‘সার্স-কোভ-২’, গালভরা নাম ভাইরাসটির। বাংলাদেশের প্রচলিত মিডিয়াতে সহজ করে যাকে বলা হচ্ছে ‘করোনাভাইরাস’। শ্বাসপ্রত্যঙ্গের রোগ সৃষ্টিকারী এই নতুন করোনাভাইরাসের করাল থাবায় পড়েছে গোটা বিশ্ব। একবিংশ শতকের প্রতিটি দশকেই আমরা অন্তত একটা করোনাভাইরাসের সম্মুখীন হয়েছি। ২০০২ সালে সার্স, ২০১২ তে মার্স, আর ২০১৯-এর শেষে উদয় হয়ে কোভিড-১৯ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ২০২০-এও। এই সবগুলো রোগকে একে অপরের কাজিন বলাই যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এত ঘনঘন উদয় হচ্ছে যে পরিবারের ভাইরাস, তার প্রতিষেধকের জন্য এত অপেক্ষা কেন? তার চিকিৎসা এত জটিল কেন?
টিকা ঠিক কীভাবে কাজ করে, তা বুঝতে হলে সবার প্রথমে বুঝতে হবে কীভাবে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। আমাদের শরীরে ভেতরে বাইরে থেকে কোনো জীবাণু প্রবেশ করলে শ্বেত রক্তকণিকা সেই অণুপ্রবেশকারীর বিরূদ্ধে লড়াই করে। আমাদের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত এই শ্বেত রক্তকণিকায় আছে বিভিন্ন ধরণের কোষ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ম্যাক্রোফেজ, টি লিম্ফোসাইট , এবং বি লিম্ফোসাইট। সংক্ষেপে বলা যায়, ম্যাক্রোফেজ বাইরে থেকে আসা রোগ সৃষ্টিকারী অণুপ্রবেশকারীদের আক্ষরিক অর্থেই গিলে ফেলে, টি লিম্ফোসাইট অনুপ্রবেশকারী জীবাণুকে ভবিষ্যতের জন্য চিনে রাখে, আর বি লিম্ফোসাইট এন্টিবডি তৈরি করে – যা হলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন এই সিরিজের লিখাগুলো থেকে।
ফিরে আসি টিকার ব্যাপারে। টিকার কাজ মূলতঃ এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা- তবে রোগের আক্রমণ হওয়ার আগেই! প্রকৃতপক্ষে টিকা হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়া, যা দ্বারা শরীরে বড় কোনো রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু ঢোকার আগেই সেই রোগের এন্টিবডি প্রস্তুত করে রাখা হয়। বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার সর্বপ্রথম ১৭৯০ সালে আধুনিক টিকা- ভ্যাক্সিনিয়া প্রবর্তন করেন। যদিও তার এই আধুনিক টিকার কথা এখন শুনলে অবশ্য গা ঘিনঘিন করতেই পারে। তিনি আসলে গরুর গুটিবসন্তের পুঁজ মানুষের শরীরে প্রবেশ করান। এতে মানুষটি হাল্কা রোগের লক্ষণ দেখালেও গুটিবসন্তের মতো বড় রোগে আক্রান্ত হয় না। কেননা, তার শরীরে গুটিবসন্তের ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। নিজের ছেলে ফিলিপসকে বিজ্ঞানী জেনার এভাবে টিকা দিয়ে সফল হয়েছিলেন।
শুরুর দিকে টিকা তৈরির ব্যবস্থাতে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে মেরে বা দুর্বল করে শরীরে প্রবেশ করানো হত। গুটিবসন্ত, মিজলসের মতো রোগের টিকা এভাবেই তৈরি হতো। এতে টিকা নিয়ে মানুষ হাল্কা রোগের লক্ষণ দেখালেও পরবর্তীতে আর সেই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বড় অসুখে ভুগতো না। কারণ, ঐ যে! এন্টিবডি তৈরি হয়ে আছে।
কিন্তু, এইভাবে আস্ত ভাইরাস দিয়ে টিকা বানানোর কিছু ঝামেলা আছে। এইভাবে টিকা বানাতে আমাদের অনেক অনেক ভাইরাস লাগতো। তারচেয়ে বড় কথা, এই এত এত ভাইরাস নিয়ে কাজ করাও অনেক ঝুঁকির। কারণ, ছোট্ট ভাইরাসের বিবর্তনও হয় অনেক দ্রুত। এডওয়ার্ড জেনার যেই ভ্যাক্সিনিয়া গরুর বসন্ত থেকে এনে মানুষের শরীরে ঢুকিয়েছিলেন, সেই ভ্যাক্সিনিয়া আর এখনকার গরুর বসন্তের ভাইরাসের কোনো মিলই নেই! এমনকি ভ্যাক্সিনিয়ার মূল ভাইরাস এখন আর পাওয়াই যায় না। তাছাড়াও, একটা ভাইরাসকে দুর্বল করে দিলেও মানবকোষে ঢোকার পর তা বিবর্তিত হয়ে অন্য রোগ তৈরির ক্ষমতা রাখে। সেই গরুর বসন্তের ভাইরাস পরে হেপাটাইটিস আর সিফিলিসের মত রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই বিজ্ঞানীরা খুঁজতে লাগলেন এমন এক উপায়, যেটা হবে আরো বেশি নিরাপদের, আরো বেশি কাজের, আরো বেশি সহজলভ্য।
এজন্য বিজ্ঞানীরা খুব করে গবেষণা করতে লাগলেন, আর একে একে বের করে ফেললেন ভাইরাস আসলে ঠিক কীভাবে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, তার আদ্যোপান্ত। আমরা জানি, করোনা একটি এনভেলপ ভাইরাস। অর্থাৎ, এই ভাইরাসের চারিদিকে একটি লিপিড (তেল বা ফ্যাট) জাতীয় আবরণ আছে। একবার সুযোগ পেলে এই ভাইরাস তার লিপিড আবরণ মানবকোষের আবরণের সাথে জুড়ে দেয়। এই জুড়ে দেয়ার কাজে ভাইরাসকে সাহায্য করে আবরণীতে থাকা প্রোটিন কাঁটা। একবার কোষে ঢুকতে পারলে ভাইরাস নিজের ভেতরের জিনেটিক ম্যাটেরিয়াল মানুষের কোষের ভেতরে ছেড়ে দিয়ে আরো অসংখ্য ভাইরাস তৈরি করে।
এখন মলিকুলার বায়োলজির উৎকর্ষতায় আমরা ভাইরাসের জিনেটিক ম্যাটেরিয়াল- ডিএনএ , আরএনএ বের করে আনতে পারি। এমনকি কোন জিন সিকুয়েন্সের কারণে কোন প্রোটিন তৈরি হয়, তাও বের করে ফেলতে পারি। ফলে, ভাইরাসের ঠিক যেই প্রোটিন কাঁটা শরীরের কোষে প্রথমে এসে যুক্ত হয়, সেই প্রোটিন কাঁটার অংশটুকু দিয়েই আমরা কার্যকরী টিকা বানিয়ে ফেলতে পারি। এই প্রক্রিয়ার সুবিধা হচ্ছে, আমাদের আর টিকা বানাতে অনেক ভাইরাস দরকার হচ্ছে না। কৃত্রিমভাবে তৈরি প্রোটিন কাঁটার টিকা দিয়েই শরীরে এন্টিবডি তৈরি করা সম্ভব। আর সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ দিক হলো, আস্ত ভাইরাসগুলো নিয়ে টিকা বানাতে গিয়ে বড় কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকছে না।
এতটুকু পড়ার পর মনে হওয়ার কথা, তাহলে নতুন করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরিতে বাধা কোথায়? যারা এতটুকু ধৈর্য্য ধরে পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন, বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাসের জিন সিকোয়েন্স বের করেই ফেলেছেন। তাহলে আর দেরী কোথায়?
সত্যি বলতে, নতুন এই করোনা ভাইরাস আসলেই একদম নতুন। এর ব্যাপারে অনেক কিছুই আমরা এখনো জানি না। মাত্র কয়েক মাসে নিজেকে অনেক পাল্টে ফেলেছে- খুব দ্রুত বিবর্তিত হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কোভিড-১৯ রোগী থেকে সংগৃহীত স্যাম্পল থেকে তৈরি ফাইলোজেনিক ট্রি (Phylogenic tree)-তে দেখা গেছে, মাত্র কয়েক সপ্তাহে মিউটেশন হয়ে তিন টাইপের নতুন করোনা ভাইরাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। আবার এই A,B,C টাইপগুলোরও রয়েছে সাবটাইপ। বলা বাহুল্য, যে প্রোটিন কাঁটা নকশা করে বিজ্ঞানীরা টিকা বানান, সেটির গঠন মারাত্মক রকমের জটিল।
আক্ষরিক অর্থে নিরলসভাবে খাটছেন বিজ্ঞানীরা। সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে, দেরী কিন্তু হচ্ছে না। এই লেখা লিখার সময় পর্যন্ত ৬২টি টিকা নিয়ে কাজ চলছে। মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলক প্রয়োগও হয়ে গেছে। এর আগে এত দ্রুত অন্য কোনো ভাইরাসের টিকা মানুষের শরীরে প্রয়োগ হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
একটি টিকা আবিষ্কার হয়ে গেলেও এর ফলাফল হাতে আসতে সময় লাগে। তার আগ অব্দি এখন পর্যন্ত যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা তো করতে হবে। এই নতুন করোনা ভাইরাসের কার্যকরী চিকিৎসা নিয়ে চলছে অনেক আলোচনা, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তর্ক-বিতর্ক। একটা ব্যাপার সবার আগে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। যে সমস্ত রোগী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই মারা যাচ্ছে কো-মরবিডিটির দরুণ। অর্থাৎ, তারা ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট , উচ্চ রক্তচাপের মতো অন্যান্য রোগেও একই সাথে ভুগছেন। এ কারণেই, বৈশ্বিক তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগে মৃত্যুর হার বেশি। চিকিৎসকেরা জোর দিচ্ছেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার আর স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে।
এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় আলাদাভাবে বিশেষ কোনো ঔষধ দেয়া হচ্ছে না। যেহেতু এই রোগটির জন্য লক্ষণ দেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, তাই এখনো সব রোগীর জন্য কার্যকরী কোনো একটি বিশেষ ঔষধের বাড়তি সুফল পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিছু কিছু ঔষধ প্রয়োগে চিকিৎসকেরা বাড়তি সুফল দেখতে পাওয়ায় সেই ঔষধগুলোর কার্যকারিতার উপর কাজ হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরকম চারটি ঔষধ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রোগীদের উপর পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে দেখছে। এই প্রকল্প “সোলিডারিটি”র ফলাফল হাতে আসার আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঔষধ চারটির প্রয়োগে কোনো ধরণের বাড়তি উৎসাহ দেয়নি।
বিজ্ঞানীদের গল্পে হুট করে পেয়ে যাওয়া “ইউরেকা মোমেন্ট” এর পেছনে থাকে অনেক দিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর পরিশ্রম। প্রতিটি আবিষ্কারকে যেতে হয় একাধিক রিভিউয়ের মধ্য দিয়ে, অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় নিজের শুদ্ধতা। শত শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা নিভৃতেই কাজ করে গিয়েছেন, করে যাচ্ছেন। তাই কেউ যদি লাইভ টিভিতে এসে নিজের সদ্য আবিষ্কৃত টীকা বা ঔষধের কথা প্রচার করে, চোখ বন্ধ করে তাকে ধান্ধাবাজ বলে দিতেই পারেন। এ সমস্ত স্টান্টবাজদের চিনে রাখুন, দুর্দিনে যারা মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ভুল তথ্য ছড়িয়ে মানুষকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর যতদিন না আরেকবার “ইউরেকা মোমেন্ট” আসছে, বজায় রাখুন সামাজিক দূরত্ব ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা।
তথ্যসূত্রঃ
• Flint, S. J., et al. 2000. Principles of Virology: Molecular Biology
• Freeman, W.H., et al. 2008. Molecular Cell Biology
• নোভেল করোনা ভাইরাসের ফাইলোজেনিক ট্রী
• সিডিসির ওয়েবসাইটে ভ্যাক্সিন সম্পর্কে
• WHO এর ক্লিনিকাল ট্রায়াল Solidarity
• বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে করোনা সংক্রান্ত তথ্য
ফিচার ছবির সূত্র- https://www.nih.gov/news-events/news-releases/nih-clinical-trial-investigational-vaccine-covid-19-begins