২৫ আগস্ট মঙ্গলবারে প্রথিতযশা পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ে তার নতুন তত্ত্ব প্রকাশ করেন। স্টকহোমের কেটিএইচ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে অনেক গুণীমানী বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সামনে তিনি একটি বক্তৃতায় এই তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন।
তার এই নতুন তত্ত্ব মূলত কৃষ্ণগহ্বরের ‘ইনফরমেশন প্যারাডক্স‘কে সমাধান করার চেষ্টা করছে। তাহলে চলুন প্রথমে জেনে নিই ইনফরমেশন প্যারাডক্স বলতে কী বুঝায়। আমরা জানি কৃষ্ণগহ্বর হচ্ছে এমন একটি বস্তু যার প্রচণ্ড ঘনত্বের কারণে মহাকর্ষ বলের টান অত্যন্ত বেশি, এতোটাই বেশি যে এই গহ্বরের ঘটনা দিগন্ত (Event Horizon) [১] থেকে আলোও ফিরে আসতে পারে না, গহ্বরের অতল তলে হারিয়ে যায়। যখন কোন অতিকায় নক্ষত্র কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়, যেটাকে আমরা নক্ষত্রের ‘মৃত্যু’ বলে অভিহিত করি, তখন সেই নক্ষত্রের আলো ও আলোর ভেতরে থাকা সকল তথ্যও হারিয়ে যায়। কিন্তু কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মতে মহাবিশ্বের তথ্যও শক্তির মতো অপরিবর্তনীয়, এর বিনাশ বা ক্ষয় নেই, তা কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিণত হয়। তাহলে কৃষ্ণগহ্বরে রূপান্তর হওয়া নক্ষত্রের তথ্য গেল কোথায়? এই বিভ্রান্তিকেই ইনফরমেশন প্যারাডক্স বলা হয়।
এই প্যারাডক্স গত ৪০ বছর ধরে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে বাঘা বাঘা সব পদার্থবিদদের। সকলেই একমত হয়েছেন যে তথ্যটা আসলে আক্ষরিক অর্থে হারিয়ে যায় না। তাহলে কী হয় সেই তথ্যের? হকিং গত মঙ্গলবার সেই বিষয়েই তার হাইপোথিসিস উপস্থাপন করেছেন। তার প্রস্তাবনার মূল সারাংশগুলো কী কী?
- নক্ষত্রের তথ্য কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ‘জমা’ থাকে না, বরং তা আসলে ‘জমা’ থাকে গহ্বরের ঘটনা দিগন্তে। কোন কণা যখন কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করে, তখন তার ইনফরমেশনের সুতো ঘটনা দিগন্তে রয়ে যায়। ব্যাপারটাকে পিঁপড়ার পথের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পিঁপড়ারা যখন খাদ্যের খোঁজে বের হয়, তখন পেছনে ফেরোমনের ট্র্যাক রেখে যেতে থাকে। যে ট্র্যাক ধরে অন্য পিঁপড়ারা তার পিছু পিছু আসতে পারবে। আলোর কণাও কৃষ্ণগহ্বরে ‘হারিয়ে’ যাওয়ার আগে ঘটনা দিগন্তে নিজের ‘ছায়া’ রেখে যায়!
- সমস্যা হলো, এই রেখে যাওয়া তথ্যকে বিশ্লেষণ করার কোন উপায় নেই। ঘটনা দিগন্তের নিজস্ব পরিবেশে এই তথ্যের বিকৃতি ঘটে এবং তা পুরোপুরি ভগিজগিতে (gibberish) পরিণত হয়। মূল তথ্য কী ছিল, সেটা আর কোনভাবেই জানা সম্ভব হয় না। আরেকটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ধরুন, আপনি বাংলা একাডেমীর বাংলা টু ইংলিশ ডিকশনারিটি পুড়িয়ে দিলেন, তবে ছাইটুকু রেখে দিলেন। টেকনিক্যালি, এই ছাই বইটারই ভিন্ন রূপ, কিন্তু সেই ছাই থেকে “অসম্ভব” শব্দের ইংরেজি বের করা ইমপসিবল!
- ঘটনা দিগন্তে তথ্যের এই রূপান্তর তাহলে কী রকম? হকিংয়ের মতে এই রূপান্তরের ফলে কণার এক মাত্রার (dimension) তথ্য হারিয়ে যায়। একটি ত্রিমাত্রিক কণার তথ্য দুই মাত্রার কোন স্থানে সংরক্ষণ করলে যা ঘটবে, একটি মাত্রার তথ্য মিশে যাবে অপর দুই মাত্রার তথ্যের সাথে। ফলে কোন মাত্রার তথ্যকেই আর আলাদা করে পাঠোদ্ধার করা যাবে না।
- এখানে আরো উল্লেখ্য যে এসব কণা যদি ঘটনা দিগন্ত থেকে ফিরে আসে, তাহলে যাবার সময় রেখে যাওয়া তথ্যের কিছুটা নিয়েই ফিরে আসে। ১৯৭০ সালে কৃষ্ণগহ্বরের এই বিকিরণকে স্টিফেন হকিংই আবিষ্কার করেছিলেন, যাকে ‘হকিং রেডিয়েশন’ বলা হয়ে থাকে। গত মঙ্গলবারে দেয়া তার নতুন প্রস্তাবনার সাথে হকিং রেডিয়েশনের যোগসূত্র আছে।
- হকিংয়ের প্রস্তাবনা সত্য হলে আরেকটি নতুন সম্ভাবনাও সত্য হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ঢুকে পড়া কণাগুলো যেহেতু পুরোপুরি ধ্বংস হচ্ছে না, সেহেতু আমরা কি ধারণা করতে পারি যে সেটি গহ্বরের ভেতর থেকে অপর প্রান্ত দিয়ে ‘বেরিয়ে’ আসবে? হকিং বলছেন, এই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকে পড়া কণাগুলো ঘটনা দিগন্তে নিজেদের তথ্য রেখে যেতে পারছে, তার মানে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরেও তারা নিজেদেরকে অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রবেশ করছে। এটা সত্যি যে গহ্বরের ভেতরে কী ঘটছে তা আমরা এখনও জানি না।হকিংয়ের মতে, গহ্বরে প্রবেশ করা কণাগুলো অন্য প্রান্তে বেরিয়ে আসলে আমাদের মহাবিশ্বে ফেরত আসবে না, বরং তারা পৌঁছে যাবে আমাদেরই সমান্তরাল অন্য একটি মহাবিশ্বে। অনেক পদার্থবিদের মতে, কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে আরেকটি ক্ষুদে মহাবিশ্ব তৈরি হয়। কণাগুলো সেখানেও থাকতে পারে।
সম্ভাবনার যেটাই সত্য হোক না কেন, এটুকু নিশ্চিত যে এই প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে কৃষ্ণগহ্বর ও মহাবিশ্বের নতুন আবিষ্কারের পথ খুলে গেল। কে জানে, হয়তো এই গবেষণা থেকেই বেরিয়ে আসবে সমান্তরাল মহাবিশ্বের সন্ধান!
ধন্যবাদ। বিজ্ঞানের জটিল টার্মগুলো আরো সহজভাবে বিশ্লেষন করে লিখলে আমার মত আম পাব্লিকের বুঝতে আরো সুবিধা হয়। আশা করছি এ ব্যাপারে সচেষ্ট হবেন। আবারো কৃতজ্ঞতা- কষ্ট করে লেখার জন্য।
আমরা সেই চেষ্টাই করছি। 🙂
I am happy to get this information about blackhole.
আমরা তাহলে কোনো একটা ক্রিশ্ন গহ্বর এর মধ্যে আছি।
এটা একটা সম্ভাবনা।