পড়ে শেষ করলাম Simon Singh এর
The Code Book: The Science of Secrecy from Ancient Egypt to Quantum Cryptography.
বইটির সন্ধান পাই গুডরিডস ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে। Cryptography- অর্থাৎ আপনার তথ্যকে সর্বসাধারণের আড়ালে রেখে সংরক্ষণ ও প্রাপককে সরবরাহ করার বিদ্যা নিয়ে এই বই। হাজার বছর আগের রাজা বাদশাদের আমল থেকে Cryptography-র চর্চা শুরু, যার স্রোত এখন আপনার সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে সেলফোনের রিচার্জ কার্ডের ব্যবহারে চলছে সদর্পে! চারশো পৃষ্ঠার এই বইটিতে Cryptography-র রোমাঞ্চকর ইতিহাস , বিকাশের রাজনীতিক পটভূমি ছাড়াও এর গাণিতিক সৌন্দর্যের সুখপাঠ্য বর্ণনা আছে। গণিতের অংশগুলো খটমটে নয় মোটেই, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বিন্যাস-সমাবেশ, সংখ্যাতত্ত্বের সাধারণ ধারণা থাকলেই যথেষ্ট।
বইয়ের শুরু রাণী এলিজাবেথের হাতে স্কটিশ রাণীর Encryption-সংক্রান্ত ফ্যাসাদে পড়ে করুণ মৃত্যুদণ্ডের কাহিনী দিয়ে, শেষ হয়েছে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি Quantum Cryptography সম্ভাবনায়।
প্রাচীনকালে রাজা বাদশারা শত্রুরাজ্য পার হয়ে মিত্রের কাছে গোপন খবর পাঠাতে Cryptography-র আশ্রয় নিতেন।শুরুতে চর্চাটা ছিলো শুধু লুকানোতে, অর্থাৎ Steganography. স্পাই-এর মাথা কামিয়ে সেখানে মেসেজ লিখে চুল গজানোর পর পাঠানো হত, শত্রুর হাত থেকে তথ্য বাঁচাতে।খোলস অবিকৃত রেখে সেদ্ধ ডিমের সাদা অংশে লেখার পদ্ধতিও আবিষ্কার তখনি!পুরো বই জুড়েই ‘কথা-লুকানো’ বিদ্যার দুর্দান্ত সব কাহিনী, পাশাপাশি তা থেকে তথ্য বের করার কৌশল এর কথা । বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্রেও উল্লেখ করে গেছেন এর কথা,নারীদের জন্য নির্ধারিত ৬৪ কলার ৪৫ নম্বরে আছে এই বিদ্যা,”ম্লেচ্ছিকা-বিকল্প”!
ঐতিহাসিক সে কাহিনী, Code maker ও Code breaker দের যুদ্ধ। প্রথমদিকে চলত বর্ণের প্রতিস্থাপন এর মাধ্যমে Monoalphabetic Encryption ,মানে নির্দিষ্ট সংখ্যক অক্ষর শিফ্ট করা; a এর জায়গায় d ,b -র বদলে e এভাবে। এনিয়মে এক বর্ণ শিফট করে “ANT” কে লিখতে হবে “BOU”। অর্থাৎ ইংরেজি ছাব্বিশটি অক্ষর একে একে শিফট করে টেস্ট করলেই বেরিয়ে আসবে আসল মেসেজ। দিনে দিনে Cryptography কঠিন হতে লাগলো। Code maker-রা বর্ণ প্রতিস্থাপন এর পরিবর্তে Randomly বর্ণ নির্ধারণ করলেন এবারে।অর্থাৎ প্রেরক ইচ্ছেমতো বর্ণ ধরবেন,যার এক কপি থাকবে প্রাপকের কাছে।এবারে সহজে মেসেজ বের করার পদ্ধতি আর চলছে না।
কিন্তু মানুষের বুদ্ধিচর্চার Legecy টা এখানেই, পরিসংখ্যান বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই টেক্সটও পাঠের পদ্ধতিও বের করলেন Code breaker-রা। প্রতিটা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,এখানে সুনির্দিষ্ট কিছু ধ্বনি বেশি ব্যবহৃত হয়।যেমন ইংরেজিতে সবচে’ বেশি ব্যবহৃত হয় “e”,তারপর “a”,”t” ইত্যাদি।এভাবে বর্ণ বের করার পদ্ধতির নাম Frequency Analysis. আরবেরা এই পদ্ধতির জনক।ধর্মগ্রন্থে কোন কোন শব্দ কতোবার ব্যবহার হয়েছে, এই চর্চার মাধ্যমে পদ্ধতিটির আবিষ্কার(আল-শব্দটা বেশি ব্যবহার হয়,তাই সংশ্লিষ্ট ধ্বনিগুলোর বাহুল্য থাকবে এখানে)।
এবার একটা সাধারণ পদ্ধতির কথা বলছি। একটা ইংরেজি Encrypted Text ধরে নিন। আলোচ্য পদ্ধতিটির সাহায্যে কোন বর্ণ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে,তার একটা হিসেব করে আমরা “e” কোনটা বের করে নিতে পারি।স্যাম্পল হিসেবে Text থেকে বেছে নিচ্ছি তিন অক্ষরের এমন একটা শব্দ, যার শেষে ঐবর্ণটি অর্থাৎ যার আড়ালে লুকায়িত “e” আছে। এবার দেখবো দ্বিতীয় অক্ষরটিকে। পুরো Text এ যদি “e” এর পরে ঐ দ্বিতীয় অক্ষরটি না দেখা যায় তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়া যায়,অক্ষরটি “h” এবং শব্দটা “The”. পুরো ইংরেজি ভাষায় খুব বেশি শব্দ নেই যেখানে “e” এর পর “h” বসে।এভাবে ঐ বর্ণগুলো প্রতিস্থাপন করলেই আসল মেসেজের চেহারা বের হতে শুরু করবে।বাকিটা ভাষাবিদদের কাজ। বইয়ে পুরো এক অধ্যায় জুড়ে ধাপে ধাপে একটা গুপ্তবার্তা বের করে দেখানো হয়েছে, যা কোনভাবেই রহস্যোপন্যাসের কাহিনী জট ছাড়ানো থেকে চেয়ে কম নয়।
ছোটবেলায় এডগার এলান পো’র The Gold Bug এ এরকম পদ্ধতিতে গুপ্তধন বের করার কথা পড়েছিলাম, যদিও তখন কিছু বুঝিনি। ঐ অধ্যায়টা পড়ার পর পুরোনো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে চমৎকৃত হয়েছি!
চার্লস ব্যবেজ ও স্যার হুইটস্টোন (সার্কিটের Wheatstone Bridge-খ্যাত) এরকম Cryptoanalysis এ সুপারদর্শী ছিলেন।তাদের এক মজার ঘটনা না উল্লেখ করলেই নয়। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে প্রেমিক-প্রেমিকার অবাধ ভালোবাসার আদান প্রদানটাকে ঠিক সহজভাবে নেয়া হতোনা।পরিবারের কেউ যেন না জানতে পারে, তাই পত্রিকার ব্যক্তিগত কলামে Encryption এর মাধ্যমে প্রেমপত্রের আদান-প্রদান হবার ট্রেন্ড চালু হয়েছিল তখন!
স্যার হুইটস্টোন একদিন The Times পত্রিকায় অক্সফোর্ডের এক ছাত্রের প্রেমিকাকে লেখা চিঠির পাঠোদ্ধার করেন, দেখেন সেখানে লেখা পালিয়ে বিয়ে করার কথা। পরের সংখ্যায় ঐ একই Encryption মেথড-এ তিনি বুঝিয়ে সুঝিয়ে লেখেন, “দেখ বাবা, এভাবে পালিয়ে বিয়ে করাটাতো ঠিক না।” পরের সংখ্যায় প্রেমিকা বেচারি সোজা-সাপ্টা ইংরেজিতে লিখে বসেন ,”Dear Charlie, write no more. Our cipher is discovered.”
এভাবে অসংখ্য রকম ধাঁধা তৈরি ও ভাঙানোর ঘটনা ইতিহাসে জ্বাজল্যমান। হাতে কলমে লেখার ব্যাপারটা উঠে গেল রেডিয়ো-যোগাযোগ ব্যবস্থার আবিষ্কারের মাধ্যমে। Cryptography-র সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পরে। জয় পরাজয় নির্ধারণে গুপ্তবার্তাই হয়ে দাঁড়ায় প্রধান নিয়ামক। আমেরিকা ও ব্রিটেন Cryptography-র দৌড়ে তখনও এগিয়ে,এর মাধ্যমেই বিজয় ত্বরান্বিত হয়।কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানবাহিনি নামে দুর্লংঘ্য “Enigma” নিয়ে। সে সময়কার রোমহর্ষক ইতিহাসের শ্বাসসরুদ্ধকর বর্ণনা আছে বইটিতে।সে ইতিহাস শীতল স্নায়ুযুদ্ধের,মর্মান্তিক ও একই সাথে চূড়ান্ত উত্তেজনাকর।ঐ সময়টাতেই Cryptography-র বিকাশটা হয় সবচে’ বেশি। ততদিনে Cryptography-টা আর ভাষাবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়,বরং গণিতবিদ,দাবাড়ু,বিজ্ঞানীদের প্রাধান্যে এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে।অপ্রতিরোধ্য “Enigma”কেও হার মানান Bletchley Park এর বিজ্ঞানী,গণিতবিদেরা,যার অন্যতম নায়ক অ্যালান টুরিং! তিনিই প্রথম কম্পিউটারের রূপকার, মেকানিকেল ডিভাইসের মাধ্যমে এর তৈরি। পরবর্তীতে তার উন্নয়ন করা হয় ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করে।কীভাবে পর্যায়ক্রমে যান্ত্রিক কাঠামো থেকে বৈদ্যুতিক রূপ লাভ করে কম্পিউটার, ঐ অধ্যায়ও পড়লেই ধরা যায় স্পষ্ট। আরো আছে আদিম মিশরীয় ভাষা হায়ারোগ্লিফিক রহস্যভেদের কাহিনী।
আপনার ইমেইল, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট কতোটুকু সুরক্ষিত? আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলো নজর রাখছে কি? USA-র National Security Agency(NSA) ওখানকার সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর প্রতি নিয়ম আরোপ করেছে, বহির্দেশে বিক্রিত সফটওয়্যারের সিকিউরিটি যেন এমন না হয় যে, তারা তা Break করতে না পারে! এর পক্ষে তারা যুক্তি হাজির করে টেররিস্টচক্রের চক্রান্ত-পূর্বাভাস পাবার অজুহাত দেখিয়ে। যদিও নথি ঘেঁটে দেখা যায়,অনেক সময়ই ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টরা এই আড়িপাতাকে ব্যবহার করেছেন বিপক্ষদলের দূর্বলতাকে অস্ত্র হিসেবে পেতে।সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদের মতো দেশের মানুষের অবস্থানটা তাহলে কোথায়?
ইতিহাস,বিশ্বরাজনীতি,গণিত,প্রযুক্তিপ্রেমীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য এই বই।