আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এবং কসমোলজি – এই দুই ক্ষেত্রের একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হলেন Stephen W. Hawking । তাঁর “A Brief History of Time” বা “কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” বইটি মহাকাশ বিজ্ঞান এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক রচনা। এই বইটি পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা, মহাবিশ্ব ও মহাকাশবিদ্যার এক অমূল্য জ্ঞানভাণ্ডার। সে ভাণ্ড থেকে কিছুটা জ্ঞান আহরণ করে, বিভিন্ন অধ্যায়ে যা বলা হয়েছে তা অতি সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের চিত্র
(Our Picture of the Universe)
এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে মহাবিশ্ব মূলত দেখতে কেমন, বিজ্ঞানের শুরু থেকে বিভিন্ন দার্শনিক ও বিজ্ঞানী এই মহাবিশ্বকে কীভাবে দেখেছেন, কী ধারণা করেছেন, কী তত্ত্ব দিয়েছেন, কোনটি সঠিক ছিল আর কোনটি ছিল ভুল ইত্যাদি বিষয়।
এরপর সময়ের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানীগণ এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে কী বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দিয়েছেন এবং বর্তমান মহাবিশ্বের অবস্থা সম্পর্কে আমাদের যে জ্ঞান, সেটি কীভাবে আবিষ্কৃত হল, সে সম্পর্কেও বইয়ের এই অংশে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
স্থান ও কাল
(Space and Time)
আমাদের কাছে এই মহাবিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর মাত্রা হচ্ছে সময়।
কীভাবে স্থান ও কালের মাত্রা একত্রে জড়িয়ে আছে, কীভাবে স্থান ও কাল – এই দুটির সাহায্যে কোনো ঘটনার অবস্থান ব্যাখ্যা করা যায়, কীভাবে স্থান ও কাল পরস্পরকে প্রভাবিত করে ইত্যাদি বিষয়ের উপরে বইয়ের এই অংশটি রচিত।
প্রসারণশীল মহাবিশ্ব
(The Expanding Universe)
বিগব্যাং থেকে মহাবিশ্বের শুরু। তারপর থেকে মহাবিশ্ব সবসময় প্রসারিত হয়ে চলেছে এবং এখনো হচ্ছে। কী কী সমস্যা অতিক্রম করে, বিভিন্ন পরীক্ষালব্ধ ফলাফল দ্বারা এই ব্যাপারটি প্রমাণ করা হয়েছে, তা এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে।
অনিশ্চয়তার নীতি
(The Uncertainty Principle)
কণাবাদী বলবিদ্যার (Quantum mechanics) একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল অনিশ্চয়তার নীতি। নিউটনের গতিবিদ্যা ও বলবিদ্যা শুধু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও বৃহৎ বস্তুর ক্ষেত্রে কার্যকরী। যখন আমরা ইলেকট্রন, প্রোটন ও ফোটনের মত অতি ক্ষুদ্র ও আলোর গতির কাছাকাছি বস্তুর ক্ষেত্রে কাজ করতে যাব, তখন নিউটনীয় বলবিদ্যা ধ্বসে পড়ে। সেখানে প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের (Theory of relativity)। আর এই সকল ক্ষুদ্র কণার বিজ্ঞানের জগৎ হচ্ছে কণাবাদী বলবিদ্যা (Quantum mechanics) ।
এই অতি ক্ষুদ্র কণার জগতে আছে বিশাল এক সমস্যা, যেটিকে বলা হচ্ছে অনিশ্চয়তার নীতি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, অতি ক্ষুদ্র কণার অবস্থান ও গতি কখনোই একসাথে সঠিক ও নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। যদি গতি খুব বেশী সূক্ষ্মতায় নির্ণয় করা হয়, তবে তাদের অবস্থানের ক্ষেত্রে আসবে একটা বৃহৎ পরিসর। আর যদি অবস্থান নির্ণয় করা হয়, তবে অবস্থানের সূক্ষ্মতা বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকবে গতির নির্ভুলতা।
কেন দুটি পরিমাপ নির্ভুলভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয় আর কীভাবেই বা তৈরি হচ্ছে এই অনিশ্চয়তা, সেটা এই অধ্যায়ের আলোচ্য অংশ।
মৌলকণা ও প্রাকৃতিক বল
(Elementary Particles and the Forces of Nature)
আমরা সাধারণ বিজ্ঞান হিসেবে জানি যে, ইলেকট্রন, প্রোটন, এবং নিউট্রন হল সর্বশেষ মৌল কণা। হ্যাঁ, এটা সত্য। তবে এই আবিষ্কারের পর অনেক বছর পেরিয়েছে, অনেক নতুন তথ্য যুক্ত হয়েছে মৌলকণার বিজ্ঞানে। এখন আর মৌলকণা বলতে শুধু এই তিনটিকে বুঝায় না। এগুলো আরও ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত।
এখন মৌলকণার তালিকায় আছে অনেকগুলো কণা। এমনকি, আবিষ্কৃত কিছু ক্ষুদ্র কণার মাত্রা (Dimension, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা) আমাদের দৃশ্যমান আলোর সবচেয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর (বেগুনী) তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়েও কম। অর্থাৎ ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের ধারায় যদি কোনোদিন মানুষের চোখ আরও শক্তিশালী ও সংবেদনশীল না হয়, তবে আমরা এসব কণাকে কখনো দেখতে পাব না।
চারটি মূল প্রাকৃতিক বল এই মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই বলগুলোর কারণও এই ধরণের অতি ক্ষুদ্র কণা। এই প্রাকৃতিক বলগুলোর কোনটির জন্য কোন কণা দায়ী, তাদের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই এখানে আলোচনা করা হয়েছে।
কৃষ্ণগহ্বর
(Black Holes)
এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে অধরা অংশটি হল কৃষ্ণগহ্বর। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, যদি আলোর চেয়ে বেশী গতি সম্পন্ন কোনো কণা বা তরঙ্গ না থাকে, তবে কৃষ্ণগহ্বরকে আমরা কখনো দেখতে পাব না। তবে না দেখা গেলেও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা বের করেছেন, কীভাবে একটি বৃহৎ আকারের তারা বা নক্ষত্র জীবনের শেষ মুহূর্তে জ্বালানী সংকটে পড়ে কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি করে। এই কৃষ্ণগহ্বরই একমাত্র স্থান যেখানে পদার্থবিদ্যার সকল সূত্র ভেঙ্গে পড়ে, যাকে বলা হয় অনন্যতা বা সিঙ্গুলারিটি (singularity) । এর ভেতর থেকে কোনো তথ্য বেড়িয়ে আসতে না পারলেও মানব মস্তিষ্ক ও বিজ্ঞান কীভাবে এর অস্তিত্ব টের পেয়েছে এবং এর সম্পর্কে এত তথ্য দিচ্ছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে এই অধ্যায়ে।
কৃষ্ণগহ্বর অত কালো নয়
(Black Holes Ain’t So Black)
এই কথাটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কৃষ্ণগহ্বর যত অধরাই হোক না কেন, মানব মস্তিষ্ক তার কিছু তথ্য ঠিকই বের করে আনতে পেরেছে। আলোক রশ্মি, যেটি কৃষ্ণগহ্বরের আকর্ষণ বলের সীমানার ভেতরে চলে যায়, সেটি বেরিয়ে আসতে না পারলেও যেটি ভেতরে না গিয়ে তার কিনারা ঘেঁষে বেরিয়ে যায়, তার আচরণ কেমন? কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে যে এত বস্তু ও শক্তি প্রবেশ করছে, সেগুলো কী হচ্ছে? সেগুলো কি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, নাকি কৃষ্ণগহ্বরের শক্তি বৃদ্ধি করছে? এসব প্রশ্ন এবং বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত উত্তরগুলো এখানে আছে।
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি
(The Origin and Fate of the Universe)
এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এটি। এখানেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে সৃষ্টির আদি মুহূর্ত অর্থাৎ “বৃহৎ বিস্ফোরণ” বা “Big Bang” তত্ত্বটি। কীভাবে অসীম ভর ও তাপমাত্রা সম্পন্ন একটি “প্রায় শূন্য” আয়তন থেকে ( V → 0 ) আজকের এই মহাবিশ্বে আমরা আছি, আর কীভাবে এই মহাবিশ্বের সমাপ্তি ঘটবে। মহাবিশ্বের সমাপ্তি কীভাবে ঘটবে, তা নিয়ে কয়েকটি প্রস্তাবনা আছে যা নির্ভর করছে মহাবিশ্বের আমাদের না জানা কিছু সাংখ্যিক মানের উপর। এসব মানের উপরই নির্ভর করছে একসময় “মহা সংকোচন” এর মাধ্যমে সব কিছু ধ্বংস হবে নাকি অসীম কাল পর্যন্ত এই মহাবিশ্ব আয়তনে বেড়েই চলবে।
সময়ের তীর, ওয়ার্ম হোল এবং সময় পরিভ্রমণ
(The Arrow of Time, Wormholes and Time Travel)
আধুনিক পদার্থবিদ্যায় সময়কে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতার মত আরেকটি মাত্রা (Dimension) হিসাবে ধরা হয়। কিন্তু পার্থক্য এই যে, আমরা সময়ের মাত্রায় পরিভ্রমণ করতে পারি না। মূলত সময়ের মাত্রাটা কীরূপ? আসলেই কি সময় একমুখী? সময়ের অভিমুখে যাত্রা কি অসম্ভব? নাকি পর্যাপ্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আবিষ্কারের পর আমরাও সময়ের অভিমুখে যাত্রা করতে পারব? খুব সহজে আমরা যেই সময়কে দেখছি ও ব্যবহার করছি, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে এটির জটিলতা ও এই জটিলতার সমাধান কী হতে পারে, সেটাই এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়।
পদার্থবিদ্যাকে ঐক্যবদ্ধ করা
(The Unification of Physics)
এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে একবারেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা বেশ দুরূহ ছিল। তাই পদার্থবিজ্ঞানের মুল লক্ষ্য হলো, পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন অংশকে ভাগ করে নিয়ে এক একটি চূড়ান্ত তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তাদের সমন্বয় ঘটিয়ে, একটি একক তত্ত্বের আবিষ্কার করা।
পদার্থ বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সাথে সাথে বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন ভাগে পদার্থ বিজ্ঞান এই মহাবিশ্বের গতি প্রকৃতি ও তার আচরণ নির্ধারণকারী তত্ত্ব-সূত্রসমূহ আবিষ্কার করছে। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব ও সাধারণ গতিবিদ্যা (Gravity & General Mechanics), এরপর এসেছে আইনস্টাইনের আলোর গতির ধ্রুবকত্ত্ব ও চরম গতিতে অর্থাৎ আলোর গতির কাছাকাছিতে (V → c) বিশ্ববিখ্যাত আপেক্ষিক তত্ত্ব (General & Special Theory of relativity) । এরপর এলো তুলনামূলকভাবে নতুন তত্ত্ব, কণাবাদী বলবিদ্যা (Quantum Mechanics)। এখানে অতিক্ষুদ্র কণা, যা পদার্থ ও শক্তির জন্য দায়ী, তাদের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। এই তত্ত্বগুলোকে একত্রিত করে মহাবিশ্বের রূপরেখা প্রদানকারী একটি তত্ত্ব আবিষ্কার এখন পদার্থবিজ্ঞানীদের অন্যতম মূল লক্ষ্য।
মহাবিশ্বের মূল চারটি বল হলো – মহাকর্ষীয় বল (Gravitational Force), দুর্বল নিউক্লীয় বল (Weak Nuclear Force), সবল নিউক্লীয় বল (Strong Nuclear Force) এবং তাড়িত চৌম্বক বল (Electro-Magnetic Force) । এই চারটি বল এই মহাবিশ্বের সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক। এই বলগুলোর কারণেই পদার্থ, শক্তি, পদার্থ থেকে শক্তি, গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছু। এই বলগুলো সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন, তবে এদের একেকটি এক এক ক্ষেত্রে কার্যকরী গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে প্রকাশ করা হচ্ছে। এই চারটি বলের প্রকৃতি যখন একসাথে একটি তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাবে, তখন সেই তত্ত্বটিকে বলা হবে “মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব” বা “Grand Unified Theory” (GUT) । এই তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাবে মহাবিশ্বের সকল অংশের কার্যকারিতা। এরকম একটি সংঘবদ্ধ তত্ত্ব তৈরি করার কার্যক্রমের বেশ কিছু অংশ, সে সম্পর্কে কিছু বাধা বিপত্তি ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা আছে এই অধ্যায়ে।
চাইলে বইটির বাংলা অনুবাদ ও ইংরেজি মূল বইটি ডাউনলোড করে সংগ্রহে রাখতে পারেন।
Download English version
বাংলা অনুবাদ ডাউনলোড করুন
awesome