুন বইয়ের প্রকাশ উপলক্ষে দেশে আসেন। আর সে সুযোগেই, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে নয়টায় ধর্মান্ধ ঘাতকের দল তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। তার মরদেহ দান করা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। তার আগে, সেই মরদেহকে সম্মান জানাতে এগিয়ে এসেছিলেন অনেকেই। তার স্ত্রী বন্যা আহমেদও এই আক্রমণে গুরুতরভাবে আহত হন। তার মৃত্যুসংক্রান্ত হুমকি, খুন, এবং পরবর্তী তদন্তের কথা পড়তে পারেন এখানে ক্লিক করে।
অভিজিৎ রায় যে মুক্তচিন্তার প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করে গেছেন, সেটা আমাদের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ। এবং সেই একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাবে মুক্তমনাদের দল, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ওনার মৃত্যুকে বৃথা যেতে দেয়া যাবে না। মুক্তচিন্তার জয় হোক।