কালে কালে বায়োলুমিনেসেন্স বা জীবদ্যুতি নিয়ে বর্ণিত হয়েছে অনেক উপকথা। লোকমুখে ছড়িয়েছে কতো কাহিনী! সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনাকে অতিপ্রাকৃতিক দাবি করে গল্প ফেঁদেছে ভণ্ডরা। মূলত প্রাণীদেহে জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়ায় আলো নিঃসৃত হবার ঘটনাকেই বায়োলুমিনেসেন্স বা জীবদ্যুতি বলে। এই লেখায় পরবর্তীতে আমি বায়োলুমিনেসেন্স শব্দই ব্যবহার করেছি, বাংলা ব্যবহার না করে। কারণ, এমন অনেক প্রাণী বা উপাদানের নাম এসেছে যাদের বাংলা হয় না, বরঞ্চ আরো জটিল হয়ে যায় করতে গেলে। যে সকল অপরিচিত প্রাণীর নাম এসেছে সকলের নামের সাথে উইকিপিডিয়ার লিংক সংযোজিত আছে যাতে না চিনলেও দেখে অন্তত কিছুটা ধারণা নেয়া যায়।
বায়োলুমিনেসেন্স কী?
বায়োলুমিনেসেন্স নিয়ে আলোচনায় যাবার পূর্বে লুমিনেসেন্স নিয়ে সামান্য ধারণা দেয়া প্রয়োজন। প্রকৃতিতে হরেক রকমের লুমিনেসেন্স দেখা যায়। যার মধ্যে বায়োলুমিনেসেন্স এক ধরনের। আবার বায়োলুমিনেসেন্স এক রকম কেমিলুমিনেসেন্স। এই সবগুলোই আলোক উৎপাদী বিক্রিয়া বা প্রক্রিয়া। সব গুলিয়ে ফেলার আগে এই “লুমিনেসেন্সের” বংশতালিকা একবার চট করে দেখে নিলে বিভ্রান্তি এড়ানো সহজ হবে।
এবার এইসব বিভিন্ন ধরনের লুমিনেসেন্স কেনো এবং কীভাবে আলো দেয় তা এক নম্বরের প্রশ্নোত্তরের মতো বললে:
- কেমিলুমিনেসেন্স: কোনো ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে আলো নির্গত হয়।
- বায়োলুমিনেসেন্স: প্রাণীদেহে জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে আলোর উদ্ভব ঘটে।
- ইলেকট্রোকেমিলুমিনেসেন্স: বিভিন্ন রকমের তড়িৎ-রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট আলো।
- লায়োলুমিনেসেন্স: তরল দ্রাবকে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থের দ্রবীভূতকরণের ফলে আলো সৃষ্টি হয়।
- ক্রিষ্টালোলুমিনেসেন্স: পদার্থের স্ফটিকিকরণের সময় নির্গত আলো।
- ইলেক্ট্রোলুমিনেসেন্স: পদার্থের মধ্যে তড়িৎ পরিবহনের ফলে সৃষ্ট।
- ক্যাথোডোলুমিনেসেন্স: ইলেকট্রান দ্বারা কোনো লুমিনেসেন্ট পদার্থ বা উপাদানকে আঘাত করার ফলে।
- মেকানোলুমিনেসেন্স: কঠিন পদার্থের উপরে যান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগে সৃষ্ট।
- ট্রাইবোলুমিনেসেন্স: পীড়নের ফলে পদার্থের আণবিক বন্ধনে চিড় ধরার কারণে।
- ফ্র্যাক্টোলুমিনেসেন্স: কিছু কিছু স্ফটিকে আণবিক বন্ধন ভাঙার সময়।
- পিয়েজোলুমিনেসেন্স: কোনো কোনো পদার্থে অত্যাধিক চাপ প্রয়োগের ফলে।
- সনোলুমিনেসেন্স: শব্দশক্তি প্রয়োগে তরল পদার্থের বুদবুদে বিষ্ফোরণ ঘটার ফলে।
- ফটোলুমিনেসেন্স: ফোটন শোষিত হবার ফলে।
- ফ্লুরেসেন্স: বাহ্যিক আলোক উৎস থেকে শোষিত আলোর বিকিরণের ফলে, এবং শোষণ ও বিকিরণের মধ্যবর্তী সময়কাল অত্যন্ত কম।
- ফসফরেসেন্স: ফ্লুরোসেন্সের মতোই বাহ্যিক আলোক উৎস থেকে আলো শোষণ করে, কিন্তু সাথে সাথে বিকিরিত হয় না।
- রমন এমিশন: অস্থিতিস্থাপক আলোক বিক্ষেপণের ফলে।
- রেডিওলুমিনেসেন্স: আয়নাইজড তেজস্ক্রিয়তার বিষ্ফোরণজনত কারণে।
- থার্মোলুমিনেসেন্স: উত্তপ্ত পদার্থ কর্তৃক শোষিত তাপ নির্গমণের ফলে সৃষ্ট।
- ক্রায়োলুমিনেসেন্স: পদার্থের শীতলীকরণের ফলে নির্গত আলোক।
বায়োলুমিনেসেন্সের রসায়ন
যে কোনো কিছুর “রসায়ন” জিনিসটা আসলে ছোট করা খুবই ঝামেলার ব্যাপার। তবুও মোটামুটি জটিলতা এড়িয়ে মূল বিক্রিয়া বা পদ্ধতিটা রাখার চেষ্টা করেছি। উপরের শ্রেণীবিভাগ থেকে দেখেছি বায়োলুমিনেসেন্স হলো কেমিলুমিনেসেন্সের একটা প্রশাখা যেখানে জীবদেহের অভ্যন্তরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। বিক্রিয়ায় যখন কোনো এনজাইম কোনো আলো উৎপাদনকারী উপাদান কে ভাঙ্গে তখন তার একটি উপজাত হিসেবে আলো নির্গত হয়। সাধারণত যে উপাদানটি আলো তৈরী করে সেটিকে বলা হয় লুসিফারিন (Luciferin) আর যেটি বিক্রিয়ায় লুসিফারিনের বুক চিরে আলো বের করে আনে সেই উপাদান/এনজাইম সাধারণত লুসিফারেজ (Luciferase) নামে পরিচিত। এখানে উল্লেখ্য, লুসিফারিন নির্দিষ্ট কোনো একটা উপাদানকে নয় বরং যেসব যৌগে আলো উৎপাদনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তাদের সবকটাকেই বলে। উদাহরণস্বরূপ, Photinus নামক গুবড়ে পোকার লুসিফারিন Sea-Firefly -দের লুসিফারিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জোনাকি, অ্যাঞ্জেলফিশ প্রভৃতি প্রাণী আলো-নির্গমণকারী উপাদান লুসিফারিন ও লুসিফারেজ তৈরী করে। কিছু কিছু প্রজাতিতে লুসিফারিনের জারণে ক্যালসিয়াম বা ম্যাগনেসিয়াম আয়ন অথবা এডেনোসিন-ট্রাই-ফসফেট (ATP) লাগে যে বিক্রিয়ায় আলো উপজাত হিসেবে নির্গত হয়।
বিক্রিয়ার অপদ্রব্য হিসেবে পাওয়া যায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড, এডেনোসিন-মনো-ফসফেট (AMP), এবং অন্যান্য ফসফেট সমৃদ্ধ যৌগ। এই বিক্রিয়া প্রাণীকোষের অভ্যন্তরে কিংবা বাইরে ঘটতে পারে। প্রকৃতিতে লুসিফারিনের প্রকারভেদ তুলনামূলক কম। অন্যদিকে লুসিফারেজ এনজাইম প্রজাতি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়, যে কারণে এর প্রকারভেদ অনেক। তবে, লুসিফারিন-লুসিফারেজ বিক্রিয়াই একমাত্র পদ্ধতি নয় যার দ্বারা প্রাণী আলো নিঃসরণ করে। Parchment Worm নামে পরিচিত সামুদ্রিক জীবটি লুসিফারিনের বদলে অ্যাকিয়োরিন (Aequorin) নামের অন্য একধরণের ফটোপ্রোটিন কাজে লাগায়।
লুসিফারিন ও লুসিফারেজ নিয়ে কারো মনে কোনো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে কি? অথবা দুটো উপাদানের নামের সাথে পৌরাণিক কোনো নামের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে? হ্যাঁ, শয়তান কে আদর করে(!) লুসিফার নামে ডাকা হয়। এবং আদতে লুসিফারিন ও লুসিফারেজ শব্দ দুটো লুসিফার থেকেই এসেছে। লুসিফার একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ দ্যুতিবাহী (Light-bearing, Luc মানে Light, Fer মানে Bearing)। এখন যে আলো বহন করে, তাকে কেনো শয়তান বলা হবে, কিংবা অন্ধকারে আলো জ্বেলেছিলো বলেই কি ধর্মগুরুরা তাকে শয়তান বানিয়ে দিলো সে আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক!
ফ্লুরেসেন্স ও ফসফরেসেন্সের সাথে বায়োলুমিনেসেন্সের পার্থক্য
এতো বৈচিত্র্যের সব লুমিনেসেন্সের মধ্যে বায়োলুমিনেসেন্সের সাথে সবচে বেশি তালগোল পাকিয়ে যায় ফ্লুরেসেন্স, এবং ফসফরেসেন্স। কাজেই এই দুটো নিয়েও কিছুটা আলোচনার অবকাশ থাকে। ফ্লুরেসেন্স ও ফসফরেসেন্সের বাংলায় সুন্দর নাম আছে, যথাক্রমে প্রতিপ্রভা ও অণুপ্রভা। আণবিক পর্যায়ে এদের মূল কার্যপদ্ধতি প্রায় একই, ইলেকট্রনের ক্রমাগত উত্তেজনা ও প্রশমনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আলো নির্গত হয়। সংক্ষেপে পার্থক্য বলতে গেলে ফ্লুরেসেন্স ও ফসফরেসেন্স মৌল নিজে আলো উৎপন্ন করার ক্ষমতা রাখে না, তারা শুধু ফোটন বা শক্তি শোষণ করতে পারে যেখানে বায়োলুমিনেসেন্সে প্রাণী নিজে আলোর উৎস। জীবনধারণের জন্য গৃহীত খাদ্যই বায়োলুমিনেসেন্সের একমাত্র শক্তি উৎস। অপরদিকে ফ্লুরেসেন্স এবং ফসফরেসেন্সের ক্ষেত্রে বিকিরণের পূর্বে বাইরের যেকোনো আলোক উৎস থেকে ফোটন শোষিত হতে হয়। ফসফরেসেন্স নামে ফসফরাসিয় ভাব থাকলেও মৌল ফসফরাস থেকে নির্গত আলোর সাথে এর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। দীপ্যমান বস্তু হতে পদার্থ কর্তৃক শোষিত শক্তির আলো হিসেবে পুনঃবিকিরণ ফ্লুরেসেন্স ও ফসফরেসেন্সের মূল ধারণা। যদি এই বিকিরণ শোষণকালের অবিলম্বেই (সাধারণত ১০ ন্যানোসেকেন্ডের কম সময়ে) ঘটে থাকে তাহলে তাকে আমরা ফ্লুরেসেন্স বলবো, আর যদি উৎস অপসারিত হলেও আলো বিকিরিত হয় তাহলে বলবো ফসফরেসেন্স। সচরাচর তরল এবং বায়বীয় পদার্থ ফ্লুরেসেন্ট হয় এবং কঠিন পদার্থ হয় ফসফরেসেন্ট। ফ্লুরেসেন্স সম্পূর্ণ অন্ধকারে দেখা সম্ভব না। কারণ যেহেতু ফোটন শোষণ এবং বিকিরণের মধ্যবর্তী সময় ব্যবধান উপেক্ষনীয়, অতএব নিতান্তই কোনো উৎসের অনুপস্থিতিতে বিকিরণ অসম্ভব। ফ্লুরেসেন্ট বাল্ব ফ্লুরেসেন্সের একটা উদাহরণ হতে পারে। আর ফসফরেসেন্স ঠিক তার উল্টো, উৎসের উপস্থিতির কোনো প্রয়োজন হয় না। এর একটা সহজ উদাহরণ Glow-in-the-dark স্টিকার (ছবি ৩)।
বায়োলুমিনেসেন্স নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ও প্রকৃত সত্য
- অনেকেই মনে করেন প্রাণী শরীরে বায়োলুমিনেসেন্সের প্রধান কারণ বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়া। ব্যাকটেরিয়া বায়োলুমিনেসেন্ট হতে পারে, তবে প্রধান কারণ কখনোই নয়। ইতিমধ্যেই জেনেছি বায়োলুমিনেসেন্ট প্রাণীরা কিভাবে গৃহীত খাদ্য থেকে সঞ্চিত শক্তির মাধ্যমে আলো নিঃসরণ ঘটায়। আবার সকল মৃত সামুদ্রিক জীবের দ্যুতি সৃষ্টির পেছনের ঘটনা এই বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়া। এছাড়া অনেক দ্যুতিহীন জীবিত প্রাণীও পরজীবি ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দ্যুতি সৃষ্টি করতে পারে, সেসব ক্ষেত্রে তারা পরোক্ষ ভাবে বায়োলুমিনেসেন্ট। The Nature of Animal Light বইয়ের লেখক ই. নিউটন হার্ভি তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন –
কিউবায় দ্যুতি সৃষ্টিকারী গুবড়ে পোকা খোঁজার সময় একটা ব্যাঙ দেখে আমি হতবাক হয়ে গেছিলাম, যেটা কিনা আলো নিঃসরণ করছিলো তার দেহ থেকে। কৌতুহলবশত আমি ব্যাঙটাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলাম একটু আগেই ব্যাটা জোনাকি দিয়ে ভুড়িভোজন সেরেছে। তাদের আলো তার স্ফীত উদর ভেদ করে বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছিলো।
- বিড়াল বা কুকুরের চোখ বায়োলুমিনেসেন্ট বলেও ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। কিছু কিছু পোকা-মাকড়ের চোখ আগুনের কাছাকাছি এলে জ্বলজ্বল করে যা অনেকে বায়োলুমিনেসেন্স বলে ভুল করেন। প্রকৃতপক্ষে উভয়ক্ষেত্রেই আলোর প্রতিফলন এর জন্যে সম্পূর্ণভাবে দায়ী।
- নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে গভীর সমুদ্রের আনুবীক্ষণিক জীবদের চার ভাগের তিন ভাগই বায়োলুমিনেসেন্ট।
- মানুষের শরীরও বায়োলুমিনেসেন্ট হবার রেকর্ড আছে। মানব সভ্যতায় অ্যাসেপ্টিক ও অ্যান্টি-সেপটিক সার্জারী আসার পূর্বে প্রায়শই দেখা যেতো ক্ষতস্থান বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আলো নিঃসরণ করছে। সাধারণত বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়ারা সংক্রামক হয় না। রসায়নবিদ রবার্ট বয়েলের পরীক্ষা অনুযায়ী, বায়োলুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত মাংস খেয়ে কোনো প্রকার ক্ষতিসাধন হয় না,যদি না তার মধ্যে সংক্রামক ব্যাকটেরিয়া মিশে গিয়ে থাকে।
- “Milky Way” আমরা চিনি। আমাদের অতি আপন অনিন্দ্য সুন্দর ছায়াপথ, আমাদের মহাজাগতিক ঠিকানার তৃতীয় লাইন। কিন্তু “Milky Sea” চিনি কি? এ নিয়ে বহুকাল ধরে নাবিকদের মধ্যে বিভিন্ন উপকথা প্রচলিত ছিলো। বিশাল সমুদ্রের মাঝে হঠাৎ করে দেখা মিলতো দুধ সাদা ফেনিল জলের যার পরিব্যাপ্তি হতো দৃষ্টিসীমার বাইরে। অনেকেই স্রেফ গালগল্প বলে উড়িয়ে দিলেও ২০০৫ সালে এই উপকথা বাস্তবে প্রমাণিত হয়। স্টিভেন মিলারের নেতৃত্বে ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরিতে অবস্থিত ইউ. এস. নেভাল রিসার্চ একাডেমির একদল গবেষক উপগ্রহ ছবিতে দেখা পান এমনই এক Milky Sea এর। গবেষণাপত্রে তারা লিখেছেন –
An 15,400-km2 area of the northwestern Indian Ocean, roughly the size of the state of Connecticut, was observed to glow over 3 consecutive nights…
ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজ এস. এস. লিমার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় –
…এই দ্যুতি যেনো পুরো মহাসাগর জুড়ে ছড়িয়ে ছিলো, দিক-দিগন্তে যার কোনো শেষ দেখা যাচ্ছিলো না… আর মনে হচ্ছিলো জাহাজটা যেনো বিশাল তুষার প্রান্তরের উপর কিংবা পেঁজা তুলোর মতো মেঘের উপর ভেসে যাচ্ছে…
বলা বাহুল্য, এই অভূতপূর্ব দৃশ্যের পেছনের নায়ক বায়োলুমিনেসেন্স ব্যাকটেরিয়া। শুধুমাত্র একটি একক ব্যাকটেরিয়া থেকে নির্গত আলো দেখা যায় না, কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যাক ব্যাকটেরিয়া একসাথে হলে কি তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে দিতে পারে তা মাত্রই অনুধাবন করলাম আমরা!
প্রাণীজগতে বায়োলুমিনেসেন্সের প্রধান প্রধান ব্যবহার
ক) ছদ্মবেশ
গভীর সমুদ্রের অনেক প্রাণী ছদ্মবেশ (Camouflage) ধারণের জন্য বায়োলুমিনেসেন্সের সাহায্য নেয়। এই সব প্রাণীর আলোক সংবেদী কোষ নির্গত আলোর ঔজ্জল্য নিয়ন্ত্রন করে প্রেক্ষাপটের সাথে প্রাণীর রং মিলিয়ে নিতে সাহায্য করে। স্কুইডের বিভিন্ন প্রজাতি, শক্ত খোলস যুক্ত সামুদ্রিক প্রাণী যেমন কাঁকড়া বা চিংড়ি (Crustaceans), ও মাছের কিছু কিছু প্রজাতিতে বায়োলুমিনেসেন্সের এই ব্যবহার দেখা যায়।
খ) প্রতিরক্ষা
বায়োলুমিনেসেন্সের আক্রমণাত্মক ব্যবহার থেকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবহার বেশি। স্কুইড ও শক্ত আবরণের প্রাণীদের কিছু কিছু প্রজাতি কালো তরল ছুঁড়ে দেয়া স্কুইডের মতো করে বায়োলুমিনেসেন্সের ব্যবহার করে প্রতিরক্ষার কাজে। এক্ষেত্রে কালো রংয়ের তরলের বদলে বায়োলুমিনেসেন্ট তরল ছুঁড়ে দেয় শত্রুর প্রতি, যাতে কিয়ৎক্ষণের জন্যে সে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে ও এই ফাঁকে শিকার পালিয়ে যায়। Octopoteuthis deletron নামের গভীর জলের স্কুইড তার শুঁড়ের অংশবিশেষ হতে বিজলির মতো আলো জ্বালিয়ে নিবিয়ে সম্ভাব্য শত্রুকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়। Sea-firefly নামে পরিচিত প্রাণীরা সচরাচর ম্রিয়মান আলো নিঃসরিত করে, কিন্তু শত্রু বা অন্য প্রাণীর উপস্থিতিতে তীব্র নীল আলোর ছটায় চারদিক আলোকিত করে তুলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সেনাবাহিনী গেরিলা আক্রমণে আলোর জন্যে Sea-firefly ব্যবহার করতো।
গ) আক্রমণ বা আকর্ষণ
নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন গুহায় এক প্রজাতির পতঙ্গের (Arachnocampa luminosa), দেখা মিলে যাদের লার্ভা মাকড়সার জালের মতো করে বিস্তৃত হয়। এই জাল থেকে নির্গত উজ্জল আলো বাইরের পোকামাকড়কে আকর্ষণ করে। আর চকচকে আলো দেখে বোকা বনে গিয়ে অথবা অলঙ্কারের লোভে পড়ে যারা জালে আটকা পড়ে তাদের দিয়ে ওই পতঙ্গ আহার সেরে নেয়। জোনাকিরা এইরকম আলো জ্বালিয়ে সংগীর প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করে ও মিলনের আমন্ত্রণ জানায় (এইখানে এসে মনে হলো মানুষেরও এইরকম কিছু থাকলে খারাপ হতো না -_- )। এক ধরণের গুবরে পোকা (Click Beetles) আছে যারা ভালো মুডে (আসলে যখন রোমান্টিক মুডে থাকে) উড়াউড়ির সময় তলপেট থেকে কমলা রংয়ের আলো আর “খায়া ফালামু” মুডে থাকলে বুক থেকে সবুজ রংয়ের আলো নিঃসরিত করে। সঙ্গীর চোখে স্যার জোরাহ মরমন্ট থেকে দারিও নাহারিস লেভেলে যাবার জন্যে (গেইম অব থ্রোনস না দেখা পাবলিকদের জন্যে পরিভাষা: হিরো হবার জন্যে) সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে সবচে বেশি এই ফর্মুলা খাটায় শক্ত আবরণযুক্ত প্রাণীরা। Bermuda fireworm নামের প্রাণীটি মৌসুম ভেদে বায়োলুমিনেসেন্স দেখায়। মেয়েরা সাধারণত পূর্ণিমার অল্প কিছুদিন পরে পুরুষ সঙ্গীদের আকৃষ্ট করতে “হারলে কুইন” হবার চেষ্টা করে (দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যাবে)।
ঘ) সতর্কীকরণ
জীববৈচিত্র্যে বর্ণিল প্রাণীগুলো সচরাচর বিষাক্ত হয়। বায়োলুমিনেসেন্টের আরেকটা প্রধাণ ব্যবহার শত্রুকে বিভিন্ন রঙের আলোর মাধ্যমে সতর্ক করে দেয়া যে, “কাছে আসিস না, জ্বইলা যাবি”। অনেক পতঙ্গের লার্ভা শিকারী প্রাণীকে দূরে রাখতে বায়োলুমিনেসেন্সের ব্যবহার করে। সামুদ্রিক জীবদের মধ্যে আছে Scaleworms নামে পরিচিত প্রজাতির কীট, জেলিফিশ, ও তারা মাছের কিছু প্রজাতি।
ঙ) যোগাযোগ
সামুদ্রিক প্রাণীতে এতো দেখা না গেলেও স্থলভাগের প্রাণীরা যোগাযোগের জন্য আলো ব্যবহার করে। জোনাকিদের প্রজাতিতে অভ্যন্তরীন যোগাযোগের জন্যে বায়োলুমিনেসেন্সের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। Pyrosome – এ (ছবি ৮ দ্রষ্টব্য) Zooid-রা ছন্দবদ্ধ ভাবে আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে নিজেদের কলোনিতে তথ্য আদান-প্রদান করে। ছত্রাকের অনেক প্রজাতিও ঠিক একইভাবে বায়োলুমিনেসেন্সের ব্যবহার করে। আগেই জেনেছি মেয়ে ফায়ারওয়ার্মরা শরীরের আলো ব্যবহার করে পুরুষদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে, এটাও যোগাযোগের একটা উদাহরণ, যদিও বিশেষ উদ্দেশ্য(!) নিয়ে যোগাযোগ।
চ) দেখা
সাধারণত অধিকাংশ বায়োলুমিনেসেন্ট প্রাণীর আলো নীল কিংবা সবুজ হলেও গভীর সমুদ্রের এক প্রজাতির ড্রাগনফিশ লাল রঙের আলো নির্গত করে। এই রক্তিম আলো তাদের লাল রঙের শিকার খুঁজে পেতে সাহায্য করে যাদেরকে সচরাচর গভীর সমুদ্রের জ্বলে দেখা যায় না। এছাড়াও বায়োলুমিনেসেন্সের অন্যান্য কিছু কিছু ব্যবহার আছে যা এখনো গবেষণাপর্যায়ে বা অনাবিষ্কৃত।
পরিশিষ্ট
বায়োলুমিনেসেন্স নিয়ে বলতে গেলে আসলে এতো সংক্ষেপে শেষ করা কঠিন। এ এক বিশাল বৈচিত্র্যময় জগৎ। লুসিফারিন-লুসিফারেজ সচরাচর এই বিষ্ময়ালোকের মূল নেপথ্য নায়ক হলেও এর সব রকমের কার্যপদ্ধতি এখনো সম্পূর্ণরূপে আবিষ্কৃত হয়নি। অজানা রয়ে গেছে বহু ব্যবহার। সেসব জানার জন্যে নিরন্তর অনুসন্ধানের পাশাপাশি প্রাণীজগতের এই তুলনারহিত বৈশিষ্ট্যকে কিভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায় তার গবেষণাও চলছে। আমরা কোনোকিছুতেই ছাড় দিই না আসলে। সব কিছু নিজের প্রয়োজনে কেনো আসতে হবে সে এক ধাঁধা। আমরা ভুলে যাই প্রকৃতিই আমাদের জন্মদাত্রী, বিস্মৃত হই আমরাও এই বিশাল বৈচিত্র্যের এক ক্ষুদ্র অংশ বৈ কিছু না। হয়তো মাঝে মাঝে প্রকৃতিকে নিজের মতো চলতে দেয়াই উত্তম? তারচে বরং কোনো এক ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতের নির্জন বেলাভূমিতে সমুদ্র জোনাকদের একজন হয়েই তো এমন কয়েকটা জীবন পার করে দেয়া যায়, নয় কি?
তথ্যসূত্র:
১) Chemistry of Bioluminescence
২) The Nature of Animal Light by E. Newton Harvey
৪) Fluorescence, Bioluminescence, and Phosphorescence
৫) Milky-seas detected from space
৬) Detection of a bioluminescent milky sea from space
৯) Fluorescence
১০) Phosphorescence
১১) Luciferin – Merriam Webster