এটা যতোটা না বিজ্ঞানময়, মনে হয় তার চেয়ে বেশি অ্যাডভেঞ্চার গল্প। গল্পটি পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক সৃষ্টি নিয়ে। সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে সৃষ্টি হওয়া এ পৃথিবী শুরুতেই আজকের ভৌগলিক ম্যাপ পেয়ে গেছে এমন নয়। সৃষ্টির প্রথম দিকে অথৈ জলোসমুদ্রে খুব কমই স্থলভাগ ছিল, অনেকটা ছোট ছোট দ্বীপের মত বিচ্ছিন্নভাবে। এসবের আগ্নেয়গিরি থেকে ক্রমউৎগত লাভা ও টেকটোনিক প্লেটের নড়ন-চড়নে বিস্তৃত হতে থাকে স্থলভাগ। এই হিস্ট্রি শুরু করার আগে একটু প্রথম দিককার কথা বলে নেয়া যাক।
৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে (১ বিলিয়ন=১০০ কোটি) সূর্য থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হয়।চাঁদ সৃষ্ট হয় পৃথিবীর সাথে মঙ্গল-সাইজের একটা গ্রহ থিয়া ‘Theia’.(১) এর সংঘর্ষের মাধ্যমে। অভিকর্ষজ বলের কারণে ভারী পদার্থগুলো পৃথিবীর কোরের দিকে এসে জমা হতে থাকে। অক্সিজেন, সিলিকনের মত হালকা পদার্থগুলো ওপরে উঠে আসে। পৃথিবীর গঠনের শুরুর দিকে ধূমকেতু ও গ্রহাণুপুঞ্জের আঘাতে ভূমি তৈরি ত্বরান্বিত হয়, প্রাণ সৃষ্টির জন্য দরকারি কার্বনভিত্তিক জৈব যৌগও ধূমকেতু থেকেই আসে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। ধীরে ধীরে (মিলিয়ন বছর) ধরে পৃথিবী শীতল হতে থাকে। গলিত লাভার শীতল-কঠিন অবস্থাই পৃথিবীর প্রথম ভূমি।প্রাথমিক দিকের ভূমি উপাদান হল গ্রানাইট। এই গ্রানাইট পানি,নানা খনিজ পদার্থের সাথে বিক্রিয়ায় রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যে ভূমিরূপ ধারণ করে,এর নাম Creighton. এটাই মহাদেশের শৈশবিক অবস্থা।
মহাদেশিক বিচ্যুতি (Continental Drift) বর্ণনা করতে প্রথমেই যে শব্দটি চলে আসে, সেটি হল ‘টেকটোনিক প্লেট’। প্রায় ৩ বিলিয়ন বছর আগে টেকটোনিক প্লেট তৈরি হয়, ভূগর্ভস্থ ম্যাগমা ও খনিজ পদার্থ নিয়ে(২)।
পৃথিবীর লিথোস্ফিয়ার স্তরে এর অবস্থান, আরো স্পষ্ট করলে, টেকটোনিক প্লেট নিয়েই লিথোস্ফিয়ার গঠিত। এর সুনির্দিষ্ট কোন আকার নেই, দৈর্ঘ্যে ১৫ থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। মহাসাগরের নিচের প্লেট; মহাদেশেরগুলোর তুলনায় অনেক কম গভীর হয়ে থাকে। পুরো পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটকে প্রধাণত সাত-আট ভাগে ভাগ করা হয়। এছাড়াও অসংখ্য ছোট-ছোট প্লেট আছে। প্লেটগুলো চলমান, খুবই ধীরগতিতে; বছরে সর্বোচ্চ ১০০ মিলিমিটারের মত(৩)। এতটুকু নড়াচড়াতেই কিন্তু ওপরে প্রলয়ঙ্করী সুনামি, ভূমিকম্প ঘটে যায়!
এ টেকটোনিক প্লেট থিয়োরির ওপর ভিত্তি করেই মহাদেশীয় বিচ্যুতি ধারণা তৈরি। ১৯১২ সালে আলফ্রেড ভেগেনার সর্বপ্রথম এ ধারণা দেন। তাঁর মাথায় এটি আসার কারণটি মজার। একই রকমের ফসিল আবিষ্কৃত হয় এমন দুই জায়গা থেকে যেগুলো কিনা পরস্পর থেকে বিশাল সমুদ্র-ব্যবধানে দূরে।
মাঝের বিশাল নোনাপানির সমুদ্র ভেঙে আসা এর পক্ষে মোটেই সম্ভব ছিল না। তখন আলফ্রেড ধারণা করেন, নিশ্চয়ই এই দুই মহাদেশই একসময় এক ছিল! কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব ছিল, সেই ধারণা তাঁর ছিল না!
এখন প্রশ্ন আসতে পারে – এই প্লেট কীভাবে নড়ে। এর মূল কারণ ভূ-অভ্যন্তরের তাপ নির্গমন। ভূ-প্রস্তর খুব ভালো তাপনিরোধী। ছোট ছোট ভূমিখণ্ড এক হয়ে যখন অনেক বড় হয়ে যায়, তখন লাভার অতিরিক্ত তাপ সহ্য করতে না পেরে ভেঙে লাভা বেরিয়ে পড়ে। সহজভাবে বললে, তাপ লাভাসহ ভূমির স্তর ভেদ করে ওপরে উঠে আসে, আর এর ফলে দুপাশের টেকটোনিক প্লেট (চিত্রে তীরচিহ্নিত) সরে আসে। লাভা নির্গমনমুখে আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হয়।
যে কয়েকটি জায়গা থেকে মহাদেশীয় বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়, এর মধ্যে আইসল্যান্ড অন্যতম। উত্তর আমেরিকান ও ইউরেশীয় প্লেট ঠিক আইসল্যান্ডের মাঝে অবস্থিত। GPS এর মাধ্যমে ঐ জায়গার অবস্থান মেপে দেখা গেছে প্রতি বছর এ দুই মহাদেশ পরস্পরকে এক ইঞ্চি করে দূরে ঠেলে দিচ্ছে! এক শতাব্দী পর ইউরোপ এবং আমেরিকা পরস্পর থেকে ৮ ফুট দূরে সরে যাবে!
লাভার চাপে ভূ-গর্ভের স্তর যখন প্রসারিত হয়, তখন সেই প্রসারিত অংশকেও পৃথিবীর পরিধির কোথাওই অবস্থান নিতে হয়। কারণ, পরিধি তো আর বাড়তে পারে না! ভূগর্ভের ভেতর যেখানে দুই স্তর পরস্পরকে ছেদ করে, (চিত্র-খ) এর নাম “Subduction Zone”- এর বাংলা করার সাহস করছি না!
এভাবে পৃথিবী শত কোটি বছর ধরে মহাদেশীয় ভাঙাচোরার মধ্য দিয়ে চলছে। এর আভিধানিক নাম “সুপারকন্টিনেন্ট সাইকেল থিয়োরি”। এই সুপারকন্টিনেন্ট ধারার প্রথমটির নাম “ভালবারা”(Vaalbara), প্রায় ৩.৮-২.৮ বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্ট। তার পরেরগুলো যথাক্রমে আর, ক্যানরল্যান্ড, কলাম্বিয়া, রোডেনিয়া, প্যান্টোনিয়া। সর্বশেষটি, অর্থাৎ প্যান্টোনিয়া পরিবর্তিত হয়েই প্যানজিয়া’র (Pangea) সৃষ্টি হয়, এ প্যানজিয়াই (৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে সৃষ্ট) হল বর্তমানকালের দৃশ্যমান মহাদেশগুলোর আদি-অকৃত্রিম রূপ (৪)।
সবগুলো মহাদেশ একীভূত থাকার কারণে পুরো স্থলভাগ জুড়ে জলবায়ু বৈচিত্র্য ছিল কম। গ্রীষ্মে প্রচণ্ড খরা ও শীতে তুষারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে প্রাণিবৈচিত্র্য এভাবেই নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিল। বাধ সাধে ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে,যখন প্যানজিয়া’র ভাঙন শুরু হয়! সাথে সাথেই এখনকার মহাদেশগুলোর গড়ন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ভাঙন প্রক্রিয়া শুরু করে এক মহাবিপর্যয়ের;পৃথিবীর ইতিহাসে সবচে’ বড় প্রাণিবৈচিত্র্য বিলুপ্তির, নাম Permian–Triassic extinction!
এ বিপর্যয়ে তখনকার প্রায় শতকরা নব্বই শতাংশ প্রাণীই বিলুপ্ত হয়ে যায়! প্রাণিজগতের মাঝে বিপুল বিবর্তন সাধিত হয়! এই মহাদেশীয় বিচ্যুতির ফসল হিমালয়, আল্পস পর্বতমালা, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মত গিরিখাত। ফ্রান্স থেকে ইটালি, সুইতজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া তক বিস্তৃত আল্পস পর্বতমালা ,আফ্রিকান ও ইউরোপের টেকটোনিকপ্লেটের সংঘর্ষে তৈরি। উত্তরমুখী ইন্ডিয়ান প্লেটের সাথে ইউরেশীয় প্লেটের সংঘর্ষে হিমালয় গঠিত হয়। আরিজোনায় অবস্থিত পৃথিবীর সবচে’বড় প্রাকৃতিক খালটির দৈর্ঘ্য ২৭৭ মাইল, প্রস্থে ১৮ মাইল আর ১ গভীরতায় মাইল! গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যেন একটি টাইম মেশিন! এর পরতে পরতে কালের বিবর্তনের সাক্ষ্য!
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ফুট উঁচু ক্যানিয়নে শত শত সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিল পাওয়া গেছে! সাত হাজার ফুট উচ্চতায় পানি ওঠার মত অবস্থা পৃথিবীতে কোনো সময়ই ছিল না। এর একমাত্র সমাধান, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন একদা (২৫০ মিলিয়ন বছর আগে) সমুদ্রের তলায় ছিল!
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সংযোগকারী পাথুরে অঞ্চলটি ১৭ মিলিয়ন বছরে গঠিত হয়। এটি পৃথিবীর জলবায়ুর খুব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করে। আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে পানির মুক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়।দুই অঞ্চলের ভৌগলিক পরিবেশ ও জীবকুলের মাঝে পার্থক্য গড়তে থাকে।
এই ভৌগলিক বিবর্তন থেমে নেই,নিশ্চল নেই টেকটোনিক প্লেট। একটা সুনামি, সিডরই প্রকৃতির কাছে আমাদের অসহায়ত্ব বুঝিয়ে দেয়। দশ-বিশ, কিংবা একশো বছরের পর্যবেক্ষণও কোনভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর কোন পারিসংখ্যানিক প্যাটার্ন বের করার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রকৃতির প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের এ লড়াই চলছে সেই আদিকাল থেকে, এখনো।
প্রকৃতি কোটি বছরে পৃথিবীকে যতো ভাগে না ভাগ করেছে, মানুষ তার কিয়দাংশ সময়েই নিজেদের ভাগ করেছে এর চাইতে বহুগুণ বেশি। মানুষ কি সভ্যতাকে আরো অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে? প্রশ্নের উত্তরটি কিন্তু আমাদের হাতেই!
দোহাইঃ
National Geography’র Continental Collision ডকুমেন্টারি থেকে অনুপ্রাণিত।
১) giant impact hypothesis
২) http://www.livescience.com/32263-have-there-always-been-continents.html
৩) http://en.wikipedia.org/wiki/Plate_tectonics#cite_note-FOOTNOTEReadWatson1975-2
৪) http://en.wikipedia.org/wiki/Supercontinent_cycle
ছবি কৃতজ্ঞতা,National Geography, Live Science, Wikipedia ও আন্তর্জালিক সূত্র।