বাংলা বর্ষপঞ্জিকে বৈজ্ঞানিকভাবে সংস্কার বা সংশোধন করে সমন্নয় করা হয়েছে ইংরেজি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সাথে। বঙ্গাব্দের উৎপত্তি হিজরি সন থেকে হলেও বর্তমানে খ্রিস্টাব্দ ও বঙ্গাব্দ দু’টোই সৌরবছরের হিসাবে চলে। সূর্যের চারদিকে নিজ কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ১ সৌরবছর। যার দৈর্ঘ্য ৩৬৫দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। ফলে দু’টি বর্ষপঞ্জিতেই আছে অধিবর্ষ বা লিপইয়ার। তবে বঙ্গাব্দের অধিবর্ষ বের করার সূত্রটি একটু আলাদা। যদি বাংলা বর্ষসংখ্যাকে ৪ (চার) দিয়ে ভাগ করলে ২ (দুই) অবশিষ্ট থাকে, তবে সেই বাংলা বর্ষকে অধিবর্ষ বা লিপইয়ার হিসেবে গণ্য হয়। আবার বর্ষপঞ্জিকার বর্ষসংখ্যা হতে সাত বিয়োগ করে এই বিয়োগফলকে ৩৯ দিয়ে ভাগ করলে যদি ভাগশেষ শূন্য হয়, অথবা এই ভাগশেষটি যদি ৪ (চার) দিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্য হয়, তাহলে সে বর্ষটিকেও অধিবর্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে বর্ষসংখ্যার উপর দু’টি সূত্রই প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি ৩৯ বছরে ১০ টি অধিবর্ষ হয়। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি কৃষিকাজের সাথে গভীরভাবে সর্ম্পকিত বলে এটা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গাব্দ কৃষকদের কাছে ‘ফসলি সন’ নামেও পরিচিত। বাংলা একাডেমির দীর্ঘদিনের গবেষণা ও প্রচেষ্টায় বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এই সময়োপযোগী সংস্কার আনা হয়েছে।এই পরিবর্তন মূলত ১৪২৬ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন থেকে চালু হয়েছে এবং ইংরেজি ২০২১খ্রিস্টাব্দে এর পূর্ণকার্যকারিতা পরিলক্ষিত হবে।
পূর্বের নিয়মে বাংলা দিনপঞ্জির প্রথম ৫মাস অর্থাৎ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র এই ৫মাসকে গণনা করা হত ৩১ দিনের মাস হিসেবে। আর পরের ৭ মাস অর্থাৎ আশ্বিন,কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ,ফাল্গুন ও চৈত্র- এই ৭ মাসকে ৩০ দিনের মাস হিসাবে ধরা হত। অধিবর্ষ বা লিপইয়ারের অতিরিক্ত দিনটি যুক্ত হত ফাল্গুন মাসের সাথে অর্থাৎ অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস গণনা করা হত (৩০+১)=৩১দিনের মাস হিসাবে। অধিবর্ষ্ বা লিপইয়ারে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে গণনা করা হতো বলেই জাতীয় দিবসগুলোতে বাংলা ও ইংরেজি তারিখে পার্থক্য তৈরি হতো।
বর্তমানের নতুন নিয়মে বছরের প্রথম ৬মাস অর্থাৎ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ,ভাদ্র ও আশ্বিন এই ৬ মাস হবে ৩১ দিনের এবং কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও চৈত্র এই ৫মাস হবে ৩০দিনের। আর বাকী ফাল্গুন মাসটি হবে ২৯দিনের।পূর্বে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে ২৯দিনের কোন মাস ছিল না। তবে অধিবর্ষ বা লিপইয়ারের অতিরিক্ত দিনটি যুক্ত হবে এই ফাল্গুন মাসের সাথেই। অর্থাৎ অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস হবে (২৯+১)=৩০দিনের। অতিরিক্ত দিনটি ফাল্গুন মাসের সাথে যুক্ত করার কারণ হলো খ্রিস্টাব্দে যখন ফেব্রুয়ারি মাস চলে তখন বঙ্গাব্দে চলে ফাল্গুন মাস। ঠিক যথাসময়ে যথাসমন্নয়।
বিজ্ঞানভিত্তিক এই সংস্কারের ফলে কিছু অতিসংবেদনশীল বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি দূর হলো। যেমন-মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় দিন ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ৮ ফাল্গুন। কিন্তু বাংলা বর্ষপঞ্জির পুরাতন নিয়মে পরবর্তী বছরগুলোতে ২১ ফেব্রুয়ারি পড়ত ৯ফাল্গুনে। একইভাবে মহান বিজয় দিবস ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর ছিল ১ পৌষ, কিন্তু পুরাতন বাংলা পঞ্জিকার নিয়মে পরবর্তী বছরগুলোতে দিনটি পড়ত ২ পৌষ। আবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন ২৫বৈশাখ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন ১১ জ্যৈষ্ঠ- গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সঙ্গে যা মিলত না। এই বিশৃঙ্খলা দূর করে দুই বর্ষপঞ্জির মধ্যে দিন গণনার সমন্বয় করা হয়েছে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে, নিখুঁতভাবে। বাংলা বর্ষপঞ্জিকার এই সংস্কার বা সংশোধনের ফলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতিষঙ্গী বাংলা তারিখ হবে ৮ (আট) ফাল্গুন। জাতীয় স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চের প্রতিষঙ্গী তারিখ হবে ১২ চৈত্র। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী ৮ মে’র প্রতিষঙ্গী তারিখ হবে ২৫ বৈশাখ। নজরুল জন্মজয়ন্তী ২৫ মের প্রতিষঙ্গী তারিখ হবে ১১ জৈষ্ঠ্য এবং বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরের প্রতিষঙ্গী বাংলা তারিখ হবে ১ পৌষ্। একদম যথাযথভাবে মিলে যাবে। একইভাবে অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ দিবসও বাংলা বর্ষপঞ্জি ও গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির দিন গণনায় একই বা অভিন্ন হবে।
আরো একটি পরিবর্তন আনা হয়েছে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে ১৪০২বঙ্গাব্দে। ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঠিক রাত ১২.০০টার পর হতেই দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে। আমাদের দেশে এই সংস্কারগুলো করা হয়েছে। কিন্তু ভারতে এটা করা হয়নি। ফলে দুই বাংলায় দুই রকম বাংলা দিনপঞ্জির ব্যবহার হবে। হয়ত এখানেই অনেকের একটু সমস্যা হতে পারে।
লেখকঃ
আব্দুর রশীদ মিয়া
বি.এসসি সম্মান (রসায়ন), এম.এসসি (১ম শ্রেণী)
তথ্যসূত্রঃ
দৈনিক প্রথম আলো-১৪নভেম্বর ২০১৮খ্রিঃ
বিবিসি বাংলা, ঢাকা-১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০খ্রিঃ
দৈনিক কালের কন্ঠ -১৭অক্টোবর ২০১৯খ্রিঃ
দৈনিক যুগান্তর-১৭ অক্টোবর ২০১৯খ্রিঃ
দৈনিক বাংলা ট্রিবিউন-নভেম্বর ১১, ২০১৬খ্রিঃ