যদি প্রশ্ন করা হয় মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু কোনটি? আমার মতে উত্তরটি হবে কৃষ্ণ গহ্বর। নামটা একটু অপরিচিত লাগতে পারে কারণ আমরা এখন বাংলা শব্দের চেয়ে তার ইংরেজি প্রতিশব্দ বেশি বুঝি এবং সেগুলো ব্যবহারে অধিক অভ্যস্ত। এজন্যেই ব্ল্যাক হোল বললে সবাই বুঝবো, অপরদিকে কৃষ্ণ গহ্বর বললে অনেকেই বুঝতে পারবনা। এটা মাতৃভাষার এক ধরনের সূক্ষ্ম অমর্যাদা। যাই হোক সেটা ভিন্ন ব্যাপার তাই সেদিকে না যাই। কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে জানতে হলে আগে নক্ষত্র সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কারণ নক্ষত্রই একসময় কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়।
নক্ষত্রের সৃষ্টি ও ধ্বংস
নক্ষত্র সৃষ্টির মূল ক্ষেত্র হলো মহাজাগতিক মেঘ বা নেবুলা। নেবুলার অভ্যন্তরের হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো ঘনীভূত অবস্থায় নিজেদের অভিকর্ষ বলের ওপর পতিত হয়ে সৃষ্টি করে নক্ষত্র। নক্ষত্রের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়া হাইড্রোজেনের পরমাণুগুলোকে বিভক্ত হয়ে হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় বৃহৎ পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়ে থাকে যেটা তেজস্ক্রিয়তার রূপে নক্ষত্রের অভিকর্ষ বলের বিপরীতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। ফলস্বরুপ নক্ষত্রের অভিকর্ষ শক্তি ও তেজস্ক্রিয়তার ভেতরে একধরনের সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বৃহৎ নক্ষত্রগুলোর আভ্যন্তরীণ চাপ এবং তাপ হিলিয়ামের পাশাপাশি তুলনামূলক ভারী উপাদান সৃষ্টি করতে থাকে। যেমন: কার্বন, নিয়ন, সিলিকন, অক্সিজেন, লোহা। যখন এর অভ্যন্তরে লোহা উৎপন্ন হওয়া শুরু করে তখনই আসে অসামঞ্জস্যতা। কারণ যে ফিউশন প্রক্রিয়ায় লোহা উৎপন্ন হয় সেটা কোনো ধরনের শক্তির নিঃসরণ ঘটায় না। এভাবে যখন নক্ষত্রের অভ্যন্তরে লোহার পরিমাণ অত্যাধিক বেড়ে যায় তখন তেজস্ক্রিয়তা এবং অভিকর্ষ বলের সমতা বিনষ্ট হয়। ফলস্বরুপ নক্ষত্রের কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংস হবার ঠিক আগমূহুর্তে সেটা নক্ষত্রের সমস্ত ভর শোষণ করে নেয় এবং সৃষ্টি করে সকল ভারী উপাদানসমূহের। এর পরপরই ঘটে সুপারনোভা যার মাধ্যমে এসকল উপাদান সমগ্র মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সুপারনোভা সংগঠিত হবার পর দুটির যে কোনো একটি ঘটনা ঘটবে:
১। নক্ষত্রটি নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হবে।
২। ভর আরো বেশি হলে নক্ষত্রটি নিজের ভরের ওপর পতিত হয়ে কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, নক্ষত্রের ভর বেশি হলে ওপরের দুটো ঘটনার একটি ঘটবে। নক্ষত্রের ভর এদের চেয়ে কম হলে তারা সাদা বামন নক্ষত্রে পরিণত হবে, যেমন আমাদের সূর্য হবে একদিন।
কৃষ্ণগহ্বর কী?
এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে নক্ষত্রের সমস্ত ভর একটি বিন্দুতে একীভূত হয়। ফলস্বরুপ এর মহাকর্ষ বল এতোটাই বেশি হয়ে থাকে যে এমনকি আলো পর্যন্ত এটি অতিক্রম করতে পারে না। আমরা জানি, যে কোনো ভরযুক্ত বস্তুই স্থান-কালের চাদরে একটা বক্রতা তৈরি করে। যখন একটা নক্ষত্রের সামগ্রিক ভর এতোটাই বেশি হয় যে সেটা বাঁক তৈরি করতে করতে একটা গহ্বর তৈরি করে, তখন সেটাকে কৃষ্ণগহ্বর বলে।
আমরা যখন ব্ল্যাকহোলের দিকে তাকাই তখন আমরা আসলে কৃষ্ণগহ্বর দেখি না। যেটা দেখি সেটাকে বলা হয় The Event Horizon। কৃষ্ণগহ্বরটা থাকে মূলত এর কেন্দ্রে। যার ভেতরে আছে সিঙ্গুলারিটি। সিঙ্গুলারিটি এক্ষেত্রে অসীম ঘনত্বের কোনো পৃষ্ঠ হতে পারে, কিংবা সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। সুতরাং গ্রহণযোগ্য উত্তরটি হবে, আমরা জানি না।
কৃষ্ণগহ্বর হতে আলো বের হতে না পারলে অধিকাংশ ছবিতেই আমরা এর চারপাশে আলো দেখতে পাই কেন?
ইভেন্ট হরাইজনের প্রান্তে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র রয়েছে যাকে বলা হয় The Photon Sphere। এ পর্যায়ে এসে আলো কৃষ্ণগহ্বরকে আবর্তন করতে থাকে।
কৃষ্ণগহ্বর কি মহাকাশের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার?
এটি একটি ভুল ধারণা। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কৃষ্ণগহ্বর তার আশেপাশের সবকিছুই শোষণ করে নেয়। তবে এর একটি নির্দিষ্ট অভিকর্ষ বল বিদ্যমান। আপনি যদি সৌরজগতের মাঝখানে সূর্যের বদলে সেটার সমান কোনো কৃষ্ণগহ্বর স্থাপন করেন তাহলে গ্রহগুলোর কক্ষপথের কোনোরুপ পরিবর্তন হবে না। কিন্তু তাপ না থাকার কারণে আমরা ঠাণ্ডায় মারা যাব। প্রতিটি ছায়াপথের কেন্দ্রেই একটি বিশাল কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে।
এতে প্রবেশ করলে কী ঘটবে?
সেটা নির্ভর করবে কৃষ্ণগহ্বরের প্রকৃতির ওপর। যদি Stellar Mass Black hole বা ছোট কৃষ্ণগহ্বর হয় তাহলে ঘটনাদিগন্তে প্রবেশ করা মাত্রই তীব্র অভিকর্ষ বলের প্রভাবে আপনার দেহ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। আর যারা ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করবে তারা দেখতে পারবে আপনি ধীর গতিতে সেখানে প্রবেশ করছেন এবং আপনার দেহ ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আলো প্রতিফলিত না হবার কারণে। আর সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে আপনি এর কিছুটা অংশ ভ্রমণ করতে পারবেন। এমতাবস্থায় আপনার চারপাশের সবকিছু প্রচণ্ড গতিতে আপনাকে অতিক্রম করবে। দেখে মনে হবে আপনি যেন টাইমমেশিনে বসে আছেন আর পারিপার্শ্বিক সবকিছুকে অসীম গতিতে অতিক্রম করছেন। এরপর আপনি ডেথজোনে প্রবেশ করবেন এবং পূর্বের ঘটনাটি ঘটবে।
দুইটি কৃষ্ণগহ্বর একত্রিত হলে কী ঘটবে?
তেমন কিছুই ঘটবে না । শুধু একটির ভর অপরটি শোষণপূর্বক তা আরো শক্তিশালী ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে।
এর কি কোনো ধ্বংস আছে?
হ্যাঁ। তবে এটা অনেক সময়সাপেক্ষ। কৃষ্ণগহ্বর খুব ধীরগতিতে তার ভর হারাতে থাকে হকিং রেডিয়েশন নামক একটি প্রক্রিয়ায়। ধারণাটি দিয়েছেন পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং। হকিং রেডিয়েশন বুঝতে হলে আপনাকে প্রথমে কোয়ান্টাম ফোম বুঝতে হবে। ব্যাপারটি খুব সিম্পল, “কিছুই না মানে কোনোকিছু”। বুঝতে পারছেন না? আসুন আপনাকে হাতে-কলমে দেখাই।
ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ফাঁকা মনে হলেও আসলে তা নয়। আপনি যদি কোয়ান্টাম জুমিংয়ের সাহায্যে x10^35 এ ভ্যাকুয়ামে জুম করেন তাহলে মজার একটি ঘটনা দেখতে পারবেন। সেখানে গুঁড়ো সাবানের বুদবুদের মতো অসংখ্য বস্তু ও প্রতিবস্তু (ম্যাটার ও এন্টিম্যাটার) শূন্য হতে সৃষ্টি হচ্ছে এবং একে অপরের সাথে সংঘর্ষের দ্বারা বিলীন হয়ে যাচ্ছে । এসব কণাকে বলা হয় ভার্চুয়াল পার্টিকেল। এই ঘটনাটি যখন ব্ল্যাকহোলের প্রান্তে ঘটে তখন কণাগুলোর এক অংশ কৃষ্ণগহ্বর শোষণ করে নেয় এবং অপর অংশ সেখান হতে মুক্ত হয়ে বাস্তব কণায় পরিণত হয়। এভাবে কৃষ্ণগহ্বর ক্রমশ ভর হারাতে থাকে এবং এক পর্যায়ে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায়। তবে এ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দীর্ঘ। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সর্ববৃহৎ কৃষ্ণগহ্বর হলো S50014+81 যেটার ভর সূর্যের চেয়ে ৪০ বিলিয়ন গুণ বেশি এবং যার ব্যাস ২৩৬.৭ বিলিয়ন কিলোমিটার সেটা পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হতে লাগবে গুগল (10^100) বছর। যখন সেটার ভর একটি গ্রহাণুর সমান হবে তখন তার তাপমাত্রা হবে ২০° সেলসিয়াস। আর যখন তার ভর একটি পর্বতের সমান হবে তখন সেটা ৫৫০০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় থাকবে। আর সম্পূর্ণ ভর হারানোর ঠিক আগমূহুর্তে সেটা কয়েক বিলিয়ন পরমাণবিক বোমার সমান বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিলীন হয়ে যাবে।
ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণগহ্বরকে বলা হয় কীট-গহ্বর বা ওয়ার্মহোল, যেটা মহাবিশ্বে এক স্থান হতে অপরস্থানে ভ্রমণের সম্ভাব্য শর্টকাট। আর ব্ল্যাকহোলের বিপরীতে যেটা থাকে সেটাকে বলা হয় হোয়াইট হোল। এ দুটি নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত আলোচনা করবো। এতক্ষণ ধরে কষ্ট করে পড়বার জন্য ধন্যবাদ।
তৃষ্ণা মিটলো না 🙁
ভাল বুঝিয়েছেন,তবে ব্ল্যাক হোল সম্বন্ধে খুব ভাল ভাবে বুঝতে হলে Discovery-এর “How The Universe Works” সিজনটা দেখতে হবে।তবে আপনি জেভাবে বুঝিয়েছেন সেটিও প্রশংসার দাবি রাখে।