দৈনিক পত্রিকায় রাশিফল নামে একটা কলাম থাকে। সেখানে জ্যোতিষীরা আপনার জন্মতারিখ অনুযায়ী ভবিষ্যদ্বাণী করে- দূরের যাত্রা শুভ, আজ টাকা পয়সা পাবেন অনেক, প্রেমের প্রস্তাব দিয়েই দেখেন, সফল হবেন ইনশাল্লাহ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই জ্যোতিষীদের দাবী- আকাশের কোন নক্ষত্র কোথায় অবস্থান করছে, তার উপর পৃথিবীর মানুষদের ভাগ্য নির্ভর করে। অবস্থা এমন যে, মনে হয়, আকাশের নক্ষত্র বামে হেলে পড়লে আপনি বামপন্থী হয়ে যাবেন, ডান দিকে হেলে পড়লে আপনি ডানপন্থী হয়ে যাবেন!
কথা হচ্ছে, আকাশের নক্ষত্র সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। আজ মন চাইছে তাই এই পথ দিয়ে যাব, কাল ওই পথ দিয়ে হেলেদুলে যাব- এমনটা নয়। নক্ষত্রের অতীত আচরণ দেখে (অর্থাৎ তার ভর, গতিবেগ, দূরত্ব হিসাব করে) এবং আশেপাশের গ্রহ-নক্ষত্রের সাথে তার আকর্ষণ বল হিসাব করে বিজ্ঞানীরা বলে দিতে পারেন, কোন তারা বা নক্ষত্র কবে কোন দিক দিয়ে যাবে। কে কবে কোথায় থাকবে, সেটাও হিসাব করে বের করা সম্ভব। এই সকল হিসাব করেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলে দেন, পরবর্তীতে কবে সূর্যগ্রহণ কিংবা চন্দ্রগ্রহণ হবে। বিজ্ঞানীদের সেই সকল ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে মিনিটে মিনিটে, সেকেন্ডে সেকেন্ডে মিলে যায় ।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের (Astronomer) ছেড়ে আসুন আবার জ্যোতিষীদের (Astrologer) কাছে যাই। জ্যোতিষীরা (Astrologer) জ্যোতির্বিদদের (Astronomer) কাছ থেকে ধার করে হোক, অথবা নিজেদের কোনো পদ্ধতিতেই হোক, ভবিষ্যতে কোন তারা কোথায় থাকবে, সেটা বের করতে পারে। সেই অনুযায়ী তারার ভবিষ্যতের অবস্থানের উপর নির্ভর করে আপনার জন্য ভবিষ্যতের রাশিফলও বানাতে পারবে তারা । মানে, আজ ১৫ই এপ্রিল ২০২০ তারিখে পেপারে শুধু আজকের দিনে আপনার ভাগ্যে কী ঘটবে সেটাই লিখছে। কিন্তু একজন জ্যোতিষী হিসাব নিকাশ করে ২০৩০ সালের ১৫ই এপ্রিল আপনার জীবনে কী কী ঘটবে, সেটাও তো বলে দেওয়ার কথা।
জ্যোতিষীদের ব্যাপক টাকা পয়সা দেওয়া হলে তারা এই কাজ করে। কোনো বাচ্চা জন্মানোর পরে তার জন্মক্ষণ হিসাব করে সারা জীবনের জন্য একটা ভবিষ্যদ্বাণী (কুষ্ঠী) তৈরি করে দেয়, যদি যথেষ্ট টাকা পয়সা দেওয়া হয়। একইভাবে যথেষ্ট টাকা পয়সা দেওয়া হলে পত্রিকায় তারা দৈনিক ভবিষ্যদ্বাণী করা ছাড়াও সাপ্তাহিক, মাসিক বা বার্ষিক ভবিষ্যদ্বাণীও করে।
অনেক জ্যোতিষী আবার আমার-আপনার মতো আমজনতার জীবন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা ছাড়াও সেলিব্রেটিদের (সিনেমার নায়ক-নায়িকা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, খেলোয়াড় ইত্যাদি) জীবনযাপন এবং ক্যারিয়ার নিয়ে প্রেডিকশন করে। সেগুলো তাদের পেপারে বা ওয়েবসাইটে ছাপিয়ে দেয়। কোনোটা যদি মিলে যায়, তাহলে পরের বছর সেটা নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা করে।
তাদের জ্যোতিষী বলছে, ২০২০ সালে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসবে অনেক । অথচ করোনার কারনে রেমিটান্স আসা কমে গেছে অনেক। সামনে আরো কমবে। পুরা ভবিষ্যদ্বাণীর কোথাও করোনার মতো কোনো মহামারীর পূর্বাভাস নেই। “পোশাকশিল্প ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানী বৃদ্ধির” ব্যাপারে আর কিছু না-ই বলা হলো। তাছাড়া, করোনার কারণে যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো হবে (বেকার সমস্যা, দুর্ভিক্ষ,আইন শৃংখলার অবনতি) সেইগুলোর ভবিষ্যদ্বাণীও নেই কোথাও।
নিচের দ্বিতীয় স্ক্রিনশটটা নিয়েছি বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে । সেখানে তারা জ্যোতিষী লিটন দেওয়ান চিশতি, ড. কে সি পাল, রামপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক আবুল হাসান ও আকবর হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করে দেশের একটা ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ দীর্ঘ হবে। অথচ মার্চ মাসেই খালেদা জিয়া জেল থেকে বেরিয়ে গেছেন। জ্যোতিষীর কেরামতি শেষ!
পদ্মা সেতুর কাজ এই বছরে শেষের দিকে থাকবে বলেছে এদের জ্যোতিষীরা। অথচ করোনার কারণে জানুয়ারি মাস থেকেই চীনের অধিকাংশ শ্রমিক আনএ্যাভেইলেবল ছিল। এখন বাংলাদেশী শ্রমিকরাও আনএ্যাভেইলেবল ।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে কয়েকটা পত্রিকা । সেখানেও কেউ লিখেনি, আপনার সামনে একট বড় চ্যালেঞ্জ আসবে ২০২০ সালে।
এটা তো গেলো সামগ্রিকভাবে দেশ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী। আলাদাভাবে আপনার জন্মতারিখ ধরে ধরে যে জ্যোতিষীরা সারাবছরের প্রেডিকশন দিয়েছিলেন, সেখানেও কোথাও পেলাম না যে, বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমাদেরকে বেকার অবস্থায় ঘরে আটকা পড়ে থাকতে হবে। কিংবা এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল হবে, উচ্চশিক্ষার জন্য ভার্সিটিগুলার ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যাবে না- এসকল সাবধানবাণী কেউ শোনায়নি। কয়েকটা প্রেডিকশনের লিংক দিচ্ছি, আপনি একটু মিলিয়ে দেখুন তো কিছু পান কিনা!
জ্যোতিষী কাওসার আহমেদ চৌধুরীর ভবিষ্যদ্বাণী
জ্যোতিষী গুরু নুরুনানন্দ এর ভবিষ্যদ্বাণী
নামহীন জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী
কিছুই তো পেলেন না, তাই না? তার মানে এতো বড় একটা ঘটনা জ্যোতিষীদের হিসাবনিকাশে ধরা পড়েনি। তারা আগে থেকে কিছুই জানাতে পারেনি। অথচ এখনো দৈনিক পত্রিকাগুলোতে জ্যোতিষীরা তাদের মুখস্থ ভবিষ্যদ্বাণী ছাপিয়েই যাচ্ছে। জ্যোতিষীদের যদি আসলেই কোনো ক্ষমতা থাকতো, গ্রহ-নক্ষত্র হিসাব করে যদি ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতো, তাহলে তারা বলে দিক, এই মহামারী কবে শেষ হবে, কতোজন মানুষ মারা যাবে, কবে শেষ হবে করোনা।
কিছুদিন আগে নকুল কুমার বিশ্বাসও গানে গানে সেই কথাই বলে গেছেন। জ্যোতিষীদের এত ক্ষমতা থাকলে তারা করোনার কথা কিছুই বলতে পারলো না কেন আগে থেকে?