বইঃ উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাঃ সংকটেরস্বরূপ এবং উত্তরণে করণীয়।
লেখকঃ প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুল বাছিত (অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, বুয়েট)
প্রকাশকঃ সংহতি
আমার ফেইসবুক আইডিতে বেশ ক’জন বইপ্রেমী আছেন যারা বাংলা বা ভিন্ন ভাষার সাহিত্যের উপর প্রচুর বইপত্র পড়েন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করেন, লেখেনও দারুণ। আমার খুবই ভালো লাগে সেগুলো দেখতে-পড়তে এবং যারা প্রচুর বই পড়েন তাদের সবসময়ই ঈর্ষা করি। এজন্য এই লেখাটিকে কেবল আমার ‘উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাঃ সংকটের স্বরূপ এবং উত্তরণে করণীয়’ গ্রন্থটি পড়ার পর ব্যক্তিগত উপলব্ধি হিসেবে গণ্য করলেই খুশি হব। একেকজনের মতামত ভিন্ন হয় এবং সেটায় আমি সর্বদাই শ্রদ্ধাশীল।
এই বইটির লেখক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল বাছিতকে আমি গত দুই বছরের মত সময় ধরে চিনি-জানি। আমি সবসময়েই আমার নিজের বিভাগের শিক্ষকদের প্রতি একটা আলাদা অনুরক্তি বা শ্রদ্ধা পালন করি, তাদের কথা মানার চেষ্টা করি, এবং করব।আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ বাদে আমি আর খুব অল্প কিছু পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকের সাথে পরিচিত বা চিনি তার মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. বাছিত স্যার একজন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়শই তার মতামত পড়ি, অনুধাবন করার চেষ্টা করি।
গবেষণায় তার যে সাফল্য সেটা বুঝতে খুব বেশি দূর যেতে হবে না, তার রিসার্চগেটের প্রোফাইলে একটু চোখ বোলালেই চলে। এবং নতুন সকল গবেষকদের জন্য তিনি একজন অনুকরণীয় বলা চলে। যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে দেশে এসে তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন “ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটরি” যেটা এখন ক্রমশ ন্যানোটেকনোলজি বা এই সংক্রান্ত বিজ্ঞান পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নামটি তুলে ধরতে সাহায্য করছে৷ এই বিষয়ের খ্যাতনামা জার্নালে এই ল্যাবরেটরিতে করা পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের উপর লিখিত বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে যাচ্ছে। তাঁর লেখা ‘উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাঃ সংকটের স্বরূপ এবং উত্তরণে করণীয়’ বইটির শুরুতেই “আমি কেন লিখছি?” অধ্যায়টা খুবই মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। পদার্থবিদ হয়েও লেখকের সাহিত্যপ্রীতি বা অন্য আরো প্রাসঙ্গিক বিষয়ের প্রতি আগ্রহ প্রশংসনীয়। অনেক দার্শনিকের উক্তি ব্যবহার করাটা নান্দনিক ছিল।
২০০৭ এ পিএইচডি ডিগ্রির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু লেখক দেখেছেন, অনুধাবন করেছেন তারই একটি সংকলন এই বইটি৷ বইটাকে একজন গবেষকের নাতিদীর্ঘ চমৎকার সফর বললেও ভুল হবে না। এই বইতে স্যারের পিএইচডি জীবনের কথা এসেছে।কয়েকজন স্বনামধন্য পদার্থবিজ্ঞানীর সান্নিধ্যে আসার গল্প আছে। তাদের সাফল্য, ব্যর্থতার মাপকাঠি এবং জীবনবোধের গল্প আছে। তারা পৃথিবীকে কিভাবে দেখেন বা তাদের জীবনাচরণ কেমন সেটা তুলে ধরার ক্ষেত্রে লেখক মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষত আমি সুপারন্ডাক্টিভিটিতে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য থিসিস করেছি৷ যখন এই বইতে এই বিষয়টার বিজ্ঞানীদের ব্যাপারে বলা হচ্ছিলো, সেই অংশটুকু পড়তে ভালো লেগেছে৷ গবেষণা বিষয়টি কতটা একাগ্রতার আর শ্রমের ব্যাপার, সেটা এখান থেকে বোঝা যায়।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই পৃথিবীর অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রী বা গবেষণার অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন। অনেকেরই হয়তো ইচ্ছা থাকে অর্জিত অভিজ্ঞতা ছাত্রদের মাঝে সঞ্চারিত করার, কিন্তু আমাদের দেশের সংস্কৃতি বা পারিপাশ্বিকতার চাপে হয়তো অনেকেরই সেই সদ-মানসিকতার অপমৃত্যু ঘটে।এই জিনিসটা এই বইয়ের অধ্যাপক-লেখক অনেক ভালোভাবে উপলব্ধি করেছেন বলেই আমার ধারণা। তিনি স্রোতের বিপরীতে চেষ্টা করছেন তার অর্জিত জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার। বইটা ওই প্রক্রিয়ারই অংশ নিশ্চয়ই। এই বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে তার উপলব্ধির জায়গাগুলো তুলে ধরেছেন সাবলীলভাবে, তার কিছু প্রস্তাবনার কথা তুলে ধরেছেন। আমার ব্যাক্তিগত মতামত হলো এগুলোর কয়েকটাও যদি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়, তাহলে হয়তো আমাদের দেশের গবেষণার চেহারাটাই অন্যরকম হতে পারে। আমি খুব করে চাই, আমাদের দেশের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কেউ বইটি পড়ুক, তার মত ভাবার চেষ্টা করুক বা বাস্তবায়নের প্রথম ছোট একটা পদক্ষেপ নিক। যে কোনো ভালো কাজের খুব ছোট পদক্ষেপও একদিন ভালো কিছুর জন্ম দিতে সক্ষম, এটা আমি বিশ্বাস করি। Big things have small beginnings.
নতুন গবেষকদের জন্যও বইতে আছে কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। এই বইয়ের ভূমিকার অংশটি লিখেছেন আমাদের দেশের স্বনামধন্য পদার্থবিদ প্রফেসর ডক্টর কামরুল হাসান মামুন স্যার (অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। আমি চাইবো, আমার পরিচিত/ অপরিচিত কেউ যদি এতদূর পর্যন্ত পড়ে থাকেন এবং আপনি গবেষণায় আগ্রহী, তাহলে বইটা পড়ে দেখতে পারেন। আশা করি আপনার মধ্যে নতুন ভাবনার সৃষ্টি হতেও পারে। বইটি এবারের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে।
আমি এই বই লেখার পেছনের মহৎ উদ্দেশ্যের সাফল্য কামনা করি।
:::::::::::
মোঃ আবদুল্লাহ আল জামান (প্রয়াস)
প্রভাষক (পদার্থবিদ্যা), বস্ত্রপ্রকৌশল বিভাগ, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।