পৃথিবীতে মানব সভ্যতা বিকাশের পথপরিক্রমায় ‘বিগ ব্যাং’ এর পর পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর সৃষ্টি এবং পৃথিবীতে ‘প্রথম প্রাণ’ সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ গঠিত হবার সময় পর্যন্ত একটি ধারাবাহিকতা তুলে ধরা হয়েছিল প্রথম পর্বে। দ্বিতীয় পর্বে তুলে ধরা হয়েছে পৃথিবীতে ‘আদি-প্রাণ’ নামক প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হবার পর পর্যায়ক্রমে বর্তমান মানুষের সরাসরি পূর্বপুরুষ ‘প্রাইমেট’ এর উৎপত্তি পর্যন্ত সময়ে প্রাণের ক্রমবিকাশের ধারা।এখন তৃতীয় পর্বে উল্লেখ করা হচ্ছে প্রথম ‘প্রাইমেট’ এর উৎপত্তি থেকে পৃথিবীতে প্রথম আধুনিক মানুষের আবির্ভাব পর্যন্ত সময়ে প্রাইমেট ও পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবর্তন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা।
- পাঁচ কোটি বছর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষ ‘প্রাইমেট’ দের উদ্ভব হয় পৃথিবীতে। সেসময় আফ্রিকা ও আমেরিকা মহাদেশ নির্দিষ্ট আকৃতি প্রাপ্ত হয় যেটি প্রায় বর্তমানের কাছাকাছি। পৃথিবী হয়ে ওঠে উত্তপ্ত। এসময় উত্তর আফ্রিকার কাছাকাছি সমুদ্রের তলদেশে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। সমুদ্রতলে ক্ষুদ্র একপ্রকার জীবের মৃতদেহ বহু আস্তরণে জমা হতে থাকে যাদের দেহের উপাদান ছিল মূলত ক্যালসিয়াম এবং কার্বন। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জমা হয়ে এই আস্তরণ রূপান্তরিত হয় চুনা পাথরে।
এই চুনাপাথরই মানব সভ্যতার সপ্তাশ্চর্যের একটি ‘পিরামিড’ তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। এমনকি আমাদের বসবাসের বাড়িঘর তৈরিতে যে সিমেন্ট ব্যবহৃত হয় তার অন্যতম মূল উপাদান চুনা পাথরও সেই কোটি বছরের পুরনো লক্ষ বছর ধরে রূপান্তরিত হওয়া চুনা পাথর।
- এখন থেকে প্রায় এক কোটি বছর আগে পৃথিবীতে তৈরি হতে শুরু করে আমাদের বর্তমান পৃথিবীর মত দৃশ্যপট। কলোরাডো নদী ও গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সৃষ্টি হয়, তৈরি হয় হিমালয় পর্বত। হিমালয় এসময় এতই উঁচু হয়ে যায় যে এটি আবহাওয়ার ধরনের পরিবর্তন ঘটায়। উত্তপ্ত পৃথিবীকে তুলনামূলক ঠাণ্ডা একটা অবস্থায় নিয়ে আসে।আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যদিয়ে চ্যানেলের মত একটি অবিচ্ছিন্ন দ্বীপ সৃষ্টি হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে সংযোগ ঘটায়। এর ফলে সৃষ্ট সমুদ্রস্রোতের পরিবর্তন পৃথিবীকে আরো ঠাণ্ডা করে এক বরফ যুগের সূচনা করে। ‘প্রাইমেট’রা বসবাস শুরু করে পৃথিবীর উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে।
- বর্তমান থেকে সত্তর লক্ষ বছর পূর্বে ‘প্রাইমেট’ বিবর্তিত ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে টিকে গিয়ে হয়ে ওঠে আমাদের আরো কাছাকাছি পূর্বপুরুষ যার নাম ‘এপ’। এরা বৃক্ষবাসী হয়ে এসময় বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই জীবন যাপন করছিল পৃথিবীতে।তখনই পৃথিবীতে ঘটে আরেকটি বিপ্লব যেটি ‘এপ’ কে ‘মানুষ’ এ বিবর্তিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ঘটে যায় ‘ঘাস বিপ্লব’। পৃথিবীর বুকে দেখা যায় ঘাস নামের নতুন একধরনের উদ্ভিদ। আকারে ছোট হয়েও পৃথিবীতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয় ঘাস। বিশাল বিশাল বৃক্ষ জঙ্গল বিলুপ্ত হয়ে সেখানে সৃষ্টি হয় তৃণভূমি। আফ্রিকার তৃণভূমি, ইউরেশিয়ার তৃণভূমি, উত্তর আমেরিকার তৃণভূমি, আর্জেন্টিনার বৃহত্তর তৃণভূমি ঘাস বিপ্লবের সময় সৃষ্ট।ঘাস বিপ্লব ঘটার পরবর্তী সময়ে পূর্ব আফ্রিকায় কিছু সংখ্যক ‘এপ’ বাস করত। সেখানে তখন তৃণভূমির ভেতরেও কিছু বৃক্ষ অবশিষ্ট ছিল ‘এপ’দের জন্য। তবে সেগুলোর একটা থেকে আরেকটি ছিল বেশ দূরে দূরে। তাই এক গাছের ‘এপ’ রা সেই গাছেই থাকত। প্রজন্মান্তরে একই গাছে ‘এপ’ এর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এই খাদ্যাভাব দেখা দেয়ার পেছনে মরুকরণও দায়ী ছিলো। আর এই মরুকরণ তৈরি হয়েছিলো অনেক অনেক দূরে (একদম আরেক মহাদেশে) স্থলদ্বীপ তৈরি হয়ে সমুদ্রের স্রোত (ocean current) পালটে যাওয়ার ফলে, এবং মৌসুমী বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে। খাদ্যসংস্থানের তাগিদে কিছু ‘এপ’ নেমে আসে গাছ থেকে মাটিতে। যেটি মানবসভ্যতা তথা মানুষ সৃষ্টির পথে এক বড় ধরনের অগ্রগতি।
গাছের ‘এপ’ মাটিতে নেমে আসার পর থেকেই শুরু হয় তাদের মানুষে বিবর্তনের মূল প্রক্রিয়া। তারা ঘাসের উপর দিয়ে মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে শত্রু থেকে নিরাপদ থাকতে। এভাবে তারা একসময় দুই পায়ে ভর করে দাঁড়াতে ও হাঁটতে সক্ষম হয়। এটি ছিল মানব সভ্যতার জন্য যুগান্তকারী একটি ঘটনা। কারণ দুই পায়ে দাঁড়ানোর সাথে সাথে ‘এপ’ রা পায় দুটি আপাত মুক্ত অঙ্গ; যার নাম ‘হাত’। এ হাত দিয়েই মানুষ শুরু থেকে সভ্যতা নিয়ে এসেছে আজকের অবস্থায়। এসময় এই ‘এপ’ রা বিবর্তিত হতে থাকে ‘প্রোটো-হিউম্যান’ নামে পরিচিত ‘হোমিনিড’ এ।
- আজ থেকে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে ‘হোমিনিড’ রা দুই পায়ে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর পাথুরে মাটিতে। তখনকার মাটিতে ছড়িয়ে থাকা পাথর ছিল সিলিকন অক্সাইডে পূর্ণ। সিলিকন অক্সাইডে পূর্ণ থাকায় ‘হোমিনিড’ রা সেই পাথর নিয়ে সহজেই ভেঙ্গে ধারাল প্রান্ত তৈরি করে যেটি ছিল মানুষের প্রথম অস্ত্র বা প্রথম তৈরি কোনো শিকার সরঞ্জাম।এই সেই সিলিকন যেটা ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনে নিয়ে এসেছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন আবার ২৫ লক্ষ বছর পরে বর্তমানে আমাদের জীবনে নিয়ে এসেছে অবিস্মরণীয় অগ্রগতি। হাতের ইলেক্ট্রনিক ঘড়ি, পকেটের সেলুলার ফোন, রিমোট কন্ট্রোল থেকে শুরু করে পারসোনাল কম্পিউটার, সুপার কম্পিউটার এবং রোবট ও কৃত্রিম স্মৃতি ও বুদ্ধিমত্তার প্রধান উপাদান ইলেক্ট্রনিক আইসি এবং চিপ এর মূল কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত সেমিকন্ডাক্টর সেই একই পদার্থ সিলিকন।
- এরপর সময় এগিয়ে চলে। প্রায় ১৫ লক্ষ বছরের পথ পরিক্রমায় হোমিনিড রা বিবর্তিত ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে পর্যায়ক্রমে হোমো ইরেকটাস, হোমো হ্যাবিলিস এবং সবশেষে হোমো সেপিয়েন্সে পৌঁছে। যে হোমো সেপিয়েন্স আমরা, ‘মানুষ’।
- প্রায় আট লক্ষ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা; আদি মানুষ প্রথম আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। আগুনে ঝলসিয়ে খাবার গ্রহণের জন্য বেশি শক্তি পাওয়া সম্ভব হয়, যেটি সেসময়ের মানুষের আরো বড় আকারের মস্তিষ্ক তৈরিতে সাহায্য করেছিলো।আর এই প্রায় আট লক্ষ বছর আগের প্রথম নিয়ন্ত্রিত ও প্রথম কাজে লাগানো আগুন সভ্যতার সকল পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে ও আসছে। এই নিয়ন্ত্রিত আগুনকে কাজে লাগিয়ে পাত্র তৈরি, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি থেকে শুরু করে প্রথম ইঞ্জিন – স্টিম ইঞ্জিন এবং বর্তমানের হাজার হর্সপাওয়ারের IC Engine এর গাড়ি সবই লক্ষ বছরের পুরানো আগুনের ব্যবহার, যা আমরা শিখেছি আদি-আত্মীয়দের কাছ থেকে।
- প্রায় ২ লক্ষ বছর পূর্বে বিবর্তিত ‘প্রাইমেট’ বর্তমান ‘মানুষ’ এর রুপ লাভ করে। মানুষের গঠন পূর্ণাঙ্গভাবে আধুনিক মানুষের সমকক্ষ হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, পূর্ণাঙ্গভাবে বলতে এমন বোঝানো হচ্ছে না যে মানুষের বিবর্তন থেমে গেছে। যাই হোক, ঐ সময়ে স্বরযন্ত্র জটিল গঠনের হয় যাতে শুধু কোনো নির্দিষ্ট শব্দ না হয়ে যা থেকে উৎপন্ন করা যায় নানাবিধ ভিন্ন ধরনের সংকেত। যাতে তথ্য আদানপ্রদান হয় একজন থেকে আরেকজনের কাছে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
এ পর্বে প্রথম প্রাইমেট থেকে প্রথম মানুষ পর্যন্ত সময়ে প্রাইমেট ও পৃথিবীর অবস্থার পরিবর্তন-পরিবর্ধন নিয়ে আলোকপাত করা হলো। পরবর্তী পর্বে থাকছে প্রথম ‘আধুনিক মানুষ’ আবির্ভাবের পর থেকে বর্তমান মানব সভ্যতার উন্মেষের কথাচিত্র।
তথ্যসূত্র :-
১. www.history.com
২. সভ্যতা ব্লগ
৩. উইকিপিডিয়া
তাহলে এখন এপ (ape)/বানর কোথা হতে আসে তখন সব বানর যদি তৃনভূমিতে খাদ্যের জন্য বিচরন এ নামে
তখন দুনিয়ার সব এইপ যে গাছ থেকে নেমে আসছিলো, এটা কে বললো?
ভাল করে পড়েন।
বাক্যটা হল – //খাদ্যসংস্থানের তাগিদে কিছু ‘এপ’ নেমে আসে গাছ থেকে মাটিতে।//
এখানে লেখা ‘কিছু এপ’। সব বানর কই পাইলেন। আর এটাকে বানর বলা যাবে না ‘এপ’/’এইপ’ ই বলতে হবে। কারণ এটা বানর নয়।