আমাদের পৃথিবীটা অত্যন্ত প্রাণসমৃদ্ধ। কোথায় প্রাণ নেই? সমুদ্রের অন্ধকার তলদেশ থেকে শুরু করে এন্টার্কটিকার চরম বৈরী পরিবেশেও প্রাণ বিরাজমান। পানি-মাটি-বাতাস, সবখানেই প্রাণ থৈ থৈ করছে; সব জায়গাতেই প্রাণের সুর বেজে চলেছে। আমরা এখন প্রাণের যে সংগীত শুনছি, সেটার পেছনে আছে কয়েকশো কোটি বছরের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের বইতে কিছু অধ্যায় আছে, যা অপেক্ষাকৃত কম ঘটনাবহুল। আবার কিছু অধ্যায় আছে, যেগুলোতে প্রাণ তার রাজ্যের সীমানা বাড়িয়েছে অনেক দ্রুত গতিতে। আজ আমরা এমন দ্রুতগতির একটা অধ্যায় নিয়ে জানবো। সেই অধ্যায়টির নাম ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ (Cambrian Explosion) – ৫৪ কোটি বছর আগের এই ঘটনাটিকে পৃথিবীতে প্রাণের বিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তবে সেই অধ্যায়ে ঢোকার আগে, খুব সংক্ষেপে পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর সারসংক্ষেপ জেনে নেয়া জরুরি। আগের অধ্যায়ের সংখ্যা খুব একটা কম না, আর সেখানে জানার বিষয়েরও কোনো ঘাটতি নেই। তবে চেষ্টা করবো খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক ব্যাপারগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরতে।
পৃথিবী ও প্রাণের উৎপত্তি
সৌরজগতের ধূলিকণাগুলো একত্রিত হয়ে গ্রহগুলো তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিলো প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে। পৃথিবীর অবস্থান এমন একটা জায়গাতে ছিলো, যেখানে প্রাণ জন্মাতে খুব বেশি সময় নেয়নি। শুরুর দিকে অন্যান্য গ্রহাণু, ধূমকেতু, গ্রহ, ইত্যাদির সাথে পৃথিবীর অজস্র সংঘর্ষ হয়েছিলো। সেই সংঘর্ষগুলো যখনই সামান্য বিরতি পাচ্ছিলো, প্রাণের আদিকণা তৈরি হচ্ছিলো। সবচেয়ে চমৎকার প্রমাণগুলো বলছে – প্রাণ জন্ম নিয়েছিলো প্রায় ৮০ কোটি বছরের মধ্যেই, এবং আরো কমও হতে পারে। আপনার আর আমার জন্য ৮০ কোটি বছর সময়টা বেজায় দীর্ঘ মনে হলেও, প্রায় ১৪০০ কোটি বছরের ব্রহ্মাণ্ডের কাছে এই সময়টা তেমন কিছুই না।
প্রাণ বলতে কী বোঝায়, সেটা এখানে বোঝা দরকার। রাসায়নিক পদার্থগুলো তো বিভিন্ন ধরনের বিক্রিয়া করে, তা আমরা জানি। কোনো রাসায়নিক পদার্থ যদি বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের হবহু প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে, তাহলে সেই পদার্থকে আমরা বলি প্রাণসমৃদ্ধ। প্রাচীন পৃথিবীর সেই আদিম পরিবেশে এমন উপযুক্ত অবস্থা ছিলো, যেখানে কিছু অতি ক্ষুদ্র কণা একদম সরল কিছু তথ্য নিজেদের মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। তথ্যগুলো জিন-সংক্রান্ত, প্রোটিন সংশ্লেষণ সংক্রান্ত হতে পারে। কিভাবে, তা এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কারণ, দুটোই প্রাণের চিহ্ন, একটা ছাড়া আরেকটা আসলে সম্ভব না। কোন তথ্যগুলো আগে সংরক্ষণ করতে শিখেছিলো ঐ কণাগুলো, তা বিজ্ঞানের সেরা রহস্যগুলোর মধ্যে একটা। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে ব্যাখ্যাটা আমাদের সামনে আছে, তা হলো মিলার-ইউরি পরীক্ষা। প্রাণহীন অজৈব কণা থেকে প্রোটিন সংশ্লেষণে সক্ষম জৈবিক কণা তৈরির জন্য আদি পরিবেশ যে উপযুক্ত ছিলো, তা এই পরীক্ষা থেকে বোঝা যায়। সম্প্রতি, ২০১৫ এর মার্চে, নাসা’র বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে অজৈব রাসায়নিক পদার্থ থেকে মহাশূন্যের মত পরিবেশের কৃত্রিম গবেষণাগারে তারা ডিএনএ, আরএনএ, ইউরাসিল, থায়ামিনের মত প্রাণযুক্ত পদার্থ তৈরি হতে দেখেছেন।
যাই হোক, যখনকার কথা বলছিলাম, তখনো কোষ ঝিল্লীও (Cell Membrane) তৈরি হয়নি, পূর্ণাঙ্গ কোষ তো দূরের কথা। RNA থেকে কাহিনীর শুরু, এরপর লম্বা সময় পরে DNA, আস্তে আস্তে ব্যাকটেরিয়া আর আর্কিয়া তৈরি হলো। এরা অবাত শ্বসন করতে পারতো, অর্থাৎ অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতেই শ্বাসকার্য চালাতে পারতো। সাড়ে তিনশো কোটি বছর আগে সালোকসংশ্লেষণ শুরু করলো এদেরই বংশধর সায়ানোব্যাকটেরিয়া (নীলাভ সবুজ শৈবাল), যখন ক্লোরোফিল নামক সুপরিচিত বস্তুটি সৃষ্টি হলো। এই তথ্যগুলো জানা পরের অংশের জন্য বেশ জরুরি। ৮০ কোটি বছর আগে ০.১% থেকে সমুদ্রের অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ালো ১ কি ২% এর কাছাকাছি। অর্থাৎ, ১০০ থেকে ২০০ গুণ বেড়ে গেলো অক্সিজেন। উল্লেখ্য, এখনকার বাতাসে অক্সিজেন প্রায় ২১%।
প্রাচীনকোষী প্রোক্যারিয়ট থেকে আধুনিক ইউক্যারিয়ট কোষের বিবর্তন হলো ১৮৫ কোটি বছর আগে। সম্মুখ ও পশ্চাৎভাগযুক্ত প্রাণী Bilateria -এর আবির্ভাব ঘটলো প্রায় ৫৬ কোটি বছর আগে। এমনই চলছিলো অনেক বছর। এরপর ৫৪ কোটি বছর আগে, প্রাণের ব্যাপক বিস্তার ঘটলো। পৃথিবী উপভোগ করলো প্রাণের ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ।
ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ
যা যা জানলাম, এক লাইনে সেটার সারসংক্ষেপ হচ্ছে – ৫৬ কোটি বছর আগে পর্যন্ত যা প্রাণী ছিলো, তাদের সবই ছিলো অত্যন্ত সরল, এবং জটিল প্রাণীর আবির্ভাব শুরু হচ্ছিলো মাত্র। এরপর দুই থেকে আড়াই কোটি বছর ধরে চললো প্রাণের উদ্দাম নৃত্য। এই যুগটাকেই বলা হয় ক্যাম্ব্রিয়ান যুগ (Cambrian Period). জীবাশ্ম প্রমাণ থেকে আমরা জানতে পেরেছি ঐ সময়ে কেমন ধরনের প্রজাতি ছিলো। যেমন – মিঠাপানি এবং সমুদ্রের নোনা পানি উভয়ের মধ্যেই ছোটো খোলসযুক্ত প্রাণী বিবর্তিত হয়েছিলো। তখন আর্থ্রোপোডা পর্বের প্রাণী আবির্ভূত হয়েছিলো। প্রথমবারের মত পা আর জটিল চোখ তৈরি হচ্ছিলো সেই সময়েই। এমন অনেক পোকা তৈরি হচ্ছিলো যাদের আঁশটে বা পালকের মত ফুলকা ছিলো। আর অনেক বড় পরিবর্তন ঘটেছিলো চোখের বিবর্তনের ক্ষেত্রে – আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার করে দেখতে পেতো ক্যাম্ব্রিয়ান প্রাণীরা।
ঐ সময়েই বিস্তার লাভ করেছিলো প্রথমদিকের একিনোডার্ম,এখনকার স্টার ফিশের মত দেখতে অনেকটা। আর স্টারফিশ সত্যিই এই দলেরই অন্তর্ভুক্ত প্রাণী।
আর ঐ সময়কার জীবাশ্মগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ট্রাইলোবাইট; বোঝা যায় ক্যাম্ব্রিয়ান যুগে এরা খুব সহজলভ্য ছিলো। এদের মধ্যে কেউ কেউ সাগরের তলদেশে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতো খাদ্যের খোঁজে, কেউ ভেসে বেড়াতো উদ্ভিদ বা প্রাণীকণা খাবার জন্য।
এমন আরো অনেক প্রাণীর জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে সেগুলো ক্যাম্ব্রিয়ান যুগেই বেশি ছড়িয়ে পড়েছিলো। তবে এর মানে এই না যে, ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের আগে কোনো প্রাণী ছিলো না। অনেকের মধ্যে এমন একটা ধারণা কাজ করে যে, ঐ সময়েই বুঝি প্রাণের সূচনা! আবার অনেকে এমনো মনে করে যে, ইতিহাসের একদম নির্দিষ্ট একটা বিন্দুতে হঠাৎ করে সব পাল্টে যেতে আরম্ভ করেছিলো। আসলে দুটোর একটাও সত্যি না। বিবর্তন এভাবে কাজ করে না। বিবর্তন ক্রমশই কাজ করে। তবে কিছুটা দ্রুতগতিতে বিবর্তন হচ্ছিলো, এটুকুই কেবল। আগেও তো বলেছি, পৃথিবীর এই লম্বা ইতিহাসের মধ্যে দুই বা আড়াই কোটি বছর তেমন বেশি কিছু না। এতো অল্প(!) সময়ে এতোটুকু বিবর্তন হওয়াও বিস্ময়কর, তাই এটাকে বিস্ফোরণ বলে!
কেন এই গতি বেড়ে গিয়েছিলো, সেটা নিয়ে আগে থেকেই বেশ কিছু প্রস্তাব ছিলো। সম্প্রতি নেচার ম্যাগাজিনে ডগলাস ফক্স একটা প্রবন্ধ লিখলেন, যাতে বললেন কারণগুলো আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। নিচের অংশটুকু সেই প্রবন্ধের ওপর ভিত্তি করে সহজ ভাষায় লেখা।
কেন হয়েছিলো ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ?
আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে ৮০ কোটি বছর আগে সামুদ্রিক অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় ১০০ গুণ বেড়ে গিয়েছিলো, কারণ ধীরে ধীরে সালোকসংশ্লেষণ করতে সক্ষম এমন প্রাণসত্তা তৈরি হচ্ছিলো। আর ইডিয়াকারান (Ediacaran) যুগের শেষে, ৫৫ কোটি বছর আগে, আরো একবার সামুদ্রিক অক্সিজেন বেশ অনেকটুকু বেড়ে গিয়েছিলো।
অক্সিজেনের এই বৃদ্ধি মাঠে নিয়ে এসেছিলো কিছু নতুন খেলোয়াড় – উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ই। মানে, এতোদিন যারা টিকে থাকা ও বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট অক্সিজেন পাচ্ছিলো না, তারা এখন বংশবিস্তার করতে লাগলো। কিছু উদ্ভিদ এখন জল ছেড়ে স্থলেও রাজ্য বিস্তার করার ঘোষণা(!) দিয়ে বসলো।
আর নতুন বিবর্তিত প্রাণীদের খাবার? এতোদিন ধরে যারা সংখ্যায় প্রাচুর্যময় ছিলো, ওদের তো প্রতিরক্ষার কোনো উপায়ই নেই। থাকবে কিভাবে? এতোদিন তো তেমন কোনো শিকারী প্রাণীই ছিলো না। ফলাফল, ইডিয়াকারান যুগের অপেক্ষাকৃত কম বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণীরা ব্যাপক পরিমাণে খাদ্যে পরিণত হলো, আর উপযুক্ত পরিবেশে বিভিন্নভাবে বিবর্তিত হতে লাগলো ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের প্রাণীরা। আর আগেই বলেছিলাম, চোখের বেশ বিবর্তন ঘটেছিলো। হুম, শিকার আর শিকারী সম্পর্ক যখন চলে আসে, ভালোমত আশেপাশে তাকাতে পারলে যে সুবিধাটুকু পাওয়া যায়, তা কিন্তু ব্যাপক!
আমরা কথা বলছি সমুদ্রের পানির মধ্যে দ্রবীভূত অক্সিজেন নিয়ে। পানির একদম তলের দিকে যতটুকু অক্সিজেন থাকবে, সেটার চেয়ে বেশি অক্সিজেন থাকবে ওপরের দিকে, পানির পৃষ্ঠতলের দিকে। অক্সিজেনের বৃদ্ধির সাথে ক্যাম্ব্রিয়ান বিবর্তনের আসলেই কোনো সম্পর্ক আছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা এখন যেটা জানার চেষ্টা করছেন, সেটা হলো – পানির বিভিন্ন স্তরে বসবাস করা প্রাণীদের জীবাশ্ম খুঁজে বের করতে। যদি একেক স্তরে অক্সিজেনের পরিমাণের ভিন্নতার সাথে বিবর্তনের চিত্রটা খাপে খাপে মিলে যায়, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যাবে যে আসলেই দুটোর মধ্যে সম্পর্ক আছে।
চিত্র এখনো সম্পূর্ণ পরিষ্কার না। আরো কিছু কারণ থাকতে পারে, যেমন – ওজোন তৈরি হওয়া (ঐ অক্সিজেনের বৃদ্ধির কারণেই অবশ্য, এটা ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করবে), পানিতে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (খোলস তৈরিতে এটা সহায়তা করবে)। এখনো আমরা শতভাগ নিশ্চিত করে জানি না। তবে এতে লজ্জার কিছু নেই। সবসময়ই এমন কিছু না কিছু থাকবে যা আমরা জানবো না। সেগুলোকে জানার জন্য যে হাতিয়ার, সেই হাতিয়ারটার নামই বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এই যাত্রা চলবে। সবাইকে ধন্যবাদ।