(দ্বিতীয় পর্বের পর)
৬। এমিলি দ্যু শ্যাতলে (১৭০৬ – ১৭৪৯)
কে ছিলেন তিনি?
ফরাসী গণিতবিদ, পদার্থবিদ, বিজ্ঞান লেখক, নারীশিক্ষার সংস্কারক। এমিলি দ্যু শ্যাতলে বিখ্যাত হয়ে আছেন ‘রেনে দেকার্তে’-এর মাধ্যাকর্ষণ বিষয়ক মতবাদ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ফরাসী জনগণের নিকট নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ বিষয়ক মতবাদ জনপ্রিয় করার জন্যে। তদুপরি তিনি নিউটনের গতিশক্তি সংক্রান্ত সূত্রটার গাণিতিক ভুল ধরিয়ে দিয়ে পুরো ‘রকস্টার গণিতবিদ’-দের খাতায় চলে গেছেন।
কেন তিনি দুর্ধর্ষ?
(দীর্ঘশ্বাস!) উপরের প্যারাটা মনে হয় ঠিক মতো পড়েননি। যাই হোক, যেমনটা বলেছিলাম- এমিলি দ্যু শ্যাতলে ছিলেন আঠারশ’ শতকের একজন রকস্টার গণিত ও পদার্থবিদ। ফরাসী দার্শনিক ‘ভলতেয়ার’-এর মতে, “শ্যাতলে একজন তুখোড় প্রতিভাধর মানুষ, যাঁর একমাত্র ভুল ছিলো তিনি একজন নারী”। ভলতেয়ারের মতো বাঘা দার্শনিকের নাম শুনে যারা চেয়ারে একটু নড়ে-চড়ে বসেছেন, তাদের অনেকেই কাত হয়ে চেয়ার থেকে পড়ে যাবেন যদি বলি- এমিলি দ্যু শ্যাতলে ছিলেন আসলে ভলতেয়ারের প্রেমিকা! ভলতেয়ার স্যার আইজ্যাক নিউটনের চিন্তা-ভাবনা ও দর্শন নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বইয়ের প্রথমেই ছিলো একটা ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছিলো- নিউটনের চিন্তা-ভাবনাগুলো শ্যাতলের মাধ্যমে টেলিকাস্ট হয়ে ভলতেয়ারের মাথার অ্যান্টেনায় ধরা পড়ছে।
শ্যাতলে জীবনে চলা-ফেরাও করেছিলেন রকস্টারদের মতো। তাঁর বাবা ছিলেন রাজ-দরবারের কর্মচারী। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন তরবারি চালানো, ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করার নানা কলা-কৌশল। বারো বছরেই তিনি লাতিন, ইতালিয়ান, গ্রীক এবং জার্মান ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। আর তখন থেকেই সূত্রপাত এসব ভাষার বড় বড় চিন্তাবিদদের বই পড়া। বিজ্ঞানের প্রতি শ্যাতলের আগ্রহ দেখে তাঁর বাবা ফ্রান্সের বিজ্ঞান একাডেমীর বাঘা বাঘা লোকজনদের বাসায় দাওয়াত করতেন আর অনুরোধ করতেন তাঁর কন্যার সাথে বিজ্ঞান ও গণিত নিয়ে আলোচনা করার জন্যে। শ্যাতলের মা রীতিমতো আতংকিত হয়ে পড়েছিলেন বাপ-মেয়ের এসব কাণ্ড-কীর্তি দেখে। তিনি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলতেন, “এই অতি চালাক আর বাউণ্ডুলে মেয়েকে কে বিয়ে করবে আমি দেখে নেবো!” পরে অবশ্য তাঁর বড় ঘরে বিয়ে হয়েছিলো ঠিকই। বার্গান্ডির এক গভর্নরের সাথে।
তিনি বিবাহিত হলেও দার্শনিক ভলতেয়ারের সাথে ছিলো প্রেমের সম্পর্ক। দু’জনে মিলে বিজ্ঞান ও দর্শনের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। সেগুলো নিয়ে পরে একসাথে লেখালেখিও করতেন। সেই সময় ফ্রান্সের ক্যাফেতে আড্ডা জমাতে ভিড় করতো দুই ধরণের মানুষ। এক, রাজনৈতিক বিপ্লবীরা। দুই, বিজ্ঞান ও দর্শন চিন্তাবিদেরা। এমিলি চাইতেন ক্যাফেতে গিয়ে এই দ্বিতীয় প্রকারের মানুষের সাথে আড্ডা দিতে। তাঁদের সাথে বিজ্ঞানের নানা আইডিয়া নিয়ে কফির কাপে ঝড় তুলতে। কিন্তু তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে নারীদের ক্যাফেতে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিলো। এমিলি ভলতেয়ারকে বললেন, “রক্ষণশীল সমাজ-নারী-প্রাচীন সংস্কার সব বাজে কথা। আমি পুরুষদের পোশাক পরে গেলে, আমি নারী সেটা বুঝেও আমাকে ক্যাফেতে ঢুকতে দিবে”।
পরে দেখা গেলো তাই! নারী পোশাকে তিনি ক্যাফেতে ঢুকতে পারেননি। কিন্তু পুরুষদের পোশাক পরে যাবার পরে তাঁকে আর কেউ বাধা দিলো না। গেটের দারোয়ানেরা তাঁকে নারী হিসেবে চিহ্নিত করার পরেও তাঁর সাথে পাঙ্গা নেয়ার সাহস করেনি আর। ক্যাফের আড্ডাবাজ বিজ্ঞানী সমাজও তাঁকে বেশ কাছে টেনে নিয়েছিলো তাঁর চিন্তার গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে। তিনি নিয়মিত তাঁদের সাথে জুয়ার আসরেও বসতেন এবং বেশীরভাগ সময়ই জিতে আসতেন নিজের অনন্য গাণিতিক দক্ষতা কাজে খাটিয়ে। পরে সেই টাকা দিয়ে তিনি বই কিনে কিনে পড়তেন।
সেই সময়টা ছিলো মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব নিয়ে হৈ-চৈ এর যুগ। বিশ্বজুড়ে নিউটন বেশ খ্যাতি পেলেও ফ্রান্সে কেন যেন তাঁর তত্ত্বগুলো শুরুতে হালে পানি পায়নি। ফরাসীরা বরং তাঁদের স্বদেশী ‘রেনে দেকার্তে’-কে মাথায় তুলে নাচতো। রেনে দেকার্তের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বকে বিশ্বাস করতো। রেনে দেকার্তের মতে– বস্তুরা একে অপরকে আকর্ষণ করতো ‘ইথার’ নামক মাধ্যমের কারণে। এই ইথার মাধ্যমের স্থানে স্থানে আছে ফাঁকা স্থান বা ভ্যাকুয়াম। মাধ্যমের অন্যান্য ইথার পদার্থরা আসলে ছুটে যায় সেই ফাঁকা স্থান পূর্ণ করতে। ফলে তৈরি হয় একটা ঘূর্ণি। সেই ঘূর্ণির কারণেই গ্রহরা বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায়।
রেনে দেকার্তের এই মতবাদ নিয়ে যখন খুব হৈ-চৈ, তখন শ্যাতলে বলে বসলেন, “লুলজ! দেকার্তে কিনা বলে, আর ফরাসী জনগণ কিনা খায়?” এরপরে তিনি ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করে দিলেন নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা’ বইটা। ফরাসী ভাষায় এই বইয়ের অনুবাদের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত শ্যাতলের অনুবাদ কর্মটাকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শুধু অনুবাদই নয়। নিউটনের সেই সব তত্ত্ব নিয়ে ভালোই দৌড়-ঝাঁপ করতে হয়েছিলো এমিলিকে। নিউটনের গাণিতিক ব্যাখ্যাগুলো সহজ ভাষায় সবার সামনে তুলে ধরতে হয়েছিলো তাঁকে।
এই কাজ করতে গিয়েই লাগলো একটা প্যাঁচ। এমিলি দেখতে পেলেন নিউটনের বক্তব্য অনুযায়ী- বস্তুর গতিশক্তি আসলে তার বেগের সমানুপাতিক নয়। বরং সেটা “বেগের বর্গের সমানুপাতিক”। প্যাঁচটা লেগেছিলো কারণ, নিউটন বস্তুর এনার্জি বা শক্তি এবং মোমেন্টামকে আলাদা করে দেখতে পারেননি। তিনি দুটোকে একই জিনিস মনে করেছিলেন। কিন্তু শ্যাতলে গাণিতিকভাবে দেখালেন দুটো একই নয়, বরং আলাদা জিনিস। ফলে যেই সূত্র ছিলো,
Ek ∞ v
সেটা শ্যাতলের হাতে পড়ে হয়ে গেলো,
Ek ∞ v^2
আর সেখান হতেই উদ্ভূত হলো গতিশক্তির সূত্র,
Ek = ½ x m x v^2
এটাকে আমরা নিউটনের গতিশক্তির সূত্র হিসেবে জানি। কিন্তু খুব কম লোকেই জানি এটার পেছনে এমিলি দ্যু শ্যাতলে নামক এক রকস্টার গণিতবিদের অবদানের কথা। বিজ্ঞানের মজাটা এখানেই! এখানে নিউটন, আইনস্টাইনের মতো গডফাদাররাও আমজনতাকে উল্টা-সিধা একটা কিছু বুঝিয়ে দিয়ে পার পাবেন না।
এছাড়াও শ্যাতলে আগুনের ধর্ম নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। সেটা নিয়ে একটা পেপারও তৈরি করেছিলেন, যেটা পরে ১৭৩৭ সালে ফ্রান্সের বিজ্ঞান একাডেমী হতে প্রকাশিত হয়। ঐ পেপারে তিনি বলেন- তিনি দেখেছেন আগুনের রঙের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার তাপ বিকিরণের মাত্রাও বেড়ে বা কমে যায়। সেই হিসেবে বলা যায়, এক এক রঙের আলো এক এক মাত্রার তাপ দেয়। এই সূত্র ধরেই সেই লেখায় তিনি এমন একটা বিকিরণ সম্পর্কে কল্পনা ও ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যেটা তৎকালীন বিজ্ঞান একাডেমীর সকলের মাথার অ্যান্টেনার বিশ হাত উপর দিয়ে চলে গেছিলো। কেউ বুঝতে পারেননি তিনি আসলে কীসের কথা বলছেন। যখন বহু যুগ পরে ‘ইনফ্রারেড রেডিয়েশন’ আবিষ্কৃত হলো, তখন সবাই বুঝতে পারলো শ্যাতলে আসলে এই তাপ বিকিরণটার ব্যাপারেই ১৭৩৭ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।
শ্যাতলে ১৭৪৮ সালে মারা যান সন্তান জন্মদান করতে গিয়ে, মাত্র ৪২ বছর বয়সে। সত্যি কথা বলতে গেলে- শ্যাতলে ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা মানুষ। জীবনে যেটা চেয়েছেন, সেটা যেভাবেই হোক আদায় করে নিয়েছেন। যে মতবাদকে সত্যি মনে হয়েছে, সকল বাধার বিপরীতে গিয়ে সেটাই প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করে গেছেন। যাঁদের ভালো লেগেছে তাঁদেরকেই নিজের জীবনে টেনে নিয়েছেন। বই কেনার জন্যে টাকা দরকার! বিজ্ঞানী বন্ধুদের সাথে জুয়া খেলে সেই টাকা আদায় করেছেন। নাচতে ভালো লাগে! ফুল টাইম বিজ্ঞান সাধনার পর পার্ট টাইম বিভিন্ন পার্টিতে গিয়ে বন্ধুদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করে নেচেছেন। নারী শিক্ষার আরো প্রসারের প্রয়োজন! সেটা নিয়ে কাজ করেছেন। পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন। নিউটনের মতো বিজ্ঞানীর কাজে ভুল ধরে ফেলেছেন, যেখানে তাঁর নাম শুনলেই বাকিদের হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যাবার কথা। ভলতেয়ার তো আর এমনি তাঁকে “নারীর শরীরে বন্দী এক পুরুষ” বলে অভিহিত করেননি!
দুর্ধর্ষতা রেটিং
(জি* – ০.৩)/১০। শ্যাতলে ফরাসী কবি ল্যাম্বার্টের সাথে অবৈধ সম্পর্কের ফলে সন্তান গর্ভে ধারণ করে ফেলেছিলেন। পরে ৪২ বছর বয়সে সেই সন্তান জন্মদান করতে গিয়ে মারা যান। এই ভুলটুকু না করলে তিনি হয়তো আরো অনেক বছর বেঁচে থাকতে পারতেন। নিউটনকে আইনস্টাইনের আগেই সাইডে চাপিয়ে দিতে পারতেন। কারণ, আলো নিয়ে তাঁর আবিষ্কারগুলো ছিলো যুগান্তকারী। পরে আইনস্টাইনের কাজ হতো শুধু এসে টাইম মেশিনের ফর্মুলাটা আবিষ্কার করে যাওয়া। কিন্তু তা হয়নি বিধায় আধা পয়েন্ট কেটে রাখা হলো।
* জি = g = Gravity of Earth
৫। অ্যাডা লাভলেইস (১৮১৫-১৮৫২)
কে ছিলেন তিনি?
অ্যাডা লাভলেইস (ওরফে ‘অ্যাডা বায়রন’) ছিলেন ইংরেজ গণিতবিদ এবং সাহিত্যিক। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ কবি ‘লর্ড বায়রন’। তাঁর মায়ের নাম ছিলো ‘অ্যানা ইসাবেলা’, সংক্ষেপে অ্যানাবেলা। অ্যাডাই ছিলেন লর্ড বায়রনের একমাত্র সামাজিকভাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত সন্তান। এর বাইরেও আরো অনেক নারীর সাথে কবি বায়রনের বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ছিলো। অ্যাডা বায়রনের বয়স যখন মাত্র এক মাস, তখন তাঁর পিতা লর্ড বায়রন স্ত্রী অ্যানাবেলার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন এবং এর আরো তিন মাস পরে পুরোপুরি ইংল্যান্ড ত্যাগ করে চলে যান গ্রীসে, যেখানে ‘গ্রীক স্বাধীনতা যুদ্ধ’ চলাকালীন সময়ে তিনি রোগে আক্রান্ত হয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান (এক নিঃশ্বাসে পুরো বাক্যটা বলা শেষ করে জোরে দম টানার ইমো হবে এখানে)। বিজ্ঞানযাত্রার ইতিহাসে আগের লাইনটার মতো এতো ড্রামাটিক বাক্য আর কখনো লেখা হয়েছিলো কিনা আমাদের ঠিক জানা নেই। শুরু হতে শেষ পর্যন্ত প্রতিটা শব্দে শুধু ড্রামা আর সাসপেন্স। অ্যাডা লাভলেইসের জীবনের প্রারম্ভেই ঘটে যাওয়া এত সব ড্রামা অব্যাহত ছিলো তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
কেন তিনি দুর্ধর্ষ?
যে কম্পিউটারে কিংবা যে মোবাইলে (হোক তা সস্তা চায়না মোবাইল) বসে এই মুহূর্তে পড়ছেন অ্যাডার জীবনী, সেই সমস্ত আধুনিক গণনাকারী যন্ত্রের প্রথম প্রোগ্রামার ছিলেন অ্যাডা লাভলেইস। চার্লস ব্যাবেজের তৈরি করা ‘অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন’-এর জন্যে প্রথম ‘অ্যালগরিদম’ লিখে দিয়েছিলেন তিনিই। অ্যাডা লাভলেইস নিজেকে দাবী করতেন একজন “অ্যানালিস্ট” হিসেবে। গণিত এবং বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আকর্ষণকে তিনি নিজের বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছিলেন “বিজ্ঞানের প্রতি কাব্যিক ভালোবাসা” হিসেবে। কিন্তু কীভাবে জন্মালো এমন আকর্ষণ?
এর জন্যে দায়ী তাঁর পিতা লর্ড বায়রন। কিন্তু তিনি তো অ্যাডার জন্মের চার মাসের মধ্যেই তাঁদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন! তাহলে? আসলে বায়রনের স্ত্রী অ্যানাবেলার ধারণা হয়ে গিয়েছিলো- তাঁর স্বামী একটা বদ্ধ উন্মাদ। উন্মাদ না হলে কেউ ঘর-সংসার বাদ দিয়ে, স্ত্রী-কন্যাকে ফেলে বিবাগী হয়ে কবিতা লিখে বেড়ায় না। সেই ধারণা হতে নিজ স্বামীর প্রতি একটা ক্ষোভ জন্ম নেয় অ্যানাবেলার। সেই ক্ষোভ পরে রূপান্তরিত হয় ঘৃণায়। মায়ের সেই ঘৃণার কারণে জীবন তামা-তামা হয়ে যায় অ্যাডা বায়রনের। আর অ্যাডার জীবন তামা-তামা হবার সুবাদে কপাল খুলে যায় বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর মানুষের। সেটা কীভাবে?
অ্যাডা খুব ছোট থাকতেই অ্যানাবেলার বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিলো বাপের মতো মেয়ের মধ্যেও পাগলামির লক্ষণ আছে। সেই পাগলামি মাথাচাড়া দিয়ে উঠার আগেই পায়ে পিষে মারতে তিনি অ্যাডার জন্যে সমস্ত প্রকার উপন্যাস ও কবিতা পড়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। দুজন গৃহশিক্ষক রেখে দিয়েছিলেন শুধু গণিত আর বিজ্ঞান পড়ানোর জন্যে। কারণ অ্যানাবেলার বিশ্বাস ছিলো একমাত্র গণিতেই নিহিত আছে বৈরাগ্যের মতো পাগলামির মহৌষধ। অ্যাডা এমনকি সরাসরি তাঁর মায়ের সাক্ষাৎও পেতেন না। অ্যাডার নানী ‘জুডিথ’ পুরোটা শৈশব তাঁর দেখা-শোনা করেন। অ্যানাবেলা তাঁর কন্যা অ্যাডাকে সবসময় সম্বোধন করতেন “এটা-ওটা (ইংরেজিতে it)” বলে। কখনো “তুমি-সে-তাকে” ইত্যাদি বলে সম্বোধন করতেন না। এমনকি অ্যাডার ২০ বছর বয়স পূর্ণ হবার আগ পর্যন্ত তাঁকে তাঁর পিতার ফটোগ্রাফও দেখানো হয়নি।
নিজ মায়ের দ্বারা এমন নিগৃহীত থাকা অবস্থাতেই ছোটবেলায়, মাত্র আট বছর বয়সে এক ভয়ংকর অসুখে পড়েন তিনি। সেই অসুখে প্রায় এক বছর বিছানায় শোয়া অবস্থায় থাকতে হয় তাঁকে। সেই সময় তিনি শুয়ে শুয়ে তাঁর জন্যে বরাদ্দ করা সব গণিত ও বিজ্ঞানের বই পড়তেন। ধারণা করা হয়, সেই সময়ই গণিতের প্রতি তাঁর ভেতরে “কাব্যিক ভালোবাসা”-টা জেগে উঠে। যখন তাঁর বয়স মাত্র ১২ বছর, তখন তাঁর শখ হলো তিনি পরীদের মতো আকাশে উড়বেন। পরীদের ধারণা তিনি কোত্থেকে পেয়েছিলেন কে জানে? হয়তো তাঁর নানী জুডিথ তাঁকে গোপনে গোপনে দু-চারটা রূপকথার বই সরবরাহ করেছিলেন। কিন্তু এই নির্দোষ ছেলেমানুষি ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়েই দেখা গেলো বাধ্যতামূলকভাবে গণিত ও বিজ্ঞান অধ্যয়ন করার সাইড এফেক্ট! তিনি সরাসরি দুটো পাখা বানিয়ে “আমি পরী-আমি পরী” বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করে না দৌড়িয়ে রীতিমতো খাতা-পত্র নিয়ে গবেষণায় বসলেন। সেখানে পাখিদের ওড়ার অনেক কলা-কৌশলের চিত্র আঁকলেন। গণিত কষে পেন্সিলে এঁকে ডিজাইন করলেন দুটো পাখার। তাঁর পাখাগুলোর ডিজাইনে বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার করেছিলেন। আর সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন কম্পাস। তাঁর নিজের ভাষ্যে- “কম্পাস জুড়ে দেবার কারণ ছিলো যাতে কম সময়ে সরাসরি ইংল্যান্ডের অপর প্রান্তে গিয়ে পৌঁছানো যায়, যেখানে রয়েছে সারি সারি পাহাড়, নদী আর উপত্যকারা”। শেষে আর সেই ডানাগুলো বানানো হয়ে উঠেনি। কিন্তু তাঁর সেই গবেষণা আর ডিজাইনগুলো নিয়ে ‘Flyology’ নামক একটা বই তৈরি করা হয়েছিলো পরে। চার্লস ব্যাবেজ যখন অ্যাডার মুখে তাঁর ছোটবেলার এই গল্প শুনেছিলেন তখন তিনি হাসতে হাসতে অ্যাডার নাম দিয়েছিলেন ‘The Lady Fairy’.
‘The Lady Fairy’ নামের সার্থকতা প্রমাণ করতেই তুখোড় মেধাবী এই অনিন্দ্য সুন্দরীর জুটে গিয়েছিলো অনেক ভক্ত। এদের মধ্যে কয়েকজন হলেন প্রকৌশলী অ্যান্ড্রু ক্রস, স্যার ডেভিড ব্রুস্টার, বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে, লেখক চার্লস ডিকেন্স ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁদের সংস্পর্শে এসে অ্যাডার যৌক্তিক চিন্তা করার ক্ষমতা আরো শতগুণে বিকশিত হয়েছিলো।
লাভলেইসের সাথে চার্লস ব্যাবেজের সাক্ষাৎ হয় ১৮৩৩ সালে। তিনি তখন ‘অ্যানালিটিকাল মেশিন’ বা গণনাকারী যন্ত্র নিয়ে বেশ জোরে-শোরে দেয়ালে মাথা ঠুকে যাচ্ছিলেন। একটা বিশ্লেষণী যন্ত্রের ডিজাইন তিনি করেছেন। কিন্তু ঠিক কীভাবে আদেশ করলে যন্ত্রটা তার গণনার কাজ করবে, সেটা ব্যাবেজ ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। একেকটা ‘অ্যালগরিদম’ খাতায় লেখেন আর কাটতে থাকেন। এই সময় একদিন তাঁর ল্যাবে বেড়াতে এলেন আমাদের ‘লেডী ফেয়ারী’। তিনি যন্ত্রটার ডিজাইন প্রথমবার দেখেই সেটার প্রেমে পড়ে গেলেন। অনেকটা “রতনে রতন চেনে”-র মতো ব্যাপার আর কী? নিজে এক চলমান বিশ্লেষণী যন্ত্র হয়ে আরেক বিশ্লেষণী যন্ত্রের ডিজাইনের প্রেমে পড়বেন, তাই স্বাভাবিক। ফলে ব্যাবেজের সাথে তিনিও যোগ দিলেন যন্ত্রটা বানানো এবং প্রোগ্রামিং করা নিয়ে। ব্যাবেজও অ্যাডার বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখে বিস্মিত। তাই তিনিও আর নিজের আবিষ্কারের সাথে অ্যাডাকে জুড়ে নিতে দ্বিধা করলেন না।
১৮৩০ এর দশকে ব্যাবেজ একটা প্রবন্ধ দাঁড় করিয়েছিলেন বিশ্লেষণী যন্ত্রের ডিজাইনের বর্ণনা দিয়ে। ১৮৪২ সাল নাগাদ অ্যাডা ব্যাবেজের লেখা মূল বিশ্লেষণী যন্ত্র সংক্রান্ত প্রবন্ধটাকে আরো উন্নত ও বর্ধিত করেন। তারপর সেটা ১৮৪৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘সায়েন্টিফিক মেমোয়ারস’ নামক ম্যাগাজিনে। ব্যাবেজের মূল প্রবন্ধের তিনগুণ সাইজের সেই প্রবন্ধে অ্যাডা নোট আকারে লিখেছিলেন একটা অ্যালগরিদম। এই অ্যালগরিদম দিয়ে বিশ্লেষণকারী যন্ত্রটা ‘বার্নৌলি সংখ্যা’-দের গণনা করতে পারতো। এটাকেই ধরা হয় প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম। বিশ্লেষণকারী যন্ত্রটা অ্যাডার জীবদ্দশায় আর সম্পূর্ণরূপ পায়নি। তাঁর মৃত্যুর ১০০ বছরেরও বেশী সময়ের পর ১৯৫৩ সালে প্রবন্ধটা আবারও জনসম্মুখে আসে। তখন পরীক্ষা করে দেখা যায়, অ্যাডার লিখিত অ্যালগরিদমটা ঠিকই আছে।
শুধু অ্যালগরিদম লেখাই নয়। ব্যাবেজের মূল প্রবন্ধের বর্ধিত সংস্করণে অ্যাডা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’-এর সম্ভাব্যতা ও ক্ষমতা নিয়ে অনেক যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেছিলেন। ব্যাবেজ নিজেই তাঁর ডিজাইন করা যন্ত্রের ব্যাপারে বেশী আশাবাদী ছিলেন না। সেখানে অ্যাডা এই যন্ত্রের সত্যিকারের দৌড় কতটুকু সেটা কল্পনায় পুরোপুরি দেখে ফেলেছিলেন! তিনি সেই সময়ই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন- এই গণনাকারী যন্ত্রের ভবিষ্যৎ প্রজন্মরাই হবে সেই সময়কার পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ও আরো জটিল সব কাজের মূল হাতিয়ার। মানুষ এসব উন্নত গণনাকারী যন্ত্র দিয়ে শুধু সংখ্যা গণনা ছাড়াও আরো অনেক জটিল সব কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে তাঁর এসব চিন্তা সহকর্মী চার্লস ব্যাবেজের কাছে হালে পানি না পেলেও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কাছে বেশ সমাদৃত হয়েছিলো। মাইকেল ফ্যারাডে শিস বাজিয়ে বেশ হাততালি দিয়েছিলেন তাঁর এই লেখা পড়ে।
অ্যাডার বিয়ে হয়েছিলো ১৮৩৫ সালে ৮ম ব্যারন ‘কিং উইলিয়ামস’-এর সাথে। তিনি পরে ‘আর্ল অব লাভলেইস’ হন। সেই সুবাদে অ্যাডা হয়ে যান ‘কাউন্টেস অব লাভলেইস’। এখান হতেই তাঁর নাম অ্যাডা লাভলেইস হয়ে যাবার সূত্রপাত। শুরুতেই যে বলেছিলাম এই নারীর পুরো জীবনটাই ড্রামা আর ক্লাইম্যাক্সে ভর্তি- মনে আছে? বিয়ের বছর কয়েকের মাথায় এক রাতে তিনি বিছানায় তাঁর স্বামী উইলিয়ামসকে নাকি নিজের কিছু গোপনীয় কথা বলেছিলেন। সেই সব কথা শুনে ঐ রাতেই বিছানা থেকে উঠে তাঁকে ত্যাগ করে চলে যান উইলিয়ামস। কী এমন গোপন কথা বলেছিলেন অ্যাডা তাঁর স্বামীকে- তার আজ পর্যন্ত কোনো হদিস নেই। এই দম্পতির তিন সন্তান ছিলো। নাম- বায়রন, অ্যানাবেলা, গর্ডন। বুঝাই যাচ্ছে মায়ের পাগলামির ট্রিটমেন্ট সত্ত্বেও নিজের পিতাকে ভুলতে পারেননি অ্যাডা। আসলেও ঘটনা ছিলো তাই। সারাজীবন তিনি নিজের পিতাকে মনের ভিতরে ঠাঁই দিয়ে রেখেছিলেন। ১৮৫২ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যাবার পর তাঁকে সমাহিত করা হয় নটিংহ্যামশায়ারে ম্যারি ম্যাগডালেন চার্চে, তাঁর পিতার কবরের পাশে। অ্যাডার পিতা বায়রনও ঠিক ৩৬ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। পিতা ও কন্যা কেউ কাউকে জীবদ্দশায় সামনা-সামনি দেখেননি। কিন্তু মৃত্যুর আগে অ্যাডার করে যাওয়া পরিকল্পিত ‘প্রোগ্রামিং’-এর কারণে পিতা ও কন্যা অবশেষে মুখোমুখি হলেন একে অপরের, চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন পাশাপাশি।
দুর্ধর্ষতা রেটিং
০০০০১০১০/ ০০০০১০১০