“শিশুকালে শুনেছি যে কতিপয় পতঙ্গশিকারী ফুল আছে।
অথচ তাদের আমি এত অনুসন্ধানেও এখনো দেখি নি।
তাঁবুর ভিতরে শুয়ে অন্ধকার আকাশের বিস্তার দেখেছি,
জেনেছি নিকটবর্তী এবং উজ্জ্বলতম তারাগুলি প্রকৃত প্রস্তাবে
সব গ্রহ, তারা নয়, তাপহীন আলোহীন গ্রহ।”
বিনয় মজুমদারের কবিতায় বিজ্ঞানপ্রেম বেশ চোখে পড়ার মতো; বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানে। যন্ত্রপ্রকৌশলে পড়াশুনা করেছেন বলেই হয়তো বিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব ও তথ্যে অমন সড়গড় ছিলেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি কবিই ছিলেন বলে হয়তো নিউরনে অনুরণিত বিজ্ঞান রক্তবাহিত হয়ে হৃদয়ে এসে কলমের সাহায্যে তাঁর কবিতায় ভর করেছিল। নইলে “সূর্যপরিক্রমারত জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যে শুধু ধূমকেতু প্রকৃতই অগ্নিময়ী”- জাতীয় লাইন কারও কলম দিয়ে বিনা কারণে বেরোয় না!
***
“আকাশের নক্ষত্রেরা সর্বদাই ভালো থাকে, কখনোই খারাপ থাকে না।
আকাশে বশিষ্ঠ ঋষি নামক নক্ষত্র আর তার বৌ অরুন্ধতী তারা
সর্বদাই ভালো ছিল, এখনো আনন্দে আছে, চিরদিন নিরাপদে আনন্দেই রবে।
একথা অগ্নিরা জানে, এ বিশ্বের সব অগ্নি এই কথা জানে।
প্রতিদিন পৃথিবীতে বহু উল্কা এসে পড়ে
পৃথিবীর কাছে এলে এইসব উল্কাপিণ্ড জ্বলে ওঠে, অগ্নির সহিত
কথা বলা উচিৎ কি?”
পৃথিবীর আকাশের ৮৮ মণ্ডলের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মণ্ডলটি হলো সপ্তর্ষি মণ্ডল (Ursa Major)। আকাশে বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এই মণ্ডল যুগে যুগে কবিদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই বিনয় মজুমদারও এর আকর্ষণ থেকে রেহাই পাননি। উপরোক্ত কবিতায় উল্লেখিত ‘বশিষ্ঠ’ ও ‘অরুন্ধতী’ নক্ষত্রের সম্পর্ক নিয়ে যা বলা হয়েছে তা চিত্তাকর্ষক। ‘বশিষ্ঠ’ বা Mizar সপ্তর্ষি মণ্ডলের ষষ্ঠ তারা। এই বশিষ্ঠের খুব কাছেই আরেকটি তারা আছে, নাম- ‘অরুন্ধতী’ (Alcor)। তাদের এই ঘনিষ্ঠতার জন্যই তাদেরকে স্বামী-স্ত্রী বলা হয়ে থাকে। রামায়ণ পুরাণে রাজা দশরথ পুত্রসন্তান কামনায় যে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেছিল, সেই যজ্ঞের প্রধান পুরোহিতের দায়িত্বের ছিলেন পুরোহিত বশিষ্ঠ। তাঁর স্ত্রীর নাম অরুন্ধতী। এখান থেকেই অতীতে নক্ষত্রগুলোর নামকরণ হয়।
মজার ব্যাপার হলো- পরবর্তীতে পর্যবেক্ষণে দেখা গেল যে, এই নক্ষত্র দু’টো আসলে জোড়া তারা (Double star)! সত্যি সত্যি এরা সাত জন্মের বন্ধনে আবদ্ধ!
***
আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের দিকেও কবির রয়েছে মনোযোগ!
“এইসব মনে পড়ে, স্বভাবত আরো মনে পড়ে বহু নক্ষত্রের কথা
আমার চাঁদের কথা মনে পড়ে, মনোযোগ দিয়ে ভাবি আমি।
পৃথিবীতে তারকার আলোক আসার পথপাশে
চাঁদ থাকলেই সেই তারকার আলো যায় বেঁকে
চাঁদের আকর্ষণেই; তারকাদিগের খোপা, ভুরু, দুই হাত
মনোযোগ দিয়ে দেখি, তারকাদিগের সঙ্গে কথাবার্তা বলি।”
– ‘এ বছর মাঘ মাস’
***
“সূর্যগ্রহণের কালে” কবিতায় বিনয় মজুমদার একেবারে নিখুঁতভাবে একটি সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের বর্ণনা দিয়েছেন । কবিতাটি পড়ার পর আমি ভেবেছিলাম, উনি হয়তো বানিয়ে লিখেছেন। কিন্তু দু’টো ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখলাম- তাঁর বর্ণিত তারিখ ‘তেসরা ফাল্গুন শনিবার তেরশো ছিয়াশি সাল’ অর্থাৎ ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বিকেলবেলা সত্যিই একটি সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, এবং গ্রহণের পথ চলে গেছে ঠিক কোলকাতার উপর দিয়ে! তাঁর পর্যবেক্ষণ নিয়ে বড়সড় একটি কবিতা লিখে বসলেন বিনয় মজুমদার। শুরুর কয়েকটি লাইন এমন-
“সূর্যগ্রহণের কালে কিছু লেখা ভালো- এই ভেবে
আমি লিখি। আজ হল তেসরা ফাল্গুন শনিবার
তেরশো ছিয়াশি সাল। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম
সূর্যের অর্ধেক ঢেকে ফেলেছে চাঁদের ছায়া। এই
লিখে ফের উঠলাম, গ্রহণ আবার দেখে আসি।”
***
নক্ষত্র ও গ্রহের পার্থক্য বর্ণনার সময়েও বিনয় মজুমদারের বিজ্ঞান সঠিক।
“আকাশে তাকাই আমি ক্ষীণদৃষ্টি বলে শুধু বড় বড় তারা দেখা যায়
তারাদের চুল, চোখ, দুই পা, দু’হাত সব ভালো করে দেখি।
যে সকল জ্যোতিষ্কের আলো কাঁপে সে সকল তারা অগ্নিময়ী তারা আর
যে সকল জ্যোতিষ্কের আলোল কাঁপে না সে জ্যোতিষ্কসমূহ গ্রহ
আলোতাপহীন।”
***
একটি কবিতায় বিনয় মজুমদার নিজেই তাঁর জ্যোতির্বিদ্যাপ্রীতি জানিয়ে গেছেন। এই কবিতার কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপারটি হলো- তিনি অন্যান্য নক্ষত্র ব্যবস্থায় গ্রহ থাকার সম্ভাবনার ব্যাপারটি উল্লেখ করেছেন যা ঐ সময়ে আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু জ্যোতির্বিদেরা ধারণা করছিলেন। তিনি যে সে সময়কার জ্যোতির্বিজ্ঞানের হালচালের খবর বেশ ভালোই রাখতেন তা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া যায়।
“ভালো করে তারা দেখি, আমার অত্যন্ত প্রিয় কাজ তারা দেখা।
আমার নিজের মতে এই বিশ্বে ঘুরিফিরি সুনির্দিষ্ট পথে,
অবশ্য তারারা দেখে আমি ঘুরি ফিরি নানা পথে এ বিশ্বজগতে।
এবং আমার সঙ্গে নিয়মিত দেখা হয় ওসব তারার।
আমার সহিত বহু তারকাই কথা বলে, অনেক তারার শুধু মুখ চিনি আমি।
আমার ধারণা বহু তারকার গ্রহ আছে, উপগ্রহ আছে;
গ্রহগুলি যার যার তারা ঘিরে অবিরাম আবর্তিত হয়।
তবু তারাদের দেখে মনে হয় কারো গ্রহ নেই।”
***
‘আমার বাড়ির থেকে’ কবিতার শেষ ক’টা লাইন আমার খুব প্রিয়।
“পৃথিবী আমাকে নিয়ে সবেগে চলেছে ছুটে শূন্যপথ দিয়ে।
কখনো পৃথিবী যদি থেমে যায় তাহলে এ পৃথিবী সূর্যের গায়ে
আছড়ে পড়বে,
তার মানে ধ্বংস হবে,
বাঁচবার একমাত্র উপায় সর্বদা শুধু চলা।”
পৃথিবীর বার্ষিক গতিকে জীবন-দর্শনের সঙ্গে মেলানো চাট্টিখানি কথা নয়! এমন অনেক কবিতাতেই জ্যোতির্বিদ্যার স্বর শুনতে পাই। কয়েকটি কবিতা পড়া যাক-
“সকল কিছুরই বেশ আকর্ষণ আছে যথা কুসুম আমাকে বেশ
আকর্ষণ করে;
ফল, পাখি, শস্যক্ষেত, নদী, রেলগাড়ি, কারখানা
ইত্যাদি সকল কিছু সতত আমাকে বুঝি আকর্ষণ করে।
সব মিলে পৃথিবীর আকর্ষণই সবচেয়ে বেশি।
গ্রহসমূহের দাড়ি দেখি আমি, রোজ দেখি তারকাদির কানে দুল।
মানুষ অত্যন্ত ঊর্ধ্বে উঠে গেলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের
বাইরে যায় সে তাকে কেউ আর আকর্ষণ করে না, সে থাকে
সব গ্রহতারকার আকর্ষণহীন স্থানে একা।”
—
“যে সব জ্যোতিষ্ক আছে এই বিশ্বে সেগুলির সব ক’টি দেখা যায় না।
একাংশকে দেখা যায়; অতি মনোযোগ দিয়ে জ্যোতিষ্কদিগকে
দেখেছি জীবনভর। আমার ঘরের এই পশ্চিমপাশের
জানালার মাঝ দিয়ে একটি তারাকে দেখলাম।
এইসব চলৎশক্তি বিশিষ্ট জ্যোতিষ্কের গতিবিধি দেখে আমি বুঝেছি এদের।
পৃথিবীর গতিবিধি অপেক্ষা চাঁদের গতিবিধি
জটিল, প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের জটিলতম গতিবিধি যাদের তাদের
একটি আমার চাঁদ- শূন্য বিছানায় শুয়ে এই কথা মনে পড়ে যায়।”
—
“জ্যোতিষ্কদিগের গতি দেখে মনে হয় সব জ্যোতিষ্কসমূহ
সতত আমাকে ঘিরে আবর্তিত হয়, এই সূর্য চন্দ্র গ্রহ আর তারা
সকলে আমাকে ঘিরে আবর্তিত হয়- এই দেখে মনে হয়।
এরূপ প্রতীতি হয় সর্বদাই প্রত্যহই সারাটা জীবন।
অথচ আসলে এই জ্যোতিষ্কদিগের গতি বিভিন্ন প্রকার-
কেউ ঘোরে সূর্য ঘিরে, চাঁদ ঘোরে পৃথিবীকে ঘিরে;
আবার ইউরেনাস গ্রহ ঘিরে কয়েকটি উপগ্রহ ঘোরে,
অনেক জ্যোতিষ্ক কারো চারিপাশে ঘোরেই না
একস্থানে স্থির হয়ে থাকে।
অথচ দেখলে কিন্তু মনে হয় এইসব জ্যোতিষ্কদিগের গতি
সহজ সরল
অর্থাৎ সবাই শুধু আমাকেই ঘিরে ঘিরে ঘোরে বিশ্বময়।
এ একল গুপ্তকথা জানা গেছে নানাভাবে বয়স বাড়লে।
সর্বদাই এইসব জ্যোতিষ্কদিগের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় মাঠে
বাজারে হাটের মধ্যে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে ইস্কুলে কলেজে।”
***
বিজ্ঞানবিমুখ অনেক সাহিত্যপ্রেমী ভাবেন যে, বিজ্ঞান নিকটে গেলে প্রকৃত কবিতা উড়ে যায়! কিন্তু আমি দ্বিমত পোষণ করি। আমার মতে- পদ্যের ভেতর কিছু বিজ্ঞান থাকা ভালো! “ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।”
০১ / ১০ / ২০১৭