বিজ্ঞান সবসময় তথ্য, যুক্তি, প্রমাণ, তত্ত্ব, আর গণিতের সাহায্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। বিজ্ঞান গবেষণা কাজ করে যুক্তি, গণিত, আর প্রমাণের ভিত্তিতে। বিজ্ঞানে কোনোভাবেই অযৌক্তিক আর অপ্রমাণিত বিষয়ের স্থান নেই। বিজ্ঞান যখন কিছু আবিষ্কার করে, তখন সেই বিষয়কে অবশ্যই যৌক্তিক, প্রমাণ যোগ্য ও যথাযথ ক্ষেত্রে উপযুক্ত গাণিতিক ব্যাখ্যামূলক হতে হয়। শুধুমাত্র ধারণা করা হলেই তাকে আবিষ্কার বলা হয় না। ধারণাকে অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে তার সত্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞানের জগতে নতুন আবিষ্কার হিসাবে জায়গা করে নিতে হয়।
এবার আসি বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘প্রমাণ’ নিয়ে। সাধারণভাবে ‘নিজ চোখে দেখা’কেই প্রমাণ হিসাবে ধরে নিতে অনেকে অভ্যস্ত। এজন্য অনেক সময় এই ধরনের প্রশ্ন কানে আসে, “তুমি কি বিজ্ঞানের এই বিষয়টা নিজের চোখে দেখেছো?” বা, “কোনো বিজ্ঞানী কি এই ঘটনা নিজে ঘটতে দেখেছে?” এ ধরনের প্রশ্নের জন্য বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যবহৃত ‘প্রমাণ’-এর প্রকারভেদ বিষয়ে অজ্ঞতাই দায়ী। সেজন্য এখানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় যে বিভিন্ন ধরনের প্রমাণাদি নিয়ে কাজ করা হয়, সে সম্পর্কে সাধারণ কিছু ধারণা দিচ্ছি।
প্রতিটি নতুন আবিষ্কারের জন্য, প্রতিটি তত্ত্বকে প্রমাণ করার জন্য, প্রতিটি বৈজ্ঞানিক সূত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য হরেক কিসিমের অদ্ভুত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারস্থ হতে হয়। এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা থেকে আরেকটা আলাদা হয়ে থাকে। তবু কিছু মূল বিষয়ের উপর এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনেক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সে ধরনের কিছু সাধারণ প্রমাণের ধরন নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গ ও আলোক তরঙ্গ
প্রমাণের সবচেয়ে সাধারণ ঘটনা হচ্ছে, দেখতে পাওয়া। একটি ঘটনা ‘এই এই কারণে এভাবে ঘটছে’ এটা দেখতে পেলে সেটা হয় সাধারণ জনগণের চোখে সবচেয়ে সহজ প্রমাণ। কিন্তু মানুষ ‘চোখে দেখা’ বলতে যা বোঝায়, বিজ্ঞানের গবেষণাতেও কি তাই বোঝায়? উত্তর হচ্ছে ‘না’। বিজ্ঞানের ‘দেখার’ পরিসর অনেক ব্যাপক।
আলো এক প্রকার তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গ (Electro-magnetic wave)। যখন আলোক তরঙ্গ মানুষের চোখের রেটিনাতে বিম্ব তৈরি করে, তখন মানুষ তা দেখে। কিন্তু মানুষের চোখে আলোক তরঙ্গের খুব সামান্য অংশই ধরা পড়ে। তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য (Range) এক পিকো মিটার (১০-১২ মিটার) থেকে শুরু করে ১০০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। অথচ মানুষের চোখে আলো হিসাবে ধরা পরে ও মানুষ দেখতে পারে মাত্র ০.৭ মাইক্রোমিটার থেকে ০.৪ মাইক্রোমিটার অর্থাৎ ৭×১০-৭ থেকে ৪×১০-৭ মিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো। এর বাইরের আলোর জন্য মানুষের চোখ সংবেদনশীল নয়। অর্থাৎ এই রেঞ্জের বাইরের আলো মানুষ দেখতে পায় না। [১]
তাহলে বুঝাই যাচ্ছে, মানুষের দৃষ্টি কতটা ক্ষীণ! মানুষ দেখতে না পেলেও কিছু পশু-পাখি আর পতঙ্গের রয়েছে এরচেয়ে বেশি রেঞ্জের আলোক সংবেদী চোখ। যেমনঃ মৌমাছি লাল আলোর চেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলাল (Infrared) আলো দেখতে পায়।
মনুষ্য দৃষ্টিসীমার বাইরের এই তরঙ্গগুলো ‘দেখার’ জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র। যেমনঃ এক্সরে মেশিনে ধরা পড়ে X-Ray (তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ০.০৩ থেকে ৩ ন্যানোমিটার)। বাইরে থেকে শরীরের হাড় দেখা না গেলেও এক্সরে সংবেদী ফিল্মে যন্ত্রের সাহায্যে তোলা যায় হাড়ের ছবি। দেখা যায় মানুষের অভ্যন্তর ভাগ। আবার সবচেয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (১০ পিকোমিটার) অথচ সবচেয়ে শক্তিশালী গামা রশ্মি ব্যবহার করে কয়েক সেন্টিমিটার পুরু দেয়ালের ওপারে থাকা বস্তুটিকেও ঠিকই সনাক্ত করা সম্ভব।
এই তাড়িত-চৌম্বক তরঙ্গের আরেকটা রূপ হচ্ছে রেডিও ওয়েভ বা বেতার তরঙ্গ। বেতার তরঙ্গ তুলনামূলকভাবে বড়। ১ মি.মি. থেকে শুরু করে ১ কি.মি. পর্যন্ত এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে। এই ধরনের তরঙ্গ ব্যবহৃত হয় রেডিও, টেলিভিশন এমনকি আপনার হাতের মোবাইল ফোনটিতেও। এই তরঙ্গ চোখে দেখা না গেলেও যন্ত্র একে সনাক্ত করতে পারে, এবং তাতে থাকা নানাবিধ তথ্য পৌঁছে দেয় আপনাকে।
প্রতিটি উত্তপ্ত বস্তু থেকেই তাপমাত্রা অনুযায়ী নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো নির্গত হয়। কোনো বস্তুর তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে যখন সেটি লাল দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ছড়াতে শুরু করে, তখন আমরা বস্তুটিকে ক্রমাগত লাল হতে দেখি। তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে সেটি লাল থেকে ক্রমাগত হলুদ হতে হতে শেষে আমরা তাকে সাদা হয়ে যেতে দেখি, যাকে বলা হয় শ্বেততপ্ত। অর্থাৎ কোনো বস্তুর তাপমাত্রা শুধু থার্মোমিটার দিয়েই মাপতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বস্তু থেকে নির্গত আলোর রঙ কিংবা তরঙ্গদৈর্ঘ্য দিয়েও তার তাপমাত্রা নির্ণয় করা যায়।
সূর্য-সহ বিভিন্ন নক্ষত্রের উপরিপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এই পদ্ধতিতেই নির্ণয় করা হয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে সূর্যে কেউ থার্মোমিটার নিয়ে গিয়ে মেপে না এলেও সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যে ৫৮০০°সেলসিয়াস, সেটা পৃথিবী থেকে নির্ণয় করতে পারা অসম্ভব কিছু না।
দেখা যাচ্ছে, প্রামাণ্য তথ্যের উৎস হিসাবে যেকোনো তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গ ব্যবহার করা যেতে পারে, এমনকি মানুষ সেটা দেখতে না পেলেও। শুধু যন্ত্রের সাহায্যে ‘দেখা’ গেলেই চলবে।
শব্দ তরঙ্গ
শব্দ তরঙ্গ হচ্ছে কম্পনজনিত তরঙ্গ। কম্পন মানেই শব্দ উৎপন্ন হওয়া, আর শব্দ উৎপন্ন হওয়া মানেই কোনো না কোনো কম্পন, কোথাও না কোথাও কম্পন। তাহলে কোথাও কম্পন হচ্ছে কিনা তার প্রমাণ ‘শব্দ’। আর কোথাও শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে কিনা, তার প্রমাণ ‘কম্পনের প্রভাব’।
কম্পনের উৎসভেদে শব্দের তারতম্য ঘটে। কম্পনের মাত্রার উপর নির্ভর করে শব্দের মাত্রা পরিবর্তিত হয়। আবার এই উৎসের ধরনের উপর কম্পন এবং একই সাথে শব্দের প্রকার নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই শব্দ দিয়েই শব্দের উৎস সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
সাধারণ একটা উদাহরণ হল বাদ্যযন্ত্র ‘গিটার’। গিটারের বেস শুনলেই যে কেউ নিশ্চিত হতে পারবে, এটা গিটারের সবচেয়ে উপরের দিকের মোটা তার থেকে সৃষ্ট শব্দ এবং তারটা তুলনামূলকভাবে কম টানটান অবস্থায় আছে। আর লিড শুনলেই বোঝা যায়, সেটা সবচেয়ে চিকন এবং তুলনামূলক সবচেয়ে বেশি টানটান হয়ে থাকা তারের শব্দ। আরেকটা উদাহরণ হতে পারে ‘জল তরঙ্গ’। জল তরঙ্গের শব্দ শুনেই ধারণা করা যায়, কোন পাত্রে কী পরিমাণ জল আছে।
এখানেও সামনে এসে দাঁড়ায় মানুষের শ্রবণ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। কম্পন হলেই শব্দ উৎপন্ন হয়। তবে সব শব্দ মানুষ শুনতে পায় না। প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ২০ বার থেকে সর্বোচ্চ ২০,০০০ বার কম্পনের ফলে যে শব্দ উৎপন্ন হয়, শুধু সেগুলোই মানুষ কানে শোনে। ২০ হার্জ (Hz)-এর কম বা ২০,০০০ হার্জ (Hz)-এর বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ মানুষ শুনতে পায় না। অথচ বাদুড়ের চলাফেরার ব্যবস্থা ১ লক্ষ হার্জ কম্পাঙ্কের শব্দের উপর নির্ভরশীল, যা কখনোই মানুষের পক্ষে শোনা সম্ভব নয়।
এ ধরনের উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দকে বলা হয় আল্ট্রা সাউন্ড বা আল্ট্রাসনিক সাউন্ড। এ ধরনের শব্দ মানুষ শুনতে না পেলেও সেটা থেকে তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। বলছিলাম ‘আল্ট্রা সনোগ্রাফি’র কথা। মাতৃগর্ভে থাকা শিশুকে দেখার জন্য ব্যবহার করা হয় এই আল্ট্রা সাউন্ড বা শব্দোত্তর তরঙ্গ। এক্ষেত্রে অতি উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দতরঙ্গ প্রেরণ করা হয়, সেটি প্রতিফলিত হয়ে এসে যন্ত্রে ধরা পড়ে, যাকে প্রক্রিয়াজাত করে মনিটরে ছবির মত ফুটিয়ে তোলা হয় মাতৃগর্ভের শিশুকে।
এ ধরনের আল্ট্রাসনিক সাউন্ড বা শব্দোত্তর তরঙ্গ ব্যবহৃত হয় খনি সন্ধানেও। খনি বিশেষজ্ঞগণ কিন্তু খনিতে ঢুকে মাটির নিচে কোথায় কতটুকু তেল/গ্যাস/কয়লা আছে, তা দেখে আসেন না। বরং শব্দ তরঙ্গ মাটির নিচে প্রেরণ করা হয়। সেটি যখন বাধা পেয়ে ফিরে আসে, তখন তার প্রকৃতি, কম্পাংক ইত্যাদি পর্যালোচনা করে নির্ণয় করা যায় ভূগর্ভে কী আছে এবং কেমন পরিমাণে আছে। [২]
সকল তরঙ্গই শক্তি ও তথ্য সরবরাহ করে। এই তো কিছুদিন আগে আমরা নতুন এক ধরনের তরঙ্গের সন্ধান পেলাম, যার নাম Gravitational Wave. এটি প্রমাণ করে স্থান-কালের বক্রতা সম্পর্কিত অনেক কিছু।
রাসায়নিক বিক্রিয়া
বিজ্ঞান গবেষণা, বিশেষ করে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি নিয়ে গবেষণার একটি বড় উপাদান হলো রাসায়নিক বিক্রিয়া। একটি বিক্রিয়ার ফলাফল আমাদেরকে বিক্রিয়ক পদার্থ, বিক্রিয়া সংগঠনের সময়, পরিবেশ, অনুঘটক-সহ অনেক কিছুর অস্তিত্ব ও অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেয়। আবার নির্দিষ্ট বিক্রিয়া সংগঠিত হলে কখনো কখনো বিক্রিয়া সংগঠনের জায়গায় সুনির্দিষ্ট বিক্রিয়ক পদার্থের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়। যেমনঃ আমরা যে আগুন জ্বালাই, সেটা রসায়ন বিজ্ঞানের ভাষায় ‘দহন বিক্রিয়া’। যদি কোথাও আগুন ধরিয়ে দিলে আগুন জ্বলতে থাকে, তাহলে এটা নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে যে, আগুন জ্বলতে থাকা অংশে অক্সিজেনের উপস্থিতি রয়েছে। আর আগুন নিভে গেলে একাধিক কারণের মধ্যে একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, অক্সিজেনের অনুপস্থিতি।
নির্দিষ্ট পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবার পর যদি সুনির্দিষ্ট বিক্রিয়া সম্পন্ন হয়, যা বিক্রিয়ার ফলাফল ও উৎপাদ দিয়ে নির্ণয় করা হয়, তবে সুস্পষ্টভাবে বিক্রিয়ার আদিতে থাকা বিক্রিয়কের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে ধারণা করা সম্ভব। নির্দিষ্ট পরিবেশে নির্দিষ্ট বিক্রিয়া সংগঠনই সুনির্দিষ্ট বিক্রিয়কের প্রমাণ হিসাবে কাজ করে।
তেজস্ক্রিয়তা
তেজস্ক্রিয়তা একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রাকৃতিক ঘটনা। সীসার (Lead) চেয়ে বেশি পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট এবং ভারী মৌলগুলো প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিনিয়ত আলফা, বিটা, গামা প্রভৃতি তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত করে করে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, এবং একসময় সীসায় পরিণত হয়। এ ধরনের মৌলের ক্ষয়প্রাপ্তির ঘটনাটি নির্দিষ্ট গাণিতিক হার মেনে চলে, যাকে বলে অর্ধায়ু [কোনো স্থানে অবস্থিত তেজস্ক্রিয় মৌলের অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয় হতে একটি নির্দিষ্ট সময় লাগে। একেই বলে অর্ধায়ু]। অর্ধেক ক্ষয় হবার পর বাকি অর্ধেকের অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয় হতে আবার সমান সময় লাগে। প্রতি অর্ধেকেই অর্ধায়ুর সমান সময় লাগে।
তাই কোনো স্থানের তেজস্ক্রিয় পদার্থের পরিমাণ, অর্ধায়ু, এবং বাকি থাকা ‘আইসোটোপ’-এর পরিমাণ হিসাব করে সেখানে কী পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রথম অবস্থায় ছিলো ও সেটা কতদিন আগের, তা নির্ণয় করা যায়।[৩][৬] এই প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ও খনিতে থাকা তেজস্ক্রিয় পদার্থের অর্ধায়ু হিসাব করে (ইউরেনিয়াম থেকে সীসাতে পরিণত হবার সময় হিসেব করে) পৃথিবীর যে বয়স পাওয়া যায়, তা তাত্ত্বিকভাবে হিসাবকৃত বয়সের সাথে মিলে যায়। তাহলে সুদূর অতীতের বিভিন্ন বস্তু ও ঘটনার জন্য যে সময়ের হিসাব নির্ধারণ করা হয়, তার অনেকগুলো সেখান থেকে সংগৃহীত তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাওয়া যায়।
সুতরাং যে সময় মানুষের অস্তিত্বই ছিলো না, সে সময় কতদিন আগে ঘটেছিলো, সেটা কীভাবে নির্ণয় করা হয়, এই প্রশ্ন করা বাতুলতা মাত্র।
জৈব ও অজৈব স্তরীভবনঃ প্রতিটি স্তর একেকটি টাইমলাইন
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা অনেকেই হয়ত জানি, গাছের গুঁড়ির প্রস্থচ্ছেদের ‘চাকতি’-এর সংখ্যা দেখে গাছের বয়স বলে দেয়া যায়। কিন্তু এই একাধিক স্তরীভূত গোলাকার বলয়গুলো কী? কীভাবেই বা এগুলো গাছের বয়সের সাথে সম্পর্কিত?
উত্তরঃ গাছের বৃদ্ধি সব সময় সমান হারে হয় না। দেখা যায় কখনো গাছ দ্রুত বাড়ে, কখনো ধীরে। যখন কোনো গাছ দ্রুত বাড়ে, তখন তার কোষগুলো তুলনামূলক বড় এবং কম পুরুত্বের দেয়ালবিশিষ্ট হয়। এজন্য এ অংশের রঙ হালকা হয়। আবার যে সময়টাতে গাছ ধীরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তখনকার কোষগুলো তুলনামূলক ছোট ও বেশী পুরুত্বের দেয়ালবিশিষ্ট হয়। এ অংশের রঙ হয় গাঢ়। এভাবেই বৃদ্ধির তারতম্যের জন্য ‘রিং’-এর সৃষ্টি হয়।
সাধারণত প্রতি বছর একটি করে ‘রিং’ বা চাকতির সৃষ্টি হয়। এভাবে চাকতির সংখ্যা গুণে গাছের বয়সের ধারণা দেয়া সম্ভব। তবে আবহাওয়াজনিত পরিবর্তনের কারণে চাকতির গঠনে তারতম্য ঘটতে পারে। তাই সঠিকভাবে গাছের বয়স নির্ণয়ের জন্য শুধু চাকতির গণনা নয়, বরং আরো কিছু বিষয় পরীক্ষাগারে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। [৩][৪]
ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরেও এ ধরনের স্তরীভবন দেখা যায়। ভূ-প্রাকৃতিক নানা পরিবর্তনের ফলে নতুন স্তরের সৃষ্টি হয়। লক্ষ লক্ষ বছরের পরিবর্তনের ফলে একের পর এক স্তর জমে আজকের পৃথিবীর শিলাস্তর গঠিত হয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট স্তরে থাকা তেজস্ক্রিয় পদার্থ এবং তার আইসোটোপের অনুপাত থেকে সেই শিলাস্তর কত বছর আগে সৃষ্ট, তা নির্ণয় করা যায় [২][৪]। সেই সাথে ঐ শিলাস্তরে পাওয়া জীবাশ্মও যে সেই সময়কালের জীবাশ্ম, তাও বোঝা যায়।
উপসংহার
এতক্ষণ খুব সীমাবদ্ধভাবে ও বিদ্যালয়/বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রমাণযোগ্য কিছু প্রামাণ্য পদ্ধতির কথা বলা হলো। আজকের দিনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনেক বিশাল পরিসরে ছড়িয়ে আছে। অনেক বিস্তৃত তার পদ্ধতি। সকল পদ্ধতির প্রমাণ যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণিত দিয়ে প্রমাণ করা যাবে, তা নয়। জটিল বৈজ্ঞানিক বিষয়াদির প্রমাণ কখনো কখনো সহজ হলেও অনেকগুলোই বেশ জটিল এবং সেগুলো বুঝতে হলে উচ্চপর্যায়ের গণিত ও তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের জ্ঞান থাকতে হবে।
এখান থেকে অন্তত এতটুকু ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করি যে, আমাদের ‘দেখা’, ‘শোনা’, ‘অনুভব করা’র বাইরেও বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, যেগুলোর সাহায্যে নির্ভুলভাবে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সত্য উদঘাটিত হয়, এমনকি সেগুলো অবিশ্বাস্য শোনালেও।
তথ্যসূত্রঃ
১. Michigan State University
২. Australian Mining
৩. https://bigganjatra.org/determine_the_age_of_fossils/
৪. The University of Arizona
৫. http://www.forestry.gov.uk/
৬. University of California Museum of Paleontology