Evolution বা বিবর্তনের শাব্দিক অর্থ হল, কোনকিছুর ক্রমশ পরিবর্তন বা উন্নতি। বিবর্তনের মাধ্যমে সাধারণত কোনকিছু সরল ও অনুন্নত কাঠামো থেকে জটিল ও উন্নত কাঠামো লাভ করে। লক্ষ বছর আগের পশুশিকার আর ফল সংগ্রহ ভিত্তিক সমাজ বিবর্তিত হয়ে আজকের জটিল কাঠামো লাভ করেছে। ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগের সৌর নীহারিকা থেকে তৈরি ধূলিকণার স্তূপ বিবর্তিত হয়ে আজকের পৃথিবীর রূপ নিয়েছে। ডারউইনের Theory of biological evolution ব্যাখ্যা করে, কিভাবে প্রায় ৪ বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হওয়া এক কোষী প্রাণী থেকে natural selection, mutation, gene flow এবং genetic drift এর মাধ্যমে এক কোটিরও বেশি প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, জীবিত সত্তার (living being) মতো জড় পদার্থ অর্থাৎ রাসায়নিক পদার্থও বিবর্তিত হয়। Chemical evolution নিঃসন্দেহে একটি শ্বাস্রুদ্ধকর ঘটনা কারন, biological evolution জীবনের বিবর্তন ব্যাখ্যা করলেও প্রশ্ন থেকে যায়- পৃথিবীতে জীবন কীভাবে গঠিত হল। এর উত্তর রাসায়নিক বিবর্তনের মাধ্যমে পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন।
Chemical Evolution বা, রাসায়নিক বিবর্তন কী?
রাসায়নিক বিবর্তন সংগঠিত হয় তিনটি ধাপের মাধ্যমে।
১। পুনরাবৃত্তিমূলক উৎপাদন বা, repetitive production
২। বৈচিত্র্য বা, variation
৩। নির্বাচন বা, selection
১। পুনরাবৃত্তিমূলক উৎপাদনঃ
পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো নিয়মিত চক্রের মাধ্যমে সংগঠিত হয়। যেমন, দিন-রাত হওয়া, পানিচক্র, নাইট্রোজেন চক্র, অক্সিজেন চক্র ইত্যাদি। এই ঘটনাগুলো বারবার নতুন যৌগ তৈরি ও রাসায়নিক system তৈরি করতে থাকে।
এই ধাপটিই মূলত biological আর chemical evolutionএর মেকানিজমের পার্থক্য। জীবিত সত্তা যেখানে প্রজননের মাধ্যমে বৈচিত্র সৃষ্টি করে, রাসায়নিক পদার্থ পুনরাবৃত্তিমূলক উৎপাদনের মাধ্যমে সেটি করে থাকে।
২। বৈচিত্র্যঃ
এই ধাপটি biological evolution এর সদৃশ। পুনরাবৃত্তিমূলক উৎপাদনের মাধ্যমে randomly বৈচিত্রের সৃষ্টি হয়।
৩। নির্বাচনঃ
বৈচিত্র্যের কারণে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন যৌগগুলোর মধ্যে যেগুলো পরিবেশের সাথে খাপ খায় সেগুলো টিকে থাকে।
উদাহরণঃ
১। মিলার-ইয়ারি পরীক্ষাঃ
বিজ্ঞানী এলেকজেন্ডার অপারিন এবং জে. বি. এস. হেলডেন একটি হাইপোথিসিস দেন যে, আদিম পৃথিবীর পরিবেশ সরল অজৈব যৌগ থেকে জটিল জৈব যৌগ সৃষ্টির পক্ষে অনুকূল ছিল। ১৯৫২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, স্যান দিয়াগোতে স্ট্যানলি মিলার এবং হ্যারল্ড ইয়ারি পরীক্ষাগারে এটি প্রমাণ করেন।
তারা আদিম পৃথিবীর পরিবেশ সৃষ্টি করতে একটি যন্ত্র তৈরি করে। যন্ত্রে পানি ঢেলে তাপ দেন এবং কনডেনসার লাগিয়ে পানিচক্র তৈরি করেন। বায়ুমণ্ডল সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হাইড্রোজেন, মিথেন ও এমোনিয়ার মতো সাধারণ গ্যাস প্রবেশ করেন। এবং বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গের মাধ্যমে বজ্রপাত সৃষ্টি করেন। এভাবে যন্ত্রটি এক সপ্তাহ রেখে দিয়ে তারা শ্বাসরুদ্ধকর ফলাফল পান। তারা দেখতে পান তাদের সমুদ্র অর্থাৎ যন্ত্রের পানি গাঢ় বাদামি রঙ ধারণ করেছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় এখানে কয়েকটি জটিল যৌগের সাথে এমিনো এসিডও উৎপন্ন হয়েছে। যে এমিনো এসিড দিয়ে জীবিত কোষের প্রোটিন তৈরি এবং যা কেবল জীবিত কোষেই উৎপন্ন হতে পারে বলে ধারণা করা হতো।
২। ফ্যাটি এসিড গঠিত হওয়াঃ
গবেষণায় দেখা গেছে কার্বন মনোক্সাইড ও হাইড্রোজেনের মতো সাধারণ গ্যাসকে পৃথিবীর ভূত্বকে পাওয়া খনিজের সাথে উত্তপ্ত করলে অনেক জটিল কার্বন যৌগের সাথে ফ্যাটি এসিডও উৎপন্ন হয়। যদিও আগে ধারণা করা হতো ফ্যাটি এসিড জীবিত কোষের বইরে উৎপন্ন হওয়া সম্ভব না। এই বিক্রিয়া আদিম পৃথিবীর ম্যাগমা দ্বারা উত্তপ্ত হয়ে সংঘটিত হতে পারে। এবং চাপ বাড়ার সাথে সাথে ফ্যাটি এসিড ও অন্যান্য যৌগগুলো পানির স্তরে যেতে পারে। যেখানে natural selection বা, প্রাকৃতিক নির্বাচন হতে পারে- অর্থাৎ অধিকাংশ যৌগ পানিতে ভেসে যাবে অথবা তলিয়ে যাবে কিন্তু ফ্যাটি এসিড এর গঠনের কারণে পানিতে আটকে থাকে।
৩। স্বয়ং-একত্রীকরণ বা, self assembly:
এরকম অসংখ্য ফ্যাটি এসিড অণু তৈরি হওয়ায় পানিতে ফ্যাটি এসিডের ঘনত্ব বাড়তে থাকে এবং কয়েকটি ফ্যাটি এসিড মিলে স্থায়ী বলে পরিণত হয়। কারণ, পোলার পানি অণু ফ্যাটি এসিডের অক্সিজেন মাথাকে আকর্ষণ করে এবং কার্বন লেজকে বিকর্ষণ করে। ফলে কয়েক ফ্যাটি এসিড অণুর কার্বন লেজ একত্রিত হয়ে যায় (বলে পরিণত হয়)।
এরকম অসংখ্য বল মিলে ফ্যাটি এসিডের পর্দা তৈরি হয়। এ পর্দার বাইরের তল কার্বন লেজের তৈরি হওয়ায় পানি এদের বিকর্ষণ বল প্রয়োগ করে একটি ফাঁপা গোলকে পরিণত করে। এই গোলক অনেকটা জীবিত কোষের মেমব্রেন বা, তলের মতো। অবশ্যই এই গোলক জীবিত না এবং প্রজনন করতে পারে না কিন্তু এদের সম্পূর্ণ নতুন বৈশিষ্ট্য আছে। এই গোলক নিজেদের ভেতরে অন্যান্য যৌগকে ফাঁদে ফেলে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নতুন বিক্রিয়া ঘটাতে পারে।
গবেষকরা রাসায়নিক বিবর্তনের মাধ্যমে লম্বা কলাম উৎপন্ন হওয়ারও প্রমাণ পান যা অনেকটা DNAএর স্ট্রেইনের মতো।
৪। RNA সংশ্লেষণঃ
বিজ্ঞানীরা একটি মডেল প্রস্তাব করেন, বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইড, পানি ও নাইট্রোজেন থেকে আদিম পৃথিবীতে রাসায়নিক বিবর্তনের মাধ্যমে RNA সংশ্লেষিত হয়েছে। যদিও এই মডেল অনেক ত্রুটি আছে তবুও ধরে নেয়া যায়, RNA সংশ্লেষণের রহস্য উৎঘটিত হলে জীবনের উৎস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা পাওয়া যাবে।
পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি কিভাবে হল -এর সঠিক উত্তর বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না। কিংবা পৃথিবীর বাইরে কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা -এ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় নি। তবে আশা করা যায় রাসায়নিক বিবর্তন নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে অচিরেই এসবের উত্তর পাওয়া যাবে। কারণ, আমাদের দেহ তো প্রকৃতপক্ষে কিছু অতি সাধারণ কিছু রাসায়নিক পদার্থের স্তূপ মাত্র।
তথ্যসূত্রঃ
১। http://www.abenteuer-universum.de/pdf/miller_1953.pdf
২। http://onlinelibrary.wiley.com/doi/10.1002/ar.10154/full
৩। http://pubs.acs.org/doi/abs/10.1021/ar300266q