আইজাক অ্যাসিমভ নাকি অসম্ভব দাম্ভিক লোক ছিলেন। কাউকেই তেমন পাত্তা দিতেন না। উনি বলেছেন, ‘‘পৃথিবীতে আমার চেয়েও বুদ্ধিমান মাত্র দুজন ব্যক্তি আছেন। তার মধ্যে একজন কার্ল সেগান।’’
এই লোকটার নতুন করে পরিচয় করে দেওয়াটা খুব কঠিন। তার সম্পর্কে যাই বলা হোক না কেন, সেটা ওনার ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্যকে ফুটিয়ে তুলতে পারবেনা কখনোই। জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কসমোলজিস্ট, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী, লেখক, বিজ্ঞান জনপ্রিয়কারী, এবং আমার চোখে বিজ্ঞান বিপ্লবী, ক্ষণজন্মা পুরুষ কার্ল সেগান। এই বিশাল অন্ধকার মহাকাশে, পৃথিবী নামে এই ছোট্ট নীল বিন্দুটির ততোধিক নগণ্য অধিবাসী হিসেবে আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, হিংসা, দুঃখ, স্বার্থগুলো যে কতো অর্থহীন, তা বার বার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এই লোক। আবার সম্মিলিত ভাবে একই উদ্দেশ্যে কাজ করে গেলে একসময় আমরা গ্যালাক্সী থেকে গ্যালাক্সী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বো- এই স্বপ্নও দেখিয়েছেন।
তার জীবনে অর্জন ছিলো প্রচুর। কিন্তু পাশাপাশি, উপযুক্ত সময়ের অনেক আগে জন্ম নেয়ার ঝামেলাও কম সইতে হয়নি লোকটাকে। আসুন, তার বর্ণিল, ব্যস্ত, আর সর্বোপরি ছোট্টো জীবনটা নিয়ে আলোচনা করে কিছুটা সময় কাটাই।
১৯৩৪ সালের নভেম্বরের ৯ তারিখে নিউইয়র্ক শহরে তার জন্ম। Demon-Haunted World বইতে সেগান এক যায়গায় বলেছেন, ছোটোবেলায় বাবা স্যাম সেগানকে প্রশ্ন করে করে পাগল করে ছাড়তেন! তার যাবতীয় প্রশ্নই ডায়নোসর দিয়ে শুরু হয়ে এক পর্যায়ে পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ পর্যন্ত চলে যেতো। তার বাবা ধৈর্য ধরে প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করে যেতেন, আরও প্রশ্ন করার উৎসাহ দিতেন। তার সেগান হয়ে ওঠার পেছনে ঐ বিজ্ঞান না-জানা ভদ্রলোকের অবদান কম নয়।
৫ বছর বয়সে নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে “স্টার” এর ওপরে লেখা চেয়েছিলেন। সামনে দাঁড়ানো পুঁচকে ছোঁড়া দেখে লাইব্রেরিয়ান তাকে হলিউড “সুপারস্টার”-দের ওপরে লেখা ধরিয়ে দিলো। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন, সত্যিকারের নক্ষত্র নিয়ে লেখা বই। লাইব্রেরিয়ান অবাক হলো, কিন্তু এবার ঠিকঠাকমত একটা বই দিলো। সেগান সেখানেই পড়লেন, সূর্য-ও একটা নক্ষত্র; রাতের আকাশে যে তারাগুলো দেখা যায়, সেগুলোর মতই। কিন্তু সেগুলো এতো দূরে যে, ওগুলো খুব ছোটো মনে হয়।
হঠাৎ করে পুরো মহাবিশ্বটা তার কাছে বিশাল হয়ে গেলো। তিনি এই বিশালতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সারা জীবন সেই মুগ্ধতা থেকে আর বের হতে পারেননি তিনি। পেশা আর আবেগ, দুটো দিয়েই জড়িয়ে ধরলেন নক্ষত্রবিদ্যা।
ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো থেকে ১৯৫৫ সালে পদার্থবিদ্যায় অনার্স, আর ৫৬ সালে মাস্টার্স করেছিলেন। এরপরেই তার নক্ষত্রবিদ্যা আর জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করলেন। সবাই মাস্টার্স বা পিএইচডি লেভেল থিসিস লিখলেও উনি অনার্সে থাকাকালেই ফিজিক্যাল কেমিস্ট H. C. Urey এর সাথে প্রাণের উৎস নিয়ে একটা থিসিস লিখেছিলেন। পিএইচডি করে বের হবার পর দু বছর ফেলো হিসেবে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে-তে।
কেউ ম্যাসাচুসেটস এর কেম্ব্রিজে বেড়াতে গেলে, স্মিথসোনিয়ান অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল অবজার্ভেটরি’র আশেপাশে বাতাস খেয়ে আসবেন। বার্কলে থেকে বের হবার পর, ৬২ থেকে ৬৮ সাল পর্যন্ত সেগান এখানেই কাজ করেছেন। একই সাথে হার্ভার্ডে গবেষণা করেছেন, লেকচার দিয়েছেন, এবং বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য একের পর এক প্ল্যান হাতে নিয়েছেন। এই অপরাধেই ৬৮ সালের পর হার্ভার্ডে তার চাকরির মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি। কারণ হিসেবে অন্যান্য প্রফেসররা যা বলেছিলেন তা হচ্ছে- ‘‘বিজ্ঞান টিজ্ঞান ভুয়া কথা। শালায় নিজে বিখ্যাত হইতে চায়! এরে হার্ভার্ডে দরকার নাই!’’
সেগান বিখ্যাত হতে চাননি। কসমস প্রচার হওয়ার পর, পাওয়ার ম্যাকিনটশ ৭১০০ মডেলের কম্পিউটারের কোড নেইম দেয়া হয়েছিলো ‘কার্ল সেগান’। এই তথ্য জানার পর সেগান অ্যাপলের নামে মামলা করে দিয়ে বলেছিলেন, নিজের নাম ভাড়া দিয়ে পয়সা বানানো বা বানাতে দেয়ার ইচ্ছা- কোনোটিই তার নেই।
হার্ভার্ডের পর সেগান জয়েন করেন তার জন্মস্থান নিউইয়র্ক স্টেটেরই আরেক শহর ইথাকা’র কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। এখানেই কয়েক বছর পর এক ছেলের কলেজ অ্যাপ্লিকেশন দেখে তাকে তিনি ডেকে পাঠান। প্রচণ্ড ব্যস্ততার ভেতরেও অনেকক্ষণ কথা হয় দুজনের। ছেলেটির ভাষায়- ‘‘আমি জানতাম, আমি বিজ্ঞানীই হতে চাই। তবে মানুষ হিসেবে আমার কি হওয়া উচিৎ, তা ওই বিকেলে কার্ল সেগান আমাকে শিখিয়েছিলেন।’’…………… সেই হাইস্কুল সিনিয়রের নাম Neil Degrasse Tyson – বাকীটা ইতিহাস। টাইসন একা নন, কত হাজার হাজার মানুষকে কে যে সেগান বিজ্ঞানের রাস্তায় নিয়ে এসেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
তার বিজ্ঞান সংক্রান্ত আবিষ্কারগুলোর কথা তো বলাই হলোনা। শনির উপগ্রহ টাইটানে বা জুপিটারের গ্রহ ইউরোপাতে পানির সম্ভাবনা থাকার কথা তিনিই প্রথমদিকে বলেছিলেন। সবাই ভেনাসকে স্বর্গের মত বলে দাবি করলেও তিনি বলেছিলেন, ভেনাস আসলে জ্বলন্ত দোজখ, যেখানে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫০০ ডিগ্রী। তার কাজের জন্য ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সের সর্বোচ্চ সম্মান Public Welfare Medal পেয়েছিলেন তিনি।
আমেরিকার মহাকাশ যাত্রার একদম শুরু থেকে সাথে ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সাল থেকেই তিনি নাসার নাসার উপদেষ্টা অ্যাপোলো প্রোগ্রামের যে মহাকাশচারীরা চাঁদে যেতো, তাদের সাথে কথা বলাটা তার চাকরির দায়িত্ব ছিলো। UFO (Unidentified Flying Object), এলিয়েনদের দ্বারা কিডন্যাপ হবার রিপোর্ট—এসব বিষয়ে এতোই উৎসাহী ছিলেন যে তাকে ইউ এস এয়ার ফোর্সের UFO সংক্রান্ত অনুসন্ধান প্রজেক্ট- Project Blue Book-এর এর অ্যাড হক কমিটির মেম্বার করা হয়েছিলো। অনেকে দাবি করতো, ওরা এলিয়েন দেখেছে। ওদের কথা সত্যি হলেই তিনি বেশি খুশি হতেন, কিন্তু সত্যের প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো আরো বেশি। সবসময়ই বলে গেছেন, অন্য গ্রহের প্রাণীর সাথে যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, তবে চেষ্টা ছাড়েননি। ভিনগ্রহের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ নিয়ে তার লেখা সায়েন্স ফিকশন CONTACT বইয়ের উপর ভিত্তি করে মুভিও আছে একটা, একই নামে।
সায়েন্স ফিকশন CONTACT এর কথা তো বললামই। এছাড়াও তার লেখা বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে আছে Billions and Billions, Pale Blue Dot, Demon Haunted World, Broca’s Brain, The Dragons of Eden প্রভৃতি। তার মধ্যে Pale Blue Dot বইটার একটা অডিও ভার্সন বের করেছিলেন তার ভরাট, মোহনীয়, আবেগী কণ্ঠে। ওনার সেই কথাগুলো একটা ছেলেকে এতোই মুগ্ধ করেছিলো যে, সে ঐ অডিও থেকে ৪/৫ মিনিটের ক্লিপ নিয়ে নিজে দৃশ্য যোগ করে ভিডিও বানিয়েছে। সেই সিরিজেরই নাম “সেগান সিরিজ”।
আরেকটা বইয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, COSMOS: A Personal Voyage. এই বইটার সাথেই শুধু না, কসমস শব্দটার সাথেই কার্ল সেগানের নাম জুড়ে গেছে। অনেকেই যখন কসমস শব্দটা শোনে, সাথে সাথে একজনের চেহারা ভেসে ওঠে – কার্ল সেগানের চেহারা।
১৯৮০ সালে সেগান নিয়ে এলেন, তার জীবনের সবচেয়ে বিশাল প্রজেক্ট। এই প্রজেক্ট তাকে পরিচিত করে তুলেছিলো গোটা বিশ্বের কাছে। আমার মতে, তিনি বিজ্ঞানী থেকে বিপ্লবীতে পরিণত হয়েছিলো এই প্রজেক্টের মাধ্যমে। আর সেই প্রজেক্টটা হচ্ছে বিজ্ঞানভিত্তিক বিখ্যাত টেলিভিশন সিরিজ, Cosmos: A Personal Voyage. কসমস মানে সবকিছু, তাই তের পর্বের এই সিরিজের মধ্যে তিনি দেখালেন সবকিছু। অনুবাদকদের আড্ডা থেকে এই সিরিজের বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে।
আমরা যখন অর্বাচীনের মতো নিজ স্বার্থে পৃথিবী ধ্বংসে পারদর্শিতা দেখাচ্ছি, সেগান তখন কসমস সিরিজে গ্রীন হাউজ ইফেক্টের কথা বলে আমাদের সাবধান করার চেষ্টা করছেন, যুদ্ধের উদ্দেশ্যে পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন, কখনও শনির উপগ্রহ টাইটান দেখে হতাশ হচ্ছেন, আবার জুপিটারের উপগ্রহ ইউরোপার ভূপৃষ্ঠের বেশ কিছু অংশে পানির অস্তিত্ব আছে বলে প্রমাণ করছেন। ইউরোপা ভবিষ্যতে মানুষ বসবাসের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে বলে স্বপ্ন দেখছেন। পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছেন, আবার মরিয়া হয়ে আমাদের জন্য পৃথিবীর বাইরে আরেকটা বসত খুঁজে বেড়িয়েছেন!
সেগান প্রমাণ করেছেন, বিজ্ঞান শুধু ল্যাবরেটরীর বন্ধ দরজার অন্যদিকে আবদ্ধ থাকার বিষয় না। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের যেমন বিজ্ঞান চর্চার অধিকার আছে, তেমনই আছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্বন্ধে প্রত্যেকটা তথ্য জানার অধিকার! এই সিরিজ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বার বার। কর্নেলে ক্লাসের পর ক্লাস মিস গেছে; ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু ছিলো না। অন্য প্রফেসরদের কঠোর সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। কসমস দেখতে দেখতে অনেকবার মনে হয়েছে, কতো কষ্ট ভেতরে লুকিয়ে দিনের পর দিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন। হাসিমুখে আমাদেরকে সৃষ্টির আদি অন্তের গল্প শুনিয়ে গেছেন। কোনো নির্দিষ্ট মানুষ বা জাতি না- সমস্ত পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষকে এমনভাবে কখনও কি কেউ ভালোবাসতে পেরেছে?
প্রিয় সেগান,
আমি এখন ১৯৯৬ সালে। এখনও বেঁচে আছো তুমি। তিনবার মেরুদণ্ডের মজ্জা প্রতিস্থাপন (bone marrow transplant) করার অসম্ভব যন্ত্রণা ভোগ করার পর তোমাকে নিউমোনিয়ায় ধরেছে। কী করছো তুমি এখন? কষ্ট হচ্ছে খুব? শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা আছে নিশ্চয়ই! সেই কষ্ট? নাকি পৃথিবীকে আরও সময় দিতে পারলে না, সেই কষ্ট? বোকা মানুষগুলোকে আরেকটু বেশী ভালোবাসা দিতে পারলে না, সেই কষ্ট? নাকি এদের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের কোথাও আরেকটা ঘর খুঁজে দিয়ে যেতে পারলে না—সেই দুঃখটাই বেশি ছিলো?
আমার এক বন্ধু একবার আমাকে বলেছিলো, ‘‘তুমি মানুষকে নিয়ে এতো ভাবো? এক টুকরো সেগান তোমার ভেতরেও আছে।’’
আমার বন্ধুর কথা সত্য।
আমি মানতে চাই না, তুমি নেই।
পৃথিবীতে একটা মানুষও যতদিন তোমার আদর্শ বুকে নিয়ে কাজ করে যাবে, ততদিন তুমি থাকবে।
এই মহাবিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই হোক, তুমি থাকবে।
সেদিনও কেউ এমনভাবেই বলবে, “কার্ল এডওয়ার্ড সেগান, তোমার মতো করে কেউ কখনও আমাদের ভালোবাসেনি। তুমি বেঁচে থাকো অনন্তকাল”।
বিজ্ঞান যাত্রা শুভ হোক…….. খুব ভাল লাগল… 🙂
RIP of Karl Segan.❤❤❤❤❤♥️♥️♥️♥️♥️♥️💕💕💕💕