উনিশ শতকের প্রথম দিকে মাইকেল ফ্যারাডে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন যে ইলেট্রিক কারেন্টের চারপাশে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়। একটি সার্কিটের ইলেক্ট্রিক কারেন্টের পরিবর্তন অন্য একটি সার্কিটকে প্রভাবিত করতে পারে। সেক্ষেত্রে পাশাপাশি রাখা সার্কিটের মধ্যে কোনো তারের সংযোগ প্রয়োজন নেই। এইসব বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে ফ্যারাডে তার তড়িৎচৌম্বক আবেশ সম্পর্কিত তত্ত্ব দেন। এই ধারণাই আমাদের তারবিহীন(Wireless) প্রযুক্তির দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, ১৮৬৪ সালে গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেন যে ইলেট্রিক্যাল আলোড়ন একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। তিনি ফ্যারাডের ধারণাগুলোকেও গাণিতিক রূপ দিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, একদিন তাড়িৎচৌম্বক শক্তির উৎস থেকে আলোর বেগে বহুদূরে পাঠানো যাবে। এর জন্য কোনো তারের প্রয়োজন পড়বে না। এটাই মূলত ছিলো wireless technology বা তারহীন প্রযুক্তির প্রাথমিক আইডিয়া। আর এর কিছুকাল পরেই তৈরি শুরু হয় বাণিজ্যিক বেতার (commercial radio)।
একসময় প্রায় সবার বাসাতেই একটা রেডিও সেট থাকতো; চায়ের দোকানগুলোতেও। এখন অবশ্য সেই রেডিও-এর চল নেই। তবে মোবাইলে FM রেডিও শোনার ধারাটা এখনো বজায় আছে। এই রেডিও প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে সেই বিষয়েই প্রাথমিক বর্ণনা করব। পরে আমরা তাত্ত্বিক বিষয়কগুলো নিয়ে আরও গভীর আলোচনা করবো।
রেডিও শব্দটা ইংরেজি Radius থেকে আসলেও এর বাংলা পরিভাষা ‘বেতার’, যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘তারহীন’। রেডিও প্রযুক্তি হলো তারহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় রেডিও চ্যানেলে অনুষ্ঠান সম্প্রচার, মোবাইল টেলিযোগাযোগ, রাডার ইত্যাদিতে। স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ রাখতেও এটি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আছে রেডিও টেলিস্কোপ, যা দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা গবেষণা করা হয়।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বহু দূরে কোনো সংকেত বা মেসেজ পাঠানোর ক্ষেত্রে সেই মেসেজটাকে আগে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বা তাড়িৎচৌম্বক (EM) তরঙ্গে রূপান্তর করা হয়। ধরুন আপনি আপনার গাওয়া একটি গান প্রচার করবেন আপনার বাসা থেকে, যা বহু দূরে বসে শ্রোতারা উপভোগ করতে পারবে। এর জন্য প্রথমেই আপনাকে এই গানের শব্দ তরঙ্গকে EM তরঙ্গে রূপান্তর করতে হবে। তারপর আপনি এটি পাঠিয়ে দিতে পারবেন দূরের বেতার গ্রাহকযন্ত্রগুলোতে। তবে এক্ষেত্রে আরও কিছু কাহিনী আছে। যেমন শব্দ তরঙ্গ খুব দুর্বল, আর একে EM তরঙ্গে রূপান্তরের পরও তা খুব দুর্বল থাকে। এই তরঙ্গ খুব বেশি দূরে পাঠানোর যোগ্য না। একে শক্তিশালী করার জন্য যেটা করা হয় সেই প্রক্রিয়ার নাম মডুলেশন (Modulation)।
মেসেজ সিগনাল যদি শক্তিশালী না হয় তখন তা আর বেশি দূরে যেতে পারে না। তাই একে আরেকটি সিগনাল দ্বারা শক্তিশালী করা হয়। এই অতিরিক্ত সিগনালের নাম ক্যারিয়ার(বহনকারী) সিগনাল। এই ক্যারিয়ার সিগনালটিই আপনার মেসেজ সিগনাল বহন করে নিয়ে যাবে বহু দূর। ক্যারিয়ার সিগনালের কম্পাংক (frequency) অনেক বেশি থাকে। আর কম্পাংক যত বেশি, সিগনালের শক্তিও তত বেশি। ক্যারিয়ার সিগনাল দিয়ে মেসেজ সিগনাল মডুলেট করার একাধিক উপায় আছে। যেমনঃ Amplitude Modulation(AM), Frequency Modulation (FM), Phase Modulation ইত্যাদি। FM Radio এর ক্ষেত্রে FM মডুলেশন করা হয়।
এই মডুলেশন করার পর সিগনালটি এন্টেনার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর দূরে থাকা বেতার গ্রাহক এন্টেনা সিগন্যাল ধরতে পারলে সেখানে সিগন্যালটির ডি-মডুলেশন হয়। এই ডি-মডুলেশন প্রক্রিয়াটি হলো, অতিরিক্ত ক্যারিয়ারটা ঝেড়ে ফেলে মূল সিগনালটা বের করা। মূল সিগনালটা পেয়ে গেলে তার শক্তি বা প্রাবল্য বাড়িয়ে (amplify) করা হয়, এরপর EM তরঙ্গকে পুনরায় শব্দ তরঙ্গে রূপান্তর করে সাউন্ডবক্সের মাধ্যমে আউটপুট দেয়া হয়। তখন শ্রোতারা মেসেজ সিগনাল বা গানটা শুনতে পারে।
এটুকুই মূলত তারবিহীন যোগাযোগ প্রযুক্তির শুরুর দিকের কথা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নিয়ে বাংলায় তাত্ত্বিক লেখালেখি খুব বেশি নেই। এই বিষয়ে তথ্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। তবে এখানে বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি বিষয়গুলো সহজে উপলব্ধি করতে পারার জন্য কিছু বাড়তি বর্ণনাও আছে, কিছু ইতিহাসের কথাও আছে যাতে সবাই বিষয়গুলো সহজে উপলব্ধি ও উপভোগ করতে পারে।
পরবর্তী লেখায় আমি কয়েকটি এনালগ মডুলেশন টেকনিক সম্পর্কে আলোচনায় করবো।