জৈববিবর্তন নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়েই বহু জনপ্রিয় বই প্রকাশিত হলেও বাংলায় এ বিষয়ক জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইয়ের ঘাটতি রয়েই গিয়েছিলো। জৈববিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ বাংলা ভাষায় হলেও তা পর্যাপ্ত ছিলো না। প্রয়োজন ছিলো সাধারণ পাঠকদের কথা মাথায় রেখে লেখা একটি পূর্ণাঙ্গ বইয়ের। বন্যা আহমেদ সেই প্রয়োজন মাথায় রেখেই লিখেছিলেন তাঁর প্রথম বই “বিবর্তনের পথ ধরে”। অবসর প্রকাশনী থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত বইটি সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক-মহলে বেশ আলোড়ন তুলেছিল, বিশেষ করে তরুণ সমাজে। বইয়ের অধ্যায়গুলো নিয়ে এক এক করে আলোচনা করা যাক।
বইয়ের প্রথম অধ্যায় ‘এলাম আমরা কোথা থেকে?’ শুরু হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ ‘ফ্লোরেস’-এ পাওয়া বামন মানবদের ফসিল হদিশ জানিয়ে। ওখানকার বাসিন্দাদের রূপকথার গল্পে যে বামনদের কথা শোনা যেত, তা সত্য হয়ে ধরা দিলো বিজ্ঞানীদের কাছে। ১২ হাজার বছর আগে এক বিশাল অগ্নুৎপাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো ওরা। ধারণা করা হয়, মানুষেরই আরেক প্রজাতি Homo erectus এর কোনো ছোটো একটি দল বিবর্তিত হয়ে ওই দ্বীপে পরিবেশে বামন-মানবে পরিণত হয়েছিল। এই ঘটনার ফলেই বিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, অল্প ক’দিন আগেও আধুনিক মানুষের সাথেই এই বসুন্ধরায় একই সাথে হেঁটে বেরিয়েছে মানুষেরই আরো একাধিক প্রজাতি। ভাবা যায়!
সাধারণত বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে পাঠক প্রত্যাশা করে যে বইয়ের বিষয়বস্তুর প্রাথমিক অংশটুকুর ধারণা দিয়েই আলোচনা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এ বইয়ে লেখক যেন চমক দিলেন। প্রথম অধ্যায়টি শুরু করলেন- কেন আমাদের বিবর্তন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন-তা দিয়ে। এ ধরনের বইয়ের পাঠের সময়ই স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন জেগে উঠতে পারে পাঠকের মনে- বিবর্তন নিয়ে এতো মাথাব্যথা কেন? বিবর্তন না জেনেই তো কোটি কোটি মানুষ কাটিয়ে দিয়েছে তাদের পুরোটা জীবন, তাহলে আমরা জেনেই বা কী করবো? লেখক যেন আগে থেকেই জানতেন যে এমন ধরনের প্রশ্নের উদ্ভব হতে পারে, তাই তিনি বইয়ের শুরুতেই এ ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলেন। লেখকের বক্তব্য জেনে নিলেই বইটি লেখার এবং পাঠকের পড়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যায়-
“বিবর্তনবাদকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে শেখার মাধ্যমে আমরা নিজেরা যেমন আমাদের চারদিকের প্রকৃতি ও পরিবেশকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করতে শিখব, তেমনিভাবে বুঝতে ও অন্যদের বুঝাতে পারবো বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও সমাজে হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকা বহু স্থবির চিন্তাধারার মধ্যে পার্থক্য কোথায়।”
‘বিবর্তনে প্রাণের স্পন্দন’ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে উনিশ শতকের প্রথম দিককার বিজ্ঞান মহলে চর্চিত বিবর্তন ও পৃথিবীর বয়স নিয়ে গবেষণাগুলোর ইতিহাস। অনেকেই মনে করেন যে, চার্লস ডারউইন জীবজগতের বিবর্তনের ঘটনাটি আবিষ্কার করেছেন; আসলে তা ঠিক নয়। ডারউইনের অনেক আগেই জীববিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন যে প্রজাতির বিবর্তন হয়, কিন্তু এর প্রক্রিয়াটুকু সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। চার্লস ডারউইন তাঁর ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ তত্ত্বের মাধ্যমে বিবর্তনের প্রক্রিয়ার যথাযথ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ডারউইন কেবল প্রজাতির বিবর্তনের পক্ষেই প্রমাণ তুলে ধরেন নি, কীভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ও পুরোনো প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে থাকে- তাও বর্ণনা করেছেন, যা জীববিদ্যার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। এই অধ্যায়ে ডারউইনের ‘বিগল’ জাহাজের সেই বিখ্যাত বিশ্ব-ভ্রমণ সম্পর্কে সামান্য আলোচনা রয়েছে। উক্ত অধ্যায়ের বিশিষ্টতা হলো এখানে ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব’ আবিষ্কারের পটভূমি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। পাঠক বেশ ভালোভাবেই ডারউইনের মনোজগতকে উপলব্ধি করতে পারবেন, বুঝতে পারবেন ঠিক কোন পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর আবিষ্কারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন।
জীববিজ্ঞানের আধুনিক সব শাখা যেমন- জেনেটিক্স, জিনোমিক্স, মাইক্রোবায়োলজি ইত্যাদি প্রতিনিয়ত বিবর্তনতত্ত্বের পক্ষে অগুনতি প্রমাণ সংগ্রহ করে যাচ্ছে। ভাবলে অবাক হতে হয়, দেড়শ’ বছর আগে ডারউইনের যুগে এসব আধুনিক জ্ঞানের কিছুই ছিলো না, তারপরও স্রেফ পর্যবেক্ষণ, অন্তর্দৃষ্টি ও অসাধারণ চিন্তাভাবনার মাধ্যমে ডারউইন জীবজগতের বিবর্তনের পেছনের কারণটুকু সঠিকভাবে খুঁজে বের করে ফেলতে পেরেছিলেন। “বিবর্তনের পথ ধরে” গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায় ‘অনন্ত সময়ের উপহার’এ মূলত ডারউইনের ‘’প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব’’’ নিয়েই আলোচনা এগিয়েছে। এ অধ্যায়ের প্রথম অংশটুকুতে ডারউইন কীভাবে তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বে উপনীত হয়েছিলেন সে বিষয়ে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। তাছাড়া, ল্যামার্কিয় দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে ডারউইনিয় দৃষ্টিভঙ্গীর একটি মনোজ্ঞ আলোচনা রয়েছে। অধ্যায়ের শেষাংশে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের খুঁটিনাটি নানা টার্ম ও টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে ছোটো আলোচনা আছে, যা বিবর্তনের পেছনকার চালিকাশক্তির ব্যাপারে জানতে সহায়তা করবে।।
“বিবর্তনের পথ ধরে” গ্রন্থের সবচেয়ে চমকপ্রদ, সুখপাঠ্য ও আকর্ষণীয় অধ্যায় সম্ভবত এর চতুর্থ অধ্যায়টি- ‘চোখের সামনেই ঘটছে বিবর্তন’। উক্ত অধ্যায়ে ভুরি ভুরি উদাহরণের মাধ্যমে বিবর্তনের পক্ষে লেখক নানা যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। আধুনিক জীববিজ্ঞানের জগতে বিবর্তন নিয়ে এতো বেশি পরিমাণ গবেষণা হয়েছে যে, তা থেকে বিবর্তনের পক্ষে হাজার হাজার প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়। বিবর্তনের পক্ষে আজ যে প্রমাণগুলো হাজির করা যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রাণ-রাসায়নিক প্রমাণ, কোষবিদ্যা-বিষয়ক প্রমাণ, শরীরবৃত্তীয় প্রমাণ, সংযোগকারী জীবের প্রমাণ, ভৌগোলিক বিস্তারের প্রমাণ,তুলনামূলক অঙ্গসংস্থানের প্রমাণ, শ্রেণীকরণ সংক্রান্ত প্রমাণ, বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গের প্রমাণ। তাছাড়া ফসিলের পরমাণ তো আছেই। উদাহরণ হিসেবে বেশ কিছু প্রমাণ লেখক উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে । এর মধ্যে মাইক্রো-বিবর্তনের উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছে এইচআইভি ভাইরাসের বিবর্তন। কেন বিজ্ঞানীরা এইডসের জন্য কোনো প্রতিষেধক বা ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন করতে পারছে না তার উত্তর লুকিয়ে আছে ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বে’। কেন বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন তা নিয়ে বলতে গিয়ে লেখক একেবারে মোক্ষম যুক্তিটি ছুঁড়ে দিয়েছেন-
“বিবর্তনবাদকে গভীরভাবে বোঝা ও তার যথাযথ প্রয়োগ ছাড়া এই মারাত্মক এইডস রোগের চিকিৎসা কি করে সম্ভব, বলুন তো? আজকে বিবর্তনবাদ-বিরোধী যদি এই ওষুধ তৈরির কাজে নিয়োজিত হন তাহলে কোটি কোটি এইডসের রোগীর কপালে কী আছে তা তো আর বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না”।
এছাড়া বিবর্তন তত্ত্বকে ভালোভাবে বোঝার মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারব কেন বার্ড ফ্লু ভাইরাস বিশ্বব্যাপী এমন মহামারী আকারে ছড়িয়ে গেল, কেন বর্তমানে ডিডিটি দিয়ে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না, কেন জমিতে অধিক কীটনাশক প্রয়োগে পোকাগুলো অর্জন করছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত আফ্রিকায় কেন ভয়াবহ সিকেল রোগের জিনের ছড়াছড়ি। আর ব্যাকটেরিয়ার বিবর্তন ও এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে আমাদের পড়তে হবে স্বাস্থ্য-ঝুঁকির সামনে। শুধু মাইক্রো-বিবর্তনই নয়, লেখক হাজির প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া নানা ম্যাক্রো-বিবর্তনের উদাহরণও।
একবার প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী জে বি হ্যালডেনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কীভাবে বিবর্তন তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করা যায়। প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, কেউ যদি প্রিক্যাম্ব্রিয়ান যুগে একটি খরগোশের ফসিল খুঁজে বের করে দিতে পারে তাহলেই জৈববিবর্তন ভুল বলে প্রমাণিত হবে। কিন্তু আজও কেউই তা করতে পারে নি। কারণ বিবর্তন তত্ত্ব ঘোষণা করছে যে, একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণীর ফসিল কখনোই ভুল শিলাস্তরে পাওয়া যাবে না, নয়তো পুরো বিবর্তন তত্ত্বই তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়তো। তাই বিবর্তন-বিদ্যার জগতে ফসিল-বিদ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফসিল নিয়েই লেখক তাঁর গ্রন্থের ৫ম অধ্যায়- ‘ফসিল ও প্রাচীন উপাখ্যানগুলো’ এবং ৬ষ্ঠ অধ্যায়- ‘ফসিলগুলো কোথা থেকে এলো’ সাজিয়েছেন। প্রাচীনকাল থেকেই যদিও মানুষ ফসিল সম্পর্কে জানতো; কিন্তু সেগুলোর উৎপত্তি বিষয়ক যথাযথ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানতে আমাদের আঠারো শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। লেখকের প্রাঞ্জল বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই- কীভাবে প্রাচীনকালে মানুষেরা বিভিন্ন অতিকায় বিলুপ্ত প্রাণীর ফসিল দেখে নানা ধরনের মিথ এবং কল্পকাহিনী তৈরি করেছে। বর্তমানে খুঁজে পাওয়া এসব বিশালাকার ফসিলগুলোর সাথে মানুষের কল্পিত দৈত্যগুলোর মিল দেখে খুব অবাক হতে হয়। আর ষষ্ঠ অধ্যায়ে ফসিল কীভাবে গঠিত হয় তার বিশদ বর্ণনা আছে। একই সাথে আছে মহাদেশীয় সঞ্চারণ এবং প্লেট টেকটোনিক্স তত্ত্ব নিয়ে কিছু আলোচনা। বিবর্তনের মাধ্যমে কীভাবে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীগুলো সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল তা বুঝতে হলে মহাদেশীয় সঞ্চারণ তত্ত্ব বুঝে নেয়া অতীব জরুরী। এরপর ৭ম অধ্যায়ে লেখক ফসিলের বয়স ও ভূ-তাত্ত্বিক বিভিন্ন স্তরের বয়স কীভাবে নির্ধারণ করা হয় তা নিয়ে সূক্ষ্ম বর্ণনা দিয়েছেন। এ অধ্যায়ে এসে সাধারণ পাঠক সামান্য অমনোযোগী হয়ে উঠতে পারেন অধিক পরিমাণ টেকনিক্যাল টার্ম ব্যবহারের কারণে। তবে বিজ্ঞানের মনযোগী পাঠকদের জন্য এটি একটি বড়ো পাওয়া।
বিবর্তন তত্ত্বের ইতিহাসে Missing link বা মধ্যবর্তী ফসিলগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ মিসিং লিংকগুলো খুঁজে না পেলে বিবর্তন তত্ত্বের সত্যতা হুমকির মুখে পড়তো। মিসিং লিংক আসলে এমন ধরনের ফসিল যা আধুনিক প্রজাতি ও তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যবর্তী স্তরের বিবর্তনের ধাপ বা খোয়া যাওয়া ফাঁক পূরণ করে। এই মিসিং লিংকগুলোই জীববিজ্ঞানীদের অনুমানগুলোর সত্যতা প্রমাণ করেছে। যদিও সঙ্গত কারণেই খুব বেশি পরিমাণ ফসিল বা মিসিং লিংক খুঁজে পাওয়া যায় নি, তারপরও যা পাওয়া গেছে তা যথেষ্ট বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এসব মধ্যবর্তী ফসিলগুলোর মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন কীভাবে ডাইনোসর থেকে উদ্ভব ঘটেছে আধুনিক পাখির, কীভাবে ডাঙ্গার চারপেয়ে ভালুক জাতীয় প্রাণী থেকে বিবর্তন ঘটেছে আধুনিক তিমির আর কীভাবেই বা পানিতে বসবাসকারী মাছগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে আবির্ভাব ঘটেছে সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর। এই গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে উপস্থাপিত হয়েছে মিসিং লিংক বিষয়ক কৌতূহলোদ্দীপক প্রবন্ধ।
প্রজাতির বিবর্তন নিয়ে বই লেখা হবে আর তাতে আমাদের তথা মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস থাকবে না- তা তো হতে পারে না। সেই ইতিহাসই আমরা খুঁজে পাই “বিবর্তনের পথ ধরে’” গ্রন্থের নবম অধ্যায়ে। আমাদের কাছে বিবর্তনের ইতিহাসে মানুষের যাত্রার খুঁটিনাটি জেনে নেয়াটা নিজেদের স্বার্থেই প্রয়োজন। বিবর্তনের ধারায় যেমন অগুনতি জীবের উদ্ভব পৃথিবীতে ঘটেছিলো তেমনি বেশিরভাগ প্রজাতিই কালের পরিক্রমায় পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। ফসিল রেকর্ড থেকে দেখা যায়, Homo গণেরও বিভিন্ন প্রজাতি উৎপত্তি ঘটেছে, একটি প্রজাতি ছাড়া বাকিরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর আমাদের জন্য রেখে গেছে ফসিল ও জিনতাত্ত্বিক প্রমাণ। অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীদের ফসিল খুঁজে পাওয়া রীতিমতো দুঃসাধ্য হলেও এপ বা নরমানবদের ফসিলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্টো। বিজ্ঞানীরা Homo গণের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতিগুলোর এতো বেশি-সংখ্যক ফসিল খুঁজে পেয়েছেন যে তাদের আলাদা করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। এসব নিয়ে লেখক এই অধ্যায়ে মানুষের বিবর্তনের রূপরেখা তুলে ধরেছেন বিস্তারিতভাবে। প্রাসঙ্গিক ছবিগুলো পড়ার আনন্দ বাড়িয়ে দেবে কয়েক গুণ।
ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে বলা যায় এক ধরনের Paradigm shift । স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো বিপ্লবাত্মক ধারণাকেই সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য লড়তে হয় দীর্ঘ লড়াই। সে লড়াইয়ে জয়ী হয়ে বিবর্তনবাদ এখন বৈজ্ঞানিক মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত।যদিও সাধারণ জনমানসে এখনো অনেকটাই অপাংক্তেয় রয়ে গেছে। সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরাও বসে নেই। তারা বিজ্ঞানের মোড়কে হাজির করছে নানা ছদ্ম-বিজ্ঞান, যা দিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে মানুষকে। সম্প্রতি নতুন এক আর্গুমেন্ট এ মহলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যার নাম বুদ্ধিদীপ্ত অনুকল্প বা ইন্টেলিজেন্ট আইডি। এই ইন্টেলিজেন্ট আইডি দিয়ে সৃষ্টি-তাত্ত্বিকরা কী বুঝাতে চান, তাদের কী কী ধরনের দাবি আছে এবং সর্বোপরি তাদের দাবির অসারতা প্রমাণ করেছেন লেখক তাঁর বইয়ের দশম অধ্যায়ে। এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় সম্ভবত এটি প্রথম লেখা। এই অধ্যায়টি বন্যা আহমেদ এবং বিজ্ঞান-লেখক অভিজিৎ রায় যৌথভাবে লিখেছেন। আর তাছাড়া পরিশিষ্টে বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত নানা ভুল ধারণাগুলোর যুক্তি খণ্ডন করা হয়েছে। এ অংশটি বিবর্তন বিষয়ক যেকোনো বিতর্কে বিশেষভাবে কাজে লাগবে বলেই আমার ধারণা।
আমাদের দেশে প্রচলিত বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ের ভাষা সাধারণত খুব কঠিন হয়, আর নয়তো পাঠকদের বুঝাতে গিয়ে একেবারেই তরল একটি ভাষা সৃষ্টি করা হয়। আমি আনন্দের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিচার করে লেখক তাঁর ভাষায় গাম্ভীর্য যেমন বজায় রেখেছেন তেমনি একই সাথে রক্ষা করেছেন প্রাঞ্জলতা। এ এক বিরল গুণ। এজন্য লেখককে অভিনন্দন জানাতে হয়। আর বিজ্ঞান বিষয়ক টার্মগুলো এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যাতে মাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থীও পড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ে যেমনটা আশা করা হয় যে, প্রচুর প্রাসঙ্গিক ছবি থাকবে, এ বইয়েও ঠিক তেমনটিই আছে। বইয়ের শেষে যুক্ত হওয়া কালার প্লেটগুলো যেন বাড়তি পাওয়া। বিজ্ঞানে আগ্রহী পাঠকদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য একটি বই।
“বিবর্তনের পথ ধরে” হার্ডকাভারে বাজারে পাওয়া যায়। তাছাড়া, লেখক সম্পূর্ণ বইটিই অনলাইনে বিনামূল্যে পড়ার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এই লিংকে গিয়ে প্রতিটি অধ্যায় ডাউনলোড করে পড়া যাবে।