আলোচনা শুরুর আগে আমরা দেখে নিই, প্রাইম নাম্বার বা মৌলিক সংখ্যা কাদের বলে। ১ এর থেকে বড়ো কোনো প্রকৃত সংখ্যা যদি কেবলমাত্র সেই সংখ্যা এবং ১ দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিভাজ্য হয়, তাকেই তখন বলা হয় মৌলিক সংখ্যা।
সম্পূর্ণরূপে বিভাজ্য কথাটার মানে একটু বুঝে নিই। যদি বলি, ‘ক’ ‘খ’ দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিভাজ্য, তার মানে হলো ‘ক’ কে ‘খ’ দিয়ে ভাগ করলে ভাগশেষ থাকে শূন্য।
মৌলিক সংখ্যাকে ম্যাথম্যাটিকসে “গঠনের কারিগর” বলা হয়। তার কারণ, ১ এর থেকে বড় যে কোনো সংখ্যা হয় মৌলিক সংখ্যা, নয়তো একাধিক মৌলিক সংখ্যার গুণফল। উদাহরণ হিসেবে ৮৪ এর কথা বলি। ৮৪=২*২*৩*৭ ……লক্ষ্য করলে বুঝবো যে ২, ৩, ৭ প্রত্যেকেই মৌলিক সংখ্যা।
গণিতের অনেক বিস্ময়ের মধ্যে মৌলিক সংখ্যা হলো অন্যতম প্রধান একটি। এই মৌলিক সংখ্যার পর্যায়ক্রমের প্যাটার্ন অনুসন্ধান করতে গণিতবিদদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। জোড় বিজোড় সংখ্যার ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রম লক্ষ্য করা যায়- কোনো জোড় বা বিজোড় সংখ্যার সাথে ২ যোগ করলে যথাক্রমে পরবর্তী জোড় বা বিজোড় সংখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু, মৌলিক সংখ্যার সারির ক্ষেত্রে এরকম কোনো নির্দিষ্ট পর্যায়ক্রম লক্ষ্য করা যায় না। তারা যেমন খুশি হতে পারে। যেমন- ২, ৩, ৭, ১১, ১৩, ১৭, ১৯, ২৩, ২৯……. ইত্যাদি।
মৌলিক সংখ্যা আবিষ্কৃত হওয়ার মুহূর্ত থেকে এখনো পর্যন্ত বহু গবেষণা চলেছে এ বিষয়টা নিয়ে, কিন্তু কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। গণিতবিদরা এতকাল ধরেই নিতো যে মৌলিক সংখ্যার কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন হয় না, তারা এলোমেলো ভাবে পুনরাবৃত্তি করে (বা একটা মৌলিক সংখ্যার পরে এলোমেলো ভাবে আরেকটা মৌলিক সংখ্যা পাওয়া যায়)। কিন্তু কিছুদিন আগেই, ২০১৬ সালে, আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির দুই প্রফেসর ‘কান্নান সৌন্দরারাজন (Kannan Soundararajan)’ এবং ‘রবার্ট লেমকে অলিভার (Robert Lemke Oliver)’ মৌলিক সংখ্যার শেষ ডিজিট কিংবা অঙ্ক গঠনের ক্ষেত্রে একটি প্যাটার্ন লক্ষ্য করেছেন।
২ এবং ৫ মৌলিক সংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও বড় কোনো মৌলিক সংখ্যার শেষ ডিজিট সবসময় ১, ৩, ৭ এবং ৯ হয়, ২ এবং ৫ নয়। এতে সুবিধা কি হবে??… এতে এটাই সুবিধা হবে যে, কোনো জ্ঞাত মৌলিক সংখ্যার পরবর্তী মৌলিক সংখ্যাটির সন্ধানে যখন আমরা খোঁজ চালাবো, তখন কেবলমাত্র পরবর্তী যে সংখ্যাগুলির শেষ ডিজিট ১, ৩, ৭, ৯ আছে, তাদের গিনিপিগ বানিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবো। এই চারটের মধ্যে একটা না একটা তো প্রাইম নাম্বার হবেই (“হবেই” কথাটিকে খুব জোর দিয়ে ভাববেন না, কারণটা একটু পরেই বুঝবেন)।
এই দুজন গণিতবিদ একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম বানিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে তাঁরা প্রথম ৪০০ বিলিয়ন প্রাইম নাম্বার নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছিলেন। তাঁরা লক্ষ্য করেন যে, একটি মৌলিক সংখ্যার শেষ ডিজিট যা থাকে, তা ঠিক পরবর্তী মৌলিক সংখ্যাটির শেষ ডিজিট হতে চায় না। মোদ্দা কথায়, পরবর্তী মৌলিক সংখ্যার শেষ সদস্য হতে তা অনীহা প্রকাশ করে।
পরপর দুটি মৌলিক সংখ্যার শেষ ডিজিট ১ হওয়ার চান্স খুব কম, মাত্র ১৮.৫ %। সেই সাথে এটাও দেখা গেছে যে, একটি মৌলিক সংখ্যায় যেটার শেষ ডিজিট ৩, ঠিক তার পরবর্তী মৌলিক সংখ্যার শেষ সদস্য ১ এবং ৭ হওয়ার চেয়ে ৯ হওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি।
এটিকে বলা হয়- “Conspiracy of Primes” কিংবা “মৌলিকের ষড়যন্ত্র”। এই আবিষ্কার ইতোমধ্যেই শোরগোল ফেলে দিয়েছে সারা পৃথিবীতে। গণিতবিদরা কল্পনা করতে পারছেন না, কী করে এতদিন ধরে এই রহস্য অনাবিষ্কৃত ছিলো! প্রফেসর সৌন্দরারাজন নিজেই প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি এই আবিষ্কার। তাঁর কথায়, “এই আবিষ্কার খুবই রোমাঞ্চকর। ধরো তুমি পেইন্টিং খুবই ভালো জানো, কিন্তু হঠাৎ তুমি বুঝতে পারলে যে এমন এক ধরণের পেইন্টিং আছে যেটা এর আগে কখনো কোথাও দেখোনি।” তাঁর আবিষ্কারের অনুভূতিটা ছিলো অনেকটা এরকম।
এই দুজন আমেরিকান গণিতবিদ জানিয়েছেন যে, তাঁদের এই লাস্ট-ডিজিট প্যাটার্ন বিংশ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত “k-tuple conjecture” এর দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাবে। এই conjecture মৌলিক সংখ্যার গ্রুপিং করতে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য তাঁরা এটাও বলেছেন যে, মৌলিক সংখ্যার সারি যতো অসীমের দিকে যেতে থাকবে, অর্থাৎ, মৌলিক সংখ্যা যতো বড়ো হতে থাকবে, ততোই এই “লাস্ট-ডিজিট প্যাটার্ন” মেনে চলার প্রবণতাও তাদের কমবে। একটা সময় পরে তারা আবার যেমন খুশি নিজের ইচ্ছামতো প্যাটার্ন তৈরি করবে।
তাহলে বুঝলুম যে, এখনো অনেকটা পথ হাঁটতে হবে …এবং পথ হাঁটাতেই বিজ্ঞানের রোমাঞ্চ। যা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, জানার ইচ্ছাকে সমৃদ্ধ করে। k-tuple conjecture-এর জন্য যেমন ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে “লাস্ট-ডিজিট প্যাটার্ন”-কে, ঠিক তেমনি এই “লাস্ট-ডিজিট প্যাটার্ন”-ই পরবর্তী আবিষ্কার কে ত্বরান্বিত করবে। এজন্যই তো বলি, বিজ্ঞানের প্রতিটা জিনিস পরস্পরের উপর নির্ভরশীল।
তথ্যসূত্র:
১) https://www.quantamagazine.org/20160313-mathematicians-dis…/
২) https://www.wired.com/…/mathematicians-discovered-prime-co…/
৩) http://www.independent.co.uk/…/maths-experts-stunned-as-the…