বাস্তবতা বিবেচনায় সমালোচকেরা দেখেন যে, অন্তত প্রতি ৩০ বছরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষকরা অতি বুদ্ধিমান রোবট বানানোর ক্ষেত্রে সাফল্য দাবি করে আসছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫০ সালে যখন প্রথম ইলেকট্রনিক কম্পিউটার চালু করা হয়, তখন বিজ্ঞানীরা সাধারণ মানুষকে জানিয়েছিলেন এমন এক মেশিনের কথা, যা অতি দ্রুত ব্লক সাজানো, চেকার খেলা, এমনকি জটিল বীজগাণিতিক হিসাব পর্যন্ত করতে সক্ষম হবে। তখন মানুষের মধ্যে এমন ধারণা চলে এসেছিল যে, হয়তো বুদ্ধিমান যন্ত্রের আগমনের আর বেশী দেরি নেই। মানুষের বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই কিছু পত্রিকাতে রোবটের ভবিষ্যৎ উত্থান নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়, যখন রোবট মানুষের গৃহস্থালির সকল কাজ সম্পাদন করবে। ১৯৬৫ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় পথিকৃৎ হারবার্ট সিমন দাবি করেন, “পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যেই যন্ত্র মানুষের যে কোনো কাজই সম্পাদন করতে সমর্থ হবে।” কিন্তু সেই সময়েই যন্ত্রের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারটি গবেষকদের নজরে আসে। চেকার খেলতে সক্ষম যন্ত্র শুধু দাবা খেলতেই পারে, কিন্তু একজন অভিজ্ঞ দাবারুকে হারানো যন্ত্রের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে, সেই সময়ের রোবটগুলো কেবল একটি মাত্র কাজই সঠিক ভাবে করতে পারতো।
বর্তমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ পল আব্রাহাম তার ছাত্রাবস্থার কথা স্মরণ করেন। ১৯৪৮ সালের দিকে তিনি যখন প্রখ্যাত এমআইটি-র ছাত্র ছিলেন, তখন অনেক কিছুই সম্ভবপর মনে হত তার মত তরুণ গবেষকদের কাছে। তিনি তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, “যেন একদল মানুষ চাঁদে যাওয়ার জন্য উঁচু একটি টাওয়ার বানাচ্ছে, এবং প্রতি বছর টাওয়ারটি একটু একটু করে উঁচু হচ্ছে, কিন্তু চাঁদ যেন ধরা দেয় না।”
৮০র দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণার বিষয়টি একটি নতুন মাত্রা পায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা অধিদপ্তর এ সময় একটি ‘স্মার্ট ট্রাক’ বানানোর প্রকল্প গ্রহণ করে, যেটি শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের আস্তানায় প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহ, আটক সেনাদের উদ্ধার করে আবার নিরাপদে ফিরে আসতে সক্ষম হবে। জাপান সরকারও এ সময় পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার উদ্ভাবনে জাপানি শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ করে। এই কম্পিউটারটি মানুষের মত কথা বলা ও বোঝার ক্ষমতা, এবং ভবিষ্যৎ চাহিদা সম্পর্কে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে, এমন দাবিও করা হয়েছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যয়বহুল স্মার্ট ট্রাকটি তৈরি করা সম্ভব হলেও, যন্ত্রটিকে চালু করার পর আর ফেরত আসেনি নিজের আস্তানায়। আর পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার নিয়ে অনেক ঢাকঢোল পিটানো হলেও প্রকল্পটি বাদ দেয় জাপান সরকার। আবারও গবেষকদের সকল উদ্দীপনা বাস্তবতার কাছে হার মানে। তবে আশির দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা একটি নতুন মাত্রা পেলেও ফলাফল আশানরূপ না হওয়াতে বিজ্ঞানীদের মনোবল অনেকটাই কমে যায়, এমনকি এই খাতের গবেষণায় অর্থ বরাদ্দও কমতে থাকে।
এরই মাঝে ১৯৯২ সালে গবেষকদের মাঝে নতুন করে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে একটি চলচ্চিত্র নিয়ে। ১৯৬৮ সালে নির্মিত “2001: A Space Odyssey” নামের একটি চলচ্চিত্রে HAL 9000 নামে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটার দেখানো হয়েছিল, যেটি ভিনগ্রহবাসী একটি মহাকাশযান ধংস করে দিয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিল। সেই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছিল, ১৯৯২ সাল নাগাদ রোবট মানুষের মত বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে। এমনকি মহাকাশযানও পরিচালনা করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার রোবটদের বুদ্ধিমত্তা ছিল পোকামাকড়ের চেয়েও নগন্য পর্যায়ের।
১৯৯৭ সালে আইবিএম-এর তৈরি ডিপ ব্লু নামক কম্পিউটার সর্বকালের সেরা দাবারু গ্যারি ক্যাস্পারোভকে দাবা খেলায় পরাজিত করে। ডিপ ব্লুকে তখন আখ্যায়িত করা হয় প্রকৌশলের বিরাট এক অর্জন হিসাবে। এই যন্ত্রটি প্রতি সেকেন্ডে ১১ বিলিয়ন গাণিতিক হিসাব করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু এই যন্ত্রটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে নতুন দ্বার উন্মোচনের পরিবর্তে এর দুর্বল দিকগুলোকে সামনে তুলে আনে। এই যন্ত্রটি গাণিতিক হিসাব করে দাবা খেলতে পারলেও বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় একদমই উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছেই তখন স্পষ্ট হয়ে যায়, এই যন্ত্রের অনুধাবন করার কোন ক্ষমতা নেই। এমনকি দাবা খেলায় পরাজিত গ্যারি সংবাদকর্মীদের সামনে উপস্থিত হন এই বিষয়ে কথা বলার জন্য। কারণ ডিপ ব্লু যন্ত্রটির কথা বলার ক্ষমতা ছিল না। যন্ত্রটির উদ্ভাবকেরা তখন বুঝতে পারেন, বুদ্ধিমত্তা আর সেকেন্ডে বিলিয়ন হিসাব করতে পারাটা এক বিষয় নয়। গবেষক রিচার্ড হেক্লার বলে বসেন, “সামান্য টাকার বিনিময়ে দাবা খেলার প্রোগ্রাম কেনা সম্ভব, যা কিনা বিশ্বের সেরা দাবারুকে হারাতে সক্ষম। কিন্তু এগুলার পক্ষে কোনোরকম চিন্তা করা সম্ভব না।”
মোরের তত্ত্ব অনুযায়ী, সময়ের সাথে সাথে নতুন প্রজন্মের শক্তিশালী কম্পিউটার উদ্ভাবিত হয়, আর পূর্ববর্তী প্রজন্মের ব্যর্থতাগুলো বিজ্ঞানীরা ভুলে বসেন। কিন্তু একই সাথে এক ঝাঁক উদ্যমী তরুণ সামনে চলে আসেন, যারা পুনরুদ্যমে কাজ করে চলেন আরও উদ্ভাবনী চিন্তাধারা নিয়ে। সেই আশির দশকের ব্যর্থতার প্রায় ৩০ বছর পর, বর্তমানে কম্পিউটার এতটাই আধুনিক হয়েছে যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষকরা পুনরায় আশার বাণী শোনাচ্ছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন রোবট আবিষ্কার নিয়ে তারা অত্যন্ত আশাবাদী। যদি তাদের কথা সত্য হয়, মানুষের অস্তিত্ব কি তাহলে হুমকির মুখে?
[Reference: Translated from ‘Physics of the Future: How Science Will Shape Human Destiny and Our Daily Lives by the Year 2100’ by Dr. Michio Kaku, professor of theoretical physics at the City University of New York]