অতিমাত্রায় সরলীকরণ করে এক বাক্যে বলতে গেলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হচ্ছে চিকিৎসাব্যবস্থার একটি পরীক্ষা পদ্ধতি যাতে নতুন কোন চিকিৎসাব্যবস্থা রোগীর (Trial subject) উপর প্রয়োগের মাধ্যমে সেটা কতটা কার্যকরী কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ তা বাস্তবিকভাবে নির্ণয় করা হয়।
সর্বপ্রথম ১৭৫৩ সালে Dr. James Lind এর স্কার্ভি রোগের চিকিৎসা নির্ণয় পদ্ধতি “A Treatise of the Scurvy” থেকে আধুনিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পদ্ধতির বিবৃত ধারণা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে এই পদ্ধতিতে নানা পরিবর্তন, পরিবর্ধন, উন্নতি সাধন এবং সর্বশেষে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করা রোগীদের (Trial Subject) ট্রায়াল সম্পর্কিত তথ্য জানার অধিকার সংরক্ষণ ও পূর্ণ সম্মতির বাধ্যবাধকতা সংযুক্তির মাধ্যমে আধুনিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পদ্ধতি প্রাথমিকভাবে পূর্ণতা লাভ করে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কী?
১৯৬৮ সালের যুক্তরাষ্ট্রের মেডিসিন অ্যাক্ট এর অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সংজ্ঞা অনেকটা এরকম –
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হল এক বা একাধিক অনুসন্ধানমূলক গবেষণার পরম্পরা যাতে এক বা একাধিক ঔষধ বা চিকিৎসাব্যবস্থার সমন্বয় একটি সুনির্দিষ্ট বিবরণী অনুযায়ী এক বা একাধিক রোগীর উপর প্রয়োগ করে বিবরণী অনুযায়ী রোগীর উপর সেই ঔষধ বা চিকিৎসাব্যবস্থার প্রভাব প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে নিরীক্ষণ করা হয় এবং নির্ধারণ করা হয় এই পরীক্ষণীয় ঔষধ বা চিকিৎসাব্যবস্থা আদৌ কার্যকরী কিনা, কার্যকরী হলে কতটুকু কার্যকরী ও কতটা ক্ষতিকর এবং প্রাথমিক বিবরণীর বাইরে কোনো প্রভাব আছে কিনা যা রোগীর জন্য হিতকর অথবা ক্ষতিকর হতে পারে।
সহজে বললে World Health Organization (WHO) এর বিবৃতি অনুসারে বলা যায় –
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হচ্ছে এক ধরনের গবেষণা যা কোনো নতুন ঔষধ, জৈবিক পণ্য,, শল্য চিকিৎসা, তেজস্ক্রিয় চিকিৎসা, আচরণগত চিকিৎসা, কৃত্রিম প্রত্যঙ্গ/যন্ত্র ইত্যাদি উপযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক রোগীর দেহে প্রয়োগের মাধ্যমে মানবদেহে এগুলোর প্রভাব, কার্যকারিতা, সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিক এবং বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে কতটা উন্নত তা প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে নির্ণয় করে থাকে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর ধাপ সমূহ
একটি নতুন বা অপেক্ষাকৃত উন্নত চিকিৎসার প্রাথমিক আবিষ্কারের ঘোষণার পর থেকে শুরু করে কার্যকরী হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া এবং বাজারজাত পরবর্তী পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত কয়েকটি ধাপে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রতিটি ধাপে নব্য চিকিৎসাপদ্ধতিকে উত্তীর্ণ হতে হয় তুলনামূলক কঠিন পরীক্ষণ ও অধিক সংখ্যক ট্রায়াল সাবজেক্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রামাণ্য কার্যকারিতার সাপেক্ষে।
Pre-Clinical Trial
প্রি-ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশনে প্রথমেই নতুন ঔষধকে নানারকম ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ হয়ে এর কার্যকারিতার সম্ভাব্যতা প্রদর্শন করতে হয়। এর পর হয় আসে Animal Study. পরীক্ষণীয় নতুন ঔষধ প্রয়োগ করা হয় বিবিধ প্রাণীর দেহে। এই ইনভেস্টিগেশন থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে যা মূল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নীতি নির্ধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. Drug Safety: মানবদেহে নিরাপদভাবে সর্বোচ্চ কত মাত্রার ডোজ দেয়া যাবে।
২. Pharmacodynamics: দেহাভ্যন্তরে কার্যপ্রণালী ও প্রতিক্রিয়া।
৩. Pharmacokinetics: দেহাভ্যন্তরে শোষণ, বণ্টন,, বিপাক এবং অন্য ঔষধের সাথে মিথস্ক্রিয়া।
প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মূলত নতুন ঔষধ/চিকিৎসা মানবদেহে প্রয়োগের জন্য নিরাপদ কিনা তা পরীক্ষা করে। মূল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর অনুমোদনের জন্য আবিষ্কারক/উৎপাদনকারীকে তাঁর প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তথ্য এবং ট্রায়ালের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্ত তথ্য IND (Investigational New Drug) approval এর জন্য জমা দিয়ে U.S. Food and Drug Administration (FDA) বরাবর আবেদন করতে হয়।
আবিষ্কারক/উৎপাদনকারী প্রদত্ত সমস্ত তথ্য পর্যালোচনা করে Human Subject এর উপর প্রয়োগ করা নিরাপদ বোধ করলে FDA নতুন ঔষধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর ছাড়পত্র প্রদান করে। এরপর শুরু হয় মূল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম ধাপ।
Clinical Trial Phase-I
একে Human Pharmacology Study ও বলা হয়। এই ধাপে প্রথমবারের মত মানবদেহে প্রয়োগ করা হয় নতুন ঔষধ। অল্প সংখ্যক রোগীর দেহে (২০ থেকে ১০০ জন) যাদের রোগের প্রাবল্য কম ও শারীরিকভাবে সবল তাদের উপর কয়েকমাস এই ঔষধ প্রয়োগ করে ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং মানবদেহে এই ঔষধের সর্বোচ্চ ডোজ নির্ধারণ করা হয় এই ধাপে।
আনুমানিক শতকরা ৭০ ভাগ ঔষধ এই ট্রায়ালের পরের ধাপের জন্য উত্তীর্ণ হয়। বাকি ৩০ ভাগ হয়ত কোনোটি দেখা যায় প্রচুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অথবা হয়ত কোনোটি এত বেশি বা এত কম পরিমাণ ব্যবহার করা প্রয়োজন যা স্বাভাবিক নয়।
Clinical Trial Phase-II
একে Therapeutic Exploratory Trial ও বলা হয়ে থাকে। এই ধাপে আগের ধাপের চেয়ে বেশি সংখ্যক (১০০ থেকে ৩০০ জন) রোগীর দেহে প্রয়োগ করা হয় ট্রায়ালের প্রথম ধাপ পার করে আসা ঔষধ। ট্রায়াল চলতে পারে কয়েক মাস থেকে দুই বছর ব্যাপী। এই ধাপের অনুসন্ধানের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয় পরবর্তী ধাপের ট্রায়ালের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য। ট্রায়ালের এই ধাপে নতুন ঔষধের কার্যকারিতা অনেকটা অনুধাবন করা যায়। এছাড়া সমসাময়িক অন্য ঔষধের সাথে তুলনামূলক পার্থক্য, ঔষধের ডোজ এর ধরন (মৌখিক অথবা ইনজেকশন) ও পরিমাণ নির্ধারণ সহ পরবর্তী ধাপের ট্রায়ালের জন্য উপযুক্ত কিনা সে সম্পর্কিত ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করা হয় ট্রায়ালের দ্বিতীয় ধাপে।
এই ধাপে অংশ গ্রহণ করা মোটামুটি ৩৩ শতাংশ ঔষধ পরবর্তী ধাপের জন্য উত্তীর্ণ হয়। বাকিগুলো পর্যাপ্ত কার্যকারিতা ও অন্যান্য অনিরাপদ বৈশিষ্ট্যের কারণে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
Clinical Trial Phase-III
Therapeutic Confirmatory, Comparative Efficacy নামেও পরিচিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপ। ঔষধের নিরাপত্তা, ধরণ, ডোজ ইত্যাদি পূর্বের ধাপ গুলোতে নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর এই ধাপে ঔষধটি নানা ধরনের শারীরিক অবস্থা সম্পন্ন বৃহৎ সংখ্যক (৩০০ থেকে ৩০০০ জন) রোগীর উপর প্রয়োগ করে এর সার্বজনীনতা অনুসন্ধান করা হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন শারীরিক অবস্থায় এর কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিরীক্ষণ করা হয়। তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ১ বছর থেকে ৪ বছর পর্যন্ত চলমান হতে পারে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপটি বিভিন্ন ধরনের ট্রায়াল ডিজাইনে পরিচালিত হতে পারে। এর মধ্যে দুটি বহুল প্রচলিত ডিজাইন হচ্ছে Randomized placebo-controlled trial এবং Randomized positive-control study.
তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শুরুতেই সাবজেক্টদের ট্রায়াল ডিজাইন অনুযায়ী বেশ কিছু দলে ভাগ করা হয়। Placebo-controlled trial প্রক্রিয়ায় এদের কিছু দলের উপর প্রয়োগ করা হয় নিরীক্ষণে থাকা নতুন ঔষধ আর অন্য দলগুলোকে প্রয়োগ করা হয় প্লাসিবো ঔষধ বা ডামি ঔষধ। অন্যদিকে Positive-control study প্রক্রিয়ায় এদের কিছু দলের উপর প্রয়োগ করা হয় নিরীক্ষণে থাকা নতুন ঔষধ আর অন্য দলগুলোকে প্রয়োগ করা হয় সমসাময়িক প্রচলিত ঔষধ।
এরপর ট্রায়াল ডিজাইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময় চিকিৎসা চলার পর সকল দলের উপর ঔষধের প্রভাব, কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি সমস্ত তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করে নিরূপণ করা হয় নতুন ঔষধের প্রকৃত কার্যকারিতা (Placebo-controlled trial এর ক্ষেত্রে) এবং সমসাময়িক প্রচলিত ঔষধের সাপেক্ষে সাফল্য-ব্যর্থতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তুলনামূলক গ্রহণযোগ্যতা (Positive-control study এর ক্ষেত্রে)।
তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের একটি চমকপ্রদ ও প্রামাণ্য দিক হল সাবজেক্টগণ এটা জানতে পারছেন যে তাঁরা একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অংশ কিন্তু কাকে নতুন ঔষধ, কাকে প্লাসিবো আর কাকেই বা সমসাময়িক প্রচলিত ঔষধ দেয়া হচ্ছে তা সাবজেক্ট কে জানানো হয় না। একে বলা হয় “Blind Trial”. ব্লাইন্ড ট্রায়ালের উদ্দেশ্য হল অযাচিত পারিপার্শ্বিক মিথস্ক্রিয়া, নতুন ঔষধের ক্ষেত্রে অযাচিত প্লাসিবো ইফেক্ট ও অন্যান্য নানাবিধ চিকিৎসক ও ব্যক্তিপর্যায়ের পক্ষপাত (Medical & Personal Bias) দুর করা। এতে ট্রায়ালের ফলাফলে সহজে একটি বাস্তবসম্মত ও প্রকৃত কার্যকারিতার চিত্র উঠে আসে। সিঙ্গেল ব্লাইন্ড ট্রায়ালে এই তথ্য শুধুমাত্র রোগীকে জানানো হয় না। অপরদিকে ডাবল ব্লাইন্ড ট্রায়ালে রোগী এবং চিকিৎসক কেউই জানে না কোন দলে কি ধরনের ঔষধের প্রয়োগ হচ্ছে। অতি সম্প্রতি তথ্য বিশ্লেষকদের সম্পৃক্ত করে ট্রায়াল ডিজাইন করা হচ্ছে যাকে বলা হয় ট্রিপল ব্লাইন্ড ট্রায়াল। এতে তথ্য বিশ্লেষক পর্যায় থেকেও যাতে কোন পারিসাংখ্যিক পক্ষপাতদুষ্ট (Statistically Biased) ফলাফল আসতে না পারে সে বিষয়টি আরো দৃঢ় হচ্ছে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপ প্রচুর সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে থাকা রোগীর উপর অনেকদিন ধরে পরিচালিত হয় যাতে নতুন ঔষধের কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার একটি বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। ট্রায়ালের চূড়ান্ত ফলাফলে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে নতুন ঔষধ/চিকিৎসার কার্যকারিতা ও ঝুঁকির মাত্রা প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে উন্নত বলে প্রতীয়মান হলে নতুন ঔষধ বা চিকিৎসাব্যবস্থা FDA কর্তৃক স্বীকৃতি পায় ও বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়। ট্রায়ালের এই ধাপে অংশ নেয়া ঔষধের মধ্যে শতকরা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ঔষধ আধুনিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন ঔষধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাকি গুলো প্রচলিত চিকিৎসার তুলনায় উন্নত বিবেচিত না হওয়ায় FDA কর্তৃক স্বীকৃতি পায় না।
Clinical Trial Phase-IV
FDA কর্তৃক স্বীকৃতি ও বাজারজাতকরণের অনুমোদনের পরেও আরেকটি ট্রায়াল পরিচালিত হয়ে থাকে। এটি একটি Post Marketing Trial. অনেক সময় ঔষধ বা চিকিৎসাব্যবস্থা অনুমোদনের একটি শর্ত থাকে এমন যে, কোন স্পন্সর এই ঔষধ বাজারজাত হবার পর ব্যাপক পরিসরে ব্যবহারকারীদের উপর দীর্ঘদিন ধরে এর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে যাবে কোনো খুব বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিংবা ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপের চেয়েও লম্বা সময় ব্যবহার করলে ব্যবহারকারীর উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় কিনা তা সনাক্তকরণের জন্য।
“ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল”– আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় প্রামাণ্যতার রূপরেখা
মানবসভ্যতায় চিকিৎসা চর্চার ইতিহাস বহু পুরাতন এবং স্থানভেদে নানা প্রকারের চিকিৎসা পদ্ধতি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে প্রচলিত হয়ে এসেছে। পূর্ব প্রজন্মের রেখে যাওয়া চিকিৎসা চর্চার জ্ঞান এবং নতুন কোন পদ্ধতি ব্যবহারে রোগের দৃষ্টিগ্রাহ্য উপশমের উপর ভিত্তি করেই চলে আসছিল পৃথিবীর নানা অঞ্চলের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভিন্ন ভিন্ন পথে। কিন্তু বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতিকল্পে ও নিরাপদ চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলতে ক্রমান্বয়ে বিবিধ আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সংগঠন কর্তৃক প্রণীত হয় Medicine Act, Medicine Regulation এবং নানা দেশে প্রণীত হয় নিজস্ব Drug/Medicine Law। এসকল নীতিমালার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবার ক্ষেত্রে “ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল” এর মাধ্যমে ঔষধ বা অন্য চিকিৎসাব্যবস্থার কার্যকারিতা নিরূপণ করার বাধ্যবাধকতা। এর পর থেকে চিকিৎসাপদ্ধতির নানা ধারা উপধারার মধ্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও অন্যান্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে প্রামাণ্য চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয় আধুনিক রসায়ন, জৈবরসায়ন ও শল্যচিকিৎসা (Surgery) ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি যাকে আমরা মূলধারার চিকিৎসা পদ্ধতি বলে জানি। অন্যদিকে আঞ্চলিক এবং স্বল্প প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি (যেমন চাইনিজ হারবাল, ভারতীয় ইউনানি ও আয়ুর্বেদ, আকুপ্রেশার, আকুপাংচার, কাপিং ইত্যাদি) যাদেরকে “ভিন্নধারার চিকিৎসা” বা “Alternative Medicine” বলা হয় সেগুলো যথাযথ প্রমাণের অভাবে এবং বিশ্বাসভিত্তিক ও দুর্বল রাসায়নিক অনুকল্প ভিত্তিক চিকিৎসাব্যবস্থাগুলো (যেমনঃ হোমিওপ্যাথি) “Not effective more than placebo” নীতিতে পেছনে পরে যায়। সামগ্রিকভাবে পুরনো বিশ্বাসভিত্তিক ও ক্ষীণ তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা নানাবিধ ভিন্নধারার চিকিৎসাপদ্ধতির পরিব্যাপ্তি অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পরে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতেও মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পরে যথাযথ প্রমাণভিত্তিক তথ্যের অভাবে।
বর্তমানে যেকোনো নতুন ঔষধ বা চিকিৎসাব্যবস্থাকেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কঠোর ধাপ অনুসরণ করে যথাযথভাবে নিজের কার্যকারিতা প্রমাণ সাপেক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিতে হয়। এক্ষেত্রে ভিন্নধারার চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো এখনো অনেক পিছিয়ে। অনেকে দাবি করে থাকেন এই পিছিয়ে থাকাটা পর্যাপ্ত ফান্ডিং এর অভাব এবং ট্রায়ালের ব্যাপারে যথেষ্ট দৃষ্টিপাত না করার কারণে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায় National Center for Complementary and Alternative Medicine (NCCAM), বর্তমানে National Center for Complementary and Integrative Health (NCCIH) বিগত দুই দশকে অল্টারনেটিভ মেডিসিন গবেষণায় প্রায় ১.২৮৮ বিলিয়ন ডলারের ফান্ডিং করেছে। কিন্তু দুই দশকের লম্বা সময় গবেষণার পরেও মূলধারার চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধানের মত কার্যকারিতার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়া দেহাভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গের গুরুতর অসুস্থতায় যেখানে শল্য চিকিৎসা বাধ্যতামূলক সেখানে “ভিন্নধারার চিকিৎসা” পদ্ধতি দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবেই অকার্যকর।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুধু নতুন ঔষধ কিংবা চিকিৎসা ব্যবস্থাকে যাচাইপূর্বক বৈধতাই প্রদান করে না বরং এর যাচাই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন অংশে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ঔষধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার নানাবিধ পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধন করে একে অধিক নিরাপদ ও কার্যকরী করে তুলতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উন্নততর চিকিৎসা উদ্ভাবনে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অপরিহার্য একটি প্রক্রিয়া। অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন কোনো ঔষধ বা চিকিৎসা আবিষ্কারের সুযোগও তৈরি হয়ে থাকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাপ্ত তথ্যের সমন্বয়ে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নৈতিক সীমারেখার আবির্ভাব
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে মানবদেহে নতুন ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। তবে সেটি হতে হয় “সাবজেক্ট” এর অনুমোদন সাপেক্ষে এবং “সাবজেক্ট” এর পর্যাপ্ত নিরাপত্তার কথা বিবেচনাপূর্বক। কিন্তু সাবজেক্ট এর অনুমোদন, নিরাপত্তা কিংবা চিকিৎসা গবেষণায় মানবিকতার কোনো কার্যকরী দালিলিক সীমারেখা টানা হয়নি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে উদ্ঘাটিত হয়েছে জার্মান ও জাপানিজ এই দুই পরাজিত শক্তির যুদ্ধকালীন যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক জনগণের উপর পরিচালিত অবর্ণনীয় অমানবিক মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্টেশন সংশ্লিষ্ট তথ্য।
জার্মান নাৎসি বাহিনীর যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পে নিয়ম-নীতি, নিরাপত্তা, মানবিকতার তোয়াক্কা না করে জীবিত যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক মানুষের উপর চালানো হয়েছে নানা রকম লোমহর্ষক অমানবিক পরীক্ষানিরীক্ষা। এসব অমানবিক পরীক্ষানিরীক্ষার শিকার বহু মানুষ সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকে সেসব পরীক্ষানিরীক্ষার প্রলম্বিত প্রভাব বয়ে বেড়িয়েছেন আজীবন। একেবারে সুনির্দিষ্ট তথ্যনির্ভর প্রমাণের উপর ভিত্তি করে জার্মান বাহিনীর পরীক্ষানিরীক্ষার শিকার মানুষের সর্বনিম্ন সংখ্যা ১৫ সহস্রাধিক। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই অমানবিকতার শিকার মানুষের প্রকৃত সংখ্যা আরো কয়েক গুণ বেশি।
এছাড়া জাপান আর্মির “Unit 731” আরেকটি অমানবিক হিউম্যান এক্সপেরিমেন্টেশন ফ্যাসিলিটি যেখানে শুধু জীবিত বন্দিদের উপর পরীক্ষানিরীক্ষাই নয়, গবেষণা করা হয়েছে নানারকম রাসায়নিক অস্ত্র ও জৈব অস্ত্র নির্মাণের জন্য। এমনকি পরীক্ষণীয় জৈব অস্ত্র ছড়িয়ে দেয় হয়েছিল আশেপাশের এলাকায় বেসামরিক জনসাধারণের মাঝে, এর কার্যক্ষমতা নিরূপণের নিমিত্তে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটা ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পটভূমিতে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে যুদ্ধের মানবিক নীতিমালা ও বেসামরিক জনসাধারণের নিরাপত্তার লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালে প্রণীত হয় “জেনেভা কনভেনশন”।
অন্যদিকে নাৎসি বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বৈচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গঠিত International Military Tribunal (IMT) এর বিচারকার্যের একটি ছিল “United States v Karl Brandt et al” যা “Doctor’s Trial” নামেও পরিচিত। এখানে বিশ জন ডাক্তার ও চিকিৎসা গবেষক এবং তিনজন প্রশাসনিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়। এই বিচারের রায় থেকে উৎসারিত হয় দশটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি যা ঐতিহাসিক “Nuremberg Code” নামে পরিচিত। প্রথমবারের মত ১৯৪৯ সালে আন্তর্জাতিকভাবে লিপিবদ্ধ হয় কিছু নীতিমালা যা জীবিত মানবদেহে যেকোনো প্রকার পরীক্ষানিরীক্ষা করার ব্যাপারে অনুমোদনের ক্ষেত্রে নৈতিক সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করে দেয়। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে World Medical Association (WMA) এই Nuremberg Code কে আত্তীকরণ করে আরো বিবর্ধিত পরিসরে জীবিত মানবদেহে যেকোনো গবেষণার ক্ষেত্রে নৈতিক সীমানার আন্তর্জাতিক নীতিমালা “Declaration of Helsinki” প্রণয়ন করে যা এখন পর্যন্ত মানবদেহে কোনো পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে অনুসরণ করা হয় এবং বিভিন্ন সময়ে নানা প্রেক্ষাপটে এই নীতিমালা নিয়মিত হালনাগাদ করা হয়ে থাকে। এই নীতিমালার প্রধান উদ্দেশ্য যেকোনো মেডিক্যাল রিসার্চের অনুমোদনের ক্ষেত্রে “হিউম্যান সাবজেক্ট” এর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিধান এবং “সাবজেক্ট” এর পূর্ণ সম্মতির বাধ্যবাধকতা বজায় রাখা। Declaration of Helsinki অনুযায়ী নতুন কোনো ঔষধ, চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসা গবেষণার প্রয়োজনে কোনো মানুষের উপর পরীক্ষানিরীক্ষার দরকার হলে অবশ্যই সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় “সাবজেক্ট” এর পূর্ণ সম্মতি থাকতে হবে এবং রিসার্চের যেকোনো পর্যায়ে “সাবজেক্ট” এর পূর্ণ অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে চলমান পরীক্ষানিরীক্ষা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে। গবেষণার কোনো পর্যায়ের অবশ্যম্ভাবী ফলাফল যদি “হিউম্যান সাবজেক্ট” এর মৃত্যু অথবা বিকলাঙ্গতা হয় তাহলে তা নিষিদ্ধ। কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ডিজাইনে এসমস্ত নিরাপত্তামূলক ও নৈতিক বাধ্যবাধকতার ব্যত্যয় ঘটলে তা অনুমোদিত ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত তো হবেই না তদুপরি যদি কেউ এই নীতিমালার বাইরে গিয়ে কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালিত করে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শাস্তিযোগ্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হবে।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সুসংজ্ঞায়ন ও নৈতিকতার সীমারেখা নির্ধারণের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় বহু নতুন ও যুগান্তকারী চিকিৎসা পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটেছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কঠোর ধাপ অনুসরণ করে প্রমাণিত হবার পরই এসব চিকিৎসা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়নে অংশ নিয়েছে। বর্তমানে চিকিৎসা গবেষণায় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই বিবেচিত। উপরন্তু অত্যাধুনিক কম্পিউটারাইজড গবেষণাগার, চিকিৎসা গবেষণায় অটোমেশন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির ব্যবহার ইত্যাদি শুধু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কার্যকারিতাই বৃদ্ধি করেনি, চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও নব্য চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উত্তর উত্তর বৃদ্ধি করেছে। সামগ্রিকভাবে “ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল” প্রক্রিয়ার উপস্থিতি ব্যতীত আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার অস্তিত্ব কল্পনাতীত।
তথ্যসূত্র
১. Key Concepts of Clinical Trials: A Narrative Review – Postgraduate Medicine
DOI: 10.3810/pgm.2011.09.2475, PMID: 21904102, PMCID: PMC3272827, NIHMSID: NIHMS350738, NCBI Link, BAK Link
২. What is a clinical trial? – British Journal of Clinical Pharmacology
DOI: 10.1111/j.1365-2125.2004.02184.x, PMID: 15206985, PMCID: PMC1884542, NCBI Link, BAK Link
৩. Clinical trials: Overview – World Health Organization (WHO)
৪. The Drug Development Process – U.S. Food & Drug Administration (FDA)
৫. Exposing the evidence gap for complementary and alternative medicine to be integrated into science-based medicine – Journal of the Royal Society of Medicine
DOI: 10.1258/jrsm.2011.100271, PMID: 21502214, PMCID: PMC3078611, NCBI Link, BAK Link
৬. NCCIH Funding: Appropriations History – National Center for Complementary and Integrative Health (NCCIH)
৭. The victims of unethical human experiments and coerced research under National Socialism – Endeavour Journal
DOI: 10.1016/j.endeavour.2015.10.005, PMID: 26749461, PMCID: PMC4822534, NCBI Link, BAK Link
৮. United States Responses to Japanese Wartime Inhuman Experimentation after World War II: National Security and Wartime Exigency – Cambridge Quarterly of Healthcare Ethics
DOI: 10.1017/S0963180113000753, PMID: 24534743, PMCID: PMC4487829, EMSID: EMS63721, NCBI Link, BAK Link
৯. The Geneva Conventions of 1949 and their Additional Protocols – International Committee of the Red Cross (ICRC)
১০. The Nuremberg Code–A critique – Perspectives in Clinical Research Journal
DOI: 10.4103/2229-3485.80371, PMID: 21731859, PMCID: PMC3121268, NCBI Link, BAK Link
১১. Nuremberg Code – THE UNIVERSITY of NORTH CAROLINA at CHAPEL HILL Research Material
১২. Declaration of Helsinki – Ethical Principles for Medical Research Involving Human Subjects – World Medical Association (WMA)
১৩. Artificial Intelligence Applied to clinical trials: opportunities and challenges – Review Paper, Health and Technology Journal by Springer and the IUPESM in cooperation with WHO
DOI: 10.1007/s12553-023-00738-2, PMID: 36923325, PMCID: PMC9974218, NCBI Link, BAK Link