মাঝে মাঝে ভাবি- আমাদের সন্তানেরা যখন পেশাজীবি হবে, আজ থেকে বিশ-ত্রিশ বছর পর, তখন তাদের কর্মক্ষেত্রটা কেমন হতে পারে; কেমন হতে পারে তাদের পদবীগুলো। হলফ করে বলতে পারি যে ত্রিশ বছর আগে আমাদের মা-বাবা’রা কখনো ভাবতে পারেননি – তাদের ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ হবে সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার, আইটি (IT) স্পেশালিষ্ট, মেমস (Microelectromechanical systems) প্রসেস ইন্টিগ্রেশন ইনজিনিয়ার, মাইক্রোবায়োলজিষ্ট, গ্রাফিক রেকর্ডিং আর্টিস্ট, সুইট আলকেমি (Sweet Alchemist), ইত্যাদি ইত্যাদি; কত যে গালভরা পদবী, তা লিখে শেষ করা যাবে না (উল্লেখ্য যে শেষ পদবীটি আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বিলাস নয়, সেদিন এক রান্নার অনুষ্ঠানে জনৈক কেক বিশেষজ্ঞের এই টাইটেলটা দেখে আমার তো প্রায় ভিড়মি খাওয়ার দশা)। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি যেভাবে ঘোড়ার মত লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে এগোচ্ছে তাতে আজকালকার পদবীগুলো বিলুপ্তপ্রায় গোত্রভুক্ত; অচিরেই বিলুপ্ত হলো বলে!
টেড টক নামের একটা শোতে ডঃ বেথ শাপিরোর (Beth Shapiro) বক্তৃতা শুনতে গিয়ে মনে হল উনি বড়সড় রকমের পরিচিতি সংকটে (Identity Crisis) ভুগছেন, বক্তৃতার শুরুতে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে একবার বললেন যে তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির একজন “ইমারজিং এক্সপ্লোরার” বা ভুঁইফোড় অভিযাত্রী, আরেকবার বললেন যে তিনি “আণবিক জীবাশ্ম-প্রত্নতত্ত্ববিদ” (Molecular Paleontologist), আর সেমিনারের সূচীতে (Brochure) লিখা ছিলো যে উনি সান্টা ক্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী-পরিবেশ আর বিবর্তন বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। ওনার বক্তৃতা আরো খানিকটা শোনার পর বোঝা গেল যে কী কারণে এই টানাপোড়েন; “আণবিক জীবাশ্ম-প্রত্নতত্ত্ববিদ” হিসেবে ওনার কাজকারবার এক্কেবারে মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে সবার! ওনার এই কাজকারবারের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে জিনতত্ত্বের গবেষণা (Genetic Research)। দেখা যাক, সে ব্যাপারে বোধগম্য কিছু লিখতে পারি কিনা, বাঙলা ভাষায়।
পাগলের প্রলাপ মনে হলেও ইদানিং বিজ্ঞানীরা বলছেন যে পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকুল আর তরু-লতা-গুল্ম সকলে একেকটা বইয়ের মত, চাইলে পড়ে ফেলা যায় ওদের ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমান; পড়বার কায়দাটা জানতে হবে অবশ্য। এই ধরুন আমরা মানুষেরা, আমাদের শরীরে সর্বমোট কোষের (Cells) সংখ্যা এক নিযুত-কোটি (১০০ ট্রিলিয়ন), এগুলোর অধিকাংশের সাইজ এক মিলিমিটারের দশ ভাগের একভাগ। প্রতিটি কোষের মধ্যে ছোট্ট কাল ফোঁটার মত নিউক্লিয়াস, আর তার ভিতরে দুই সেট পরিপূর্ণ মনুষ্য জিনোম (কেবল ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মধ্যে আছে একখানা সেট)। মজার ব্যাপার হলো যে এই একেকটি জিনোমের মধ্যে ত্রিশ থেকে আশি হাজার জিন সাজানো আছে ২৩ টি ক্রোমোজোমের আকারে। পিতৃ আর মাতৃ-জিন গুলোর ভেতর খুব সামান্যই প্রভেদ, এই সামান্য পার্থক্যের কারণেই কিন্তু কার চোখের রঙ কী রকম হবে, নাকটা লম্বা না বোঁচা হবে, কার হবে দীঘল কালো কেশ – এসব ঠিক করা আছে। এই জিনোমকে তুলনা করা যেতে পারে একটা বই হিসেবে –
-জিনোম বইয়ে তেইশটি অধ্যায়, এরা “ক্রোমোজোম” (Chromosome)।
-প্রতিটা অধ্যায়ে অনেকগুলো গল্প, এই গল্পগুলোই “জিন” (Gene)।
-প্রতিটি গল্পে আছে অনুচ্ছেদ, এদের নাম “এক্সন” (Exon)।
-প্রতিটি অনুচ্ছেদে আছে অসম্ভব সুন্দর সব শব্দের সমারোহ, এরা “কোডোন” (Codon)।
-প্রতিটি বাক্যে রয়েছে অভিনব কিছু অক্ষর, এদের নাম “বেইস” (Base)।
ভাবতে পারেন – এক বিলিয়ন শব্দের সমন্বয়ে এই পুস্তক, প্রায় ৮০০ বাইবেল আর ১৩০০০ কোরান শরীফ সাইজের! আমি যদি প্রতি সেকেন্ডে একটি করে শব্দ পড়তাম তবে এই বই পড়ে শোনাতে শতবর্ষ পেরিয়ে যেতো। যদি পাশাপাশি একটি একটি করে শব্দ লিখে যেতাম এবং এক মিলিমিটার জিনোমের লেখ্যরুপের দৈর্ঘ্য হত দানিয়ুব নদীর সমান। কিন্তু কি আশ্চর্য! এহেন সুবিশাল দানবাকৃতির বইখানাকে কিনা আটানো হয়েছে ছোট্ট আণুবীক্ষণিক নিউক্লিয়াসের ভিতর! এ কি আজব লীলা!
জিনোমকে বইয়ের সাথে তুলনাটা কিন্তু কেবল রূপক-অর্থে নয়। বইপুস্তক আসলে কি? তথ্যের সাংগ্রহিক সংকলন; যা লিখিত হয় সরল-রৈখিক (linear), এক-মাত্রিক (one-dimensional), আর একমুখী (one-directional) আকৃতিতে; যার সার্বজনীন অর্থ, আবেদন সংজ্ঞায়িত হয় কতক কোড বা সংকেতের মাধ্যমে এবং এইসব কোড তৈরি করা হয় একটা বর্ণমালার গুটিকতক বর্ণবিন্যাসের (groupings) পথ বেয়ে। জিনোমের গড়ন হুবহু একই, ওটি আক্ষরিক ভাবেই একখানা পুস্তক! কেমন অদ্ভুত শোনালো, না? মজার ব্যাপার হলো যে বাংলা-ইংরেজি বইগুলো আমরা সব সময় বাম দিক থেকে ডান দিকে পড়ি, কিন্তু জিনোমের কিছু অংশ পড়তে হয় ডান থেকে বাঁয়ে আবার কিছু অংশ পড়তে হয় বাঁ দিক থেকে ডানে; অবশ্য এই বাম-ডানের ঘটনাটা ত্রিমাত্রিক জগতে কিছুটা আপেক্ষিক।
ইংরেজী বইয়ে ছাব্বিশটি হরফের ভাণ্ডার থেকে নিয়ে একটি-দুটি অথবা একাধিক অক্ষর পাশাপাশি সাজিয়ে বানানো হয় একেকটি শব্দ; কিন্তু জিনোমের তাবৎ শব্দ মাত্র তিনটি হরফ দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, ত্রি-আক্ষরিক। আর ওর বর্ণমালায় আছে মাত্র চারটি অক্ষর বা বেইজ; A (এডেনিন), C (সাইটোসিন), G (গুয়ানিন), T (থায়ামিন)। আমাদের বইয়ের অক্ষরগুলো যেমন কালিতে লেখা হয়, জিনোম বইয়ের এ সকল হরফ প্রোটিনে গড়া; আর সমতল কাগজের বদলে লেখার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় অন্য জিনিস- চিনি আর পেপটোডের লম্বা চেইনের ধারে ধারে হরফগুলো বসিয়ে মালার মত গড়া ডিএনএ পরমাণু দেখলে যে কারো মনে হবে- “আরে এতো দেখছি সপ্তমাশ্চর্যকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে।”
এরকমই দুটো বিশাল লম্বা ডি-এন-এ পরমাণু নিয়েই তৈরী একেকটি ক্রোমোজোম, আমাদের জীবনমালা! চিন্তা করুন- যদি এই বিশাল গ্রন্থটা পড়ার কায়দা জানতে পারেন তাহলে কী মজাটাই না হয়! মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস চলে আসতো হাতের মুঠোয়, রোগ-শোক বালা-মুসিবত নিরাময় করা তখন কোনো ব্যাপারই হতো না আর। কিন্তু এই বিদ্যা রপ্ত করা আসলে এত সহজ নয়, ডক্টর শাপিরোর মত মেধাবী বিজ্ঞানীদেরও এটা করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে!
চিত্র ১- কোষ, জিনোম আর ডিএনএ
যাই হোক অনেক আগডুম-বাগডুম বলা হয়ে গেলো, এবার মূল বিষয়ে ফেরত যাওয়া যাক- ডক্টর শাপিরোর লেকচার। ডঃ শাপিরো নিজের পদবী নিয়ে যতই হাতি-ঘোড়া মারুন না কেন, আসলে ওনার গবেষণা এমন একটি বিষয় কেন্দ্রিক যেটা এ যুগের মনুষ্য সমাজে হরহামেশাই আলোচনা হচ্ছে। অনেকের কাছেই ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। এইতো সেদিনই প্রেসিডেন্ট ওবামা স্বয়ং এই সম্পর্কে অনেক গুরুগম্ভীর বক্তৃতা দিয়ে দিলেন এক বিশেষ সম্মেলনে। বিষয়টা – পরিবেশের বিরূপ পরিবর্তন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক-উষ্ণায়ন! এটা সর্বজনবিদিত যে গত একশত বছর ধরে পৃথিবীর জলবায়ুর যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে তাতে তাবৎ প্রাণীকুলের মাথার উপর বিপর্যয় প্রায় নেমে এলো বলে; পত্রপত্রিকা খুললেই আমরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নিত্যদিনই কোনো না কোনো প্রবন্ধ দেখি যেগুলোর শুরু অথবা শেষটা অনেকটা এরকম – “ হে মানব, প্রস্তুত হও! তোমাদের নরকবাস সমাসন্ন”।
কিন্তু বেথের মত বিজ্ঞানীরা হাত পা গুটিয়ে, মাথা নিচু করে এহেন ভবিতব্য স্বীকার করে নেবার পাত্রপাত্রী নন। উনি তলিয়ে দেখতে চান আদৌ এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব কিনা! আর যদি যায়, সেটা কিভাবে! এজন্যে জীনবিদ্যাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি। আগামী শতাব্দীতে, এমনকি আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই যে জলবায়ুর পরিবর্তন সমস্ত প্রজাতির প্রাণীকুলের ডিএনএ-তে পরিবর্তনের ছাপ ফেলবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। সমস্যা হলো- আজকের ডিএনএ প্রোফাইল দেখে কিভাবে একশ বছর পরে কী হতে পারে তার কোন ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়? বেথের মত আণবিক জীবাশ্ম-প্রত্নবিদেরা এই কঠিন সমস্যার মোটামুটি একটা অভিনব সমাধানও বের করে ফেলেছেন।
পরিবেশবিদ্যায় যাদের একটু আগ্রহ আছে এবং এ বিষয়ে পেপার-টেপার পড়েন, তাঁরা একটি গ্রাফ দেখলেই চিনে ফেলতে পারবেন – মাইকেল ম্যানের হকিষ্টিক প্লট (চিত্র-২)। হকিষ্টিকের মত দেখতে এই রেখাচিত্রটিতে গত একহাজার বছর ধরে পৃথিবীর তাপমাত্রার অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে; ১৯০২ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে নিখুঁত পরিমাপ আর বাকি সময়টার তথ্যভিত্তিক (Noisy Data like tree rings, ice-cores, sub-fossil pollens, etc.) আনুমানিক মাপ। একটা মজার (অথবা ভীতিজনক) ব্যাপার লক্ষ্য করা যায় এতে – গত একশত বছর ধরে পৃথিবীর তাপমাত্রার অস্বাভাবিক দ্রুত বেড়ে যাওয়া। যেখানে ১০০০ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা প্রায় সমান ছিল, সেখানে ১৮৯০ এর পর থেকে আজ অবধি তাপের বৃদ্ধি এক ডিগ্রীরও বেশি! “এক ডিগ্রী” শুনতে তেমন কোন ব্যাপার মনে না হলেও, ভেবে দেখুন যদি এহেন হারে টেম্পারেচার বাড়তে থেকে, তবে আগামি কয়েক শতাব্দীতে কি হতে পারে বলুন তো? ঘোর কেয়ামত!
চিত্র ২- হকিষ্টিক রেখাচিত্র
ডঃ বেথ অবশ্য এতে মনে হল তেমন বিচলিত নন। কারণ উনি আরেকটি রেখাচিত্র নিয়ে আলোকপাত করলেন ওনার বক্তৃতায়, ভোষ্টক তুষার মজ্জা থেকে পাওয়া গত ৫০ হাজার বছরের তাপমাত্রার ডেটা সমৃদ্ধ গ্রাফ। কেমন অবিশ্বাস্য সব গবেষণা (চিত্র -৩)! মেরু অঞ্চলে বছরের পর বছর তুষারের আস্তরণের সাথে জমা পড়তে থাকে সে সময়কার জলবায়ুর সূক্ষ্ম সব উপাদান (বায়ুবাহিত ধূলিকণা, ছাই, রেণু, ইত্যাদি)। একেকটি গভীর বরফের স্তরে নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত এসব সূক্ষ উপাদান (Climatic Proxies) বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা হাজার বছরের পৃথিবীর তাপমাত্রা বলে দিতে পারেন। এমনই একটি বরফের স্তরে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায় যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নতুন কোনো ব্যাপার নয়, আগেও ঘটেছে এমন ঘটনা।
চিত্র ৩ – মেরু তুষার স্তর থেকে নিখুঁতভাবে বের করা পঞ্চাশ হাজার বছরের তাপমাত্রা
লেখচিত্রটার আনুভূমিক অক্ষে (x-axis) আছে এখন থেকে কত বছর পুরোনো দিনের ব্যাপার, সে সংখ্যাটা; আর দুটো উল্লম্ব অক্ষের (y-axis) একটা (বামদিকে) আছে তাপমাত্রা (নীল রেখার জন্যে); আর ডানদিকে আছে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ (হলুদ রেখার জন্যে)। একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলে দেখা যায় যে গত একশ বছরে যেমন করে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়েছে তার চাইতেও অনেক অনেক দ্রুত গতিতে টেম্পারেচারের পরিবর্তন ঘটেছিল আজ থেকে পনেরো থেকে বিশ হাজার বছর আগে। সে সময়টা এসেছিল হলোসীন আইস এজ বা তুষার যুগের ক্রান্তিলগ্নে। কী আজব ব্যাপার! তাহলে কি জলবায়ু পরিবর্তনের দায় একদমই মানুষের নয়? অন্য কোনো কারণ যার জন্যে বিশ হাজার বছর আগেই এমন ঘটনা ঘটেছিলো? এতদিন যে বিজ্ঞানীদের একটা বড় দল পরিবেশ নিয়ে মানব সম্প্রদায়ের যথেচ্ছাচারকেই দায়ী করছিলেন সেগুলো কি আসলে মিথ্যে কথা? তাহলে কি সুবিধাবাদী রিপাব্লিকান রাজনীতিবিদরাই ঠিক?
এমন বিতর্ক করে অর্থহীনভাবে সময় নষ্ট করবার পাত্রী নন ডঃ বেথ। বরং এই উষ্ণায়ন সেই সময়ের প্রাণীজগতের উপর কেমন প্রভাব ফেলেছিল তা জানতে ডঃ বেথের মত অনেকেই আশ্রয় নিচ্ছেন ফসিলের ডিএনএ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়াতে, উদ্দেশ্য হল যে– এই তথ্য থেকেই হয়তো বের করা যাবে আমাদের সমাসন্ন বিপর্যয় মোকাবেলার উপায়। তবে কাজটা খুব একটা সহজ নয়। তার একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে, মৃত-প্রাগৈতিহাসিক জিনোমের অনুক্রমিক বিন্যাস (Sequencing) করতে গিয়ে দেখা যায় বহুদিন ধরে যেন-তেন ভাবে পড়ে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ঢুকে পড়েছে জিনের ভিতর। প্রায় সময়ই দেখা যায় যে এসব ফসিলের হাড্ডি-গুড্ডিতে মূল প্রাণীটির ডিএনএর খুব সামান্য অংশই অক্ষুণ্ন আছে। বাকিটা কলুষিত হয় হাজার বছরে জমে ওঠা বিভিন্ন ধরনের ব্যাক্টিরিয়া, উদ্ভিদের ডিএনএ দিয়ে; এমনকি স্বয়ং প্রত্নতত্ত্ববিদের জিনও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে ওগুলোতে। খোঁড়াখুঁড়ির সময় ধুলোবালিতে হাঁচি-কাশি সামলাতে পারে কজন!
তবে, হ্যাঁ, ফসিল যদি খুব ঠাণ্ডা কোনো জায়গা থেকে খুঁড়ে তোলা যায়, তবে তাতে বিজাতীয় ডিএনএর সংক্রমণের সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের একদম উত্তর-পশ্চিমের এলাকাগুলো আর উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়ার যে জায়গাগুলো আমেরিকার রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ স্যারা পালিনের ঘরের আঙিনা হিসেবে বিখ্যাত সেসব জায়গাতেই দেখা গেছে এ ধরনের হিমায়িত নিখুঁত জীবাশ্মর ছড়াছড়ি। বেরিংজিয়া (Berengia) নামেই বেশি পরিচিত এই এলাকার চেহারা বিশ-ত্রিশ হাজার বছর আগে একদম অন্যরকম ছিলো। এখনকার মত প্রাণহীন হিমশীতল তুন্দ্রা ছিলো না এটা সেসময়; পশমী (wooly) ম্যামথ (আজকালকার হাতির প্রায় একই সাইজের), ম্যাস্টাডন, পশমী গণ্ডার, দু-তিন ধরনের ঘোড়া, ষোল ফুট লম্বা দানবাকৃতির কালো ভালুক, আরও অসংখ্য নাম না জানা প্রাগৈতিহাসিক প্রজাতির বিচরণ সমৃদ্ধ একটা সুফলা-নয়নাভিরাম তৃণভূমি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। একটা মজার কথা না বললেই নয়! এখন যেখানে বেরিং সাগর, বেরিং প্রণালী এশিয়া আর আমেরিকাকে বিচ্ছিন্ন করেছে, সেই সুপ্রাচীন কালে এমন কোনো বিভাজন ছিল না এই দুই মহাদেশের। আর সে অবিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের (land bridge) উপর দিয়েই এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে অভিবাসন চালাত এসব প্রাণীকূল। বলা যেতে পারে আমেরিকার অভিবাসী সমস্যার সূত্রপাত সেই প্রাগৈতিহাসিক কালেই! হা হা হা!
তারপর তুষার যুগ চলে গেলো, বরফ গলে সাগরের জলের উচ্চতা অনেক বেড়ে উঠলো, তলিয়ে গেলো বেরিংজিয়ার ভূ-ব্রিজ, হারিয়ে গেলো মেগাথনদের পায়ের আওয়াজ। কিন্তু ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া মাটির নিচে চাপা পড়ে রইলো চরম সব ফসিলের ভাণ্ডার। ডঃ বেথের অভিযাত্রী-বিজ্ঞানী দলের জন্যে এ যেন স্বর্ণখনি! হিমায়িত মাটি, যাকে বলে পার্মাফ্রস্ট (Permafrost), তা গলিয়ে বের করে আনতে শুরু করলেন সাতশ হাজার বছর আগের ঘোড়া, ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর পুরোনো ম্যামথ, বাইসন, গুহা সিংহ, প্রভৃতির সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত জিনোম ভর্তি হাড়-গোড়। একেক সময়ের জিনোম কোডের বিশ্লেষণের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে লাগলো একেকটি প্রজাতির ইতিহাস!
ওদের খাদ্যাভাস কেমন ছিলো? ওদের বিচরণক্ষেত্রের পরিবেশ কী ছিলো? ওরা কি সেই মহূর্তে বিলুপ্তপ্রায়? নাকি বিলুপ্তির হুমকি কাটিয়ে জৈবিক-বৈচিত্র্যে (Bio-diversity) ভরপুর ওদের জ্ঞাতিগুষ্টি? বাতাসের ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে চলতে পারছে কি না; টেড টকশোতে এহেন তথ্যসম্ভারের কথা বলতে গিয়ে প্রফেসর শাপিরোর চোখ দুটো চকচক করে উঠছিলো, উত্তেজনাতে হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়িও বাদ পড়ছিল না – আবেগোচ্ছাসে ভরা পাগলা-বিজ্ঞানীদের যা হয় আর কী!
বক্তৃতার এক পার্যায়ে একটু কপট রাগ, একটু কপট অভিমান ভরা কণ্ঠে বললেন যে উনি প্রায়ই যখন এসব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা নিয়ে বাজেট কমিটি বা বিদগ্ধ একাডেমিয়াদের কাছে কোনো প্রেজেন্টেশন করেন, তখন শেষমেষ সবার একটাই প্রশ্ন থাকে – “তোমার এই জেনেটিক বিদ্যা আর সিকোয়েন্সিং কাজে লাগিয়ে তুমি কবে পশমী ম্যামথের ক্লোন বা হুবহু জীবন্ত রেপ্লিকা বানাবে?” বলে কী, হায়! এদিকে কেয়ামত আসন্ন, আর পরিবেশ-টরিবেশের চিন্তা বাদ দিয়ে এরা কিনা চায় ম্যামথের মত প্রাগৈতিহাসিক দানবের পুনরুজ্জীবন!
(অদূর ভবিষ্যতে মাম্যথের ক্লোন বানাবার চ্যালেঞ্জ, যদি সত্যিই ক্লোন করা সম্ভব হয়, তবে প্রকৃত প্রক্রিয়াটা কী, আর এ ধরনের ক্লোন গ্লোবাল ওয়ার্মিং মোকাবেলাতেও যে ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যাপারে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।)
— অনিরুদ্ধ বাশার, এরিজোনা, মার্চ ২০১৬
(লেখাটি ইতোপূর্বে সচলায়তনে প্রকাশিত)
সূত্রঃ
১) Ridley, Matt. Genome: The Autobiography of a Species in 23 Chapters. Perennial 2000
২) Shapiro, Beth. How to Clone a Mammoth: The Science of De-Extinction. Princeton Univ. Press, 2015
৩) Mann, Michael. The Hockey Stick and the Climate Wars: Dispatches from the Front Lines. Columbia University Press. ISBN 978-0-231-15254-9