১.
চমক হাসান গণিতের শিক্ষক হিশেবে তাঁর ছাত্রদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। বুয়েট পাশ এই তড়িৎ-প্রকৌশলী যদি বিজ্ঞানের কোনো বই লিখতেন স্বাভাবিকভাবেই সেটি গণিত, পদার্থবিজ্ঞান কিংবা তাঁর লেখাপড়ার বিষয় নিয়েই হতে পারতো। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইটি জীববিজ্ঞানের! আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে, বইটি একটি বিদেশী বইয়ের বাংলা রূপান্তর। এটুকু তথ্যই বইটির প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ‘গল্পে-জল্পে জেনেটিক্স’ চমক হাসান অনূদিত ও রূপান্তরিত একটি জীববিজ্ঞানের বই, যেখানে মূলত জেনেটিক্সের মূল বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। বইয়ের আগ্রহোদ্দীপক মুখবন্ধ লিখেছেন ডাক্তার সৌমিত্র চক্রবর্তী।
‘গল্পে-জল্পে জেনেটিক্স’ বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ল্যারি গনিকের “The Cartoon Guide to Genetics” বইয়ের বাংলা রূপান্তর, যা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে; পরিবর্ধিত সংস্করণ বের ১৯৯১ সালে। ল্যারি গনিক বেশ বিখ্যাত কার্টুনিস্ট। বইটির সহলেখক মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক মার্ক হুইলিস। ল্যারি গনিক অবশ্য ‘The Cartoon History of the Universe’ এর জন্যই বেশি বিখ্যাত। তাঁর Cartoon Guide সিরিজের আরো বেশ কিছু জনপ্রিয় বই বেরিয়েছে। যেমন- The Cartoon Guide to Physics, The Cartoon Guide to Chemistry, The Cartoon Guide to Statistics।
২.
আপনি ভাবতে পারেন, “গল্পে-জল্পে জেনেটিক্স” একটি কমিক্সের বই, খুব বেশি কিছু জানা যাবে না, অল্প একটু তথ্যের সাথে অনেকগুলো মজাদার কার্টুন পাওয়া যাবে। এমনটা ভাবলে বই কিনে আপনি অবাক হবেন। কেননা এটি কমিক্সের মতো করে লেখা হলেও, খুবই সিরিয়াস একটি বই। জেনেটিক্সের সত্যিকারের বিষয়গুলো এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জেনেটিক্স-১০১ কোর্সের সমপর্যায়ের বিষয়বস্তু এতে আছে। তাই হেলাফেলা করার মতো বই এটি নয়।
বইয়ে জেনেটিক্সের মূল বিষয়গুলোতে প্রবেশের আগে জীববিজ্ঞানের ইতিহাস এবং বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন প্রচেষ্টা ও থিওরি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তকে শুধুমাত্র রসহীন বিজ্ঞানটুকুই ভরে দেয়া হয়, এর পেছনের ইতিহাস ও বিজ্ঞানীদের নির্ঘুম প্রচেষ্টার কথা একেবারেই নিয়ে আসা হয় না। এই ইতিহাসগুলো পড়ে পাঠক জীববিজ্ঞানের গবেষণার নানা পর্যায় এবং তা থেকে উত্তরণে বিজ্ঞানীদের ভূমিকা ভালোভাবে জানতে পারবেন। তাছাড়া ‘গল্পে জল্পে জেনেটিক্স’ বইয়ের সবচেয়ে বড়ো যে বৈশিষ্ট্য তা হলো- এতে যে প্রসঙ্গ ও তথ্যটি পরবর্তী বিষয়টি বুঝতে কাজে লাগবে না তা শুধু শুধুই তুলে দেয়া হয় নি, বরং কোনটার পর কোনটা জানলে পাঠকের পুরো বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে সুবিধে হবে সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা হয়েছে। আমাদের স্কুলে-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে কোষের ভেতরের অঙ্গাণুগুলোর বর্ণনা, ডিএনএ’র গঠন ইত্যাদি একেবারে শুরুতেই শেখানো হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জানানো হয় না কেন সে এই বিষয়টি শিখছে। এই বইয়ে মেন্ডেলের জিনতত্ত্বে আলোকপাত করা হয়েছে, কারণ এই বিষয়গুলো জানতে কোষ কিংবা ডিএনএর গঠন না জানলেও চলে। এরপর বিষয়বস্তু ধীরে ধীরে আরো জটিল হয়েছে, কিন্তু কোথাও ধারাবাহিকতা হারায় নি। এটিই আলোচ্য বইয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক।
এই বইয়ের আরেকটি শক্তিশালী দিক হলো- এর ড্রয়িং। ল্যারি গনিকের ড্রয়িং অসাধারণ। ফিজিক্যাল লেভেল থেকে জিন লেভেল পর্যন্ত ল্যারি গনিকের ড্রয়িং এর পরিচ্ছন্নতা সবাইকে মুগ্ধ করবে। মাইটোসিস ও মিয়োসিস কোষ বিভাজনের পর্যায়গুলো যেভাবে এই বইয়ের চিত্রের সাহায্যে দেখানো হয়েছে- তা আমি আর কোনো বইতে পাই নি। একইভাবে ডিএনএ-আরএনএ এর গঠন, প্রোটিনের স্ট্রাকচার, বিভিন্ন কোডন, এমিনো এসিডের গঠন ইত্যাদি যে কুশলতার সাথে দেখানো হয়েছে তার কোনো জবাব নেই। শুধুমাত্র এই চিত্রগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য এই বইটি কিনলেও পাঠকের পয়সা উসুল হবে।
তবে বইটির যে দুর্বল দিক আছে সেটি হলো- জেনেটিক্সের মতো জটিল বিষয়ের ততোধিক জটিল অংশগুলোয় প্রবেশের জন্য খুবই সহজ-সরল ভাষা বেছে নেয়া হয়েছে। এ কারণে পাঠক খুবই দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে পরের পৃষ্ঠায়। কিন্তু জেনেটিক্সের টেকনিক্যাল বিষয় পাঠকের আরো বেশি মনোযোগ দাবি করে। পাঠক দ্রুতগতিতে পরের অংশে চলে গেলে পূর্বের অংশগুলো আত্মস্থ করার সময়টুকু পাবে না। আর জেনেটিক্স আত্মস্থ করতে গেলে শুধু বই পড়াই যথেষ্ট নয়, শিক্ষার্থীর জন্য ব্যক্তিগত অনুশীলনের ব্যবস্থাও জরুরী। যদিও এই বইয়ে কিছুদূর পর পর থেকে গিয়ে পূর্বের তত্ত্বগুলো মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে, যা প্রশংসার যোগ্য।
৩.
চমক হাসানের অনুবাদের হাত অসাধারণ। বিশেষ করে বিজ্ঞানের বইয়ের ক্ষেত্রে সহজ-সরল শব্দ ব্যবহার করে পাঠককে জটিল বিষয়ের ভেতরে প্রবেশ করানোর চেষ্টা তিনি করেছেন তা সফল হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ল্যারি গনিকের চেয়েও চমক হাসানের ভাষ্য মনোরম মনে হয়েছে। ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তরের সময় চমক হাসান চেষ্টা করেছেন যাতে বাংলা ভাষার টোনটাই প্রধান হয়ে উঠে। কিছু উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। ‘The Cartoon Guide to Genetics’ বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা- ‘Our ancestors had a first-hand knowledge of nature. In those days, everyone was a biologist and The World was a classroom!!’ চমক হাসান অনুবাদ করেছেন- ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রকৃতি সম্বন্ধে সামান্যই জ্ঞান রাখত। তখন প্রত্যেকেই ছিল একেকজন জীববিজ্ঞানী আর গোটা পৃথিবীটাই ছিল তাদের পাঠশালা’। চমক হাসান একেবারে আক্ষরিক অনুবাদের পথ বেছে নেন নি, যা তাঁর রূপান্তরকে করে তুলেছে প্রাঞ্জল।
চমক হাসানের সেন্স অব হিউমারের দেখা আমরা পাই, যখন দেখতে পাই আসল বইয়ের কৌতুকের তুলনায় তাঁর হিউমারগুলো বেশি উন্নত। প্রথম পৃষ্ঠায় যেখানে ল্যারি গনিক লিখেছেন- “I’m in a scientific mood…”, সেখানে চমক হাসানের রূপান্তরিত টেক্সট হলো- ‘হুম…আমি একটু ‘ভাবে’ আছি…কেমন জানি বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী ভাব!” ২৭ পৃষ্ঠায় উপরে দু’জন নারী-পুরুষের কথোপকথনে মহিলার স্কার্ট উঁচিয়ে ধরে পুরুষটি বলে- “Signora! Lemme see your organs! I’ll be scientific…”, চমক হাসানের রূপান্তরে যা দাঁড়ায়: “ম্যাডাম, একটু দেখতে দিন…কথা দিচ্ছি, সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মতভাবে দেখব…”। এসব উদাহরণ থেকে চমক হাসানের হিউমারের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে শুধু হিউমারই নয়, সহজভাবে বুঝাতে পারাও চমক হাসানের বড় গুণ। চলে যাই ১২৫ তম পৃষ্ঠায়। এখানে ল্যারি গনিক রেপ্লিকেশন অংশের সূচনা করেছেন এভাবে- “Gene copying, or DNA REPLICATION, a Watson and Crick saw, is simple in principle. Each strand of the double helix contains the information necessary to make its complementary strand.” এই লাইনটি হুট করে বুঝতে পাঠকের একটু সমস্যা হতে পারে। এজন্য চমক হাসান বাংলায় রূপান্তরের সময় আরো কিছু বিষয় যুক্ত করে দিয়েছেন- “ডিএনএ রেপ্লিকেশনের মূলনীতিটা যথেষ্টই সোজা, যেনটা ভেবেছিলেন ওয়াটসন এবং ক্রিক। ডাবল হেলিক্সের দুইটা সূতার যেকোনো একটা পাশ জানলেই অন্যপাশে কী আছে সেটা বোঝা সম্ভব। একপাশে A থাকলে আরেকপাশে থাকবে T, একপাশে G থাকলে অন্যপাশে C- এভাবে পূরক ক্ষারের ধারণা থেকে- যেকোনো একতা সুতা থাকলেই অন্য সুতা বানিয়ে ফেলা যায়”। এই উদাহরণে চমক হাসানের রূপান্তরের বিশিষ্টতা স্পষ্ট না হলে, আমি পাঠককে পরামর্শ দিব মূল বই এবং চমক হাসানের বাংলা রূপান্তর পাশাপাশি রেখে পড়ার।
৪.
মূল বইয়ের শেষাংশে একটি ইনডেক্স জুড়ে দেয়া ছিল, যা চমক হাসানের বাংলা রূপান্তরে অনুপস্থিত। এই ইনডেক্সটি বই থেকে যেকোনো নির্দিষ্ট টপিক কিংবা রাসায়নিক পদার্থের নাম খুঁজে বের করতে বেশ সাহায্য করবে। আমি আশা করছি, বইটির পরবর্তী সংস্করণে মূল বইয়ে থাকা ইনডেক্সটি অনুবাদ করে ‘গল্পে-জল্পে জেনেটিক্স’ এ যুক্ত করা হবে।
‘The Cartoon Guide to Genetics’-এর সংশোধিত সংস্করণ বেরুনোর পর প্রায় দু’দশক কেটে গেছে। স্বাভাবিকভাবে গত দুই দশকের জেনেটিক্সের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা এই বইয়ে উঠে আসে নি। তা পাঠকের এই বইয়ে জেনেটিক্সের সর্বশেষ জ্ঞান ও তথ্য-প্রাপ্তির আশা না করাই উচিত। তবে জেনেটিক্সের একেবারে মূল বিষয়গুলো এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। একারণে বইটি স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীর কাজে আসবে। এমন একটি বই বাংলায় রূপান্তর করে পাঠকদের উপহার দেয়ার জন্য চমক হাসান সাধুবাদ পাবার যোগ্য।
মন্তব্য