(প্রথম পর্বের পর)
৮। উলফগ্যাং ডুয়েবলিন (১৯১৫ – ১৯৪০)
কে ছিলেন তিনি?
উলফগ্যাং ডুয়েবলিন-এর জন্ম ১৯১৫ সালের ১৭ মার্চ জার্মানিতে এক ইহুদি পরিবারে। “১৯১৫ সাল, জার্মানি, ইহুদি”- এই এক লাইনেই বুঝা যাচ্ছে ঘটনা কোনদিকে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিক তাই। ডুয়েবলিনের পরিবার এক পর্যায়ে তাদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে চলে আসে, আর ঠাঁই নেয় ফ্রান্সে। ডুয়েবলিন জার্মানিতে থাকতেই হাই স্কুল শেষ করেছিলেন। ফ্রান্সে এসে উলফগ্যাং ডুয়েবলিন তাঁর পিএইচডি শুরু করেন ‘ইন্সটিটিউট অব হেনরি পঁয়েকারে (Henry Poincare)’-তে। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ!
কেন তিনি দুর্ধর্ষ?
হেনরি পঁয়েকারে ইন্সটিটিউটে ডুয়েবলিনের অনন্য প্রতিভা নজরে পড়লো সবার। পিএইচডি করার সময়ে তাঁর নাম হয়ে গেলো ‘Gifted Theorist’. ‘ফ্রেশে’-এর মতো আরেক জিনিয়াস ফরাসী গণিতবিদের তত্ত্বাবধানে থেকে মাত্র ২৩ বছরে পিএইচডি পেয়ে গেলেন তিনি গণিতে। এই সময়ে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয় তাঁকে। কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে তিনি মনস্থির করলেন আর্মিতেই থেকে যাবেন তিনি। জোরাজুরি করে থেকেও গেলেন। এর কিছুদিন বাদেই শুরু হয়ে গেলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধে তাঁকে উত্তর ফ্রান্সের ‘জিভেই (Givet)’ নামক এলাকায় পাঠানো হলো ‘টেলিফোন অপারেটর’ হিসেবে। তাঁর দায়িত্ব ছিলো রণাঙ্গনের সাথে হেড-কোয়ার্টারের যোগাযোগ বজায় রাখা।
এই দায়িত্বের একটা অংশ হচ্ছে- যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কানের পাশ দিয়ে বুলেট ছুটে যাওয়ার সময় বন্দুক হতে পালটা গুলি না চালিয়ে বরং একটা টেলিফোন নিয়ে দলের কমান্ডারের পিছে পিছে ছুটে চলা, যাতে কমান্ডার গুলি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে জরুরি প্রয়োজনে সেই টেলিফোন দিয়ে হেড-কোয়ার্টারে যোগাযোগ করতে পারেন এবং দলকে দিয়ে অপারেশন পরিচালনার সমস্ত নির্দেশনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের থেকে পেতে পারেন। এবার অনুভব করুন যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের বুলেট এড়িয়ে কাঁধে বন্দুকের বদলে একটা ভারী ব্যাগে টেলিফোন আর কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি নিয়ে দৌড়ে বেড়াতে কেমন সাহসের প্রয়োজন! ভারী কাঁধ-ব্যাগ আর টেলিফোন বাদ দিন। বর্তমান প্রযুক্তিতে যুদ্ধের ময়দানে হাতে কিংবা পকেটে মোবাইল ফোন নিয়ে যুদ্ধ করা আর একইসাথে হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ রক্ষা করাই তো প্রচণ্ড বিপজ্জনক কাজ হবার কথা- তাই না?
যাই হোক, ফুল টাইম যুদ্ধের পরে যখন একটু অবসর পেয়ে অন্যান্য সৈন্যরা ঘোড়ার মতো ফোঁস ফোঁস করে নাক ডেকে ঘুমাতো, তখন ডুয়েবলিন একান্তে বসে বসে পার্ট টাইম গণিত চর্চা করতেন। শুধুই গণিতের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে! কিন্তু কী ধরণের গণিত চর্চা? তাঁর পছন্দের বিষয় ছিলো ‘প্রোব্যাবিলিটি থিওরি’ বা সম্ভাব্যতার তত্ত্ব। তাঁর পিএইচডিও ছিলো সম্ভাব্যতার ওপরে। তিনি যুদ্ধকালীন সময়েই বসে বসে সম্ভাব্যতার ‘চ্যাপম্যান-কলমোগ্রোভ থিওরি’-এর উপর কাজ করেছিলেন। কী এই ‘চ্যাপম্যান-কলমোগ্রোভ থিওরি’? বলছি দাঁড়ান। তার আগে ডুয়েবলিনের জীবদ্দশার গল্পটা শেষ করে নেই। তাঁর জীবনের কাহিনী আর বেশি বাকি নেই বলতে (আসলে তাঁর বেশির ভাগ কাহিনীই হচ্ছে মারা যাবার বহু বছর পরে ঘটা সব ঘটনা)!
ডুয়েবলিনের ব্যাটেলিয়ন যুদ্ধের ময়দানে ক্রমান্বয়ে আগাতে লাগলো শত্রুপক্ষদের পিছু হটিয়ে দিয়ে। ১৯৪০ সালের এপ্রিলে তারা পৌঁছালো ‘সারে’ নদীর কাছাকাছি, যেখানে ফ্রান্সের ‘ফোর্টিফায়েড সেক্টর অব সারে’ হতে ফরাসী ব্যাটেলিয়ন প্রহরা দিয়ে যাচ্ছিলো ‘মাজিনো লাইন’। মে মাসে আচমকা জার্মান বাহিনীর আক্রমণের মুখোমুখি হয় সেই সেক্টর। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে ডুয়েবলিনের বাহিনীর। ফরাসী বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। জার্মান বাহিনীও প্রবল চাপ অব্যাহত রাখে। জুনের ২২ তারিখে ঐ সেক্টরের ফরাসী বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় জার্মান বাহিনীর কাছে। তার ঠিক একদিন আগে, অর্থাৎ ২১ জুন ১৯৪০ সালে ডুয়েবলিন রিভলভার দিয়ে নিজ মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। একটা ছোট্ট গ্রামে ফরাসী বাহিনীর বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা আত্মগোপনে থাকার সময় যখন গ্রামটাকে জার্মান সৈন্যরা ঘেরাও করে ফেলে, তখন ডুয়েবলিন প্রথমে দৌড়ে গিয়ে নিজের সমস্ত গণিতের নোট ও পেপারগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। তারপরেই তিনি আত্মহত্যা করেন। বুঝতেই পারছেন তাহলে, আত্মহত্যার সময়ে তাঁর বয়স ছিলো মোটে ২৫ বছর। এই হলো ডুয়েবলিনের জীবদ্দশার গল্প। দি এন্ড! পরের অংশে ফিরে আসছি একটা ছোট্ট বিরতির পর।
পরের কাহিনী শুরু ডুয়েবলিনের মৃত্যুর ৫০ বছর পর, ১৯৯১ সালে। জার্মানির ‘টুবিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়’-এ এক ফরাসী গণিতের প্রফেসরকে দাওয়াত দেয়া হলো সম্ভাব্যতার ‘মার্কভ প্রসেস’-এর উপরে একটা বক্তৃতা দেয়ার জন্যে। সেই প্রফেসর মার্কভ প্রসেসের পেছনে কোন কোন গণিতবিদের অবদান জড়িত, সেটার লিস্ট করতে নামলেন। সেখানে তাঁর নজরে আসলো একটা সিল-গালা করা খাম। এই খামটা ৫০ বছরেরও আগে উলফগ্যাং ডুয়েবলিন নামক এক ব্যক্তি ‘ফ্রেশে’ নামক গণিতবিদের কাছে পাঠিয়েছিলেন, ‘ফ্রেঞ্চ একাডেমী অব সায়েন্স’-এর ঠিকানায়। যেহেতু ‘ফ্রেশে’ নামটা গণিত সমাজে বেশ পরিচিত, তাই ঐ প্রফেসর চাইলেন খামটা খুলে দেখতে যে গণিতবিদ ফ্রেশের এই ডুয়েবলিন নামক ছাত্রটা কী এমন জিনিস লিখে সেটা সিল-গালা করে পাঠিয়েছেন। কিন্তু বাঁধলো বিপত্তি! যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে খামটা পাওয়া গিয়েছিলো, ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম হলো- যদি সিল-গালা করা খামের প্রাপক খামটা খুলে না থাকেন এবং প্রেরক-প্রাপক কেউই জীবিত না থাকেন, তবে একমাত্র প্রেরকের পরিবারের কারো অনুমতি সাপেক্ষেই খামটা খোলা যাবে। ঐ প্রফেসরও হাল ছাড়ার পাত্র নন। তিনি হারিকেন দিয়ে খুঁজে বের করলেন ডুয়েবলিনের ভাইকে, যিনি তখনো জীবিত। তার অনুমতি নিয়েই খোলা হলো খামটা। খামটা খুলে প্রফেসরের বিষম খাবার দশা হলো!
উপরে উল্লিখিত ‘চ্যাপম্যান-কলমোগ্রোভ’ সমীকরণের উপরে ভিত্তি করে একটা ফর্মুলা দাঁড় করিয়েছিলেন ‘কিয়োশি ইতো’ নামক এক গণিতবিদ ১৯৫০ এর দশকে। ঐ ফর্মুলাটাকে গণিতশাস্ত্রে এক নামে ডাকা হতো ‘Ito’s Lemma’ নামে। Lemma মানে হলো কোনো একটা গাণিতিক তত্ত্ব প্রমাণ করার মাঝামাঝিতে থাকা অবস্থায় প্রমাণিত আরেকটা তত্ত্ব। Lemma হচ্ছে মূলত সহায়তাকারী তত্ত্ব যেটা মূল তত্ত্ব প্রমাণে সাহায্য করে। কিয়োশি ইতো মূল চ্যাপম্যান-কলমোগ্রোভ তত্ত্বটাকে চুইংগামের মতো টেনে বের করেছিলেন ‘ইতোর তত্ত্ব’। ডুয়েবলিনের পেপার আবিষ্কার করার পর দেখা গেলো ডুয়েবলিনও একইভাবে করে গেছিলেন এই চুইংগাম টানার কাজটা, তবে ইতোর আরো এক যুগ আগেই!
কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে এই কলমোগ্রোভ তত্ত্ব জিনিসটার নাম শুনছি, ব্যাপারখানা আসলে কী? যাচ্ছি সেই আলোচনায়। তার আগে আসুন দেখে নেই চ্যাপম্যান-কলমোগ্রোভ সমীকরণটা দেখতে আসলে কেমন।
সহজভাবে বলছি – যারা সম্ভাব্যতা সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে কিছু পড়াশোনা করেছেন, তারা জানেন দু’টা ঘটনা যদি স্বাধীন হয় তবে একটার উপর আরেকটা ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা নির্ভর করে না। যেমন- ঢাকায় বৃষ্টিপাত হবার ঠিক একই সময়ে নিউইয়র্কে বরফ পড়ার সম্ভাব্য ঘটনা পুরো স্বাধীন। এরা একসাথে ঘটতে পারে, নাও ঘটতে পারে। কিন্তু এমন কিছু কিছু স্বাধীন ঘটনা আছে, যারা স্বাধীনভাবে ঘটলেও ভবিষ্যতে আরেকটা স্বাধীন ঘটনা ঘটার পূর্বাভাস দিতে পারে। যেমন হচ্ছে- আবহাওয়া। ধরুন, আজকে বেশ গরম পড়েছে। কিন্তু কালকেও যে গরম পড়বে সেটার কোনো গ্যারান্টি নেই। আগামীকাল বৃষ্টিও হতে পারে। খেয়াল করলে দেখবেন আজকের গরম এবং কালকের বৃষ্টি পড়া দুটোই স্বাধীন এবং বিচ্ছিন্ন (random) ঘটনা। তবুও প্রত্যেকদিনের এই স্বাধীন ঘটনার ইতিহাসগুলো যদি আপনি তালিকা করেন এবং পর্যালোচনা করেন, তবে কিন্তু আপনি একটা নকশা দাঁড় করাতে পারবেন। আর সেই নকশা ধরে ৭ দিন পরের আবহাওয়ার একটা সম্ভাব্য ধারণা দাঁড় করাতে পারবেন। কলমোগ্রোভ তত্ত্ব এই ব্যাপারটা নিয়েই কাজ করে। ডুয়েবলিন এবং কিয়োশি ইতো এই তত্ত্বটাকেই চুইংগামের মতো টেনে নিয়ে গেছেন আরো বহুদূর পর্যন্ত।
বর্তমানে ইতোর তত্ত্বকে ডুয়েবলিনের সাথে মিলিয়ে ডাকা হয় ‘ইতো-ডুয়েবলিন তত্ত্ব‘। হুলুস্থুল পড়ে যায় নব্য আবিষ্কৃত এই গণিতবিদকে নিয়ে গণিত সমাজে। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বের হয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর দুর্ধর্ষ ইতিহাসের কথা। মাত্র ২৫ বছর বয়সে এই প্রতিভার মৃত্যুর কথা। ২০০৭ সালে অ্যাগনেস এবং হ্যারি নামক দুই পরিচালক নির্মাণ করেন ডকুমেন্টারি ফিল্ম। নাম ‘A Mathematician Rediscovered’. এই ডকুমেন্টারিতে তুলে ধরা হয় ডুয়েবলিনের বিস্তারিত জীবনী। ‘ফিনান্সিয়াল ম্যাথম্যাটিকস’-এ এখন ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘ইতো-ডুয়েবলিন তত্ত্ব’।
দুর্ধর্ষতা রেটিং
৮.৫/১০। তাঁর দুর্ধর্ষতা ও প্রতিভা নিয়ে আমাদের মনে কোনো সন্দেহই নেই। তাঁকে অনেকে তুলনা করেন তরুণ গণিতবিদ গ্যালোয়ার সাথে। কিন্তু তিনি আত্মহত্যার পূর্বে তাঁর সম্ভাব্যতার ওপরে তৈরি করা সমস্ত গবেষণাপত্র জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, যেটা আমাদের মতে- পুরা খামাখা। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন তাঁর কাগজগুলো জার্মানদের হাতে না পড়ুক। কিন্তু উপরে দেখেন কী হয়েছে। ঠিকই বহু বছর পরে একজন ফরাসী প্রফেসর জার্মানিতে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে সদ্য আবিষ্কৃত ডুয়েবলিনকে নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন, যেই জার্মানি ছিলো ডুয়েবলিনের জন্মস্থান! কাগজগুলো হাতে পেলে কে জানে আমরা হয়তো টাইম মেশিন বানানো আদৌ সম্ভব কিনা- সেটার সম্ভাব্যতা বের করে ফেলতে পারতাম এতদিনে। তাই কিছু পয়েন্ট কেটে রাখা হলো।
যাই হোক, গ্যালোয়ার প্রসঙ্গ যখন আসলোই…………..
৭। এভারিস্ট গ্যালোয়া (১৮১১-১৮৩২)
কে ছিলেন তিনি?
এভারিস্ট গ্যালোয়া ছিলেন একজন ফরাসী গণিতবিদ। ১৮১১ সালের ২৫ অক্টোবর তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন রিপাবলিকান মতবাদের সমর্থক, এবং লিবারেল পার্টির একজন নেতা। গ্যালোয়ার মা ছিলেন একজন আইন বিশেষজ্ঞ এবং লাতিন ও ক্লাসিক সাহিত্যের ভক্ত। মূলত মায়ের হাত ধরেই গ্যালোয়ার পড়াশুনায় হাতে-খড়ি হয়। শুধু তাই নয়। পুরো দশ বছর তিনি কোনো স্কুলে না গিয়ে বাসায় মায়ের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করেছেন। গ্যালোয়াকে ‘কলেজ অব রাইমস’-এর পক্ষ থেকে সেখানে ভর্তি করিয়ে পড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছিলো। কিন্তু তাঁর মা সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। সম্ভবত তাঁর মায়ের ধারণা ছিলো- কলেজের পোলাপান সব বিড়ি-সিগারেট খায়। তাই নামের মধ্যে ‘কলেজ’ শব্দটা দেখেই তিনি হয়তো ধরে নিয়েছিলেন- তার দশ বছরের বাচ্চাকে কলেজে দিলে সেও বিড়ি খাওয়া শিখে যাবে! আমাদের ধারণা- তিনি আসলে বুঝতে পারেননি ওরা আসলে প্রাথমিক স্কুলে গ্যালোয়াকে ভর্তি করানোর কথা বলছিলো।
কেন তিনি দুর্ধর্ষ?
অবশেষে ১২ বছর বয়সে গ্যালোয়াকে স্কুলে ভর্তি করানোর পরে দেখা গেলো ‘বাসায় বসে স্বশিক্ষিত হওয়া’ এই ছাত্র স্কুলের অন্যান্যদের চেয়ে যথেষ্ট মেধাবী। এতোই মেধাবী যে আরো দু’বছর বাদে গ্যালোয়ার কাছে স্কুলে পড়ানো বিষয়গুলো পুরো একঘেয়ে লাগা শুরু করলো। টিনেজ বয়সে যখন পোলাপানের খাটের তোষকের নিচে ফুটপাত থেকে পাওয়া অথবা বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া ‘বিশেষ শিক্ষামূলক’ কিছু বই পাওয়া যায়, ঐসময় ১৫ বছর বয়সী গ্যালোয়ার বিছানার বালিশের নিচে তার মা খুঁজে পেয়েছিলেন আদ্রিয়েন ম্যারির লেখা একটা জ্যামিতির বই। তিনি খেয়াল করে দেখলেন, গ্যালোয়া একটা উপন্যাস পড়ার মতোই গোগ্রাসে সেই জ্যামিতির বই গিলছে! শুধু তাই নয়, সেই জ্যামিতির বই শেষ করে তিনি সরাসরি পড়া শুরু করলেন গণিতবিদ ‘জোসেফ লুই লেগ্রাঞ্জ’-এর গবেষণাপত্র। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। গবেষণা কর্মের উপরে লেখা কোনো বই নয়, সরাসরি লেগ্রাঞ্জের মূল গবেষণাপত্রগুলোই তিনি গোগ্রাসে গেলা আরম্ভ করেছিলেন। এদিকে তাঁর স্কুলের হোম ওয়ার্কের খাতায় মাছি উড়ে! ফলে স্কুল থেকে অভিযোগ আসলো, “গ্যালোয়া তার প্রতিভা বাজে কাজে নষ্ট করছে”।
১৮২৮ সাল নাগাদ গ্যালোয়া ফ্রান্সের সবচেয়ে অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইকোল পলিটেকনিক’-এ ভর্তি হবার চেষ্টা করলেন (ইকোল = ‘স্কুল’-এর ফরাসী সংস্করণ)। কিন্তু তিনি ফেইল করলেন ভর্তি পরীক্ষায়। পরে আরো একবার দিলেন ভর্তি পরীক্ষা। কিন্তু সেটাতেও ফেইল করলেন। দুই দুইবার ফেইল করার কারণ কী? কারণ পরীক্ষায় গাণিতিক সব প্রশ্নের যেসব উত্তর দিয়েছিলেন সেসব উত্তর পরীক্ষকের মাথার অ্যান্টেনার ২০ হাত উপর দিয়ে গিয়েছিলো। তিনি এতো সংক্ষেপে বিশাল বিশাল সব গাণিতিক সমস্যার সমাধান লিখেছিলেন খাতায় যে পরীক্ষক নিজেই বুঝতে পারেননি একটা সমীকরণের সমাধানে আগের ধাপের সাপেক্ষে পরের ধাপটা কোথা থেকে এলো! মৌখিক পরীক্ষায় যখন তাঁকে ব্যাখ্যা করতে বলা হলো ধাপগুলো, তখন তাঁর ব্যাখ্যাগুলোও সেখানে উপস্থিত পরীক্ষকদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে গেলো। এক পর্যায়ে মেজাজের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন গ্যালোয়া। ফলাফল- ভর্তি হবার আগেই পলিটেকনিক হতে তিনি বহিষ্কৃত! মেজাজ হারানোর আরেকটা কারণ ছিলো অবশ্য। তাঁর পিতা গ্যালোয়ার দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেবার দিন কয়েক আগেই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।
গ্যালোয়া ট্রেনের মতো চলতে থাকা অমূলদ সব ভগ্নাংশদের নিয়ে তাঁর জীবনের প্রথম গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন, মাত্র ১৭ বছর বয়সে। ইকোল পলিটেকনিকে ভর্তি হতে না পেরে তিনি ঢুকে পড়েন পলিটেকনিক স্কুলের সাধারণ সংস্করণ ‘ইকোল নরমালে’-তে। সেখানে তাঁর শিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, “এই ছাত্রটা মাঝেমাঝে তার আইডিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেশ দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে সবার কাছে, কিন্তু এছাড়া তার মেধা ভালো এবং গবেষণার প্রতিও বেশ উদ্যমতা আছে”।
১৮৩০ সালে ‘গণিতবিদ পয়সোঁ’-এর পরামর্শে গ্যালোয়া ফ্রান্সের সায়েন্স একাডেমীর এক গাণিতিক জার্নাল প্রতিযোগিতায় নিজের একটা গবেষণাপত্র জমা দেন। পেপারটা তিনি জমা দিয়েছিলেন একাডেমীর তৎকালীন সেক্রেটারি ‘জোসেফ ফোরিয়ে’-এর কাছে। তিনি সেটা পকেটে রেখে দিয়েছিলেন। এর দিন কয়েক বাদেই ফোরিয়ে হঠাৎ করে মারা যান। আমাদের ধারণা- ফোরিয়েকে পকেটে গ্যালোয়ার সেই গবেষণাপত্র থেকে যাওয়া অবস্থাতেই কবর দিয়ে ফেলা হয়েছিলো। কারণ পরে আর বহু খুঁজেও সেই পেপারটা পাওয়া যায়নি। গণিতবিদ পয়সোঁ নিশ্চিত ছিলেন তাঁর ছাত্র গ্যালোয়াই প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পাবে। কিন্তু পেপারই যেখানে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে প্রতিযোগিতা তো আরো বহু দূরের ব্যাপার।
এদিকে চলছিলো আরেক কাহিনী। ১৮২৪ সালে ফ্রান্সে ‘অষ্টাদশ লুই’-এর পরে ক্ষমতায় এলেন ‘দশম চার্লস’। কিন্তু বছর তিনেক যেতে না যেতেই তার পার্টি জনসমর্থন হারিয়ে চোখে সরিষা ফুল দেখা শুরু করলো। তখন গদি বাঁচাতে দশম চার্লস জারি করলেন ‘জুলাইয়ের অধ্যাদেশ’, যেখানে এক প্রকার জোর করেই নিজের শাসন ক্ষমতা বহাল রেখেছিলেন তিনি। এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে শুরু হয়ে গেলো আন্দোলন। ইকোল পলিটেকনিকের সব ছাত্র নেমে গেলো রাস্তায় দশম চার্লসের বিরুদ্ধে আন্দোলনে। কিন্তু ইকোল নরমালে-এর ডিরেক্টর গেইটে তালা ঝুলিয়ে রাখলেন, যাতে তার প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা রাস্তায় নামতে না পারে। গ্যালোয়া ও তাঁর বন্ধুরা চেষ্টা করেছিলেন পাঁচিল টপকে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে। কিন্তু পারেননি। পরে তিনি নিজের নাম স্বাক্ষর করে একটা চিঠি লিখেন যেখানে ডিরেক্টরের বাপ-মা সহ চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করা হয়। এই চিঠির কথা জানার পরে ইকোলে নরমালে হতেও বিতাড়িত করা হয় তাঁকে ১৮৩১ সালে।
১৮৩১ সালে দশম চার্লসের পতনের পর ‘লুই ফিলিপ’ বসেন ক্ষমতায়। তিনি বিশাল এক পার্টি দেন। সেখানে গ্যালোয়া সহ তাঁর অন্যান্য ফিলিপ সমর্থক বন্ধু-বান্ধবরাও আমন্ত্রিত হন। সেই পার্টিতে গ্যালোয়া একটা ওয়াইনের গ্লাস তুলে ধরে ফিলিপের উদ্দেশ্যে ‘টোস্ট’ করেন। কিন্তু সেই গ্লাস দেখে ফিলিপের মুখ শুকিয়ে যায়। কারণ গ্লাসের উপরে একটা ‘ড্যাগার’ ও রাখা ছিলো। গ্যালোয়ার মেসেজ একদম পরিষ্কার! ফিলিপ যদি ফ্রান্সের সাথে ধোঁকাবাজি করে, তবে তাকেও ফেলে দেয়া হবে। এই মেসেজ ঠিক হজম করতে না পারায় গ্যালোয়া ও তার বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজনকে জেলে পাঠানো হয়। গ্যালোয়ার হয়ে যায় ছয় মাসের জেল।
জেলে বসেই তিনি একের পর গবেষণা দাঁড় করাতে থাকেন। তাঁর হাত ধরেই তখন বেরিয়ে আসে ‘গ্রুপ থিওরি’, যেটা গণিতশাস্ত্রে এক বিপ্লব সৃষ্টি করে। গ্যালোয়াকেই ধরা হয় গ্রুপ থিওরির জনক। জেলে যাবার আগে গণিতবিদ পয়সোঁ বলেছিলেন- গ্যালোয়া যেন তার সমীকরণ তত্ত্বটা (Theory of Equation) জলদি শেষ করে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সেটা পয়সোঁর হাতে পৌঁছায় গ্যালোয়া জেলে যাবার পরে। সেই পেপারটা বিশ্লেষণ করে অনেক কিছুরই মাথা-মুণ্ডু বুঝে উঠতে পারেননি পয়সোঁ। তাঁর মতামত ছিলো, “গ্যালোয়ার আইডিয়াগুলো দুর্বোধ্য। গাণিতিক যুক্তিগুলো পুরোপুরি পরিষ্কার নয় যে সেটা ধরে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে”। সুতরাং বাতিল!
এই খবর গ্যালোয়ার কানে গেলে তিনি মুষড়ে পড়েন। কিন্তু সেই সাথে রিভিউ রিপোর্টে পড়ে দেখলেন পয়সোঁ নাকি এও বলেছেন, “আশা করছি এই গণিতবিদ তাঁর পুরো কাজগুলোকেই সম্পূর্ণ আকারে আমাদের সামনে হাজির করবেন, যাতে করে আমরা তাঁর মেধার ব্যাপারে একটা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারি”।
এ কথা পড়েই গ্যালোয়া কাজে নেমে পড়লেন। তাঁর জীবনে করা সকল গবেষণা কর্মগুলোকে একটা পুস্তকের মধ্যে নিয়ে আসা শুরু করলেন। এর কিছুদিন বাদেই ১৮৩২ সালের ২৯ এপ্রিল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান গ্যালোয়া। কিন্তু মাস খানেকের মধ্যেই ঘটে ট্রাজেডি। অজানা এক ঘটনায় ডুয়েল লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় গ্যালোয়াকে। মূল ঘটনা একেক ইতিহাসবিদ বলেন একেক রকম। অনেকে বলেন- মূল দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিলো এক ডাক্তারের কন্যার সাথে গ্যালোয়ার প্রণয়ের ঘটনা নিয়ে। কিন্তু লেখক ‘আলেকজান্দার দ্যুমা’ বলেন প্রেমের ঘটনাটা আসলে ছিলো ফাঁদ। সাজানো ঘটনা। মূল কারণ ছিলো রাজনৈতিক। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে একটা প্রেমের নাটক দিয়ে এমনভাবে গ্যালোয়াকে ফাঁসানো হয় যাতে তিনি চ্যালেঞ্জে ডুয়েল লড়তে বাধ্য হন। ডুয়েলের দিন ঠিক করা হয় ৩০ মে, ১৮৩২।
ডুয়েলের ঠিক আগের রাতে হঠাৎ গ্যালোয়ার মনে হলো- আগামীকাল তিনি আর বাঁচবেন না। আগামীকালের ডুয়েলে তিনি মারা যাবেন। তাহলে? কী হবে তাঁর গণিত সংক্রান্ত অসমাপ্ত সব কাজের, যেটা তিনি জেলে বসে শুরু করেছিলেন। তখন তিনি মোমের আলোয় লিখতে শুরু করলেন গণিত নিয়ে তাঁর সব চিন্তাধারা। সেই ১৭ বছর বয়সের প্রথম রেলগাড়ির মতো চলতে থাকা ভগ্নাংশদের থেকে শুরু করে আজকের ইকুয়েশন থিওরি পর্যন্ত সব কাজ। দুর্বোধ্যতার কারণে বাতিল হয়ে যাওয়া সব আইডিয়া। দিস্তার পর দিস্তা কাগজে লিখে চললেন তিনি। মাত্র এক রাতে শেষ করে ফেললেন তাঁর সারাজীবনের সমস্ত গাণিতিক ধ্যান-ধারণাকে সংকলন করে ফেলার কাজ।
তারপর লিখলেন কয়েকটা চিঠি। তাঁর কমরেড বন্ধুদের উদ্দেশ্যে। তাঁর ভাইয়ের উদ্দেশ্যে। জানালেন সবাইকে- আগামীকাল তিনি চলে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কাজগুলো অন্তত যাতে যথাযথ ব্যক্তির হাতে পড়ে- সেটা যেন তারা লক্ষ্য রাখে।
পরদিন ডুয়েলে মাত্র ২০ বছর বয়সে মারা যান এই তুখোড় ফরাসী গণিতবিদ, বীজগণিতের গ্রুপ থিওরি এবং গ্যালোয়া তত্ত্বের জনক এভারিস্ট গ্যালোয়া।
দুর্ধর্ষতা রেটিং
৯/১০। এমন দুর্ধর্ষ গণিতবিদের রেটিং-এ এক পয়েন্ট কেন কাটা গেলো? কারণটা নিজের কাছেও ‘দুর্বোধ্য’ ঠেকছে। মনে হয়, উনার থেকেও আরো বড় বড় সব গণিতবিদদের রেটিং করা বাকি আছে এখনো, তাই! হ্যাঁ, গ্যালোয়ার থেকেও দুর্ধর্ষ গণিতবিদদের কাহিনী আসছে পরের পর্বগুলোতে। সুতরাং, দম খিঁচে বসে থাকুন।